দারুচিনি দ্বীপ
(আহমেদ শরীফ শুভ, বন্ধুবরেষূ)
আমি কি তাদের মতো হতে পারি
তাহাদের মতো?
তাহাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকেছিলো
পশ্চিমা বাতাস,
তবু কবে কোন জোৎস্নার রাত
এখনো তাদের কবিতায় লেখা থাকে,
চোরাকাঁটা হয়ে এখনো তাদের বুকে
সবুজের চিহ্ন আঁকা থাকে যেন
সমুদ্র গভীরে এক দারুচিনি দ্বীপ।
তারা কেমন উর্ধশ্বাস পার হয়ে গেল,
পার হলো নদী আর সমূদ্রের পথ
পার হলো গাছ পালা
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর ছায়া;
আমি যে তাদের মতো দৌঁড়তে পারিনা
আমি কেবল ঘাসের ডগা দাঁতে কেটে নিয়ে
প্রবল জোৎস্না রাতে
কোলে নিয়ে মাত্র ছয় পণ কড়ি
দারুচিনি দ্বীপে জেগে থাকি।

জনকের গল্প
ব্যস্ত শহর দেয়না যে কোন অবসর
তারই মাঝে দোলাচালের নাগরদোলায়
মস্তিষ্কের ঘুপচিতে টোকা দিয়ে যায়,
শেকড় গভীরে এক প্রোথিত জীবন।
মৃত্তিকার কাছাকাছি কোন উর্বর পলিভূমিতে
একদিন জন্ম নেয়া বাবার শৈশবে ঠিক
হূট করে ঢুকে পড়ে বর্ণমালার ম্যাজিক,
পাঠশালা অলৌকিক এক ছিলো ক্রোশ দূরে
উপাসনা চলে তার সব অগোচরে
চলে মাটির অক্ষরে তার সকল সাধন,
লক্ষ্য ছিলো তার নিছক অক্ষর আহরন,
পরিশ্রান্ত জোয়ালটি খুলে তাই তার নিত্যকার
অরক্ষিত শৈশবে চলে প্রথা ভাঙ্গার গান।
নিষেধের মৌন ভূমি থেকে স্বপ্ন ডানা
তার ছড়ালো যে এক ভাসমান মেঘের বেশে,
সমুজ্জ্বল মৃত্তিকার দেশে।
এভাবেই মাটিরই কাছাকাছি জন্ম নেয়া
কোন বৃক্ষের গল্প, স্বপ্নের নিকটচারী।

আশাবরী
অবেলার রোদ, অবেলার ছায়া
মনে রেখ-
এখনও হতে পারি পুরুষ বেহায়া।
বাষ্পরুদ্ধ জল, পলাতকা নারী
শুনে রেখ-
এখনও আমি ভালোবাসা দিতে পারি।

নরক গভীর
আবারো অই নারীর কাছে ফিরে এলাম
কামুক লম্পট দেবদূত-
সমুদ্র বিস্ফোরিত হলে
ঝলসে উঠে ফেনিল আহবান,
কাঁচের আড়ালে ঘেরা স্নানঘর, তারই
সীমান্ত মেঘে মুখ লুকায় যে অধরা রমনী,
তার হাতে খেলা করে অনভ্যস্ত খোলা খঞ্জর;
মৃদু স্পর্শে যে পীড়িত
তারে দেখি সরীসৃ্প অঙ্গের আকারে,
আমারে ঠেলে দেয় নরকের নীল গভীরে।

নক্ষত্রের কাছে
আমি আর আমার দুঃখ পাশাপাশি শুয়ে আছি
সমস্ত শরীর জুড়ে লকলকে গরল ছড়ায়ে যেন
বেহুলার স্বামী হয়ে ঘুমায় লখিন্দর;
আমি চলি সেও চলে পিছু পিছু-
তেষ্টা পায় প্রবল , তবু কুজো থেকে গড়িয়ে জল-
তেষনা মেটাতে ইচ্ছে করে না আজ,
মাঝরাতে বিষাদের ছাই মেখে শুয়ে থাকি অপলক।
জানিনা কোথায় আজ রাতের কপোল বেয়ে
রক্তের স্রোতের মতো বয়ে চলে রাধার যমুনা,
পৃথিবীর সব তারা বুঝি আজ অন্ধকারের দখলে,
তবু আকাশের গায়ে জেগে থাকা বুড়ি চাঁদ-
জীবনের চাওয়া পাওয়ার হিসাব করে রাখে,
সমবেদনার জ্যোৎস্না মশারীর নীচে ছুড়ে দিয়ে যায়।
নাছোড় নিষ্টুর দুঃখ আমার-
এমন খামচে ধরোনা হৃদয়,
ভুলো না, অজ্ঞাতে তা উৎসর্গ করা আছে
পৃথিবীর সব দুঃখী মানুষের নামে,
বুকের আগল থেকে ছিটকে ওঠা ফিনকি-
তাকে বলি শান্ত হও, কাল আসবে নতুন ভোর;
হেরে ফিরে যাবো বলে এ নক্ষত্রের কাছে আমি আসিনি।

পূজার বেদীতে স্বর্গের পারিজাত
এখন আর তেমন হারাবার কিছু নেই-
মাঘ পূর্ণিমার রাতে ভেঙ্গে যায় বাউলের মেলা
গুপীযন্ত্রে টান পড়ে পোড়া আঙ্গুলের,
মাঝ রাতে বসে বসে তাই নাছোড় হিসেব-
তুমি ছাড়া আর কিছু হারাবার নেই এ জীবনে।
আমি তো নই হাওয়ায় উড়ে আসা জ্যোৎস্নার ছাই
অথবা শাড়ির পাড়ে কোনো চোর কাঁটা
যখন যেমন খুশী ইচ্ছে হলে ফেলে দেবে ভাগাড়ে জঞ্জালে,
দুপায়ে মাড়ানো উলুখাগড়ার মতো যে জীবন
তুমি সাদা কালো আর কালো সাদা ম্যাজিক মুড়িয়ে
বেনোজলে ভাসিয়েছো নির্বিকার –
দোচালার ঘাসখড় পুড়ে পুড়ে আজ সব দুঃখের অংগার।
আমি কেবল ফোটাই দূঃখ মেশানো স্বর্গের পারিজাত
তারপর মিশে যাই রিক্ত সর্বনাশে পূজার বেদীতে।

অরণ্যের দিনরাত্রি
আমাদের ভ্রমনের দিন-
আমাদের ঘোরাঘুরির দিন বিস্মৃত প্রায়।
সমুদ্দুর নত ছিল,
একাকী জলকেলি করা মৎস কন্যা-
তার কোল ঘেঁষে অবশেষে
থরথর কাঁপা বরফের স্বপ্নবিন্দু।
সহস্র বৃক্ষের ছায়া-
দুপুরের ধাবমান নগরে
মানুষের মহিমা তুলে ধরে
আর অজস্র শব্দাবলী নিরবে খাক হয়
মানুষের উৎসব বিভাজিত করে স্বপ্ন নদী ।
মানুষের ছায়ার নীচে
চঞ্চল কাঠবেড়ালি থমকে দাঁড়ায়
কুমারি সর্পের ফনা বিনাশী বিকেলে
আনে এ কোন মুগ্ধ বিষ্ময়; তার মাঝে
দুঃস্বপ্নের মহিমা উড়ে উড়ে ছোবল উঁচায়;
অবিনাশী প্রান্তর জুড়ে হু হু করে উঠে আসা জল
যাদুঘরের চিত্রকলা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়-
আমি ভুল করে ভুল পাত্রে সম্প্রদান করি
স্বপ্নময় চাঁদের দ্যূতি, সবুজ অরণ্যের দিনরাত্রি।

লেখক:
শামীম হাসান, কবি, অধ্যাপক, চিকিৎসক
প্রাক্তন অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ