সংকটে প্রাণী বৈচিত্র্য: স্তন্যপায়ী পর্ব

Comments

।। জয় হাসান অপু ।।

ভালো খবর দিয়েই শুরুটা করা যাক। ৮ আগস্ট, ২০১৮, গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু সাফারী পার্কে জন্ম হয় দুইটি বাঘ শাবকের। শাবক দুইটির একটি ছিল সাদা। ঠিক তার আগের মাসেই, ১৯ জুলাই, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় জন্ম নেয়া তিনটি শাবকের একটি ছিল সাদা। জীব বৈচিত্রের এমন নতুন খবর যেমন আমাদের অবাক করে তেমনি অবাক চোখেই তাকাই ১৯৪০ এর দিকে এই ভূখণ্ডে শেষ দেখতে পাওয়া নীলগাইকে। কিছুদিন আগে যা ধরা পড়েছিল ঠাকুরগাঁও-এ। আবার মনটা একটুখানি খারাপও হয় ঢাকা চিড়িয়াখানায় আফ্রিকান সাদা সিংহের মৃত্যুতে।

চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় জন্ম নেয়া সাদা বাঘ সাবক

প্রাণী জগতে বিবর্তন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেই বিবর্তনে নতুন পালক যেমন জোড়া লাগছে তেমনি হারিয়ে যাচ্ছে অনেক প্রাণীর অস্তিত্বও। প্রাকৃতিক কারণ ছাড়াও মানুষ সৃষ্ট নানা কারণে পৃথিবীব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তন প্রভাব ফেলছে এই বিবর্তনে। পরিবর্তনের এই হাওয়া বাংলাদেশে এসেছে ব্যাপকভাবে। তাই পৃথিবীব্যাপী বেশ কয়েকটি সংগঠন জোড়ালো ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে প্রাণী বৈচিত্র্য রক্ষা করতে। বিশ্বজুড়েই এই প্রেক্ষিতে প্রতি বছর ৪ অক্টোবর পালিত হয়ে আসছে ‘বিশ্ব প্রাণী দিবস’।

হেনরিক জিম্মারম্যান

হেনরিক জিম্মারম্যান

‘বিশ্ব প্রাণী দিবস’ ধারণাটির প্রবক্তা ধরা হয় হেনরিক জিম্মারম্যানকে, যিনি ছিলেন একজন জার্মান লেখক ও প্রকাশক। ‘ম্যান্স এন্ড হুন্ড (মানুষ এবং কুকুর)’ নামে একটি ম্যাগাজিন বের করতেন তিনি। তিনিই প্রথম প্রাণী দিবসের আয়োজন করেন ২৪ মার্চ ১৯২৫ সালে বার্লিনে যা পরবর্তীতে ৪ অক্টোবর তারিখে প্রথমবারের মত পালন করা হয় ১৯২৯ সালে। প্রথম দিকে শুধুমাত্র জার্মানি, অস্ট্রিয়া, সুইটজারল্যান্ড ও চকোস্লাভিয়ায় থেকে অনুসারী পাওয়া গেলেও একসময় সমগ্র বিশ্বেই এর গ্রহণযোগ্যতা তৈরী হয়। হেনরিক জিম্মারম্যানের নিরলস প্রচারণায় এটি ১৯৩১ সালে ‘বিশ্ব প্রাণী দিবস’ হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

সচেতনতা তৈরী করতে কাজ করলেও প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই প্রাণীকুলে সংকট বেড়েই চলছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন)-এর লাল তালিকা থেকে জানা যায় ৯৩৫৭৭টি প্রজাতির উপর চালানো পর্যালোচনায় ২৬১৯৭টি প্রজাতিই আছে চরম সংকটে। বাংলাদেশে চালানো এক জরিপে আইইউসিএন জানিয়েছে, গত ১০০ বছরে হারিয়ে গিয়েছে প্রায় ১৩ প্রজাতির বন্য প্রাণী।

নতুন তালিকায় আরও জানা যায়, ৩৯০ প্রজাতির বন্য প্রাণী কোনো না কোনোভাবে বিপন্ন। তবে আশার কথা ১৪ প্রজাতির নতুন প্রাণীর সন্ধানও দিয়েছে তারা। যার মধ্যে পাঁচটি ইঁদুরের ও পাঁচটি প্রজাপতি বর্গের প্রজাতি।

একসময় রাজশাহী অঞ্চলে দেখা মিলত ডোরাকাটা হায়েনাদের। সময়ের বিবর্তনে ডোরাকাটা হায়েনা এখন আর নেই। তেমনি, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে ধূসর নেকড়ে, দিনাজপুরে নীলগাই, বান্টিং বা বনগরু পাওয়া যেতো চট্টগ্রাম ও সিলেটে যার কোনটির হদিসই এখন আর পাওয়া যায় না। দেশের সব জায়গায় দেখতে পাওয়া বন মহিষও বিলুপ্ত হওয়া প্রাণীর কাতারে চলে গিয়েছে অনেক আগে। সুন্দরবনে বিচরণ ছিলো গন্ডারের। মোটামুটি তিন প্রজাতির গন্ডার দেখা যেত এই অঞ্চলে। কিন্তু শিকারিদের নজরে পড়া গন্ডার এখন আর চিড়িয়াখানা ব্যতীত মুক্তভাবে দেশের কোথাও পাওয়া যায় না। সিলেটের হাওড় অঞ্চলে পাওয়া যেত বাদা বা জলার হরিণ। শিঙ্গা হরিণ নামেও ডাকা হতো হরিণের এই প্রজাতিকে। এখন এই প্রাণীর দেখা পাওয়া যায় ভারতের অল্প কিছু জায়গায়। তাছাড়া, কৃষ্ণষাঁড়, মন্থর হরিণ, গয়াল, মন্থর ভালুক বিলুপ্ত হয়েছে গত শতাব্দীতেই। যদিও ভারত ও মিয়ানমার এর কিছু কিছু অরন্যে গয়ালের অস্তিত্ব আছে ধারনা করা হয়। বাংলাদেশে কিছু জায়গায় সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে এই প্রজাতির শেষ কিছু সদস্যকে।

ডোরাকাটা হায়েনা

বিপন্ন হওয়ার পথেও আছে বেশ কিছু প্রাণী। যার মধ্যে অন্যতম বাংলার রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। তবুও মাঝেমধ্যেই খবর আসছে বাঘ মারার। কিংবা চামড়া ও অন্যান্য অঙ্গ পাচারের সময় পাচারকারীদের ধরা পড়ার খবর। খবর পাওয়া যায় বাঘ পাচারেরও। দেশের বাইরে জীবিত বা মৃত বাঘের খুব দাম থাকায় শিকারিরাও নির্বিচারে বাঘ শিকারে মেতেছে। তাছাড়া, খাবারের অভাবে লোকালয়ে এলেও মারা পড়ছে বাঘ। এর জন্য দায়ী করা যায় সুন্দরবনের বাস্তু ব্যবস্থাকে, যার দায় প্রকৃতির কম, মানুষেরই হয়তো বেশি। বর্তমানে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা নিয়ে রয়েছে নানা গড়মিল। ২০১৫ সালের জরিপ অনু্যায়ী বাঘের সংখ্যা ১০৬ টি বলে জানা যায়। যেখানে ২০০৪ সালে বাঘের পায়ের ছাপের মাধ্যমে করা জরিপে সংখ্যাটা ছিলো ৪৪০। ২০০৬ সালে ক্যামেরায় ছবি তুলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল হাসান খান ব্রিটিশ জুয়োলজিক্যাল সোসাইটির সহায়তায় সুন্দরবনে বাঘ গণনা জরিপ করেন। তাতে বাঘের সংখ্যা ছিল ২০০টি। সেই হিসাবে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা গত নয় বছরে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এ ছাড়া ২০১০ সালে বন বিভাগ ও ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ যৌথভাবে সুন্দরবনের খালে বাঘের বিচরণ পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে একটি জরিপ করে। এতে বাঘের সংখ্যা ৪০০ থেকে ৪৫০টি বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে দ্রুতই বিলুপ্তির পথে এগুচ্ছে আমাদের এই সম্পদ। যেখানে একসময় সারা দেশেই বন জঙ্গলে বাঘের বিচরণ ছিলো বলে ধারণা করা হয়। ইংরেজ আমলেও এই অঞ্চলে প্রায় লাখ খানেক বাঘ ছিলো বলে ধারণা পাওয়া যায়।

রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার

রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার

লাজুক বানর

তাছাড়া, বিলুপ্তির পথে আছে বা মহাবিপন্ন প্রাণীর মধ্যে আছে হাতি, ভোঁদড়, লামচিতা, চিতা, বনরুই, উল্লুক, চশমা পরা হনুমান, বনগরু, সাম্বার হরিণ, প্যারাইল্লা বানর, ডোরাকাটা কাঠ বিড়াল ও কালো ভালুক। বিপন্ন প্রজাতির মধ্যে আছে লাজুক বানর, কুলু বানর, রামকুত্তা, গেছোবাঘ, উদ্বিয়াল, ভালুক, বনছাগল, বনবিড়াল ও মেছোবাঘ।

বন বিড়াল

ধরা হয়, মহা বিপন্ন প্রজাতিগুলোর প্রতি প্রজাতির ৮০ শতাংশ প্রাণীই এখন আর নেই। বাকীরা আগামী তিন প্রজন্মের মধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আর বিপন্ন প্রজাতির ক্ষেত্রে বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় ধরা হয় এবং ধারণা করা হয় প্রজাতির ৪০ শতাংশ সদস্যই এখন আর নেই।

যেভাবে বনভূমি উজাড় হচ্ছে তাতে করে ভবিষ্যতে এই প্রজাতি গুলোকে টিকিয়ে রাখা যে আরও কঠিন পরিস্থিতিতে যাচ্ছে তা ধারণা করাই যায়।

 

 

তবে অঞ্চল চিহ্নিত করে এসব প্রাণীর বর্তমান বিচরণ ক্ষেত্র গুলোকে অভয়ারণ্যে রূপ দেয়া এবং বিভিন্নভাবে সংকটে থাকা প্রাণীগুলোর সংরক্ষণ ও জীবন রহস্যের উন্মোচন ঘটানো আটকাতে পারে বিলুপ্তির পথ। তবে তার আগে আমাদের সচেতন হওয়া ছাড়া প্রথম বিকল্প পথ হয়তো খোলা নেই।

আগামী পর্বে বাংলাদেশের উভচর ও পাখির বৈচিত্র্য ও সংকট নিয়ে থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।

বাঙালীয়ানা/জেএইচ/এজে

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট