“১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পরে পূর্ণ গণতন্ত্র ও শোষণমুক্ত সমাজের আদর্শকে যাঁরা সামনে এনেছেন মণি সিংহ তাদের একজন। বাংলার মেহনতী মানুষের সর্বাঙ্গীন মুক্তি সংগ্রামে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগঠক প্রিয় নেতাকে কায়েমী স্বার্থের রক্ষকেরা দমন করার সব রকম চেষ্টাই করেছেন”।— সত্যেন সেন
বিপ্লবী কমরেড মণি সিংহ। যে নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের শোষণমুক্তির লড়াই-সংগ্রাম। জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস ও ঐতিহ্য। কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষেত্রে প্রবাদতুল্য মণি সিংহ একটি জীবনদর্শন। তিনি সংগঠন ও সংগ্রামের প্রতীক। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসন-শোষণের হাত থেকে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে তিনি ছিলেন অন্যতম বিপ্লবী। পাকিস্তানের স্বৈরশাসন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণে স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসের অন্যতম মহানায়ক তিনি। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানী শোষণের অবসান ঘটিয়ে একটি সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা ছিল তাঁর।
মার্কসবাদী জীবনাদর্শনই তাঁকে পথ দেখিয়েছে একজন বিপ্লবী মানুষ হিসেবে নিজ পরিচয় ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করে যেতে। তিনি প্রায়ই বলতেন, “বিপ্লবী মানবতাবাদ হচ্ছে কমিউনিস্ট আদর্শের মর্মকথা। আমরা লড়াই করছি কেবল একটি শ্রেণীর মুক্তির জন্য নয়, সার্বিকভাবে মানবমুক্তির জন্যই আমাদের সংগ্রাম। ঐতিহাসিক বিচারে তাই মানুষই আমাদের সাধনার কেন্দ্রবিন্দু। সেই মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মানবপ্রেমকেই বিপ্লবী ধারায় সমাজে সার্বজনীন করে তুলতে হবে”।
মণি সিংহের জন্ম ১৯০১ সালের ২৮ জুলাই কলকাতা শহরে। বাবা কালীকুমার সিংহ ছিলেন নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলার জমিদারের সন্তান। মণি সিংহের বয়স যখন আড়াই বছর তখন তাঁর বাবা মারা যান। এসময় তাঁরা কিছুদিন ঢাকায় তাঁর মামা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সুরেন সিংহের বাড়িতে থাকেন।

পার্টি নেতাকর্মীদের প্রিয় বড় ভাই কমরেড মণি সিংহ
মা ছিলেন তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোণা মহকুমার সুসং-দুর্গাপুরের জমিদার পরিবারের মেয়ে। মণি সিংহের বয়স যখন ৭ বছর সেই সময় থেকে তাঁরা সুসং-দুর্গাপুরে বসবাস শুরু করেন। এখানেই মণি সিংহ প্রাথমিক পড়াশুনা শুরু ও শেষ করেন। তারপর মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য কলকাতায় যান। ওই সময় ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ঘৃনা ও ক্ষোভ জমে যায় তাঁর চেতনায়। তাই ১৯১৪ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে ব্রিটিশকে উচ্ছেদের জন্য সশস্ত্র বিপ্লবী দল অনুশীলনের সাথে যুক্ত হন। ধীরে ধীরে নিজের সাহস ও দৃঢ়তা দিয়ে সাংগঠনিকভাবে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে দক্ষতার পরিচয় দিতে থাকেন।
১৯২১ সালের অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের ব্যাপকতা তাঁকে সংগ্রামের চেতনায় শাণিত করে। এ সময় তিনি ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র জাতীয় সংগ্রামে কৃষকদের সংগঠিত করার জন্য নিজ জেলায় কৃষকদের মধ্যে কাজ শুরু করেন। বঞ্চিত হাজং কৃষকদের সন্তানদের জন্য একাধিক পাঠশালা তৈরী করেন তিনি। রুশ বিপ্লবের প্রত্যক্ষদর্শী ও মার্কসবাদী বিপ্লবী গোপেন চক্রবর্তীর সাথে কমরেড মণি সিংহের সাক্ষাৎ হয় ১৯২৫ সালে। দিনে দিনে দু’জনের মধ্যে গড়ে ওঠে মার্কসবাদী চেতনার সম্পর্ক। এ সময় তিনি মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের রাজনীতি, দর্শন ও আদর্শে নিজেকে নির্মাণ করেন।
শ্রমিক আন্দোলনের উপায় খুঁজে বের করার জন্য ১৯২৬ সালের শেষের দিকে মণি সিংহ কলকাতায় ক্লাইভ স্ট্রীটের গুপ্ত ম্যানশনে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে ‘ওরিয়েন্টাল ট্রেডিং’ নাম দিয়ে একটি অফিস খোলেন। এখানে যোগাযোগ স্থাপিত হয় গোপেন চক্রবর্তী, ধরণী গোস্বামী, নীরোদ চক্রবর্তী, নলীন্দ্র সেনসহ আরো অনেক কমিউনিস্ট বিপ্লবীর সঙ্গে। ১৯২৮ সালের প্রথম দিকে গোপেন চক্রবর্তী মণি সিংহকে জানালেন শ্রমিক আন্দোলনের সুবর্ণ সুযোগ এখন। মণি সিংহ এসুযোগ গ্রহণ করে মেটিয়াব্রুজের কেশোরাম টেক্সটাইল মিলের শ্রমিক ধর্মঘটে অংশ নেন এবং সেখানে থেকেই শুরু করেন শ্রমিক আন্দোলন।
১৯৩০ সালে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে অস্ত্রাগার লুটের ঘটনায় ব্রিটিশ শাসক পাগলা কুকুরের মতো ক্ষিপ্ত হয়ে নির্বিচারে গ্রেফতার শুরু করে। শত শত বিপ্লবীকে গ্রেফতার করে। ৯ মে কলকাতায় গ্রেফতার হন মণি সিংহ। টানা ৫ বছর বিভিন্ন জেল-ক্যাম্প ঘুরিয়ে এনে ১৯৩৫ সালে সুসং-দুর্গাপুরে নিজ গ্রামের বাড়িতে নজরবন্দী করে রাখা হয় তাঁকে। এখানেই সাধারণ প্রজাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন তিনি। যার কারণে মণি সিংহকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। আপিলে এ সাজা দেড় বছর হয়।
১৯২৫ সালে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের দীক্ষা নেয়া মণি সিংহ ১৯২৮ সাল থেকে কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষনিক কর্মী হয়ে যান। তখন পার্টিতে সভ্যপদ অত্যন্ত রক্ষণশীল প্রক্রিয়ায় দেয়া হত। তাই শ্রমিক আন্দোলনে একনিষ্ঠ হলেও পার্টির সভ্যপদ তখনও তিনি পাননি। তবে কমরেড মোজাফ্ফর আহমদ ১৯২৮ সালে তাঁকে ‘ওয়ার্কার্স এন্ড পিজেন্টস’ পার্টিতে নিয়ে নেন। ১৯৩৭ সালে জেল থেকে বের হওয়ার পর পার্টির সভ্য বলে তাঁকে জানানো হয়।
কমরেড মণি সিংহ এ প্রসঙ্গে ‘জীবন-সংগ্রাম’ বই-এ লিখেছেন, “আমি ১৯৩৭ সালের মাঝামাঝি করিমপুর থানা, নদীয়ার জেল থেকে মুক্তি পাই। আমার কাছে যে রেলওয়ে পাস ছিল- ঐ পাস নিয়ে ঐ দিনই- আমার গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম- মায়ের সাথে দেখা করার জন্য। গ্রামে আসার ২/৩ দিনের মধ্যেই ৮/১০ জন বয়স্ক মুসলিম কৃষক আমার বাড়িতে এসে বললেন, “খোদার রহমতে আপনে খালাস পাইছেন- আমরা খুব খুশি হইছি। এহন আপনে টংকটা লইয়া লাগুইন। আমরা আর টংকের জ্বালায় বাঁচতাছি না”। আমি তাঁদের বললাম, “আমি কলকাতায় শ্রমিক আন্দোলন করি, মাকে দেখার উদ্দেশ্যে সাতদিনের জন্য বাড়ি এসেছি, কাজেই আমি ফিরে যাবো”। তাঁরা বললেন, “এডা হয় না। দেশের ছাওয়াল দেশে থাকিয়া টংক লাইয়া লাগুইন। আমরা যাতে বাঁচি তার চেষ্টা করুইন। খোদা আপনার ভালা করব”।আমি তাঁদের বুঝিয়ে- সুঝিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু প্রতিদিন তাঁরা এসে আমাকে টংক আন্দোলন করার জন্য অনুরোধ করতে থাকলেন।”
চার পাঁচদিন পর একদিন রাত্রিবেলায় শুয়ে শুয়ে তিনি চিন্তা করলেন, তিনি কি ট্রেড ইউনিয়ন কাজের জন্য কলকাতা যেতে উদগ্রীব? ঐ সময়ে মেটিয়াবুরুজে একটি ট্রেড ইউনিয়নের বেস সৃষ্টি হয়েছিল, কারণ মনি সিংহরা প্রতিটি শ্রমিক সংগ্রামে জয়লাভ করেছিলেন। এখানে টংক আন্দোলন করা জটিল ও কঠিন ব্যাপার। কারণ যাদের বিরুদ্ধে টংক আন্দোলন করতে হবে, তাঁরা সবাই তাঁর আত্মীয়। কেবল তাই নয়, তাঁর নিজ পরিবারেও টংক জমি আছে। কাজেই তাঁকে সংগ্রাম করতে হবে সকলের বিরুদ্ধে । হয়ত এই সব ভেবেই তিনি পিছিয়ে যাচ্ছেন। এই কথা যখন তাঁর মনে উদয় হল, তখন তাঁর মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হল। ট্রেড ইউনিয়ন না টংক আন্দোলন?
টংক মানে ধান কড়ারী খাজনা। ময়মনসিংহ জেলার উত্তরে কলমাকান্দা, সুসং-দূর্গাপুর, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ি, শ্রীবর্দি থানায় এই প্রথা প্রচলিত ছিল। বিশেষ করে সুসং-জমিদারি এলাকায় এর প্রচলন ছিল ব্যাপক। কেন টংক নাম হল তা জানা যায় না। এই প্রথা বিভিন্ন নামে ঐ সময়ের পূর্ববঙ্গে প্রচলিত ছিল, যেমন চুক্তিবর্গা, ফুরন প্রভৃতি। ঐ সময় পশ্চিমবঙ্গেও ঐ প্রথা প্রচলিত ছিল। ধারণা করা হয় যে সুসং-জমিদাররা গারো পাহাড়ের অধিকার হতে বঞ্চিত হয়ে এই প্রথা প্রবর্তন করেন। জোত স্বত্বের জমির বন্দোবস্ত নিতে হলে প্রতি সোয়া একরে একশ টাকা থেকে দুইশ টাকা নজরানা দিতে হত। গরীব কৃষক ঐ নজরানার টাকা সংগ্রহ করতে সমর্থ ছিলেন না। আর টংক প্রথায় হোক বা না হোক কড়ার মত ধান দিতে হতো। টংক জমির ওপর কৃষকদের কোন স্বত্ব ছিল না। তাই টংক প্রথায় কোন নজরানা লাগত না। কাজেই গরীব কৃষকের পক্ষে টংক নেওয়াই ছিল আপাতঃ সুবিধাজনক। সুসং জমিদার এলাকার যে টংক ব্যবস্থা ছিল তা ছিল খুবই কঠোর। সোয়া একর জমির জন্য বছরে ধান দিতে হত সাত থেকে পনের মণ। অথচ ঐ সময়ে জোত জমির খাজনা ছিল সোয়া একরে পাঁচ থেকে সাত টাকা মাত্র। ঐ সময় ধানের দর ছিল প্রতিমণ সোয়া দুই টাকা ফলে প্রতি সোয়া একরে বাড়তি খাজনা দিতে হত এগার টাকা থেকে প্রায় সতের টাকা। এই প্রথা শুধু জমিদারদের ছিল তা নয় মধ্যবিত্ত ও মহাজনরাও টংক প্রথায় লাভবান হতেন। একমাত্র সুসং-জমিদাররাই টংক প্রথায় দুই লক্ষ মণ ধান আদায় করতেন। এটা ছিল এক জঘন্যতম সামন্ততান্ত্রিক শোষণ। টংকের হার প্রথমে এত বেশি ছিল না। কৃষকরা যখন টংক জমি নেওয়ার জন্য এগিয়ে আসলেন, তখন প্রতি বছর ঐ সব জমির হার নিলামে ডাক হত। ফলে হার ক্রমে বেড়ে যায়। যে কৃষক বেশী ধান দিতে রাজী হত তাঁদেরই পূর্বে ডাককারী কৃষকের কাছ থেকে জমি ছাড়িয়ে হস্তান্তর করা হত। এইভাবে নিলাম ডাক বেড়ে গিয়ে ১৯৩৭ সাল থেকে হার সোয়া একরে পনের মণ পর্যন্ত উঠে যায়।
মণি সিংহ ভাবতে লাগলেন, তিনি যদি মার্কসবাদ-লেনিনবাদে বিশ্বাসী হন, যদি মার্কসবাদ-লেনিনবাদ গ্রহণ করে থাকেন, তবে সেখানে তাঁর এবং তাঁর পরিবারের স্বার্থ নিহিত থাকা সত্বেও আদর্শের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা তাঁর কর্তব্য। যা অন্যায়, যা সামন্ততান্ত্রিক তাঁর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা উচিত। সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে চেতনা উদ্দীপ্ত করা ও তাঁদের সংগঠিত করা একান্ত প্রয়োজন। এইভাবেই দেশকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রসর করা সম্ভব। এটা তাঁর আদর্শের সাথে সংগতিপূর্ণ। এখানে তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থ নিহিত আছে বলে তিনি ঐ আন্দোলন হতে কখনোই নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন না। তাঁর আদর্শিক স্বার্থ আছে বলেই তাঁকে কৃষকদের নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কৃষকদের এই সংগ্রামে সাথী হয়ে যদি এই সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারেন, তবেই তাঁর সঠিক পথে যাত্রা শুরু হবে। এটা তাঁর জীবনের মূল পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় তাঁকে উত্তীর্ণ হতেই হবে।
তাঁর যতটুকু মার্কসবাদ-লেনিনবাদের জ্ঞান ছিল, আর যেটুকু শ্রমিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাকেই ভিত্তি করে সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে মনি সিংহ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, টংক আন্দোলনে তিনি সর্বতোভাবে শরিক হবেন। মণি সিংহ টংক আন্দোলনের সাথে জড়িত হলেন এবং কালক্রমে এ আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হলেন।
আন্দোলনের তীব্রতা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেলে ১৯৪০ সালে সরকার সার্ভে করে টংকের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। ওই বছর নভেম্বর মাসে কৃষকদের নিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি তাঁদের নিজ জমিদারী টংক প্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। এ সময় তিনি নিজ বংশ থেকে সম্পর্কচ্যুৎ হন। দীর্ঘদিন এ আন্দোলন চলেছিল। ১৯৪১ সালের জানুয়ারী মাসে গভর্নর টংক এলাকার অবস্থা সচক্ষে দেখতে এলে পূর্বাহ্নে কয়েকজন সহকর্মীসহ মণি সিংহকে গ্রেপ্তার করে ১৫ দিন আটক রাখা হয়। ছাড়া পেয়ে পরিস্থিতি বুঝে তিনি আত্মগোপন করেন। ওই বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও এই যুদ্ধকালে কমিউনিস্ট পার্টি আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদ বিরোধী ‘জনযুদ্ধের’ নীতি গ্রহণ করায় টংক আন্দোলন কিছু দিনের জন্য বন্ধ থাকে। এক পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকার টংক প্রথার সংস্কার করলেও প্রথাটি একবারে উচ্ছেদ হলো না। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন কৃষক সভা টংক প্রথার পুরোপুরি উচ্ছেদ চাইলো।
১৯৪৪ সালে মণি সিংহ সারা বাংলার কৃষাণ সভার প্রেসিডিয়াম সভ্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৫ সালে নেত্রকোনায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কৃষাণ সভার ঐতিহাসিক সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে মণি সিংহ ছিলেন সম্মেলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক। এ সম্মেলনে নেত্রকোণা শহরের নাগড়ার মাঠে একলক্ষ লোকের সমাবেশ ঘটে। এ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কমরেড মোজাফ্ফর আহমদ, পিসি জোশীসহ ভারত বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ। ১৯৪৭ সালে অনুষ্ঠিত ভারতের সাধারণ নির্বাচনে তিনি নেত্রকোণা জেলার নিজ এলাকা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও টংক আন্দোলন চলতে থাকে এবং তা সশস্ত্র আন্দোলনে রূপ নেয়। সে সময় প্রচলিত গল্প ছিল যে, কমরেড মণি সিংহ একটি সাদা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৫০ সালে টংকের পরিবর্তে টাকায় খাজনা প্রবর্তিত হয় এবং জমিতে কৃষকের স্বত্ব স্বীকৃত হয়। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে এই টংক আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নারী-পুরুষ-শিশুসহ অনেক মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। কৃষকদের শতশত বাড়ি ধুলিসাৎ ও গ্রাম পুড়িয়ে ছারখার করা হয়েছে। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এলাকায় কৃষক সভা ও কমিউনিস্ট পার্টির শাক্তিশালী তৃণমূল সংগঠনও গড়ে উঠেছিল। পাকিস্তানের প্রথম মুসলিম লীগ সরকার মণি সিংহের বাড়ি ভেঙ্গে হালচাষ করে এবং তাঁর স্থাবর সম্পত্তি নিলাম করে দেয়।
পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে ষাটের দশকের শেষ পর্যন্ত টানা ২০ বছর তাঁকে বাধ্য হয়ে আত্মগোপনে থাকতে হয়। এ সময় আইয়ুব সরকার তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ১৯৫৫ সালে আবু হোসেন সরকারের সময় মাত্র ১ মাস প্রকাশ্যে থাকতে পেরেছিলেন। জেলে থাকা অবস্থায় তিনি ১৯৬৮ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত পার্টির চতুর্থ সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে জাতীয় অনেক নেতৃবৃন্দের সাথে কমরেড মণি সিংহকেও গ্রেফতার করা হয়। তবে ১৯৬৯ সালেই ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের পর ২২ ফেব্রুয়ারী সকলের সাথে তিনিও মুক্তি পান।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কমরেড মণি সিংহ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন । মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি জেলে বন্দী ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হলে ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল বন্দীরা রাজশাহী কারাগার ভেঙ্গে তাঁকে মুক্ত করে। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি ভারতে যান। তাঁর প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনী। যে বাহিনী মূলত যুদ্ধের কৌশলী বাহিনী ছিল।

১৯৭৪ সালে সাবেক যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট যোশেফ ব্রজ টিটো বাংলাদেশ সফরে এলে বিমান বন্দরে বঙ্গবন্ধু গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন। কমরেড় মণি সিংহের সাথে করমর্দনরত যোশেফ ব্রজ টিটো। পাশে ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ। প্রেসিডেন্ট টিটোর আড়ালে ঢাকা পড়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ছবি: রশীদ তালুকদার
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন আদায়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের রাজনৈতিক, কুটনৈতিক সমর্থন ও সাহায্য সহযোগিতা আদায়ে কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টির অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কমরেড মণি সিংহ ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করে কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী সংগঠিত করার কাজে সমর্থন আদায়ে সক্ষম হন। যুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারকে পরামর্শ দেয়ার জন্য গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম প্রধান সদস্য ছিলেন মণি সিংহ।
১৯৭৩ সালের দ্বিতীয় কংগ্রেসে তিনি পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কমরেড মণি সিংহকে তাঁর বাড়ি- ভিটা ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। উত্তরে কমরেড মণি সিংহ বলেছিলেন, “টংক আন্দোলন ও বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনে লক্ষ লক্ষ মানুষ তার প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে এবং তাদের বাড়ি ঘর উচ্ছেদ হয়েছে। যতদিন পর্যন্ত এই দেশের প্রতিটি মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা ও কর্মসংস্থান না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত আমার বাড়ি-ভিটা ফিরিয়ে নেয়ার প্রশ্ন উঠতে পারে না। যে দিন সবার ব্যবস্থা হবে সেদিন আমারও ব্যবস্থা হবে”।
১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারীতে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সকল রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ (বাকশাল) নামে জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠন করেন। বিলুপ্ত কমিউনিষ্ট পার্টির নেতাদের নিয়ে মণি সিংহ বাকশালে যোগ দেন।
১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টের পর বাকশাল বাতিল করা হলে ১৯৭৬ সালে পার্টিকে আবার সংগঠিত করেন মণি সিংহ। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পরে পার্টির নেতা ও কর্মীরা সামরিক সরকারের কঠোর নিপীড়নের শিকার হন। পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃবর্গ এবং জেলা পর্যায়ের অসংখ্য নেতা গ্রেফতার হন, অনেকের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। ১৯৭৭ সালের মাঝামাঝি সময় ৭৭ বছর বয়সী কমরেড মণি সিংহকে গ্রেপ্তার করে বিনা বিচারে ছয় মাস অন্তরীণ রাখা হয়। ১৯৭৭ সালের অক্টোবর মাসে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। অবশ্য ১৯৭৮ সালে পার্টির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং পার্টির নেতা ও কর্মীদের মুক্তি দেয়া হয়।
১৯৮০ সালের তৃতীয় কংগ্রেসে তিনি দ্বিতীয়বারের মত পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন।
ব্যক্তিগত জীবনে অনাড়ম্বর সাদামাটা জীবনের অধিকারী কমরেড মণি সিংহ সহধর্মিনী ছিলেন কমরেড অনিমা সিংহ। সিলেটে মেডিকেল স্কুলের ছাত্রী থাকা অবস্থায় অনিমা সিংহ বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন ও কমিউনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত হন। তিনি কৃষক নেত্রী ছিলেন। টংক আন্দোলনের সময় তিনি ঐ আন্দোলনে যোগদান করেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তিনি কমরেড মণি সিংহের সাথে আত্মগোপন অবস্থায় ছিলেন। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম.এ ডিগ্রী অর্জন করেন। স্বাধীনতার পর তিনি কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। ১৯৮০ সালের ১ জুলাই মাত্র ৫২ বছর বয়সে এক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রয়াত কমরেড মণি সিংহকে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার ২০০৪ (মরণোত্তর)’ প্রদান করা হয়। শান্তি, গণতন্ত্র ও সমাজ প্রগতির সংগ্রামে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে মৈত্রী সুদৃঢ়করণের ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মণি সিংহকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার ‘অর্ডার অব ফ্রেন্ডশিপ অব পিপলস’ পদকে ভূষিত করে। কেবল সোভিয়েত ইউনিয়ন নয় বুলগেরিয়া এবং চেকোশ্লোভাকিয়া সরকারও তাঁকে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদানের স্বীকৃতি প্রদান করে।
১৯৮৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী কমরেড মণি সিংহ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘ সাত দশক কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য, শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে এবং মানুষের চূড়ান্ত মুক্তির জন্য কমিউনিস্ট আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলায় নিরলস অবদান রেখে ৬ বছর অসুস্থ থাকার পর ১৯৯০ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্য সূত্র:
১. গুণীজন: gunijan.org.bd;
২. কমরেড মণি সিংহ স্মারকগ্রন্থ: সম্পাদনা-এম এম আকাশ, এ এন রাশেদা। জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ঢাকা। প্রকাশকাল, ২০০৯;
৩. জীবন-সংগ্রাম: কমরেড মণি সিংহ। জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ঢাকা। প্রকাশকাল, ২৮ জুলাই ১৯৮৩;
৪. জননেতা কমরেড মণি সিংহ: মণি সিংহের সংক্ষিপ্ত জীবনী, গ্রন্থনা: কমরেড মণি সিংহ মেলা উদযাপন কমিটি, ২৬ ডিসেম্বর ২০০২;
৫. গণমানুষের মুক্তির আন্দোলন: মাহফুজা খানম/তপন কুমার দে, প্রকাশকাল ২০০৯;
লেখক:
সাগর লোহানী, সম্পাদক, বাঙালীয়ানা