শুক্রবার, ২৮ জুন , ২০১৯, দুপুরে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা শহীদ বদিউল আলম বীর বিক্রমের স্বজন ও সহযোদ্ধারা সমবেত হয়েছিলেন এক স্মরণ-সম্মিলনী সভায়। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে রাজধানী জুড়ে পাক সেনাদের কাছে মূর্তিমান ত্রাস হয়ে ওঠা নগর কেন্দ্রিক গেরিলা যোদ্ধা বাহিনী, এই ক্র্যাক প্লাটুনের বীরত্ব গাঁথা জানেনা এমন বাঙা্লী তো নেইই, দেশ বিদেশেও এঁদের শৌর্য বীর্যের গল্প ইতিহাস সমান সুপরিচিত।
শহীদ বদিউল আলম, বদি নামে সুপরিচিত। নানা আদর করে নাম রেখেছিলেন তপন, অর্থাৎ সূর্য। সূর্যের মতোই তেজস্বী, ভয়হীন বদির অভিধানে ‘অসম্ভব’ শব্দটার অস্তিত্বই ছিল না। ছয় ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন বদি। তাঁর বড্ড আদরের একমাত্র ছোট বোন, জাহানার বেগম (শামীম) সম্প্রতি দেশে এসেছেন। আজীবন বুকের ভিতর ভাইয়ের স্মৃতি লালন করা বোনটির ইচ্ছে ছিলো এবার দেশে আসলে শহীদ বড় ভাইয়ের সহযোদ্ধাদের নিয়ে একটা ছোটখাটো সম্মিলনী ও স্মৃতিচারণের আয়োজন করবেন।

স্মৃতিকাতর বীর যোদ্ধারা
২৬ জুন ১৯৪৮ সালে জন্ম নেয়া বদির একাত্তরতম জন্মদিনকে ঘিরে আয়োজনের দিন নির্ধারিত হয় ২৮ জুন। সঙ্গত ভাবেই সব ভাই এবং পরিবারের সবার মাঝে এমন একটা আয়োজন ইচ্ছেকে ঘিরে আগ্রহ আকাঙ্ক্ষা বেড়ে উঠছিলো। ব্যাপারটা ঠিক ঠিক বাস্তবায়ন সম্ভব হলো মুক্তিযুদ্ধ ও যোদ্ধাদের প্রতি অনন্য ভালোবাসা ও তাঁদের নিয়ে নানান প্রকাশনা এবং কর্মযজ্ঞের আয়োজনে সিদ্ধহস্ত শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘরের প্রাক্তন কর্মকর্তা রুবিনা হোসেনের নিরলস উদ্যমের কল্যাণে।
ক্র্যাক প্লাটুনের সহযোদ্ধা, বদির অগ্রজ অনুজ বন্ধু; আরও মুক্তিযোদ্ধা এবং নানান প্রাজ্ঞজনেরা, যাঁরা উপস্থিত থাকলে শহীদ বদিউল আলম, বীর বিক্রমের স্মৃতিচারণ ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন সম্যক সম্ভব হয়ে উঠতে পারে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ ও পুরো আয়োজনের কাজগুলো সম্পন্ন করেছেন রুবিনা হোসেন। সেই সাথে স্বজনদের সহযোগিতায় নির্মাণ করেছেন প্রায় পঁচিশ মিনিট দৈর্ঘ্যের প্রসংশার্হ্য একখানা ডিজিটাল প্রেজেন্টেশন। গোটা আয়োজনে সহায়তা জুগিয়েছেন রঙধনু টিভির কর্ণধার স্বনামধন্য সাংবাদিক সানাউল্লাহ লাবলু। গুলশানস্থ ক্যাডেট কলেজ ক্লাব প্রাঙ্গনে দুপুর থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করবার ভার পড়েছিল আমারই উপরে।

শহীদ বদির উপরে নির্মিত প্রেজেন্টেশনে মগ্ন সহযোদ্ধারা
ছোট অনাড়ম্বর ও ঘরোয়া এ অনুষ্ঠানের শুরুতে সমবেত হবার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করার পরপরই ছিলো মধ্যাহ্নভোজ। মধ্যাহ্নভোজের পর অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রদর্শিত হয় শহীদ বদিউল আলমকে নিয়ে সুনির্মিত তথ্যচিত্রটি। তারপর একে একে স্মৃতিচারণমূলক বক্তব্য রাখেন উপস্থিত ক্র্যাক প্লাটুনের সহযোদ্ধারা, অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা এবং পরিবারের স্বজনরা।
একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাগমে সভাস্থল হয়ে ওঠে আলোকজ্জল দীপ্র এক সাহসের সমাবেশ। ক্র্যাক প্লাটুনের দুর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধারা একে একে স্মরণ করেন বদিউল আলমের যুদ্ধে যোগদান, ট্রেনিং, অপারেশন, সাহস, প্রজ্ঞা, জ্ঞান, পাঠের নেশা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, সততা, মেধা থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত প্রেম ভালোবাসা, দেশাত্ববোধ, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নানান স্মৃতিকথা। তাঁর ভাই বোনরাও বলেন এমন নানান স্মৃতির কথা। মূল উদ্যোক্তা বোন জাহানারা বেগম (শামীম) আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ভাইয়ের স্মৃতিচারণায়। নিবেদিতপ্রাণ আয়োজক রুবিনা হোসেনের বক্তব্যে দেশ ও দেশের জন্য প্রাণত্যাগী মুক্তিযোদ্ধাদের কথা উঠে আসে অনন্য আবেগ ও ভালোবাসায়।
ক্র্যাক প্লাটুনের খ্যাতনামা সব মুক্তিযোদ্ধারা – হাবিবুল আলম, বীর প্রতীক; কামরুল হক স্বপন, বীর বিক্রম; আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন, বীর প্রতীক; এ এফ এম এ হ্যারিস এবং মেজর (অবঃ) ফেরদৌস খান প্রমুখের বক্তব্যে অনেক স্মৃতিকথার পাশাপাশি বদিউল আলম, বীর বিক্রমের মতো এমন বিরল ও সাহসী সহযোদ্ধার কৈশোর, তারুণ্য, ছাত্রজীবন, যুদ্ধজীবন এসব নিয়ে নানান জানা অজানা তথ্য ও স্মৃতি তুলে আনেন।

চলছে প্রেজেন্টেশন
সবশেষে বক্তব্য রাখেন ছোট ভাই মাহবুব উল আলম এবং সর্বকনিষ্ঠ ভাই সাইফুল আলম কাঁকন। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন বদির ক্র্যাক প্লাটুনের সহযোদ্ধা এবং ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সতীর্থ ও অগ্রজরা। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ফতেহ আলী চৌধুরী, মেজর (অবঃ) মুনিব, মেজর (অবঃ) মিজান; সহপাঠী লেঃ কর্নেল (অবঃ) শাহরিয়ার চৌধুরী, জুলফিকার রহমান রানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নাদির জুনায়েদ, বাঙালীয়ানা সম্পাদক সাগর লোহানী। উপস্থিত ছিলেন বদির অনুজ ফজলুল আলম সেলিম এর স্ত্রী এবং আরো অনেকে।
অনুষ্ঠানে শহীদ বদিউল আলম বীর বিক্রমকে নিয়ে একটি স্মারক গ্রন্থ প্রকাশনার কাজ চলছে বলেও জানানো হয়। সম্প্রতি তাঁর মা রওশন আরা খানমের লেখা রোজনামচাকে ভিত্তি করে প্রকাশিত স্মৃতিচারণ মূলক জীবনী গ্রন্থ ‘শহীদ বদি ও আমার স্মৃতিতে একাত্তর’ গ্রন্থটি অনুষ্ঠানস্থলে রাখা হয় সংগ্রহের জন্য। নিকট আগামীতে বদিউল আলমের জীবন ভিত্তিক একটি তথ্য প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের ব্যাপারে পরিকল্পনার কথাও অনুষ্ঠানে জানানো হয়।
লেখক পরিচিতি:
লুৎফুল হোসেন,কবি ও কথাকার