‘ঈশ্বর না করুন, যদি কোনদিন সংসারে নারী বিরল হইয়া উঠেন, সেই দিনই ইঁহার যথার্থ মূল্য কত, সে তর্কের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হইয়া যাইবে—আজ নহে। কিন্তু দাম যাচাই করিবারও একটা পথ পাওয়া গেল। অর্থাৎ পুরুষের কাছে নারী কখন, কি অবস্থায়, কোন্ সম্পর্কে কতখানি প্রয়োজনীয়, তাহা স্থির করিতে পারিলে নগদ আদায় হউক আর না হউক, অন্তত: কাগজে-কলমে হিসাব-নিকাশ করিয়া ভবিষ্যতে একটা নালিশ-মকদ্দমারও দুরাশা পোষণ করিতে পারা যায়। একটা উদাহরণ দিয়া বলি। সাধারণত, বাটীর মধ্যে বিধবা ভগিনীর অপেক্ষা স্ত্রীর প্রয়োজন অধিক বলিয়া স্ত্রীটি বেশি দামী। আবার এই বিধবা ভগিনীর দাম কতকটা চড়িয়া যায় স্ত্রী যখন আসন্ন-প্রসবা; যখন রাঁধা-বাড়ার
লোকাভাব, যখন কচি ছেলেটাকে কাক দেখাইয়া বক দেখাইয়া দুইটা খাওয়ান চাই। তাহা হইলে পাওয়া যাইতেছে—নারী ভগিনী-সম্পর্কে বিধবা অবস্থায়, নারী ভার্যা-সম্পর্কীয়ার অপেক্ষা অল্প মূল্যের। ইহা সরল স্পষ্ট কথা। ইহার বিরুদ্ধে তর্ক চলে না! একটা শ্লেট-পেন্সিল লইয়া বসিলে নারীর বিশেষ অবস্থার বিশেষ মূল্য বোধ করি আঁক কষিয়া কড়া-ক্রান্তি পর্যন্ত বাহির করা যায়…… নারীত্বের মূল্য কি? অর্থাৎ, কি পরিমাণে তিনি সেবাপরায়ণা, স্নেহশীলা, সতী এবং দুঃখে কষ্টে মৌনা। অর্থাৎ, তাঁহাকে লইয়া কি পরিমাণে মানুষের সুখ ও সুবিধা ঘটিবে। এবং কি পরিমাণে তিনি রূপসী! অর্থাৎ পুরুষের লালসা ও প্রবৃত্তিকে কতটা পরিমাণে তিনি নিবদ্ধ ও তৃপ্ত রাখিতে পারিবেন।’
যে কথাসাহিত্যিক নারীর মূল্য প্রবন্ধে চড়া সুরে এই কথা বলতে পেরেছেন (প্রসঙ্গত প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল অনিলা দেবীর নামে, অর্থাৎ ছদ্মনামে), তাঁর উপন্যাসে, গল্পে নারীচরিত্র স্বাভাবিক ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমরা কিভাবে দেখব এইসব মেয়েদের, কিভাবে দেখব তাঁদের বেদনার, জ্বালার, প্রতিবাদের প্রকাশকে।
আমাদের যুগের দৃষ্টিতে মনে হবে না কি যে শরৎচন্দ্রের নারী, সেই সময়ের, সেই যুগের সমাজের আঙ্গিকে গড়ে উঠেছে। শরৎচন্দ্রের লেখায় সম্ভবত মেয়েদের প্রতি তাঁর সমবেদনার প্রকাশ অকুন্ঠ। তবুও, প্রতিটি চরিত্রের গঠনগত প্রভেদ থাকলেও তারা কোথাও যেন ক্রমশ একমাত্রিক হয়ে ওঠে। অবহেলিত নিপীড়িত নারীর ভাগ্য অধিকাংশ সময়েই সমাজের বাইরে দাঁড়াবার সাহস রাখে না। রাজলক্ষী বাইজীর পরিচয়ের মধ্যে আ টকে যায়, শ্রীকান্তের জীবনসঙ্গী হওয়ার সব যোগ্যতা থাকা সত্বেও, সে দ্বিধা দীর্ণ, তাদের সম্পর্কের মধ্যে সমাজ বাধা হয়ে ওঠে। লেখককে তখন বলতে হয়, ‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না ইহা দূরেও ঠেলিয়া ফেলে’। যদিও শেষ পর্বে, আমরা দেখি সে নিজের প্রেমের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। সমাজের, ধর্মের অনুশাসনের ওপর জায়গা দিয়েছে শ্রীকান্তের ওপর তার ভালবাসার অধিকারকে। আবার অন্নদা দিদি দুঃশ্চরিত্র স্বামীর সব অপরাধ মেনে নিয়ে নির্বিবাদে বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে আসে, শুধু স্বামী এই সম্পর্ককে সম্বল করে, তাকে প্রশ্নাতীতভাবে ভালবেসে। বামুনের মেয়ের কাহিনী শেষ হয় হতভাগিনীর নিরুদ্দেশ যাত্রা দিয়ে, সমাজের শক্তিশালী পুরুষদের কাছে মাথা নত করে। বিরাজ বৌ কাহিনীতে বিরাজবৌ, মেজদিদির মেজদি স্নেহ আর আদর্শের আদলে গড়া অনন্যসাধারন চরিত্র, কিন্তু দুঃখ লোভ, কামনা বাসনাময় রক্তমাংসের মানুষ।পল্লীসমাজের রমার বৈধব্য রমেশের প্রতি প্রেমানুভূতির প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। গৃহদাহের অচলা বা চরিত্রহীন কাহিনীতে কিরণময়ীর প্রেম কিন্তু সেই যুগের তুলনায় বৈপ্লবিক, যেখানে বিবাহ সম্পর্কের বাইরে বিবাহিতা নারীর প্রেমের কথা এসেছে। অথচ সেখানেও দৈহিক শুচিতার ধারণা প্রবল, এমনকি তা কিরণময়ীর মতো ব্যক্তিত্বময়ী বুদ্ধিমতী যুক্তিবাদী রমণীর মানসিক বৈকল্যের কারণ হয়ে ওঠে। ফলে এই চরিত্র গুলির যন্ত্রনা, সমাজের এই অবিচার পাঠককে কষ্টকর এক অনুভূতির দিকে ঠেলে দেয়। শরৎসাহিত্যের নারী সেই যুগে যে শাসন এবং শোষণ সহ্য করত আজ নারী স্বাধীনতার যুগে মানুষ হিসেবে অনুভব করতে পারি, মিলিয়ে নিতে পারি আমরা।
সেই দিক থেকে আশ্চর্য ব্যতিক্রম অভয়া,নামকরনেও তার ইঙ্গিত মেলে।অভয়া স্বামীর অন্য নারী সঙ্গের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলে,বেতের প্রহারে গর্জে ওঠে, বিদ্রোহ করে। প্রতিষ্ঠা করে নিজের প্রেম, নিজের জীবনকে, পাত্তা দেয় না সমাজের ভ্রূকুটিকে। আর মনে রাখতেই হবে শেষ প্রশ্নের কমলকে, যে প্রায় আজকের মেয়ের মুখের ভাষায় কথা বলে, বিবাহ নামে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই আঙুল তোলে, স্বাধীন প্রেমের জয়গানে সে সোচ্চার, শুধু কথায় নয়, অজিতের বিবাহের প্রস্তাবকে ঠেলে সে আজকের যুগের ‘লিভ টুগেদার’ বেছে নেয়, নিজের ভবিষ্যৎ বাজি রেখে সে প্রমাণ করে তার বিশ্বাসকে।
তার পরেও কিন্তু তাঁর নারীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেবাপরায়ণা (রেঁধে বেড়ে কাছে বসে খাইয়ে পুরুষের রসনা তৃপ্তিতে তাদের সর্বাধিক আনন্দ!), লেখকের ভাষায় সহিষ্ণু, মহীয়সী, স্নেহময়ী। সব মিলিয়ে তাঁর উপন্যাসের নারীরা অনেক বেশি বর্ণময়, লেখকের সহানুভূতির তুলিতে প্রাণময়ী তাঁরা একথা অনস্বীকার্য। এ কথা মানতেই হবে যে, তাঁর সাহিত্যে তিনি বাঙালীর মেয়েকে পুরুষের চেয়ে এগিয়ে রেখেছেন, তাদের আত্মস্বার্থ ত্যাগকে মহিমান্বিত করছেন, যা পরবর্তী বাংলা সাহিত্য সৃষ্টিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।
সুতপা দত্ত
লেখিকা সাংবাদিক। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখা ছাড়াও একটি বাংলাদেশ পত্রিকার প্রতিনিধিও ছিলেন সুতপা। তাঁর নয়টি বই ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে যার মধ্যে সুচিত্রা সেনের উপর বইটি জনপ্রিয়তা পায় এবং ভ্রমণ সমগ্র বেষ্টসেলার হয়।