“আমি একজন শিল্পী হয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না। শিল্পীর ভূমিকাটা কী? সাহিত্যিকের ভূমিকাটা কী? আমি যে সৃষ্টি করছি তা কি এমনি? ‘সৃষ্টি’ শব্দটার মানে কী? সৃষ্টি এতো ফাইজলামি নাতো। তাহলে তো সবাই সৃষ্টি করতো। সৃষ্টির কতগুলো লক্ষ্য আছে। লক্ষ্য হচ্ছে ট্রুথ। সেই ট্রুথ আমি যদ্দুর পারি ধরার চেষ্টা করি। দ্যাটস ইজ দ্যা সিমবল আই টুক ফ্রম বঙ্গবন্ধু, আই টুক ফ্রম রবীন্দ্রনাথ, আই ফিল প্রাউড। তোমরা ছিলে বলে আমি এতদূর এসেছি। শুধু তোমাদের কারণে। এই যে এতো শহীদ হয়েছে। তোমাদের কথা বলার জন্য আমাকে রেখে দেয়া হয়েছে। এগুলো আমি অনুভব করি।”
শাহাবুদ্দিন আহমেদের একটি সাক্ষাৎকার থেকে লাইন গুলো নেয়া। বিখ্যাত বাঙালী চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ। আধুনিক ঘরানার প্যারিস-প্রবাসী এই শিল্পীর খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে মাস্টার পেইন্টার্স অব কনটেম্পোরারী আর্টসের পঞ্চাশজনের একজন হিসেবে বার্সেলোনায় অলিম্পিয়াড অব আর্টস পদকে ভূষিত হন। ২০০০ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে। এছাড়া চিত্রকর্মে অসামান্য অবদানের জন্য ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা নাইট উপাধি পেয়েছেন।
শাহাবুদ্দিন, যিনি ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন, তাঁর চিত্রকলায় সংগ্রামী মানুষের প্রতিকৃতিতে দুর্দমনীয় শক্তি ও অপ্রতিরোধ্য গতির ইংগিতময় অভিব্যাক্তির জন্য সুপরিচিত। তিনি মনে করেন, মানুষের মুক্তিযুদ্ধ অদ্যাবধি চলমান, এবং রং ও তুলির দ্বৈত অস্ত্র সহযোগে তিনি এ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে চলেছেন। সত্তুরের দশকের প্রারম্ভে বাংলাদেশে বিমূর্ত চিত্রকলার যে দুবোর্ধ্য পর্বের সূচনা হয়েছিল, তার সঙ্গে গাঁটছড়া না-বেঁধে তিনি নির্মাণ করেন স্বকীয় শৈলী যার ভিত্তিতে রয়েছে শারীরী প্রকাশভঙ্গী। তাঁর এই চিত্রশৈলী বাংলাদেশের পরবর্তী প্রজন্মকে গভীরভাবে প্রভাবান্বিত করে।
তার পৈতৃক নিবাস নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার আলগী গ্রামে হলেও তিনি ১৯৫০ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে শাহাবুদ্দিনের বাবা তায়েবউদ্দীন প্রধান ছিলেন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর মায়ের নাম সাইফুন্নেছা আহমেদ। ব্যক্তিগত জীবনে আনা’কে বিয়ে করেন শাহাবুদ্দিন আহমদে। সংসারে তার দুই মেয়ে – চিত্র ও চর্চা।
শিল্পী শাহাবুদ্দিন ১৯৬৮ সালে এস,এস,সি পাশ করেন ফরিদউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে৷ তিনি ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টসে পড়াশোনা করে বিএফএ ডিগ্রী অর্জন করেন। ঐ বছরই ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। পরবর্তীতে ফ্রান্স সরকার হতে চারুকলায় বৃত্তিলাভ করে ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইকোল দে বোজার্ট চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে অদ্যাবধি প্যারিসে কর্মরত আছেন।
বড় ক্যানভাসের পর্দায় গতিশীল ও পেশীবহুল অতিমানবীয় পুরুষের ছবি আঁকতে ভীষণ পছন্দ করেন শাহাবুদ্দিন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে উপজীব্য করে রংয়ের তুলির সাহায্যে যথাযথ উপস্থাপনা, প্রতিস্থাপন ইত্যাদি বিষয়গুলো সার্থক ও সফলভাবেই সম্পন্ন করেছেন তিনি। এছাড়াও, শাহাবুদ্দিনের তুলিতে নারী চিত্রকর্মগুলোয় তাদের চিরায়ত কোমলতা, দ্যুতির স্পন্দন, স্নিগ্ধতা দেখা যায়। মিহি কাপড়ের মাধ্যমে নারীকে আবৃত করে শারীরিক সৌন্দর্য্যের দ্যূতি তুলে ধরেন তিনি যাতে রমণীর অলৌকিক ও অসীম শক্তি বিচ্ছুরিত হয়।
দেশ-বিদেশের অনেক গ্যালারীতে তাঁর একক ও যৌথভাবে চিত্রকর্মের প্রদর্শনী হয়। তন্মধ্যে একক প্রদর্শনী হিসেবে – ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ বন্যায় আক্রান্তদেরকে অর্থ সাহায্যের জন্য ঢাকায় চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে চিত্র প্রদর্শনী। হল্যান্ড, পোল্যান্ড, সেনেগাল, বেলজিয়াম এবং ভারত-সহ সুইজারল্যান্ডের লুসানে অবস্থিত অলিম্পিক মিউজিয়াম এবং ফ্রান্সের বোর্গ-এন ব্রেজ মিউজিয়ামেও বৈশ্বিকভাবে প্রদর্শন অন্যতম। যৌথ প্রদর্শনী হিসেবে –
সেঁজুতির প্রথম চিত্রকলা প্রদর্শনী ও ভাষা আন্দোলন উপলক্ষে চিত্র প্রদর্শনী, ঢাকা, বাংলাদেশ;
প্যারিসে অধ্যয়নরত শিল্পীদের আন্তর্জাতিক চিত্র প্রদর্শনী, প্যারিস, ফ্রান্স;
প্যারিসে ইউনেস্কো আয়োজিত আন্তর্জাতিক চিত্র প্রদর্শনী, প্যারিস, ফ্রান্স;
বাংলাদেশের সমকালীন শিল্পকলা প্রদর্শনী, চীন;
গ্যালারী কনট্রাস্টে চিত্র প্রদর্শনী ব্রাসেলস, বেলজিয়াম;
“দি হারমোনী শো”, মুম্বাই, ভারত;
ইতালি ও কিউবাতে চিত্র প্রদর্শনী;
“সিগার দ্য লা হাভানা আ হরিজন ২০০০” চিত্র প্রদর্শনী, প্যারিস, ফ্রান্স অন্যতম।
শাহাবুদ্দিন আহমেদের বিভিন্ন চিত্রকর্ম বাংলাদেশ-সহ বুলগেরিয়া, তাইওয়ান, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়া, ফ্রান্সের বিভিন্ন প্রখ্যাত গ্যালারী, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষিত আছে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধে তিনি প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে নেতৃত্ব দেন। সহযোদ্ধা হিসেবে তাঁর সাথে ছিলেন – ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা এবং পপ সম্রাট ও গুরু আজম খান। শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড গতি, শক্তি, জীবন বাজি রেখে সম্মুখ রণাঙ্গনে অগ্রসর হবার কারণে তিনি তার ছবিতে গতিকে প্রাধান্য দেন বেশী। একজন গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে শাহাবুদ্দিন এখনও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তার ছবির মোটিফ, রঙ ও কম্পোজিশনে অতুলনীয়ভাবে উপস্থাপন করে চলেছেন। তার ছবির মুখ্য বিষয় হলো সমসাময়িক মানুষ ও সময়। তার ছবিতে আশাবাদী মনোভঙ্গির প্রকাশ পায়। শিল্পী শাহাবুদ্দিনের ফিগার খুবই উদ্দীপনাময়। তার ব্রাশের সজীবতা এবং শক্তি এসব ফিগারে প্রাধান্য পায়। রেখার টান এবং স্থিতির জন্য তার স্কেচগুলো হয়ে ওঠে শক্তিশালী। বিশেষ করে তার চারকোণ স্কেচ খুবই দৃষ্টিনন্দন ও সজীব। তিনি অনবরত আঁকেন বঙ্গবন্ধু, মহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথকে। তিনি শুধু তাদের পোর্ট্রেট করেন না, তাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেন মানবীয় অনুভূতি, আবেগ এবং আত্মপ্রকাশ।