শিল্পকলার মঞ্চে কামালউদ্দিন নীলুর নাটক স্তালিন । রাহমান চৌধুরী

Comments

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মঞ্চে ঢাকাস্থ সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার প্রযোজিত, কামালউদ্দিন নীলুর রচিত এবং নির্দেশিত স্তালিন নাটকটি যথেষ্ট বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। বহুজন নাটকটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করার কথা বলেছে। নাটকটি বিতর্কিত সন্দেহ নেই কারণ সেখানে ইতিহাস নিয়ে ভয়াবহ মিথ্যাচার করা হয়েছে। কিন্তু নাটকটি নিষিদ্ধ করার ব্যাপারটাও নিন্দনীয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপ্লবের পর মায়ারহোল্ড, বুখারিন, যখন পুশকিন, টলস্টয়, তুর্গনেভ, চেখভ প্রমুখের রচনা বাতিল করে দিতে বলে, বিপ্লব পূর্বের সকল সাংস্কৃতিকর্ম, নাটক নিষিদ্ধ করতে উদ্ধত হয়, তখন লেনিন তার বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। লেনিন স্পষ্ট বলেছিলেন, সকলের মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে। তিনি বলেছিলেন, শত্রপক্ষের যেমন মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, বিপ্লবী পার্টির তেমনি অধিকার থাকবে সেগুলি সমালোচনা করার। কিন্তু গায়ের জোরে কিছু বাতিল করা যাবে না। মাও সে তুং সেই কথাটাই বলেছিলেন চীন বিপ্লবের পর। তিনি বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য প্রসঙ্গে বলেছিলেন, শত ফুল ফুটতে দাও। সকলকে তার প্রতিভা প্রকাশ করতে দেওয়া হোক এটা ছিলো মাওয়ের কথা। যদি তার মধ্যে বিপ্লব বিরোধী কিছু থাকে তাকে সমালোচনা করা হবে কিন্তু বাধা দান নয়।

কামালউদ্দিন নীলুর নাটকের বক্তব্য নিয়ে আরো অনেকের মতো আমারও নানা প্রশ্ন রয়েছে। নাটকের বিষয়বস্তু নিয়ে খুবই বিরক্ত হয়েছি আমি। কারণ নাট্যকার নাটকটা রচনা করতে গিয়ে ন্যূনতম সততা রক্ষা করেনি। পুরো নাটকের বক্তব্য চার লাইন, নীলু সেটাকেই বারবার পুনরাবৃত্তি করেছে, স্টালিন নামক মানুষটা কতো নিষ্ঠুর আর কতো বড় ভাঁড় তা প্রমাণ করার জন্য। নাট্যকার তা করতে গিয়ে নিজেই এক দাম্ভিক মিথ্যা প্রচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। স্তালিনকে নিয়ে নাটক লিখবার জন্য নীলুর লেখাপড়া যে কতো কম, নীলুর ইতিহাস চেতনা যে কতো দুর্বল তার প্রমাণ নাট্যকারের রচনার মধ্যেই পাওয়া যায়। নাটকটা দেখলে এমন মনে হতে পারে, নাট্যকার মিথ্যা প্রচারের জন্য কারো কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করেছে। জানি না, সেটা সত্যি কি না। নাট্যকার স্তালিনকে ভাঁড় প্রমাণ করতে গিয়ে, পুরো নাটকটাকে হাস্যকর করে তুলেছে। নাটকটার মধ্যে সামান্যরকম সুস্থ চিন্তা নেই, ইতিহাসের স্তালিনকে সেখানে খুঁজে পাওয়া যায় না। আমি নাটকটা নিয়ে গঠনমূলক একটি সমালোচনা লিখবার জন্য, বন্ধু নীলুর কাছে তার নাটকের স্ক্রিপ্টটা চেয়েছিলাম। নীলু তা দিতে অস্বীকার করেছে। আমি মনে করেছিলাম, স্ক্রিপ্টটা পেলে লাইন ধরে ধরে তার লেখার অসঙ্গতি কোথায় তা বুঝিয়ে দিতে পারতাম। নীলু আমার বহু অনুরোধ বা যুক্তি দেওয়া সত্ত্বেও তার স্তালিন নাটকের স্ক্রিপ্টটি নানা ছুঁতোয় আমাকে দিতে রাজি হলো না। নীলু যে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছে, এটা তার প্রমাণ। নীলুর স্ক্রিপটি দিতে ভয় কোথায়, যদি সে নাটকে সত্য কথাই বলে থাকে? নীলু আগামীকাল (১৫ মে) ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। মাসখানেকের জন্য বাংলাদেশে এসে হঠাৎ কেন তার স্তালিনকে নিয়ে বিতর্কিত এক নাটক করতে হলো? আর নাটক করেই চলে যেতে হচ্ছে কেন, মানুষের জবাবদিহিতার মুখোমুখি না হয়ে? সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে কামালউদ্দিন নীলু কখনো নাটক করেননি। সর্বদাই সে নাটক করেছে আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য। নীলু সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেছে প্রধানত নরওয়ের টাকায় আর সে টাকায় বেশির ভাগ ইবসেনের নাটক করেছে এককালে, তারপর নরওয়ের বাসিন্দা হয়েছে। নীলুর এই পুরো কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে, নাটক তার কাছে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠার ব্যাপার। জনগণের কাছে, সমাজের কাছে তার কোনো দায়বদ্ধতা ছিলো না। নীলুর মতোই আরো বহু মানুষ একই লক্ষ্য নিয়ে নাটক করছে, নীলু একা নয়। বহু লোক আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য নাটক করে নিজেদের ভাগ্য পাল্টে নাটক করা এখন ছেড়ে দিয়েছে। সবাই অবশ্য নয়, অনেকের ত্যাগ তিতিক্ষা আছে, অনেকে নাটক করছেন জনগণে স্বার্থে। নীলু বাংলাদেশের ঢাকায় নাট্যচর্চা করেছে বিদেশীদের টাকায়, নিজের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তুলবার জন্য, যা আরো অনেকেই করে থাকে। বেশ অনেক বছর ধরে সে বাইরে থাকে, বড় অঙ্কের কিছু টাকা পয়সা জোগাড় করে ঢাকায় এসে নাটক মঞ্চস্থ করে হৈ চৈ ফেলে দেবার চেষ্টা করে। নীলুর মতো আরো অনেকেরই নাটক করবার মূল লক্ষ্যটা আত্মপ্রতিষ্ঠার। হয়তো নীলু সঙ্গে তাদের কর্মসূচীর ভিন্নতা থাকতে পারে। পুরো মধ্যবিত্তের নাট্যচর্চা বা ভদ্রলোকদের এসব উদ্যোম হলো, নিজের আখের গোছানো। নীলুকে নিয়ে এই আলোচনার ভিতর দিয়ে আমাদের নাট্যচর্চার ভিতরে ফাঁপা জায়গা তুলে ধরা দরকার বলে এসব কথা বলা। না হলে শুধুমাত্র নীলুকে খলনায়ক বানালে, মিথ্যাচার করা হবে।

নীলুর স্তালিন নিয়ে নাটকটি নিয়ে পরে কখনো দীর্ঘ একটি সমালোচনা লিখতে চাই। আজকে সামান্য প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছি শুধু। ফেসবুকে একজন কামালউদ্দিন নীলুর পক্ষে লিখেছেন, মধুসূদন দত্ত যদি রামের সমালোচনা করতে পারে, কামালউদ্দিন নীলু তবে স্টালিনের সমালোচনা করলে দোষ কি? যিনি কথাটি লিখেছেন, তিনি ইতিহাসের সঙ্গে মিথকে গুলিয়ে ফেলেছেন। রাম ইতিহাসের চরিত্র নয়, স্তালিন ইতিহাসের চরিত্র। দ্বিতীয় কথাটি হলো নীলু তো স্তালিনের সমালোচনা করেনি, নিন্দা করেছে অন্ধভাবে। নাট্য জগতের একজন খুব পরিচিত ব্যক্তিত্ব বলেছেন, নীলু সাম্রাজ্যবাদের টাকা খেয়ে স্তালিনের বিরুদ্ধে প্রোপাগাণ্ডা করেছে। যদি তার কথাটাকে গুরুত্ব নাও দেই, তাহলে বলবো, স্তালিনের সমালোচনা করতে হলে যোগ্যতার দরকার। নীলুর সে যোগ্যতা নেই। কামালউদ্দিন নীলুর সে যোগ্যতা ছিলো না বলেই, একপেশেভাবে স্তালিনের নিন্দা করে খুব তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছে। ইতিহাসের একজন সিরিয়াস ব্যক্তিত্বকে ভাঁড় বানিয়ে মনে করছে সে খুব বিরাট নাট্যকার হয়ে গেছে। কিন্তু আসলে স্তালিনের সকল গুনাবলী, যোগ্যতাকে বাতিল করে দিয়ে স্তালিনকে নিয়ে ক্যারিকেচার করে নীলু তার নিজের প্রতিভা আর মেধার সীমাবদ্ধতাগুলি আর তার অসততাগুলি আমাদের বুঝতে সাহায্য করেছে। নীলু যদি সত্যিই স্তালিনের সমালোচনা করতে সক্ষম হতো, তাহলে এদেশের অনেক মানুষ এবং নাটকের দর্শকরা সমৃদ্ধ হতে পারতো। স্তালিনকে নিয়ে বহু বড় বড় চিন্তাবিদ সমালোচনা করেছেন, সেই সমালোচনা করেছেন ইতিহাসের আলোকে। নীলু শুধু স্তালিনের নয়, সেইসঙ্গে লেনিন, মার্কস, মাও সে তুংয়ের সমালোচনা করতে ছাড়েননি। নীলুর মূল লক্ষ্য স্তালিনের সমালোচনা নয়, তার চেয়েও ভিন্ন উদ্দেশ্যে সে নাটকটা করেছে। নীলুর এজেণ্ডা হলো, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে আক্রমণ করা। সোভিয়েত ইউনিয়ন আর চীনের বিপ্লবকে হেয় প্রতিপন্ন করা। ব্যাপারটা হলো “হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কতো জল?” নীলু কাকে খুশি করবার জন্য এইরকম এজেণ্ডা নিয়ে বাংলাদেশে ছুটে এসেছিলো, জানি না। কিন্তু এই নাটকটি করার পেছনে নীলুর একটি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছিলো। সেই উদ্দেশের আসল কথাটা পুঁজিবাদ আর সাম্রাজ্যবাদের হয়ে সমাজতন্ত্রকে আক্রমণ করা। নীলুর এটা করবার স্বাধীনতা আছে। তার সে স্বাধীনতার প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, শিল্পকলায় এইরকম নাটকের দু চারটা প্রদর্শনী করে সমাজতন্ত্রকেও হারিয়ে দেওয়া যায় না, আবার বিপ্লবের পক্ষে দু-চারটা নাটকে করেও বিপ্লব ঘটানো যায় না। সবকিছু দীর্ঘ চর্চার ব্যাপার, আন্দোলনের ব্যাপার। নাটকের একটা প্রচারের শক্তি আছে, নীলুর মতো সস্তা নাটক দিয়ে সে প্রচারটা হবে না। পুঁজিবাদীরা যদি নীলুকে সে লক্ষ্যে ব্যবহার করতে চায়, বলবো পুঁজিবাদীরা এক অযোগ্য লোককে বেছে নিয়েছে। ইতিপূর্বে ইউনেস্কো, বেকেট, পিন্টাররা এসব চেষ্টা করে কিছু্ করতে পারেনি। আমি যদি একটি মেয়ে সম্পর্কে এমন দুর্নাম করি যে, সে প্রতি রাতেই একজন করে প্রেমিক পাল্টায় সেটাও লোকে বিশ্বাস করতে পারে, কিন্তু আমি যদি বলি একটি মেয়ে প্রতি রাতে দশজন প্রেমিক পাল্টায় লোকে বিশ্বাস করবে না। সেই গল্পের মতো, আমার বাবা আশি হাত লম্বা কুমির মেরেছিলো। নীলু তার নাটকে স্তালিন সম্পর্কে এতোটাই মিথ্যাচার করেছে, যার সামান্য চেতনা আছে, কাণ্ডজ্ঞান আছে সে এসব বিশ্বাস করবে না।

নীলুর পুরো নাটকে স্টালিনের ইতিবাচক কোনো দিক নেই। স্তালিন চরিত্রের মধ্যে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক কোনো গুণাবলী খুঁজে পাওয়া যায়নি। নীলুর মতে স্তালিন একটা নিষ্ঠুর, খুনি, পাগলাটে, ভাঁড়। পলিটব্যুরোর সদস্যদের সঙ্গে লেনিনের নিষ্ঠুর অসংলগ্ন আচরণ হলো পুরো নাটকের মূল বিষয়বস্তু। যুক্তিবাদী স্তালিনকে নাটকে কখনো পাওযা যায় না। শুধু স্ত্রীর প্রতি প্রেম নিয়ে তার কিছুটা সহানুভূতি একবার লক্ষ্য করা গেছে। বাকি সময়টা নিজের স্বার্থে, নিজের ক্ষমতার লোভে পাগলামি করতে দেখা যায়। তাহলে কি এই পাগল স্তালিনই কোনো যোগ্যতা ছাড়া দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলারের বাহিনীকে পরাজিত করেছিলো? স্তালিনের যোগ্যতা ছিলো না বলেই কি, সোভিয়েত ইউনিয়নের এতো দ্রুত উন্নতি হয়েছিলো? খুনি, নিষ্ঠুর স্তালিনই কি জনগণের মধ্যে এতো জনপ্রিয় ছিলো যে, সকল মানুষ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে স্তালিনের পিছনে দাঁড়িয়ে গেল? হিটলারকে যখন কেউ হারাতে পারছে না, সোভিয়েত ইউনিয়ন তাকে হারালো কি স্তালিনের মতো পাগল, খুনি, অযোগ্য একজন ভাঁড়ের নেতৃত্বে? ফ্রান্স, ব্রিটেন, আমেরিকা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে স্তালিনের বন্ধুত্ব আশা করেছিলো কেন? স্তালিনের মতো একজন ভাঁড়কে কি কারণে তারা যুদ্ধের অন্যতম নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছিলো? নীলু যতোই চেষ্টা করুক স্তালিনকে ভাঁড় বানাতে, ইতিহাস কি সাক্ষ্য দেয়? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলারকে হারাবার পর স্তালিন শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নে নয়, সারা বিশ্বে তো বটেই, ইউরোপের যুবসমাজের কাছে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। নীলুর এসব ইতিহাস পড়া নেই বলে, তার কাছে স্তালিন এক খুনি পাগল। স্তালিনের যে সব রচনা রয়েছে, কখনো কি কামাল তা পড়ে দেখেছে? স্তালিনের রচনার তেরোটি খণ্ড আছে, কী মনে হয়? একজন খুনি আর ভাঁড় লিখেছে সেগুলি? স্তালিনের অন্য লেখা বাদ দেই, শিল্প-সাহিত্য নিয়ে যে লেখা আছে, নীলুর শিল্প সাহিত্য নিয়ে তা লিখবার যোগ্যতা কি আছে? নীলু একবার স্তালিনের লেখাগুলি পাঠ করে দেখতে পারে। স্তালিন সম্পর্কে মাও সে তুং সব সময় উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন আর অনেক প্রশংসা বাক্য লিখে রেখে গেছেন। চীনের বিপ্লবের আগে পরে স্তালিন নানাভাবে চীনকে সাহায্য করেছে। স্তালিন বিপ্লবের পর চীনকে প্রযুক্তি দিয়ে সহযোগিতা করেছে। আর নীলু তার নাটকে দেখাচ্ছে,মাও সে তুংয়ের সঙ্গে স্তালিনের নাকি ছিলো ভয়াবহ বিরোধ। এর জন্য তর্ক করার দরকার নেই, মাও কী বলেছেন স্তালিন সম্পর্কে সেগুলি পড়ে নিলেই হয়। কতো ক্ষুদ্র জ্ঞান নিয়ে যে কতো অযোগ্য মানুষ নাটক লিখতে আসে কামাল তা আবার প্রমাণ করলো। কামাল কি মনে করে পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ অধ্যাপনা করলে, তাকে আলাদা করে বড় মাপের পণ্ডিত ভাবা হবে? মোটেই তা নয়, বৃক্ষ তোমার নাম কি ফলে পরিচয়। কাজ দিয়ে প্রমাণিত হবে সকলের পরিচয়।

স্তালিনের সমালোচনা আছে। মার্কসবাদীরাই স্তালিনের বহু কাজের সমালোচনা করেছেন। বেশ কিছু ভুলের কথা বলেছেন স্তলিনের। পঁচিশ বছর যিনি ক্ষমতায় ছিলেন, তিনি ভুল করবেন না তা কি করে হয়? স্তালিন নিজেও নিজের কাজের ভুল স্বীকার করেছেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে বুখারিন, রাইকভ, জিনোভিয়েভ সহ কিছু সংখ্যক রাজনৈতিক নেতা, সেনাবাহিনীর জেনারেল এবং একজন পুলিশ প্রধানের বিচার হলো, বিচারে তাদের প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু তার কারণ কী ছিলো? কারণটা নিয়ে নীলুর বক্তব্য নেই। স্তালিনের সমালোচনা করেছেন জর্জ টমসন, গঠনমূলক সমালোচনা। তিনি দেখিয়েছেন, নিষ্ঠুর অনেক পদক্ষেপ না নিলে সোভিয়েত ইউনিয়নই ধ্বংস হয়ে যেতো। টমসন এটাও দেখিয়েছেন, সোভিয়েত পুলিশের হাতে বিপুল সংখ্যক গুপ্তচর আর বিদেশি এজেণ্ট প্রাণ হারিয়েছিলো। যারা প্রাণ হারিয়েছিলো সবাই নির্দোষ নয়। আবার নির্দোষ মানুষও প্রাণ হারিয়েছিলো। পঁচিশ বছর একটানা ক্ষমতায় থাকার চাপে স্তালিন অনেক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। স্তালিন নিজে স্বীকার করেছেন, কে শত্রু আর কে মিত্র বুঝে উঠতে না পারার জন্য “গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভুল হয়েছিলো। সোভিয়েত ইউনিয়নের চারদিকে অবস্থিত পুঁজিবাদী দেশগুলি তখন একটার পর একটা ষড়যন্ত্র করছিলো। ভিন্ন দিকে ব্রিটেন হিটলারকে বেড়ে উঠতে দিচ্ছিলো সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংস করবার জন্য। এ রকম পরিস্থিতিতে বন্ধু চিনতে গিয়ে ভুল করেছে, বিরোধীদেরও ঠিক মতো চিনতে পারা যায়নি। আমলাতান্ত্রিক হয়ে উঠছিলো প্রশাসন, জনগণ দূরে সরে যাচ্ছিলো। নানা সঙ্কট তৈরি হচ্ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিতরে। হতেই পারে, সমাজের ভিতরে নানা শ্রেণী দ্বন্দ্ব থাকে সেটা তো মার্কসবাদেরই কথা। ব্যক্তি স্তালিনকে নিয়ে মিথ্যা টানা হেঁচড়া না করে যদি গোটা সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্কটগুলি তুলে ধরে, শাসক হিসেবে স্তালিনের ভূমিকাকে ফুটিয়ে তোলা হতো, তাহলে কামালকে প্রাণ খুলে সমর্থন দিতাম। যদি নীলুর নাটকে এসব দেখানো হতো, সকলেই উপকৃত হতো। স্তালিনের ভুল করবার কারণগুলি দর্শকরা ধরতে পারতো। কিন্তু কামালের নাটক দেখে মনে হয়, স্তালিনের খুন করার একটা রোগ ছিলো্। তিনি জনগণের মঙ্গলের জন্য কিছুই করেননি। শুধু হত্যা আর নিষ্ঠুরতা চালিয়েছেন। কামাল যেন স্টালিনকে আর সমাজতন্ত্রকে খুনি প্রমাণ করতেই নাটকটা করেছে। স্তালিনের মতো দৃঢ় চিত্তের ইতিহাসের একটি চরিত্রকে কেন ভাঁড় বানাতে হলো, কেন তাঁর হাতে বন্দুক তুলে দিয়ে পলিটব্যুরোর সদস্যদের মাতাল আর যৌন নিপীড়ক হিসেবে প্রতিপন্ন করতে হলো তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া কঠিন। সেটা কি নাট্যকারের অযোগ্যতা, নাকি ইতিহাস না জানার ব্যর্থতা, নাকি ইচ্ছাকৃত মিথ্যা প্রচারণা? এর জবাব কামালই ভালো জানবে। নাটকটি তাৎক্ষণিক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারবে কি না জানি না, তবে এর আয়ু দীর্ঘ নয়। নীলুর স্তালিন চিরায়ত নাটক হতে না পারলেও, স্তালিন আরো বহু যুগ মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকবে তাঁর দোষ গুণ নিয়ে।

লেখক পরিচিতি:
রাহমান চৌধুরী, লেখক, শিল্প সমালোচক
Raahman Chowdhury

*এই বিভাগে প্রকাশিত লেখার মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই এখানে প্রকাশিত লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই। – সম্পাদক

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.