বাউল শাহ আব্দুল করিম প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি গান লিখেছেন এবং সুরারোপ করেছেন। বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে তাঁর ১০টি গান ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। শিল্পীর চাওয়া অনুযায়ী সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের উদ্যোগে বাউল আব্দুল করিমের সমগ্র সৃষ্টিকর্ম নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর বিশাল সৃষ্টি কর্ম থেকে বিখ্যাত ১০টি গানের কথা নিয়ে আমাদের এই আয়োজন:
বাংলা মায়ের ছেলে
আমি বাংলা মায়ের ছেলে
জীবন আমার ধন্য যে হায়
জন্ম বাংলা মায়ের কোলে
বাংলা মায়ের ছেলে
আমি বাংলা মায়ের ছেলেবাংলা মায়ের মুখের হাসি
প্রাণের চেয়েও ভালোবাসি
মায়ের হাসি পূর্ন শশী- রত্ন-মানিক জ্বলেমায়ের তুলনা কি আর ধরণীতে মিলে
মা আমার শস্য-শ্যামলা সুশোভিত ফলে ফুলে
বাংলা মায়ের ছেলে, আমি বাংলা মায়ের ছেলেগাছে গাছে মিষ্ট ফল, মাঠে ফলে সোনার ফসল
রয়েছে সুশীতল জল, নদী-নালা খালে-বিলেকোকিল ডাকে কুহ স্বরে, বুলবুল নাচে ডালে
শুক-সারী গান গায় মা যেন থাকেন কুশলে
বাংলা মায়ের ছেলে, আমি বাংলা মায়ের ছেলেবাউল আব্দুল করিম বলে, জীবন লীলা সাঙ্গ হলে
শুয়ে থাকবো মায়ের কোলে, তাপ-অনুতাপ ভুলে
মাকে ভুলে না মায়ের খাঁটি সন্তান হলে
মা বিনে আর কে আছে কার, সুখে-দুখে মা-মা বলে
বাংলা মায়ের ছেলে, আমি বাংলা মায়ের ছেলে।।
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতামহিন্দু বাড়িতে যাত্রা গান হইত
নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম
জারি গান, বাউল গান
আনন্দের তুফান
গাইয়া সারি গান নৌকা দৌড়াইতাম
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতামবর্ষা যখন হইত,
গাজির গান আইত,
রংগে ঢংগে গাইত
আনন্দ পাইতাম
কে হবে মেম্বার,
কে বা গ্রাম সরকার
আমরা কি তার খবরও লইতাম
হায়রে আমরা কি তার খবরও লইতাম
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতামকরি যে ভাবনা
সেই দিন আর পাব নাহ
ছিল বাসনা সুখি হইতাম
দিন হইতে দিন
আসে যে কঠিন
করিম দীনহীন কোন পথে যাইতাম
আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম
আমরা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।।
মুর্শিদ ধন হে
মুর্শিদ ধন হে কেমনে চিনিব তোমারে
দেখা দেওনা কাছে নেওনা, আর কত থাকি দূরে
কেমনে চিনিব তোমারে, মুর্শিদ ধনহে কেমনে চিনিব তোমারে ।মায়া জালে বন্দি হয়ে আর কত কাল থাকিব
মনে লয় সব ছাড়িয়া তোমারে খুঁজে নিব
আশা করি আলো পাব, ডুবে যাই অন্ধকারে
কেমনে চিনিব তোমারে, মুর্শিদ ধনহে কেমনে চিনিব তোমারে ।তন্ত্র-মন্ত্র করে দেখি তার ভিতরে তুমি নাই
শাস্ত্র-গ্রন্থ পড়ি যত আরও দূরে সরে যাই
কোন সাগরে খেলতেছ লাই, ভাবতেছি তাই অন্তরে
কেমনে চিনিব তোমারে, মুর্শিদ ধনহে কেমনে চিনিব তোমারে ।বাউল আব্দুল করিম বলে দয়া কর আমারে
নতশিরে করজোড়ে বলি তোমার দরবারে
ভক্তের অধীন হও চিরদিন, থাক ভক্তের অন্তরে
কেমনে চিনিব তোমারে, মুর্শিদ ধনহে কেমনে চিনিব তোমারে।।
কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু
কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু
ছেড়ে যাইবা যদি
কেমনে রাখবি তোর মন
কেমনে রাখবি তোর মন
আমার আপন ঘরে বাধিরে বন্ধু
ছেড়ে যাইবা যদিপাড়া পড়শী বাদী আমার
বাদী কাল ননদী
মরম জ্বালা সইতে নারি
দিবা নিশি কাঁদিরে বন্ধু
ছেড়ে যাইবা যদিকারে কী বলিব আমি
নিজেই অপরাধী
কেঁদে কেঁদে চোখের জলে
কেঁদে কেঁদে চোখের জলে
বহাইলাম নদী রে বন্ধু
ছেড়ে যাইবা যদিবাউল আব্দুল করিম বলে
হলো এ কী ব্যাধি
তুমি বিনে এ ভুবনে
তুমি বিনে এ ভুবনে
কে আছে আছে ঔষধি রে বন্ধু
ছেড়ে যাইবা যদি।।
কেমনে ভুলিবো আমি বাঁচি না তারে ছাড়া
কেমনে ভুলিবো আমি বাঁচি না তারে ছাড়া
আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা
সখী লো আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা।
না আসিলে কালো ভ্রমর, কে হবে যৌবনের দোসর
সে বিনে মোর শুন্য বাসর, আমি জিয়ন্তে মরা
আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা
সখী লো আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা।
কূলমানের আশা ছেড়ে, মন প্রান দিয়াছি যারে
এখন সে কাঁদায়া মারে, একি তার প্রেমের ধারা
আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা
সখী লো আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা।
আসার পথে চেয়ে থাকি, যারে পাইলে হবো সুখি।
এ করিমের মরণ বাতি হইলো না অঝোরধারা
আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা
সখী লো আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা।।
বন্ধে মায়া লাগাইছে
বন্ধে মায়া লাগাইছে,পিরিতি শিখাইছে
দেওয়ানা বানাইছে
কি যাদু করিয়া বন্ধে,মায়া লাগাইছে।
বসে ভাবি নিরালায়
আগেতো জানিনা বন্ধের পিরিতের জালায়
যেমন ইটের ভাটায় কয়লা দিয়া আগুন জালাইছে।
আমি কি বলিব আর
বিচ্ছেদের আগুনে পুড়ে কলিজা আঙ্গার
প্রান বন্ধের পিরিতের নেশায় কুলমান গেছে।
বাউল আব্দুল করিম গায়
ভুলিতে পারিনা আমার মনে যারে চায়
কুলনাশা পিরিতের নেশায় কুলমান গে।।
তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো
তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো
আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে
বসন্ত সময়ে কুকিল ডাকে কুহু সুরে
যৌবন বসন্তে মন থাকতে চায়না ঘরে
তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো
আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে
আতর গোলাপ সোয়া-চন্দন আনো যতন করে
সাজাও গো ফুলের বিছানা পবিত্র অন্তরে
তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো
আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে
নয়ন যদি ভুলে সইগো মন ভুলেনা তারে
এগো প্রেমের আগুন হইয়া দ্বিগুণ দিনে-দিনে বাড়ে
তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো
আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে
আসে যদি প্রাণবন্ধু দুঃখ যাবে দূরে
আমারে যেন ছেড়ে যায় না প্রভুক দিও তারে
তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো
আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে
আসিবে আসিবে বলে ভরসা অন্তরে
এ করিম কয় পাই যদি আর ছাড়িবো না তারে
তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো
আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে।।
আমি কুলহারা কলঙ্কিনী
আমি কুলহারা কলঙ্কিনী
আমারে কেউ ছুঁইয়ো না গো সজনী
আমারে কেউ ছুঁইয়ো না গো সজনী
প্রেম করে প্রাণবন্ধুর সনে
যে দুঃখ পেয়েছি মনে
আমার কেঁদে যায় দিন-রজনী
আমারে কেউ ছুঁইয়ো না গো সজনী
আমি কুলহারা কলঙ্কিনী
আমারে কেউ ছুঁইয়ো না গো সজনী
প্রেম করা যে স্বর্গের খেলা
বিচ্ছেদে হয় নরক জ্বালা
আমার মন জানে, আমি জানি
আমারে কেউ ছুঁইয়ো না গো সজনী
আমি কুলহারা কলঙ্কিনী
আমারে কেউ ছুঁইয়ো না গো সজনী
সখি আমায় উপায় বলনা?
এ জীবনে দূর হলনা
বাউল করিমের পেরেশানি
আমারে কেউ ছুঁইয়ো না গো সজনী
আমি কুলহারা কলঙ্কিনী
আমারে কেউ ছুঁইয়ো না গো সজনী।।
কোন মেস্তরি নাও বানাইছে
কোন মেস্তরি নাও বানাইলো এমন দেখা যায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায় ।
চন্দ্র-সূর্য বান্ধা আছে নাওয়েরই আগায়
দূরবীনে দেখিয়া পথ মাঝি-মাল্লায় বায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায় ।
রঙ-বেরঙের যতো নৌকা ভবের তলায় আয়
রঙ-বেরঙের সারি গাইয়া ভাটি বাইয়া যায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায় ।
হারা-জিতা-ছুবের বেলা কার পানে কে চায়
মদন মাঝি বড়ই পাজি কতো নাও ডুবায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায় ।
বাউল আব্দুল করিম বলে বুঝে উঠা দায়
কোথা হইতে আসে নৌকা কোথায় চলে যায়
ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায়।।
গাড়ি চলে না চলে না
গাড়ি চলে না চলে না, চলে না,
চলে না রে, গাড়ি চলে না।
চড়িয়া মানব গাড়ি
যাইতেছিলাম বন্ধুর বাড়ি
মধ্য পথে ঠেকলো গাড়ি
উপায়-বুদ্ধি মেলে না
গাড়ি চলে না চলে না, চলে না,
চলে না রে, গাড়ি চলে না।
মহাজনে যতন করে
তেল দিয়াছে টাংকি ভরে
গাড়ি চালায় মন ড্রাইভারে
ভালো-মন্দ বোঝে না
গাড়ি চলে না চলে না, চলে না,
চলে না রে, গাড়ি চলে না।
ইঞ্জিনে ময়লা জমেছে
পার্টসগুলো ক্ষয় হয়েছে
ডাইনামো বিকল হয়েছে
হেডলাইট দুইটা জ্বলে না
গাড়ি চলে না চলে না, চলে না,
চলে না রে, গাড়ি চলে না।
ইঞ্জিনে ব্যতিক্রম করে
কন্ডিশন ভালো নয় রে
কখন জানি ব্রেক ফেল করে
ঘটায় কোন দুর্ঘটনা
গাড়ি চলে না চলে না, চলে না,
চলে না রে, গাড়ি চলে না।
আবুল করিম ভাবছে এইবার
কনডেম গাড়ি কি করবে আর
সামনে বিষম অন্ধকার
করতেছে তাই ভাবনা
গাড়ি চলে না চলে না, চলে না,
চলে না রে, গাড়ি চলে না।।
বাঙ্গালীয়ানা/এমএ/