বাস থেকে নেমে রিক্সায় বসেই খলবল করে কথা বলা শুরু করলো রিয়া। যেন অনেকদিন পর কথা বলার যুতসই উপলক্ষ পেয়েছে। রিয়াকে নিতে আসা আব্বাস মামা অবাক। রিয়াতো এমন ছিল না। ওর আচরণতো এমন নয়। ধীর-স্থির শান্তশিষ্ট নরম স্বভাবের মেয়ে রিয়া। তা’হলে কি বিদেশ গিয়ে এমন হয়েছে? আব্বাস একা-একা ভাবে। মাঝে মাঝে বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে রিয়ারকে। দেখতে-দেখতে মেয়েটা কত বড় হয়ে গেল। এইতো সেদিন প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে এলেন। আজ সে বিদেশ থেকে বড় ডিগ্রি নিয়ে ফিরছে। মাঝখানে কতগুলো বছর কেটে গেছে। তারমানে-এই বছরগুলো আব্বাসের জীবন থেকেও হারিয়ে গেছে। বুড়ো হয়ে যাচ্ছে সে। জীবনের পড়ন্তবেলা শুরু হয়েছে। গতি আর বেশি নেই। আব্বাসের ভাবনা তাকে ক্লান্ত করার মুহূর্তে রিয়া তাকে ভাবনা থেকে টেনে সামনে তুলে ধরে। বিস্ময় ভরা মুখে স্মৃতি হাতরে বলে, মামা, ‘এই রাস্তাটা আগে কাঁচা ছিল না?’
‘হ্যাঁ।’ আব্বাস অনুচ্চস্বরে জবাব দেয়। ‘বছরখানেক হলো পাকা হয়েছে।’
রিয়া মন খারাপ করে বলে, ‘রাস্তা পাকা হয়েছে ভাল কথা-কিন্তু রাস্তার পাশে নিবিড় ছায়া দেয়া সেই বড়-বড় গাছগুলো কোথায়?’ রিয়ার কন্ঠে হাহাকার ঝরে।
আব্বাস বলে, ‘একটা পেলে আরেকটা হারাতে হয়। আগে দেখতে হবে-কোনটা মানুষের বেশি প্রয়োজন? এই যে পাকা রাস্তায় তুই আরাম করে রিক্সায় যাচ্ছিস-তার কি কোন মূল্য নেই? তোর কি অন্য রকম ভালালাগা কাজ করছে না?’
রিয়া বলে, ‘তা করছে। কিন্তু গাছগুলোর জন্যে মায়া হচ্ছে। যাকগে। তোমার কথাই রাইট। একটা পেলে আরেকটা হারাতে হয়। এই যেমন আমি। স্বাধীনতা পেয়েছি। স্বাধীনতার জন্যে বাবাকে হারিয়েছি। আগে বলো, মা কেমন আছে? এতক্ষণ ধরে বক বক করে যাচ্ছি। আসল কথাই জানা হয়নি। আচ্ছা মামা, এত দেরিতে মা’র কথা মনে হলো কেন? আমি কি মাকে ভুলে যাচ্ছি? আর তুমি বা কেমন মামা-কতক্ষণ হলো রিক্সায় যাচ্ছি। আমাকে একবারও মা’র কথা মনে করিয়ে দাওনি? কেমন আছে মা?’
আব্বাস দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলে, ‘কেমন আর থাকবে। তুই আসবি, তার নাওয়া-খাওয়া বন্ধ। পথ চেয়ে বসে আছে।’
‘আমার মা’টা বড় দুখি, তাই না মামা? যৌবনে স্বামী হারিয়েছে। সুখের মুখ দেখতে পেল না।’
আব্বাস কথা ঘুরিয়ে দেয়, ‘তুই একা এলি, ছেলেটাকে সঙ্গে করে আনলি না কেন?’
‘ওর পরীক্ষা।’ তারপর হেসে বলে, ‘বাপের নেওটা। আমার সঙ্গে আসবে না। বাপের সঙ্গে আসবে।’
‘কত বয়স হলো?’
‘এইতো সামনের ডিসেম্বরে দশে পড়বে। ভীষণ দুষ্টু।’
‘বাংলা বলতে পারে?’
‘পারবে না মানে? এইটা তুমি কি বললে মামা? ওর বাবা এবং আমি বাংলা ভাষা এবং স্বাধীনতার ব্যাপারে নো কোম্প্রমাইজ। ঘরে আমরা সবাই বাংলা বলি। বাইরে বেরুলে ইংরেজি। দেশটা ইংল্যান্ড না?’
রিয়া কথা বলছে কিন্তু তার দৃষ্টি সাই-সাই করে ঘুছে চারপাশ। রিয়া হঠাৎ উচ্ছ্বল হয়ে ওঠে। ‘মামা, আমরাতো এসে পড়েছি। বাড়িতো আর বেশি দূরে নেই। চলো আমরা হেঁটে যাই।’ বলেই রিক্সাওয়ালাকে রিক্সা থামাতে বলে। আব্বাস কি বলবে বুঝতে পারছে না। রিয়া তাকে ধরে নামায়। আব্বাস বুঝতে পারে রিয়া যখন বায়না ধরেছে তখন হেঁটে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। আব্বাস রিক্সাওয়ালাকে বলে, ‘তুইতো আমাদের বাড়ি চিনিস। তুই গিয়ে ব্যাগটা রেখে আয়। ফেরার পথে ভাড়া নিয়ে যাবি।’ রিক্সাওয়ালা ব্যাগ নিয়ে চলে যায়। মামা-ভাগ্নি হাঁটছে।
‘মামা, সামনের বাঁক ঘুরলেই আমাদের বাড়ি, তাই না?’
আব্বাস হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে।
‘কতদিন বাড়িটা দেখা হয় না।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিয়া। এটা রিয়ার বাবার বাড়ি নয়, মামার বাড়ি। রিয়া এটাকেই নিজের বাড়ি হিসেবে জানে। বাবার বাড়ি তার দেখা হয়নি। যায়নি কোনদিন সেখানে। বাবাকেও দেখেনি রিয়া। রিয়ার জন্মের আগে বাবা এ পৃথিবী ছেড়ে গেছে। রিয়ার বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছে। রিয়া তখন মায়ের গর্ভে। যুদ্ধ থেকে রিয়ার বাবা ফিরে আসেনি। বাবা সম্পর্কে যেটুকু জেনেছে সেটা মায়ের মুখে শোনা।
হাঁটতে-হাঁটতে এক জায়গায় এসে থেমে পড়ে রিয়া। ‘মামা, এইখানে একটা গাবগাছ ছিল না?’ আব্বাস মাথা নেড়ে স্বীকার করে। রিয়া স্মৃতি হাতড়ে বলে, ‘কতদিন এই গাছের গাব পেড়ে খেয়েছি।’ রিয়া দাঁড়িয়ে পুরনো স্মৃতি হাতরাতে থাকলে আব্বাস হেসে বলে, ‘তোর চেয়ে কি আমার স্মৃতি কম। তুইতো তোর জন্মের কথা জানিস না। আমি জানি।’
‘কি ভাবে জানবো? আমিতো বাবাকে দেখিনি। আচ্ছা মামা, আমার বাবা দেখতে কেমন ছিল?’
‘সুদর্শন। সুঠাম দেহী। দুদার্ন্ত সাহসী। কেন, ছবি দেখিসনি?’
‘দেখেছি। ছবিটা সাদা-কালো। ম্যারম্যারে ধরনের। স্মার্ট না।’
‘কিন্তু সে ভীষণ স্মার্ট ছিল। যুদ্ধের মাঝপথে একরাতে হঠাৎ তোর বাবা এসে হাজির।’
‘যুদ্ধের সময়?’
‘হ্যাঁ। তখন ভয়ংকর যুদ্ধ চলছে চারদিক। গভীর রাতে দরজায় শব্দ। আমিতো ভয়ে অস্থির। ভেবেছিলাম বুঝি পাকআর্মী এসেছে।’
‘কেন, তোমার এমন মনে হলো কেন?’
‘ওরা তখন মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজছিল। রাজাকাররা বলে দিত কে বা কারা মুক্তিযুদ্ধে গেছে। কার বাড়ি কোথায়-কিভাবে সে বাড়িতে যেতে হবে, পথ চিনিয়ে নিয়ে যেত রাজাকাররা।’
‘তারপর?’ রিয়া জিজ্ঞেস করে।
‘তারপর ফিস ফিস করে তোর মায়ের নাম ধরে ডাকছিল। আমি গিয়ে দরজা খুলে দেখি মুখে একরাশ দাড়ি ঝাঁকড়া চুল নিয়ে অচেনা কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। কাধে স্টেন গান। মাথায় স্বাধীন বাংলার পতাকা। আমি ভয়ে সরে আসতে আমাকে বলে, ‘আব্বাস ভাই, আমি শফিক। তারপর আমি তাকে ঘরে নিয়ে এসে বসতে দিলাম। তোর মাকে ডেকে তুললাম। তোর মা তোর বাবাকে দেখে আনন্দে-আবেগে কথা বলতে পারছিল না। কি যে সুন্দর লাগছিল তোর বাবাকে। মনে হচ্ছিল সত্যিকারের একজন বীর।’
‘ইস! মাথায় পতাকা বাঁধা একটা ছবি যদি তুলে রাখতে তা’হলে কত ভাল হতো। আমি সারাক্ষণ একজন মহান বীরকে সঙ্গে নিয়ে বয়ে বেড়াতাম। আমার কি যে ভাল লাগতো। জান মামা, লন্ডনে বাঙালিরা গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে একটি অনুষ্ঠান করেছিল। সেই অনুষ্ঠানে আমাকে ওরা বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ডেকেছিল। আমি বাবার কথা বলতে গিয়ে আর কিছুই বলতে পারলাম না। শুধু কাঁদলাম। গর্বের কান্না মামা। এই দেখ আমি এখনও কাঁদছি। চোখের পানি আমার গাল চুইয়ে পড়ছে। আমার বাবা দেশের স্বাধীনতার জন্য শহীদ হয়েছে-এটা ভাবলে আমার আর কোন কষ্ট থাকে না। গর্বে আমার বুকটা ফুলে ওঠে। মনে হয় দেশটা আমার। এই দেশের জন্য আমার বাবা রক্ত দিয়ে গেছে। এ দেশের সবকিছুতে আমার অধিকার। আমার মতো ভাগ্যবতি আর কে আছে মামা? আমি ভাগ্যবতি না?’
‘অবশ্যই ভাগ্যবতি।’
‘বাবা কোথায় যেন শহীদ হয়েছিল?’
‘কামালপুর সেক্টরে। তার কয়েকজন সাথী পাক আর্মীর এ্যামবুশে আটকে পড়েছিল। তাদের উদ্ধার করতে গিয়ে পাক আর্মীর ব্রাশ ফায়ারে তোর বাবা শহীদ হন।’
‘বাবার খুব সাহস ছিল, তাই না মামা?’
‘সাহস না থাকলে সাথীদের উদ্ধার করতে জীবন হাতে নিয়ে শক্রর আস্তানায় কেউ ওভাবে যায়?’
রিয়া বলে, ‘ঠিকই বলেছ। সাহসী বলেইতো মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। এই জন্যেতো সে মুক্তিযোদ্ধা। তোমার সাহস ছিল না। তাই তুমি মুক্তিযোদ্ধা হতে পারোনি।’
‘তুই ঠিকই বলেছিস। মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসী ছিল। তারা দুর্ধর্ষ পাক আর্মীর বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে যুদ্ধ করেছে। সাহস না থাকলে যুদ্ধ করবে কিভাবে?’
‘ইস! বাবাকে যদি দেখতে পেতাম। মনে বড় সান্ত্বনা থাকতো।’
‘দুঃখ করে আর কি করবি। এখন মা’র কথা ভাব। সে তোকে বুকে নিয়ে বাকি জীবনটা পার করলো। কি পেল জীবনে?’
‘কি বলো মামা-কি পেলো মানে! সে শহীদের স্ত্রী। এটা কি তার কম বড় পাওয়া। কয়জনের ভাগ্যে এমন ঘটে? কয়জন মেয়ে শহীদের স্ত্রী হতে পেরেছে?’
‘সেটা ঠিকই বলেছিস। এবার ২৬ মার্চ তোর মাকে প্রধানমন্ত্রী দাওয়াত করে নিয়ে গিয়েছিলেন।’
‘তাই! সে কথা এতক্ষণ বলোনি কেন?’
‘বাড়িতে চল। প্রধানমন্ত্রীর সাথে তোর মায়ের ছবি আছে, দেখবি।’
‘ছবিটা আমি বাঁধাই করে লন্ডনে নিয়ে যাব। আমার ছেলে দেখলে ভীষণ খুশি হবে।’
‘আমরাই কি কম খুশি হয়েছি? তোর মা ছবিটা বাঁধাই করে দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছে।’
‘ছবির আর কপি নেই?’
‘আছে না? উপজেলায় গিয়ে কমপিউটারে আরো অনেক কপি করেছি আমি। তোর জন্যও এক কপি আলাদা করে রেখেছে তোর মা। তুই আসবি সারাদিন তার শুধু এই কথা। কখন আসবি? প্লেন কখন আসবে? সারাদিন শুধু একই কথা।’
আব্বাসের কন্ঠ আবেগে ভারী হয়ে আসে। বলে, ‘তুই কি জানিস, তুই যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিস, সেই রাস্তাটি এখন তোর বাবার নামে? ‘শহীদ শফিক সরণি’। রিয়া এবার হাঁ হয়ে তাকায়। তার রক্তের মধ্যে হঠাৎ ঝলকে ওঠে ঝড়। ‘কি বলছো মামা! আবার বলো। আমি যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি-সেটা এখন শহীদ শফিক সরণি? আমার বুকটা ফুলে পাহাড় হয়ে যাচ্ছে মামা। আনন্দে আমার চোখ ফেটে কান্না আসছে। আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে, আমি সেই বীরের সন্তান-যার রক্তে এ দেশের স্বাধীনতা এসেছে। আমার পিতা এই দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছে।’ রিয়ার হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়, ‘মামা, আমি এই রাস্তায় দৌড়ব। ছুটবো। যা ইচ্ছে তাই করবো।’
আব্বাস হাসে। ‘তুই কি পাগল হয়ে গেলি? তুই কি এখন সেই কচি খুকিটি আছিস? কত বয়স হয়েছে, খেয়াল আছে? একসন্তানের মা তুই। তুই রাস্তায় দৌড়লে লোকে কি বলবে?
‘লোকজন যা ইচ্ছে বলুক মামা। বাবার নামের রাস্তায় সেই শহীদের সন্তান ছুটবে-তার রক্তে এখন সেই উন্মাদনা।’
রিয়ার পরনে শাড়ি। সে শাড়ি উঁচিয়ে ধরে সত্যি-সত্যি দৌড়তে শুরু করে। আব্বাস হতভম্ব মুখে তাকিয়ে হাসে। পেছন থেকে ‘দাঁড়া-দাঁড়া’ বলে রিয়াকে ডাকতে থাকে আব্বাস। রিয়া দাঁড়ায় না। ছুটছে। যেন সে ছোটবেলায় ফিরে গেছে।
রিয়া ছুটতে-ছুটতে হঠাৎ সামনে একটি পাকা পিলার দেখে থমকে দাঁড়ায়। পিলারের গায়ে লেখা ‘শহীদ শফিক সরণি’। উদ্বোধন করেছেন, মাননীয় সাংসদ…… উদ্বোধকের নাম পর্যন্ত পড়ার ধৈর্য ছিল না রিয়ার। ওর দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে। একসময় সে পিলার ধরে বসে পড়ে।
আব্বাস অস্থির ভাবে কাছে আসে। ‘কি করছিস? চল বাড়ি চল। তোর মা অপেক্ষা করছে।’
রিয়া বলে, ‘মা বাড়িতে আছে-থাকবে। কিন্তু বাবা? আমি বাবাকে রেখে যাব না। তাকে রেখে কিভাবে যাব মামা? তাকে নিয়ে যাব না? জান মামা, এই পিলারটাকেই মনে হচ্ছে আমার বাবা। আমার না দেখা বাবা। দেশের জন্য যে মানুষ জীবন দিয়েছে। এই পিলারকে আমার জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে মামা।’ রিয়া বলেই পিলারটাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। আব্বাস ভাষা হারিয়ে ফেলে। তার চোখ দিয়েও জলের ধারা বইছে।
কান্না থামিয়ে রিয়া আঁচলে চোখ মোছে, বলে, ‘মামা বলতো, ‘এই স্তম্ভ-না না স্তম্ভ না। এটা আমার স্মৃতির মিনার। এই মিনারের বেদীমূলে কি দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো যায়?’ আব্বাস কি বলবে বুঝতে পারে না। রিয়া বলে, ‘এমন স্মৃতিফলকে মাথার মুকুট খুলে দিলে সম্মানটা যথার্থ হতো। আমার মাথায়তো মুকুট নেই। মাথায় জড়ির লাল ফিতা আছে। আমি মাথার ফিতা দিয়ে স্মৃতিফলকে সম্মান জানাবো। রিয়া মাথায় ফিতা খুলে স্মুতিফলকে জড়িয়ে বেঁধে দেয়। লাল ফিতাটা যেন পিতার রক্তের তীব্রতা আরো স্পষ্ট করে তোলে।
আব্বাস তাড়া দেয়, চল। ‘ওই যে দেখ, তোর দেরি দেখে তোর মা এসে পড়েছে।’ রিয়া মুখ তুলে দেখে ওদের ছেড়ে দেওয়া রিক্সায় মা আসছে। মাকে দেখামাত্র ‘মা’ বলে আকাশ কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে রিয়া। সেই চিৎকার যেন সারা চরাচর আছড়ে পড়ে। গোটা প্রকৃতিতে যেন সেই মা ডাক ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। মা-সন্তানের কান্নারত আলিঙ্গন পরিবেশ যেমন ভারী হয়ে ওঠে তেমনি আনন্দে বেদনাগুলো দূরে সরে যেতে থাকে।
রিয়া বলে, ‘মা, এই স্তম্ভ তুমি দেখেছ? না দেখলে ভাল করে দেখ। এইখানে আমার বাবার নাম। দেখ দেখ।’ রিয়া বলছে আর কাঁদছে। রিয়ার মা কথা বলতে পারছে না। মনে হচ্ছে তার এতদিন পুষে রাখা বুকের ভার জলের ধারায় গলে-গলে শরীর বেয়ে নেমে যাচ্ছে। ভীষণ হাল্কা লাগছে তাঁর। মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে তারপর বুকে জড়িয়ে ধরে। বলে, ‘তোরতো আরও একজন বাবা আছে। তাকে রেখে এলি কেন?’
‘ভুল বলেছ মা। আমার একজনই বাবা। তিনি শহীদ শফিক। তাঁর জায়গায় আর কাউকে আমি স্থান দিতে পারবো না। সে স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ। সে আমার শহীদ বাবা।’
লেখক:
ইসহাক খান, কথাসাহিত্যিক