কবিতা একটি যুদ্ধ
(বিজয় দিবসের কথা স্মরণ করে)
অনেক রাত্রির ঘুম চোখে মারাত্মক মারাণাস্ত্র হাতে
ওসমানপুর থেকে মোসাদ্দেক,
সাহা পাড়া থেকে জগদীশ
প্রায় ছয়ফুট উঁচু আক্ষখেত পার হয়ে দীর্ঘদেহী সোলায়মান
জোনাকির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে…
ওদের সবার চোখে স্বাধীনতার ঝিলিক
কবিতা একটি যুদ্ধ, যাকে শর্তহীন ভালাবাসা যায়
আর তাই
আমি এমন কবিতা চাই যে বন্দুক চালাতে পারে
চিপা গলিতে শত্রুপক্ষের সাথে তুমুল ধ্বস্তাধস্তি শেষে
তাকে ধরাশায়ী করতে পারে,
মেঘ বৃষ্টি ঝড়ে
বিদ্যুৎ খুঁটির মতো একরোখা
নিশ্চুপ
দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।
কবিতা একটি যুদ্ধ, যা পকেটে রাখা যায়। আর
তাকে ভালবেসে
নতুন পতাকা হাতে সর্ষে ক্ষেতের ভেতর দিয়ে
ছুটতে ছুটতে ছেলেগুলো গেয়ে ওঠে
জয় বাংলা…
একজন ভিখারি শূন্য থালা উচিয়ে বলে
বুকের ভিতর আজীবন
জয় বাংলা…
এক জোড়া বালিহাঁস কচুরিপানার ভেতর থেকে
উঁকি দিয়ে টুকু দেয়…
জয় বাংলা…
দাউ দাউ পূর্ণিমায়, ঝিঁ-ঝিঁ পোকা আর জোনাকির
উৎসবে এতো সুর করে কে গায়
জয় বাংলা।
সারি সারি মোটরগাড়ি,
রিক্সা, ঠেলাগাড়ি,
ট্রেনের ছাদে
জামার বোতাম খুলে
যশোর রোডে,
হিলি, বেনাপোলে ভিড়,
ভিড় বাড়ে
কুমিল্লা, জয়পুরহাটে… যেন
সুনামীর মতো ভেঙে-চুরে আসছে সব।
আর গঞ্জের হাটে,
হাট-ভাঙা মানুষ ওয়ানব্যান্ড রেডিওতে
কান পেতে
শোনে
ঢাকার খবর কি।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী
তারামন বিবি,
গাছের গুড়িতে বসে শীত-সকালে
রোদ পোহায়
ভাবলেশহীন…
ওরা প্রাণ দিয়ে দেখে উড়ে যাওয়া পাখি, খোলা আকাশ,
শত্রুহীন মাঠ-ঘাট
বিজয়ের প্রথম হাসি। আর তাই
আমি চাই এই কবিতাটি সকলে পড়ুক
জোরে জোরে, কিম্বা
মনে মনে, প্রতিদিন…
সকাল সন্ধ্যা।

বঙ্গ-ভঙ্গ, অথবা…
(আর যদি একটা গুলি চলে…
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম…
-শেখ মুজিবর রহমান)
আর যদি একটা গুলি চলে…
বাঙ্গালী জাগে
টিএসসি, কলাভবন
নক্সীকাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট
১৯০৫
বঙ্গভঙ্গ
গান্ধী…জিন্নাহ
উত্তপ্ত কলকাতা
বিষের বাঁশি, অগ্নিবীণা
উত্তম সুচিত্রা
আসাদের শার্ট, রক্তমাখা
অপুর সংসার,
সোফিয়া লরেন, মার্লোন ব্রান্ডো
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম…
ভুট্টো, ইয়াহিয়া
প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে
রাইফেল
স্টেনগান
অসংখ্য মৃত্যু
টেলিফোন তারে কালো কালো কাক
হর্ষধ্বনি
ইস্টিমার
মানুষ বোঝাই রেলগাড়ি
রাজ্জাক-কবরী
১৯৭৪
দুর্ভিক্ষ
ক্ষুধা
মৃত্যু,
আরও কয়েকটি মৃত্যু
খাল-কাটা
কুমিরের চাষ
বুটের মচমচ
নিঃশব্দ পায়চারি
লেফটেন্যান্ট জেনারেল
মিছিল
মিছিলে শ্লোগান
স্বপ্ন দেখে রঙ্গিন টেলিভিশন
স্বপ্ন দেখে আফজাল-সুবর্ণা
স্বপ্ন দেখে নতুন বৌ, ফুলির মা, পদ্মা-যমুনা
স্বপ্ন দেখে পূর্ব-পশ্চিম
স্বপ্ন দেখে কুড়িগ্রাম, কুতুবদিয়া
টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া…

স্বাধীনতা
আমি এক বন্দী যুবকের চোখে তাকিয়েছিলাম
এবং ছুরির মতো ধারালো দৃষ্টিতে তার
দেখেছি বিজয়।
আমি এক পুত্রহারা জননীর চোখে তাকিয়েছিলাম
এবং সজল চোখে তার
প্রথম দেখেছি সূর্যোদয়।
আমি একদিন ভোরের আকাশে চোখ
মেলে রেখেছিলাম এবং
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে দেখেছি লাল
সবুজের মেলা।
আমি এক থুত্থরে বৃদ্ধার চোখে চোখ
রেখেছিলাম এবং তার চোখে দেখেছি প্রথম
বাংলার সূর্যাস্ত।
অফিস আওয়ারে এক কেরানির দিকে
তাকিয়েছিলাম, টেবিলের
’পর জমে থাকা ধূলোয় আঙুল দিয়ে আনমনে
লিখেছে সে মুক্তি।
রেসকোর্স মাঠে মুজিবের ভাষণ শুনেছিলাম।
এবং দেখেছি
সবাই তাদের পূর্ব–নাম মুছে প্রতি ঘাসে
এবং ধূলিকণায় লিখে রেখেছে বাংলাদেশ।
আমি এক তরুণ কবির
প্রথম কবিতা পড়েছিলাম এবং তার শিরোনাম
ছিলো স্বাধীনতা।

প্রধান চরিত্র
আমরা সেদিন রণক্ষেত্রগুলো পুনর্বার দেখতে গেলাম।
গ্রামগঞ্জে যেন অসুস্থ হয়ে না পড়ি সেজন্য উদ্বিগ্ন
মায়েরা খাবার–দাবার এবং প্রয়োজনীয় ঔষধপত্রও
ঝোলা ভরে দেন। আমাদের ফুটফুটে গাড়িটি যখন
যমুনার মাথা ছুঁলো, বিষন্ন শহর একটু একটু করে
নগ্ন হতে থাকে রোদের খুনসুটিতে।
একঝাঁক ছেলে–বুড়ো আমাদের প্রায়
ঘিরে দাঁড়ালো। একটি মেয়ে প্রকান্ড বিস্ময়ে ড্যাব–ড্যাব চেয়ে
আছে যেন বুঝে গেছে সে মানুষে মানুষে কতটা
ফারাক। আমরা হাঁটতে হাঁটতে বুড়ো গাছটার
নিচে দাঁড়াই, ছিনাল জল শিকড় বাকল
ছুঁয়ে ভাঙনের গানে মত্ত। এইখানে,
ঠিক এইখানে তিনদিন পর নিতাই ধোপার
লাশ ভেসে উঠেছিলো। খুব ফর্সা
করে কেঁচে দিতো কাপড়, বলতো দ্যাখো ছোটোবাবু,
ময়লা কাপড় দিলকে ময়লা করে।
ওই যে দূরে মেয়েটি দাঁড়িয়ে, ওর নাম সন্ধ্যা। নিতাই ধোপার
মেয়ে, কথা বলতে পারে না। ওর দিকে তাকাতেই ধূর্ত
চড়ুইয়ের মতো দৌড়ে পালালো ও। আর
উত্তরে মাঠটা ওখানেই ঘটেছিলো
আসল যুদ্ধটা। ওরা পালাবার আগে কমপক্ষে দু’শ লোক
রক্তে রক্তে রক্তহীন করে। কুকুরের আহারে প্রাচুর্য ছিল
বেশ কিছুদিন। স্কুলের সামনে ছিল স্মৃতিফলক
ভোরের হাওয়ায় জলছবি হয়ে উঠতো ওদের
মুখ। ডুবে গেলো সব প্রতিমা বিসর্জনের মতো। মাঝে মাঝে
সরকারি লোক আসে। যে বাড়িটার মাথায় টিভির এন্টেনা
ওখানেই থাকে গোলাম আদম। জাপানি হোন্ডায়
ধুলা ওড়ায়। ঝাপসা করে রাখে আমাদের চোখ।
খাঁ খাঁ শূন্যতাকে বুকে নিয়ে দানব গাড়িটা ছুটে
চলে। আমাদের চোখে স্মৃতির আগুন। ঘুম থেকে উঠে আসা
ফোলা ফোলা চোখের ভিতর গুচ্ছ গুচ্ছ
প্রশ্ন। গাড়িটা যখন বাড়ির সামনে
তখনও সবাই ঘুমে। দুঃখ, রাত জেগে
আদর করছে নগরের অসুস্থ শরীর আর
আমি মনে মনে খুঁজি এ যুদ্ধের প্রধান চরিত্র।

তুমি যেভাবেই দেখো, বব
কোত্থেকে যে শুরু করি, ছিঁড়ে যাওয়া কাগজের মানচিত্রে, ঠিক
এইখানে, বঙ্গোপসাগরের বুকের হাঁড় থেকে জেগে ওঠা
একখন্ড পলিমাটি। এইখানে, গঙ্গা
মেঘনা শীতলক্ষ্যার তলদেশ থেকে প্রবাহিত জলধারা,
রক্তস্খলিত ফেনায় আজও ভেসে যায়… এই
জলধারা আমাদের পবিত্র উঠোন।
আর এই যে বিস্তীর্ণ পোড়া জমি, বারুদের গন্ধমাখা, এইখানে
সারি সারি কামান মর্টার মিসাইল তাক করাঘুমন্ত গ্রামের দিকে
নীলক্ষেত আর শস্যের গন্ধের দিকে
এই দ্যাখো, অবারিত গাছের ছায়ায় সমবেত পাখিদের
প্রাণের সাধক লালনের জন্মভূমি
মিরপুর বধ্যভূমি
কলাভবনের অপরাজেয় বাংলা
আর ঠিক এইখানে, উত্তরবঙ্গ… যখন গভীর রাত
চাঁদ এসে ঢলে পড়ে শিশুদের তুলতুল গালে,আর
ওদের বুকের ওমে পদ্মা আর ব্রহ্মপুত্রে
ভাতের ঢাকনা তোলা গরম বাষ্পের মতো
বুকের গভীর ব্যাথা
কেঁদে কেঁদে ওঠে
এই দ্যাখো, এই সেই রেসকোর্স মাঠ, প্রেমিকার ছোট ছোট
লাজ কথা, ঘাসের সবুজে চুপ করে থাকা ফড়িঙের অভিমান,
তর্জনি উচিয়ে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিলেন তিনি এইখানে,
সঙ্গে সঙ্গে উড়ন্ত বিদ্যুতের মতো আতঙ্ক ছড়ালো
চতুর্দিকে, ভয়াবহ…
বহুদিন লাল হয়ে ছিল আমাদের নীলাকাশ।
এটাই সবচে’ বড় যুদ্ধক্ষেত্র,
আমাদের সবচে’ বিখ্যাত ইতিহাস…
বব, তোমাকে বলেছিলাম আমার দেশের মানচিত্র দেখাবো তোমাকে…
কিন্তু দ্যাখো, আমি ভুল করে এতক্ষণ দেয়ালে টাঙানো ছবিটার
কথাই বলছিলাম। আসলে ওটাই আমাদের মানচিত্র…
তুমি যেভাবেই দেখো, বব…

লেখক:
শামস আল মমীন, কবি