অনুকবিতা
১.
যদি মন হারাবার কথাই না ছিল
তবে কেন সকালবেলার রোদ্দুর হতে চাও?
তবে কেন হেমন্ত দিন হতে চাও?
২.
এভাবেই চলে যেয়ো যেভাবে চলে গেছে শেষ বসন্তের পাখিরা,
এভাবেই একা করো যেভাবে একা করেছে পুরোনো পোস্টবক্স,
ল্যান্ডফোনে বিরতিহীন বার্তায় শেষকৃত্য করে দিও গত জীবনের প্রেমালাপের।
এভাবেই চলে যেয়ো উজানে
এভাবেই চলে যেয়ো।।
৩.
কি করে কাটে গো দিন দেখলা না
তোমার জন্য রক্ত জল ফুরিয়ে গেল জানলা না
শর্ত ছিল দুপুর হবে
শর্ত ছিল শালিক হবে
ভুইলা গেলা?
৪.
গোলাপী অভিমান ফিরে যেও চন্দ্রাবতীর স্রোতে
এখানে শিশিরে শরত জমেছে
মেঘেরা মেখেছে নতুন চাঁদের আলো
আকাশেরও জানা আছে বক শাদা রোদের দিন
একলা নীলেই লাগে ভালো….!
৫.
যে বিষাদে ঘুম পালিয়ে যায়
আজ তেমন বিষাদ ঝরেছে সারাটা ঘর জুড়ে
দীর্ঘমেয়াদী বর্ষণে বিপদসীমায় ছুঁই ছুঁই
অভিমানে রাত হয় গভীর
সুগভীর সেই রাতের বাতাসে ভেসে যায়
আর আর সব সরল প্রেমের জটিল হিসাব নিকাশ
ঘুমহীন রাত জুড়ে থাক বৃষ্টি
উজানে তুমি থেকো সুখে…।
৬.
এই যে তপ্ত প্রেমিক!
শুনছো?
তোমার বুকের বাঁ পাশের জানালা থেকে বলছি
শুনছো?
আমার চুলে তোমার চুম্বনের
উষ্ণতার অভাবে ঝরে পড়ছে তুষার
শীত তীব্রতায় জমে গেছে ওষ্ঠ, গ্রীবা…।
তুমি কি একটু আসবে?
উষ্ণ ঝড়ের মতো,
উত্তাল ঢেউয়ের মতো???
৭.
পদচিহ্ন মেপে মেপে ঠিক পৌঁছে যাব সমুদ্দুর
রঙধনু মেঘে খুঁজে নেব বৃষ্টির ঠিকানা
তুমি যেখানে ফেলে গেছো ছায়া
সেখানেই বিছিয়ে দেব ঝাউবন মায়া!!
৮.
রোজ রোজ রাত্তিরবেলা বৃষ্টি নামলে বুঝতে পারি
বসন্তেরও হয়েছে বৃষ্টিলাগা প্রেম
আকাশ দেখে বসন্তও কী ডাকে…
এই তুমিও কী বাসলে ভালো
আমারই মতন ঝরা পাতা?
বনপ্রান্তর উড়িয়ে কুয়াশা
তুমিও কী ভিজলে আমারই মতন
বুনো ফুল?
পায়ের তলায় ছড়িয়ে দিলে জোনাক জ্বলা সন্ধ্যে?
বসন্ত, তুমিও ভালোবাসলে এই বেলা কুহুতান?
৯.
অতটা একাকিত্ব জমা করো কেন?
জানোই তো বুক পকেটে আজকাল
ব্যস্ত নাবিকের আনাগোনা,
নোনা বাতাসে ঝাপসা করো কেন চোখ?
জানোই তো কপট অভিমানে শিশির জমে না আজকাল
শালিকের ডানায়,
ঘাসফুল ও স্বর্ণলতার সঙ্গমে জন্মায় না প্রেম কিংবা মায়া
অতটা একাকিত্ব জমা করো কেন?
বরং প্রলুব্ধ উল্লাসে ছিঁড়ে ফেলো
কবিতার খাতা,
ঘরবাড়ি ডুবিয়ে দাও
বানভাসি হও
অথবা যা খুশি তাই করো।
১০.
এই মৌসুমে নাহয় একাকিত্বই বেচো কবি
আসছে সুদিন;
সামনের মৌসুমে ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে নাহয় কিনবে
একরত্তি আকাশ, দুটো ময়না
একটা কি দুটো দুঃসাহসী প্রেমের গল্প!

তিনি
তিনি ছিলেন তিনি থাকবেন এমন নিশ্চয়তার দাবী জানাতে
পথে নেমেছে শহুরে বারোয়ারী মানুষের দল
কতকটা অবাঞ্চিতের মিছিল
কতকটা যেন সাজানো ঘটনাপ্রবাহ
কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা ভিখারি যুবকটি মাথা চুলকে ভাবে
যদি তিনি এতই কাম্য সকলের তবে দেখা দেন না কেন?
কেন তারে খুঁজতে নগরপাল লোক পাঠালেন ত্রিলোকে!
ওদিকে হাড়-হাভাতে শিক্ষিত কুকুরগুলো গলা ছেড়ে গান গাইছে
এমন দিনে গান গাইতে ওদের কেউ কেন করেনি মানা!
ভাবতে ভাবতে ভিখারি যুবক হাতের শক্ত তেলোয়
রুপোর চাকতিটি বার তিনেক ঘুরিয়ে আনে
মনে মনে বলে–যদি ক্ষিধেটা এত না জ্বালাতো
এ শহরের পশ্চাতদেশে লাত্থি মেরে কবেই ভেগে যেতো
ফি-বছরে গোলাপবাগানে কাঁটা বেছে ফুল তোলা কি সুগন্ধি কারখানায়
কাজ করতে তার কোনই আপত্তি থাকত না
কিন্তু পেরিফেরিতে কাজের মূল্য নেই
অল্পস্বল্প যা দেয় তাতে চায়ের জল গরম করাও কঠিন
দীর্ঘশ্বাস ফেলে যুবকটি রুপোর চাকতিটি পরখ করতে করতে বলে
‘তিনি জাহান্নামে যাক! শহরের পয়সাওয়ালারা বেঁচে থাক হাজার বছর।
ওরা বেঁচে থাকলেই তো রুপোর ঝনঝনাৎ…’
সূর্য ডুবে গেলে কাক ডাকে ইদানীং
বেড়ালগুলো এঁটোকাঁটা ফেলে মার্গারিটা খায়
দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি তাতে হলুদ আলোয়
তিনি রাগতঃ চোখে মাপেন শহরে হাওয়ার বদল
৩০/৯/২২

ভালো থাকার বিকল্পের খোঁজে
ভালো থাকার বিকল্প খুঁজতে খুঁজতে পড়ে গেলাম কয়লাটে এক কুয়োর মধ্যে
পতন কখনই সুখকর নয় তাই আমারও হলো না
অভিযোগ ভর্তি সে কুয়োয় আমি
পড়ছি, পড়ছি, পড়ছি…
যেন অভিকর্ষজ ত্বরণের তীব্রতা কমে গেছে
আমি হয়ে গেছি তুলোর বল।
ভালো থাকার উপায় ছিল না আমার
তিন দফা নিঃসঙ্গতায় বেঁচে রইলাম পূর্ণ মেয়াদে
তিন রকম জীবন যদিও ঘটনাপ্রবাহ একই রকম।
প্রথমবার একজন ভিখারির জীবন পেলাম
ভাবলাম, ভিক্ষে করে যাকে বেঁচে থাকতে হয় তার একলা থাকাই ভালো
আমি পড়ে রইলাম কুকুর হয়ে মানুষের পায়ে পায়ে।
দ্বিতীয় জীবনে আমি ছিলাম একজন চৌকশ চোরাকারবারি
তারকাঁটার বেড়া পার করে কত কি-ই-না
কেনাবেচা করেছি সেই জীবনে
নানান জাতের পণ্য…
নারী, শিশু, মদ, স্বর্ণমুদ্রা কিংবা দক্ষ জুয়ারী
আর কে না জানে পণ্যের কোন লেবেল থাকে না
একই বয়ামে চাঁদের আলো এবং চালতার আচার বিক্রি হতে পারে,
হতে পারে একই টাকায় নানারকম মিথ্যের বেসাতি।
এমন উত্তেজনাপূর্ণ জীবনে আমি একাকিত্ব সাদরে গ্রহণ করেছিলাম
কেননা সেটাই ছিল যৌক্তিক।
তৃতীয়বার জন্মাতেই চাইনি জানো!
সত্যি বলছি
আমার ইচ্ছেই করেনি আর একবার নিঃসঙ্গতায় বেঁচে থাকি
অথচ আমার জন্ম হলো বেদুঈনের ঘরে
যাযাবর হওয়াই যার নিয়তি
মরুভূমিতে বৃষ্টি খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে গেছিলাম আদিগন্ত বিস্তৃত এক মৃত সাগরে
সেবার বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে মিশে গেছিলাম লবনাক্ত সামুদ্রিক ঢেউয়ে।
তিন-তিনবার মানুষের জীবনে আমি ভালোই ছিলাম
একা কিন্তু সুখী।
এবারে জন্মেছি নিঃসঙ্গ হাসপাতালের একটি নিরব কক্ষে
এই দফা রাজনৈতিক নেতা হবার কথা ছিল
তা না হয়ে আমি হলাম খবর সংগ্রাহক
নানারকম তথ্যের কাণ্ডারী এখন
ছায়ার ভেতর ছায়া বাজি খেলতে খেলতে আমি
লোকেদের গোপন পাপরাশির করি সওদা
হা হা হা হা…
কারো চাই বাক্সভর্তি গোপনীয়তা
কারো চাই স্পর্শকাতর তথ্য
এ জীবনে নামহীনতায় বেঁচে থাকতে চেয়েছিলাম
চেয়েছিলাম ভালো থাকতে
কিন্তু ক্রমাগত মানুষের জীবন ঘেঁটে ঘেঁটে আমার বমি পেতো
ভালো থাকায় ভীষণ অরুচি
তাই আজকাল ভালো থাকার বিকল্প খুঁজতে বেরোই।
ভালো থাকার বিকল্প খুঁজতে খুঁজতে আমি পড়ে যাই কুয়োর ভেতর
অগণিত সোনালী মাছে ভরপুর সে কুয়োর তলায়
বসে থাকি একাকীত্ব বুকে নিয়ে,
বসে থাকি ভরশূন্য কায়াহীন সুখ নিয়ে,
বসে থাকি জন্মজন্মান্তরের নিঃসঙ্গতায়…
২/৯/১৯

আলোর মিস্তরি
মিয়া জাহাঙ্গীর আলোর মিস্তরি কই লুকায়া থাকো?
দিনদিন ইট চুরি হইতাছে গতর খইসা যাইতাছে
আলো পাইনা এক ফোঁটা
কই থাকো মিয়া?
আন্ধারের কারবারি কর নাকি আইজকাইল?
চাঁন যে মুন ফিকা ফিকা লাগে তুমিও মিয়া হেইরকম হারামি হইতাছো
মাইনষের বগলে ঘুমাওনি?
রক্তের গন্ধ ভালা পাইতাছো?
মিয়া জাহাঙ্গীর কলিজায় ফরমান জারি হইতাছে
যমের বাড়ি ডাকতাছে আয় আয় কইয়া
দেখছনি চারপাশ ভইরা যাইতাছে অমানুষে?
অমানুষ সাফ করার কাম তো তোমারই আছিল জানতাম
আইজকাইল কই হান্দায়া থাকো?
মন্নুজানের আসর ভাইঙা গেছে
ঘুঙুর বাজে কেবল বুকের ভিত্রে
মন্নুজান এখন ইটের ভাটায় কইলজা পুড়ায়
গন্ধ পাও না মিয়া?!
মিয়া জাহাঙ্গীর আলোর মিস্তরি
এইবার বুকের ভিতর আকাশ আইনা দাও
চাঁন্দের আলোয় জোছনা হইব
বুকের তলায় জোনাক জ্বলব
লক্ষ্মী পেঁচায় হুহুম হুহুম ডাকব
আর তকখন তকখনই শোনা যাইব
…… কব্বরে কে ঘুমায়? কব্বরে কে ঘুমায়?
মিয়া জাহাঙ্গীর বাত্তি জ্বালাও
বাত্তি জ্বালাও
ওই আইল মন্নুজান
ওই আমার দুনিয়া…
২৬/৮/২০২০

প্রস্থান
দেখ গভীরতায় কোন আপত্তি ছিল না আমার
শুধু একাকীত্বের ভাগ চেয়ো না,
ছবির ফ্রেমে দুঃখ বাঁধিয়ে রাখতে চাও
কোনদিনই বলিনি ওটা অপ্রয়োজনীয়
শনি কিংবা বুধবার অন্য ছবিও রাখতে পারো
সেরকম কোন দাবীও নেই!
অতিরঞ্জিত প্রেমে বা অপ্রেমে
বিশ্ব আলোকিত করার ইচ্ছেরা
কবেই হারিয়েছে মহাকালের শীতলতায়।
প্রতিনিয়ত একই গোলকধাঁধায়
তোমার অরুচি নেই জানি
কিন্তু আমার বদলে গেছে অভিপ্রায়!
বিষাদ কিংবা আনন্দ এখন
অনায়াসে করতে পারি উপেক্ষা।
রক্তের গভীরে জমানো পাপ
নির্দ্বিধায় করো অস্বীকার!
আমিও ভুলে গেছি
গতজন্মের দেনাপাওনার হিসাব।
প্রতিধ্বনিত গল্পটা তুমিই শোন
প্রতিবিম্বিত আয়নাটা তুমিই দেখ
আপত্তি নেই।
ফিরতি পথে দাঁড়িয়ে নেই আমি
আমার আর নেই কোন অবসর
ভালোবাসাহীন ভালোই আছি
তুমিও ভালো থেকো।
১৯/৮/১৮

ভ্রম
ভ্রম ভেঙে গেলে দিনের গায়ে ব্ল্যাকহোলের জন্ম হয়
ব্রহ্মদত্যি ব্ল্যাকহোলের ভেতর বসে কেবলই হেসে হেসে
খেয়ে ফেলছে তোমার আয়ু
তুমি এরপরেও বলো ‘ভালোবাসি গো ভীষণ ভালোবাসি’
যেন ভালোবাসা সস্তা মোড়কে প্যাঁচানো কাগুজে আলাপ
ভ্রম ভেঙে গেলে সবটাই এড্রেনালিন রাশ
সবটাই গেম অফ হরমোন
আদতে তোমার নিজের ছায়ার সাথেই ছায়াবাজি খেলা চলছিল
তুমি বুঝতে পারোনি
তুমি ভাবছিলে জাদুর আয়না সত্যি বলেছে
তুমি ভাবছিলে কাচের জুতো পায়ে দেখছো প্রেমিক মেলা
ঘুম ভেঙে যাবার পরের দামামায় তোমার হাতে ভাঙা বোতলে
শরবত নাকি রক্ত
এ বিভ্রম কিছুতেই কাটে নাই গত একশো বছরে
গত একশোটা বছরে ঘর নেই
নেই উদ্যান
নেই কোন হিসেবের বাহানা
ছেঁড়া পাল উড়িয়ে দূরে যাবার আসমানী ইশারায়
শরীর কাঁপে আজ
শরীর কাঁপে উত্তরের হাওয়ায়
হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে যায় ইমারত ভেঙ্গে যাবার ক্রমবর্ধিত আওয়াজ
ভীষণ সে আওয়াজে ভ্রম ভেঙে যাচ্ছে
যেন কাচের সমুদ্রে চলছে দুর্দান্ত ঝড়ের তাণ্ডব!!
১৬/৮/২২

লেখক:
শ্রাবণী জুঁই, কবি