ঠাণ্ডা ঘরে বসে কত বাহারি কাপে কত রকমের চা পান করি আমরা। চা পান করতে করতে রাষ্ট্রের, সমাজের, পরিবারের এমনকি বিশ্বের নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়, চায়ের কাপে ঝড় উঠে কত বিষয় নিয়ে, আবার কত ধরনের সিদ্ধান্তও হয় চা পান করতে করতে। কিন্তু যাঁদের অভুক্ত শরীরের ঘামে আর হাড়ভাঙা শ্রমে এই চা আমাদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে এল, সেই চা শ্রমিকদের কথা কি কখনো ভেবেছি আমরা! আমরা শুধু দেখি বড় বড় কোম্পানির লেবেল। টেলিভিশনে সংবাদপত্রে বড় বড় কোম্পানীর বিজ্ঞাপন।
চা শ্রমিকরা অবহেলিত, তাঁদের উপযুক্ত মজুরি নাই, জীবনমানের চিন্তা তো দূরস্ত। অবহেলিত শ্রমিকদের মধ্যে সবচাইতে অবহেলিত আমাদের চা শ্রমিকরাই। তাঁদের ওপর আজও ব্রিটিশ বেনিয়াদের ধারাবাহিকতায় বর্বরতা চলে। নিজেদের অধিকার নিয়েও যে ভাবতে হয়, সে কথা ভাববার সুযোগই কখনো পান না তাঁরা। তাঁদের নূন্যতম মজুরিটাও ঠিক মত দেয়া হয় না। কাজে এতটুকু ভুলে চলে অমানবিক শারীরিক নির্যাতন। গত পঁচিশ বছর আগেও দিনে মজুরি ছিল ১৮ টাকা। তা বেড়ে এখন হয়েছে ১২০ টাকা। তাও একটি বাগানে ৪০ শতাংশ থাকেন নিয়মিত শ্রমিক। তাঁরা বাগানে চাকরি করেন। আর শতকরা ৬০ ভাগ দিনমজুর। তাঁদের কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই। একেকটা পরিবারে ৮-৯ জন সদস্য। চালের কেজি ৫০ টাকা। কী হয় এই ১২০ টাকায়! যেখানে চা বাগানের মালিক বা তাদের সন্তানদের একটি বার্গারের দাম ৮৫০ টাকা! চা শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। ছেলে মেয়েরা পাঁচ ক্লাস পর্যন্ত পড়ে সেখানে। ইচ্ছা থাকলেও পরিবারের সামর্থ নাই পয়সা দিয়ে বাগানের বাইরের স্কুলে পড়ানোর। তাই পাঁচ ক্লাসের বেশি পড়াও হয় না তাঁদের।
চা শ্রমিকদের কাজ ছাড়ার স্বাধীনতা নাই। তাঁরা ভয়ও পান বংশানুক্রমিক এই কাজ ছেড়ে অনিশ্চয়তায় পা বাড়াতে। দু একজন যদি ছেলেকে বাইরে পাঠান কষ্ট করে তবে তারা আর ফিরে আসে না বাগানে। আবার পড়াশুনা করে কেউ কেউ বাগানে ফিরে এসে অফিসার পদে যোগ্যতার বলে চাকরি চাইলেও মালিকদের মানে লাগে কুলি-কামিনের ছেলের সঙ্গে একসাথে কাজ করতে। তাই বেশিরভাগ চা শ্রমিক সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই চা বাগানের কাজ শেখান। ব্রিটিশ বেনিয়াদের প্রায় পুরো শোষণ এখনো বর্তমান। কুলিরা সাহেবদের রাস্তায় হাঁটতে পারেন না। বাবুদের বাড়িতে ডাক পড়লে সব রকম কাজ করতে চা শ্রমিকরা আজও বাধ্য। ব্রিটিশদের মত না হলেও বাগানে নারী নিগ্রহ এখনো বর্তমান। চা শ্রমিকদের ভুলিয়ে রাখার জন্য ভাটিখানায় কম পয়সায় মদ বিক্রি এখনো চলে বাগানে।
দুই
মুল্লুক চলো আন্দোলন বিষয়টি নিয়ে দু একজন চা শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেখলাম, তাঁদের এই মর্মান্তিক দিনটির কথা কেউই তেমন জানেন না। যখন বললাম, আপনাদের অনেককে যে মেরেছিল পুলিশ। ওঁরা বললেন, ‘হ্যাঁ বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ ডেকেছিল, আমাদের বাপ কাকারা অনেকে যুদ্ধে মরেছিল’। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের কথা স্মরণ করেন। কিন্তু তাঁদের নিজেদের আত্মত্যাগের কথা তাঁরা জানেনই না। জানেন না কী জুলুম করে ইংরেজরা চা চাষের জন্য ভারতের বিহার, মাদ্রাজ,উত্তর প্রদেশ, উড়িষ্যা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে দারিদ্র ও দুর্ভিক্ষপীড়িত সাঁওতাল, লোহার, কুর্মী, মুন্ডা, কুলবিল কানু, তেলেগু, রবিদাস, গোয়ালাসহ প্রায় ১১৬টি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ জাহাজে করে নিয়ে এসেছিল ‘গাছ হিলালেই পয়সা মিলবে’ এই মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে। পাহাড়-জঙ্গল আর বন্য প্রাণীর প্রতিকূল পরিবেশে এনে নৃশংস নির্যাতন চালিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে রেখে জঙ্গল পরিষ্কার করিয়ে চা চাষের কাজে লাগিয়েছিল তাঁদের। পেটে খিদে আর নানা ধরনের অসুখ-বিসুখে বিভৎস জীবনের সম্মুখীন হন তাঁরা। বাগান থেকে পালানোরও কোনো উপায় ছিল না। ধরে নিয়ে এসে বুটের লাথি আর চাবুকের ঘায়ে রক্তাক্ত করা হতো। পুরুষদের মজুরি ছিল চার আনা, নারীদের দু আনা আর শিশুদের এক আনা।
ইংরেজরা চীন থেকে চা আমদানি করতো। এক সময় চীন-জাপান যু্দ্ধের কারণে চা আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে ইংরেজ বেনিয়াদের নজর পড়ে ভারতবর্ষের দিকে। এখানে চা চাষের উপযোগিতা পরীক্ষা করার জন্য ১৮৩৫ সালে বিজ্ঞানীদের নিয়ে কমিশন গঠিত হয়। কমিশন কাজ শুরুর আগেই শিলচর করিমগঞ্জে চা গাছের সন্ধান পাওয়া গেলে ১৮৩৮ সালেই পরীক্ষামূলকভাবে সিলেট ও কাছাড়ে চা উৎপাদন শুরু হয়। ভারতবর্ষে আসামের লাথিমপুরে, সিলেট ও কাছাড়ে চায়ের উৎপাদন ব্যাপকতা পায়। চা উৎপাদনে প্রচুর শ্রমিক প্রয়োজন বলে ভারতের নানা জায়গা থেকে প্রায় ৮৪,৯১৫ জন শ্রমিক জাহাজে করে নিয়ে আসা হয়। অনাহারে-অসুখে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক মারা যান বলে জানা যায়।
চা বাগানের ব্রিটিশ মালিকদের অত্যাচার, শোষণ, অনাহার, অসুখ-বিসুখ ও নিজ জন্মভূমি থেকে দূরে থাকায় অতীষ্ট চা শ্রমিকরা নিজ দেশে নিজ মুল্লুকে ফিরে যাবার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ১৯২০ সালে শ্রমিক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে চা-বাগানগুলোতে।
১৯২১ সালের ৩ মার্চ অনিপুর চা বাগান থেকে ৭৫০ জন শ্রমিক বেরিয়ে এলে শ্রমিকদের মধ্যে বাগান ছাড়ার উদ্দিপনা দেখা দেয়। দলে দলে শ্রমিকরা কাজ বয়কট করে চা-বাগান ছেড়ে বেড়িয়ে এসে মুল্লুক যাবার উদ্দেশ্ স্ত্রী-পুত্র নিয়ে রেললাইন ধরে হাঁটতে থাকেন। ক্লান্ত ক্ষুধার্ত শ্রমিকেরা চাঁদপুর জাহাজ ঘাটে এসে সমবেত হন। সেখানে ব্রিটিশ পুলিশ আগে থেকেই উপস্থিত ছিল। স্টিমার ঘাটে ভেড়ার সাথে সাথে হুড়মুড় করে শ্রমিকরা স্টিমারে উঠতে গেলে কর্মীদের সাথে টিকেট নিয়ে বচসা ও ধাক্কাধাক্কি হয়। সিঁড়ি দিয়ে কে কার আগে উঠবে সেই ঠেলাঠেলিতে অনেকে পানিতে পড়ে যান। ব্রিটিশ পুলিশ নীলনক্সা অনুযায়ী সিঁড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়তে থাকে। এ সময় কত শ্রমিক যে নিহত হন, তার কোনো গোনাগুনতি নেই। শুধু নদীতে ভাসতে দেখা গেছে অগণিত লাশ আর লাল হয়েছে নদীর পানি।
চাঁদপুর রেলস্টেশনে ও রেলইয়ার্ডে ৩/৪ হাজার শ্রমিক সমবেত হয়। ২০ মে ষ্টীমার ঘাটে পৌঁছনোর অপেক্ষা। কিন্তু রাতের অন্ধকারে গুর্খা রেজিমেন্টের সৈন্যরা রেলওয়ে ইয়ার্ড ঘিরে ফেলে। গভীর রাতে সরলপ্রাণ ক্লান্ত শ্রমিকরা সবাই যখন ঘুমে অচেতন তখন পুলিশ কমিশনার কে সি দে-এর নির্দেশে গুর্খা সৈন্যরা ঘুমন্ত শ্রমিকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শ্রমিকদের আর্তচিৎকারে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠে। রাতের অন্ধকারে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলা হয়।
এই বেদনা বিধুর অথচ গুরুত্বপূর্ণ “মুল্লুক চলো” আন্দোলনের দিনটি লোকচক্ষুর আড়ালেই প্রায় একশত বছর পার করে দিলো। যে চা শ্রমিকদের শোক আর গৌরবগাথা এ ‘মুল্লুক চলো’ আন্দোলন তার স্বীকৃতি আদায় এবং চা শ্রমিকদের অধিকার সচেতন করার দায় আমাদের। দিনটি সেদিনই সার্থকতা পাবে, যেদিন বাগানে বাগানে দিনটি পালিত হবে এবং চা শ্রমিকরা শত বছর আগের পূর্বসুরীদের আত্মত্যাগে গর্বিত হবেন।
লেখক:

সঙ্গীতা ইমাম
লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী
*প্রকাশিত এ লেখার মতামত এবং বানানরীতি লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই এখানে প্রকাশিত লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা বানানরীতি বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই। – সম্পাদক