সংগ্রামী চেতনায় ভাস্বর ১৯ মে’র ভাষা আন্দোলন

Comments

সন্দীপ দে 

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বাংলাভাষা-পরিচয়’ নিবন্ধের ‘ভাষা ও সাহিত্যশিরোনামে এক জায়গায় লিখেছেন:

” সমাজ ও সমাজের লোকদের মধ্যে এই প্রাণগত ও মনোগত মিলনের ও আদান-প্রদানের উপায়স্বরূপে মানুষের সব চেয়ে শ্রেষ্ঠ যে সৃষ্টি সে হচ্ছে তার ভাষা। এই ভাষার নিরন্তর ক্রিয়ায় সমস্ত জাতকে এক করে তুলেছে; নইলে মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে মানব ধর্ম থেকে বঞ্চিত হত।”

এই ভাষার মর্যাদা ও অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য লড়াইয়ে আত্মবলিদানের ইতিহাসে দু’টি উজ্জ্বলতম দিন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় ১৯৫২-র ২১ ফেব্রুয়ারি ও আসামের শিলচরের ১৯৬১-র ১৯ মে।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি গোটা বিশ্বে মাতৃভাষার জন্য আন্দোলনের ইতিহাসে একটি অনন্য স্থান অধিকার করে আছে। এই সূত্রেই উচ্চারিত হয় আসামের বরাক উপত্যকার শিলচরে ১৯৬১ সালের ১৯ মে মাতৃভাষার জন্য এগারো জন ভাষাব্রতীর আত্মবলিদানের ঐতিহাসিক ঘটনা। বর্তমানের জটিল-বিক্ষুব্ধ সময়ে প্রতিবাদী ও আশাবাদী প্রগতিকামী মানুষ যাঁরা সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে গণ আন্দোলন ও শ্রেণি আন্দোলনের বহুধা-বিস্তৃত ধারায় শামিল রয়েছেন, তাঁদের সামনে প্রেরণার আলোক স্তম্ভ হিসেবে দীপ্ত রয়েছে একুশে ফেব্রুয়ারি ও উনিশে মে’র ইতিহাস-বিধৃত ভাষা আন্দোলন। বিশেষকরে ভারতীয় উপ মহাদেশে এই দু’টি ভাষা আন্দোলনের আলোকোজ্জ্বল ইতিহাস সমস্ত আন্দোলন-সংগ্রামে কিছুটা হলেও প্রেরণা সঞ্চার করছে। ১৯৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ইউনেস্কো ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারির মহান ভাষা আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিয়ে একুশ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। সেই হিসেবে বিশ্ববাসী ২০০০ সাল থেকে এই দিনটিকে ভাষার মর্যাদা ও অধিকারের দিন হিসেবে পালন করে আসছে।  বাংলা ভাষার জন্য নিবেদিত আন্দোলনে রক্তঝরা একুশে ফেব্রুয়ারি আজ বিশ্ব স্বীকৃত, গৌরবে ভূষিত হলেও উনিশে মে সেক্ষেত্রে যেন কিছুটা ম্রিয়মান— একথাও অস্বীকার করা যাবে না। এমনকী অনেকের কাছে,বিশেষ করে আজকের নবীন প্রজন্মের অংশ বিশেষের কাছে আজও অজানা শিলচরে ১৯ মে’র রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। তবে যাই হোক, ২১ ফেব্রুয়ারির পাশাপাশি ১৯ মে’র ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও গৌরবও কখনো ম্লান হবার নয়।

আরও পড়ুন
জান দেবো তবু জবান দেবো না

ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট

এই ইতিহাস অনেকেরই জানা, ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষে ‘ভাগ করো আর শাসন করো’ নীতিতে বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে ও নানা কারণে রাজ্য ও রাষ্ট্রের সীমানা পরিবর্তন করেছে। তেমন ভাবেই ১৮৭৪ সালে শ্রীহট্ট বা সিলেট জেলাকে বাংলা বিভাগ থেকে কেটে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে আসামকে চিফ কমিশনার-শাসিত রাজ্যে পরিণত করে। এর প্রতিবাদে শ্রীহট্টে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তখন মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত করার জন্য ভারতের তদানীন্তন বড়োলাট নর্থব্রুক শ্রীহট্টে ছুটে আসেন। ব্রিটিশ সরকার নবগঠিত আসাম রাজ্য যাতে এক ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী রাজ্য হিসেবে গড়ে উঠতে না পারে তারজন্য আসামকে দু’টি উপত্যকায় ভাগ করে। এই দু’টি উপত্যকার নাম ছিল আসাম উপত্যকা এবং সুরমা উপত্যকা। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা নিয়ে আসাম উপত্যকা গঠিত হয়। শ্রীহট্ট জেলা আসামের রাজনীতির অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখান থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আসাম বিধানসভার সদস্য ছিলেন। কিন্তু অদ্ভুতভাবে শ্রীহট্ট কাছাড়ের কংগ্রেস কিন্তু আসাম কংগ্রেস কমিটির অধীনে ছিলনা,তারা ছিল বেঙ্গল কংগ্রেসের অধীনে। আশ্চর্যের বিষয় যে, একই রাজ্যের দুই কংগ্রেস দল ছিল দুই রাজ্যের কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত। ফলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার কোনো সুযোগ ছিলনা। উলটে বিদ্বেষ ছিল ক্রমবর্ধমান।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য, স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময়ে চূড়ান্ত জাতিবিদ্বেষ তৈরি হয়। তখন আসামের অন্যতম সমৃদ্ধশালী জেলা শ্রীহট্টকে অভিনব পন্থায় পাকিস্তানে ঠেলে দেওয়া হয়। শ্রীহট্ট জেলা ভারতে থাকবে না পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হবে এ নিয়ে গণভোট হয়। এতে ৫২৭৮০ ভোটে শ্রীহট্ট জেলা পাকিস্তানে চলে যায়। এই জেলায় তখন প্রায় আড়াই লক্ষ চা শ্রমিক ছিলেন যাঁরা আসাম বিধানসভা ও পার্লামেন্টের নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু শ্রীহট্টের গণভোটের সময় তাঁদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়নি। তখন মুসলিম লিগ ঘোষণা করেছিল যে, চা বাগানের শ্রমিকরা শ্রীহট্টের স্থায়ী বাসিন্দা নন। কাজেই তাদের ভোট দেওয়া চলবে না। অন্যদিকে এই চা শ্রমিকদের ভোট দেওয়ার ব্যাপারে কংগ্রেসীদের কোনো বিশেষ উদ্যোগ ছিল না। অথচ তখন আসামে ছিল কংগ্রেস সরকার। আসাম রাজ্যের অন্যতম সমৃদ্ধশালী জেলা শ্রীহট্টকে পাকিস্তানে ঠেলে দিয়ে রাজ্যের চরম ক্ষতি সাধন করা হলো। তখন শ্রীহট্টের হিন্দুরা নিজের মান সম্মান রক্ষার জন্য দলে দলে চলে আসেন আসামে। এরা সকলেই ছিলেন আসাম রাজ্যের। এরা পরিস্থিতিজনিত কারণে স্থানান্তরিত হওয়ায় পরিস্থিতি জটিল হলো। কারো কারো উপলব্ধি হলো শ্রীহট্টের মূল্যবান ভূমি পাকিস্তানে চলে গেল। আর শ্রীহট্টের মানুষ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে বাস্তুচ্যুত হয়ে চলে এলেন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা হয়ে উঠলো অগ্নিগর্ভ। তারই জের হিসেবে পরবর্তীকালে (১৯৬০) ‘বাঙ্গাল খেদা’র নামে সংঘটিত হয় নারকীয় দাঙ্গা। এই সংকটময় পরিস্থিতিতে রাজ্যে ক্রমাগত চলেছে শাসকদলের অন্তর্বিরোধ। তাতে নীতি আদর্শের কোনো বালাই ছিল না, শুধুই প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির লড়াই।

Borak_May19_Rally

১৯ মে ভোরে ভাষা আন্দোলনকারীরা শিলচর ষ্টেশনে রেলপথ অবরোধ করলে শুরু হয় পুলিশী একশন।

ভাষা নিয়ে কংগ্রেসের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ

 বরাক উপত্যকায় ভাষা আন্দোলন শুরুর আগে মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বিষ্ণুরাম মেধি। তিনি নানা কারণে কংগ্রেস সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বিরাগভাজন হন। সেজন্য তাঁকে তৎকালীন মাদ্রাজের রাজ্যপাল করে পাঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর জায়গায়  বিমলা প্রসাদ চালিহাকে মুখ্যমন্ত্রী করার লক্ষ্যে সোনারি বিধানসভা কেন্দ্রে প্রার্থী করা হয়। কিন্তু চালিহা পরাজিত হন। তবু্ও নেহরু বিষ্ণুরাম মেধিকে মাদ্রাজের রাজ্যপাল করে রাজ্যের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে পরাজিত বিমলা প্রসাদকেই মুখ্যমন্ত্রী পদে বসিয়ে দেন। এরপর বরাক উপত্যকার বদরপুর আসনটি আদালতের রায়ে শূন্য হয়।সেই কেন্দ্রের উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে বিমলা প্রসাদ চালিহা পাকাপোক্তভাবে মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসেন। বিষ্ণুরাম মেধি রাজ্যপাল হয়ে বাইরে চলে গেলেও প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিতে তাঁর অনুগামীদেরই প্রাধান্য ছিল। এই পরিস্থিতিতে ১৯৬০ সালের ২১ ও ২২ এপ্রিল আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয় শিলংয়ে। সভার মূল আলোচ্য বিষয় ছিল আসামের রাজ্য ভাষা স্থির করা। জানা যায় মূলত মেধির অনুগামীদের চাপে দু’দিন আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়, আসামের একমাত্র রাজ্য (সরকারি) ভাষা হবে অসমিয়া। এবং এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে আসাম বিধানসভায় একটি বিল আনা হবে। কাছাড়ের সদস্যরা এর বিরোধিতা করলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে এই সিদ্ধান্তই গৃহীত হয়। এরফলে কাছাড় জেলা জুড়ে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়,যা পরবর্তীকালে বৃহত্তর ভাষা আন্দোলনে পরিণত হয়।

প্রদেশ কংগ্রেসের এই সিদ্ধান্তের পর মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা এই সংক্রান্ত একটি বিল অবিলম্বে বিধানসভায় উত্থাপন করা হবে বলে ঘোষণা করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬০ সালের ২ ও ৩ জুলাই শিলচরে নিখিল আসাম বাংলা ভাষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন থেকে আসামে ভাষার প্রশ্নে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা এবং এবিষয়ে আসামের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে ঐকমত্য না হওয়া পর্যন্ত রাজ্য ভাষা বিল আনা থেকে বিরত থাকার জন্য রাজ্য সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়। এছাড়াও ৩ তারিখের প্রকাশ্য সমাবেশ থেকে বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম রাজ্যভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে বৃহত্তর গণ আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দেওয়া হয়।

এই ভাষা সম্মেলন শেষ হবার পরদিন গৌহাটিতে একটি ছাত্র মিছিলের উপর পুলিশের গুলি চালনায় একজন ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে গোটা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় নারকীয় দাঙ্গার আগুন জ্বলে ওঠে। একের পর এক হিংসাশ্রয়ী ঘটনায় হাজার হাজার বাঙালিসহ অ-অসমিয়াদের উপর শারীরিক আক্রমণ ও তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তাঁরা বাড়িঘর, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে পালাতে শুরু করেন। অসমিয়া ভাষা কেড়ে নেবার জন্য শিলচরে বাঙালিরা সম্মেলন  করেছে বলে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় জোর  অপপ্রচার চালানো হয়। এদিকে সারা আসামে হিংসাত্মক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে কাছাড়ের সমস্ত বিধায়ক, সাংসদ এবং কংগ্রেসের বিভিন্ন জেলা কমিটির পক্ষ থেকে কেন্দ্রের সরকার ও কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতির কাছে আসামে চলতে থাকা দাঙ্গা অবিলম্বে বন্ধ করতে উপযুক্ত পদক্ষেপের দাবি জানানো হয়।

এই পরিস্থিতির মধ্যেই ১৯৬০ সালের ৭ জুলাই করিমগঞ্জে ভাষা সংগ্রাম পরিচালনার জন্য গড়ে ওঠে ‘ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’। এই কমিটি সিদ্ধান্ত নেয়, আসামে সংঘটিত জাতি দাঙ্গার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা, সমস্ত ভাষা ও জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য বজায় রাখা হবে। সেই সঙ্গে আসামের রাজ্যভাষা হিসেবে অসমিয়ার সঙ্গে বাংলাকেও স্বীকৃতি দেওয়া ও অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেবার দাবি উত্থাপন করে। এই লক্ষ্যে ধাপে ধাপে তীব্র গণ আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি শুরু করে। ১১ জুলাই এই কমিটির ডাকে করিমগঞ্জে সর্বাত্মক বন্ ধ পালিত হয়, বিকেলে অনুষ্ঠিত হয় জনসভা। ১২ জুলাই কাছাড়ের সাংসদ ও বিধায়কদের এক প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে স্মারকলিপি প্রদান করেন। একইভাবে রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদ সহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসামের পরিস্থিতি তুলে ধরেন। এভাবেই নানা ঘটনাবলির মধ্যে ১৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রী নেহরু শিলংয়ে আসেন। তিনি আসামের রাজ্যপাল জেনারেল নাগেশের কাছে কাছাড়ের ছাত্র-যুবদের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় উদ্যোগের জন্য ভূয়সী প্রশংসা করেন।

১৮ আগস্ট (১৯৬০) করিমগঞ্জ শহরে করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি ও শিলচরের ছাত্রনেতাদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে যেসব প্রস্তাব গৃহীত হয় তারমধ্যে ছিল–কাছাড় জেলায় স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল-ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, বেতার কেন্দ্র স্থাপনের দাবির পাশাপাশি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় হিংসাত্মক ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার শরণার্থীদের সুষ্ঠু পুনর্বাসন এবং বহুভাষিক রাজ্য আসামে অসমিয়া, বাংলা ও হিন্দিকে রাজ্যভাষা করতে হবে ইত্যাদি।

এরমধ্যে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থ আসামে আসেন ৫ অক্টোবর (১৯৬০)। তিনি দফায় দফায় রাজ্য সরকারের মুখপাত্র, প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ, কাছাড়ের কংগ্রেস দলের সদস্য, সাংসদ, ভাষা দাঙ্গায় পীড়িত ত্রাণ কমিটির প্রতিনিধি, অসমিয়া-বাঙালি ও পার্বত্য উপজাতীয় দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেন। কিন্তু সহমতের ভিত্তিতে কোনো সমাধান সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই  পরিস্থিতির মধ্যেই ১০ অক্টোবর আসাম বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা রাজ্য (সরকারি) ভাষা অসমিয়া করার বিল উত্থাপন করেন। ১৪ অক্টোবর ভাষাবিল সংশোধন করে সরকার। ১৮ অক্টোবর সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির সভাপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডি মুখ্যমন্ত্রী চালিহাকে এক জরুরি তারবার্তা পাঠিয়ে ভাষা বিলটি স্থগিত রাখার আবেদন জানান। এরপর ২২ অক্টোবর তদানীন্তন  কাছাড় জেলার সাতজন বিধায়ক নন্দ কিশোর সিংহ (মণিপুরী ভাষী), রণেন্দ্র মোহন দাস, হেমচন্দ্র চক্রবর্তী, তজমুল আলি বড়লস্কর,জ্যোৎস্না চন্দ,রামপ্রসাদ চৌবে ও গৌরীশঙ্কর রায় (হিন্দি ভাষী) বিতর্কিত ভাষা বিলটি স্থগিত রাখার দাবি জানান। এই সমস্ত দাবিকে উপেক্ষা করে ২৩ অক্টোবর কংগ্রেসের দলীয় সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, কোনো কংগ্রেস বিধায়ক সরকার উত্থাপিত ভাষা বিলে কোনো ধরনের সংশোধনী আনতে পারবেন না। এই পরিস্থিতির মধ্যে ২৪ অক্টোবর, ১৯৬০ আসাম বিধানসভায় বিলটি পাশ হয়। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বিধায়ক গোপেশ চন্দ্র নমঃশূদ্র এই বিলের বিরোধিতা করে বিধানসভা ত্যাগ করে বেরিয়ে আসেন। রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরী বিল নিয়ে আলোচনার আগেই বিধানসভা কক্ষ ত্যাগ করেন । এভাবে কাছাড় জেলার সমস্ত বিধায়ক বিধানসভা থেকে ওয়াকআউট করেন। ২৪ অক্টোবর রাজ্যভাষা বিলটি চূড়ান্তভাবে গ্রহণের জন্য বিধান পরিষদে উত্থাপিত হয়।  এর প্রতিবাদে আসামের তৎকালীন রাজধানী শিলংয়ে সেখানকার পার্বত্য নেতৃত্বের সংগ্রাম পরিষদ হরতালের ডাক দেয়। ২ নভেম্বর কাছাড় জেলায় সংগ্রাম পরিষদ গড়ে ওঠে। এছাড়া ২ ও ৩ নভেম্বর হোজাইয়ে নিখিল আসাম বঙ্গভাষী সম্মেলনের উদ্যোগে এক বিশাল কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। এভাবেই ধীরে ধীরে প্রতিবাদী আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে।

আন্দোলনের সূচনা

বরাক উপত্যকায় বাংলাভাষীদের উপর অসমিয়া ভাষা চাপিয়ে দেবার প্রতিবাদে ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি করিমগঞ্জ শহরে ‘কাছাড় জেলা জনসম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে সমগ্র কাছাড় জেলা থেকে প্রায় চারশো প্রতিনিধি যোগদান করেন। সম্মেলন থেকে ১ বৈশাখ,১৩৬৮ বঙ্গাব্দ থেকে কাছাড় জেলা জুড়ে অসহযোগ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই জনসম্মেলন থেকেই শিলচর, হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জ– এই তিন মহকুমায় গণ সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ৯ এপ্রিল, ১৯৬১ কাছাড় জেলা গণ সংগ্রাম পরিষদের এক সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১ বৈশাখ (১৪ এপ্রিল) কাছাড় জেলা জুড়ে সংকল্প দিবস পালিত হয়। সেই সঙ্গে পরদিন ১৫ এপ্রিল থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ মানুষকে সচেতন করে আন্দোলনমুখী করার লক্ষ্যে জনসভা, পদযাত্রা, মিছিল ইত্যাদি সংগঠিত হয়। আন্দোলনকারীরা প্রায় ২২৫ মাইল বরাক উপত্যকার গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার চালান। এই কর্মসূচির শেষে গণ সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয় যদি ১৩ এপ্রিলের (১৯৬১) মধ্যে বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা না হয় তাহলে ১৯ মে ব্যাপক হরতাল সংগঠিত হবে।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন,ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে কৃষক সভার কর্মীরা ১৯৬১ সালের ১৬ জানুয়ারি থেকে গ্রামেগঞ্জে পদযাত্রা শুরু করেন। কৃষক সমাজকে সচেতন করার লক্ষ্য নিয়ে এই পদযাত্রা সংগঠিত হয়েছিল। এই পদযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ দাবি ছিল সরকারের ভাষা বিলের পরিবর্তন। পদযাত্রীরা ৮ দিন ধরে প্রায় একশো মাইল ও শতাধিক গ্রাম পরিক্রমা করেন। সেই সঙ্গে দেড় শতাধিক ছোটো বড়ো সভা-বৈঠক করেন তাঁরা। এই গুরুত্বপূর্ণ পদযাত্রার নেতৃত্বে ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী ও আন্দামান সেলুলার জেল ফেরত প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা গোপেন রায় সহ যজ্ঞেশ্বর দাস, মুদরিস আলি, মইয়ব আলি,রমেন্দ্র শর্মা প্রমুখ। এই পদযাত্রার মধ্য দিয়ে গ্রামে গ্রামে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা সঞ্চার হয়েছিল।

সেই সময় কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় উদ্যোগে বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন ব্যাপক আকার নিয়েছিল। তখন কাছাড় জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা অচিন্ত্য ভট্টাচার্য, শ্রীহট্ট জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা বীরেশ মিশ্র। এছাড়া করিমগঞ্জ মহকুমার কংগ্রেস সম্পাদক ছিলেন স্বদেশ পালচৌধুরী, সহ সম্পাদক যজ্ঞেশ্বর দাস এবং সুনামগঞ্জ মহকুমার কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক ছিলেন লালা শরদিন্দু দে। তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন বিপ্লবী কমিউনিস্ট এবং সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই সমস্ত নেতৃবৃন্দ জীবনভর বহু আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। তাঁদের প্রচেষ্টায় বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপায়িত হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের ঠিক প্রাক্কালে ১৯৬১ সালের ১৬ মে করিমগঞ্জে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন অচিন্ত্য ভট্টাচার্য। এই সভা ভাষা আন্দোলনে বাড়তি মাত্রা সংযোজিত করেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা জরুরি, মণিপুরি সমাজে তখন কমিউনিস্ট পার্টির ভিত ছিল খুবই শক্তিশালী। বাংলাভাষার আন্দোলনে মণিপুরি সমাজও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিল।

610519_Borak_Language Movement01

আন্দোলনে দৃপ্ত ১৯ মে

সংগ্রাম পরিষদের ঘোষণা অনুযায়ী ১৯ মে শিলচর, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জসহ কাছাড় জেলার সর্বত্র হরতাল পালিত হয়। তার আগের রাতে করিমগঞ্জে কমিউনিস্ট পার্টির দপ্তর থেকে পার্টির নেতা ও বিভিন্ন গণ সংগঠনের কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়। বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সংগ্রাম পরিষদের অনেক নেতা-কর্মীকে। সেই খবর বিদ্যুৎ বেগে ছড়িয়ে পড়তেই ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে অগণিত মানুষ পথে নামে। সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনকে দমন করতে ১৪৪ ধারা জারি,গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারিসহ সর্বত্র পুলিশের উদ্যত মহড়া, ভীতি প্রদর্শন ইত্যাদি সরকারের স্বৈরাচারী পদক্ষেপের কোনো কিছুই বাদ ছিল না।

১৯ মে ভোর চারটা থেকে শিলচর রেল স্টেশনে আন্দোলনকারীদের অবরোধ শুরু হয়। করিমগঞ্জে আন্দোলনকারীরা সরকারি অফিস, আদালত, রেলওয়ে স্টেশন সর্বত্র পিকেটিং শুরু করেন। দোকানপাট, যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সর্বত্র শান্তিপূর্ণভাবেই সত্যাগ্রহ চলছিল। শিলচর স্টেশনে উপস্থিত বিপুল জনতা। এই অবস্থায় ট্রেন চালাতে উদ্যত হয় কর্তৃপক্ষ,তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে জেলা প্রশাসন। শুরু হয় লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ,সেইসঙ্গে সত্যাগ্রহীদের গ্রেপ্তার। গ্রেপ্তারের সঙ্গে সঙ্গেই শূন্যস্থান পূরণ করতে লাগলেন নতুন  সত্যাগ্রহীরা। সেদিন সমস্ত পথ যেন এসে মিশেছিল শিলচর রেল স্টেশনে,তখন যার নাম ছিল তারাপুর স্টেশন । এভাবেই একদিকে পুলিশ মিলিটারির তৎপরতা,লাঠিচার্জ, গ্রেপ্তার; অন্যদিকে সত্যাগ্রহীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ — এভাবেই কেটে যায় কয়েক ঘণ্টা। তারপর পরিবেশ-পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে। ২০০১ সালের ১৯ মে ‘যুগশঙ্খ’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে শিলচরের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক কর্মী অনন্ত দেবের বিবরণ থেকে জানা যায়, বেলা দু’টোর পর একটি বেডফোর্ড ট্রাকে পুলিশ কয়েকজন সত্যাগ্রহীকে গ্রেপ্তার করে লেভেল ক্রসিং পার হয়ে আসতে দেখে সেখানে আন্দোলনরত সত্যাগ্রহীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁরা ট্রাকটিকে থামিয়ে দারোগা, পুলিশের সামনেই হ্যান্ডকাফ পরা সত্যাগ্রহীদের ছিনিয়ে নেয়। সেই মুহূর্তে একজন অজ্ঞাত পরিচয় যুবক দৌড়ে এসে ট্রাকের পেট্রোল ট্যাঙ্কে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গেই উপস্থিত জনতা রাস্তার পাশের বালি দিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলে। এরপরেই গুলি চালায় সিআরপিএফ, সঙ্গে চলে পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জ। মোট ১৭ রাউন্ড গুলি চলে। ১২ জনের দেহে গুলি লেগেছিল। তাঁদের মধ্যে সেদিনই ৯ জনের মৃত্যু হয়, পরে মৃত্যু হয় দু’জনের। মাতৃভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে শহিদ হন ১১ জন ভাষাব্রতী।

সেই মহান শহিদেরা হলেন কমলা ভট্টাচার্য, কানাইলাল নিয়োগী,চণ্ডীচরণ সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস, কুমুদরঞ্জন দাস,সুনীল দে সরকার,সুকোমল পুরকায়স্থ, তরণী দেবনাথ,বীরেন্দ্র সূত্রধর, শচীন্দ্রনাথ পাল এবং সত্যেন্দ্র দেব। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, কমলা ভট্টাচার্য বিশ্বে প্রথম মহিলা ভাষা শহিদ।

১৯ মে যেদিন শিলচরে ভাষা সত্যাগ্রহীদের উপর কংগ্রেস সরকারের পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করেছিল,সেদিন সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু গৌহাটিতে এক সমাবেশে ভাষণ দেন। তিনি তাঁর ভাষণে অগ্নিসংযোগের জন্য পুলিশের গুলিচালানোর পক্ষে সাফাই দেন। কিন্তু একবারের জন্যও এতজনের প্রাণ যে অকালে ঝরে গেল তার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেননি।

এই মর্মান্তিক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় শিলচর সহ গোটা কাছাড় জেলায় প্রতিবাদী আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। ২০ মে শিলচরে কারফিউ উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ নয়জন শহিদের শবদেহ নিয়ে মিছিল করে দৃপ্তকণ্ঠে আওয়াজ তোলেন–“শহিদ স্মরণে জীবন মরণে রক্ত ঋণ শোধ করো”,” মাতৃভাষা  জিন্দাবাদ”,”বাংলাভাষা জিন্দাবাদ”,”শহিদ তোমায় ভুলিনি ভুলব না”…..বুকে কালো ব্যাজ,শোকে বিহ্বল, বিক্ষোভে উত্তাল জনতার শোকমিছিল গোটা শিলচর শহর পরিক্রমা করার পর শিলচর শ্মশানে নয় শহিদের অন্তিম সংস্কার হয়। পরদিন আরও দুই শহিদের (বীরেন্দ্র সূত্রধর, সত্যেন্দ্র দেব) দেহ রেল স্টেশন সংলগ্ন পুকুর থেকে উদ্ধারের পর তাঁদের দেহ নিয়েও একইভাবে শোকমিছিলে শামিল হন হাজারো মানুষ। শোকমিছিলের পর শিলচর শ্মশানঘাটে তাঁদেরও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

২১ মে কলকাতায় বামপন্থীদের এক বিশাল সমাবেশে ভাষা আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশের নৃশংস আক্রমণ ও  গুলিচালনার তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয় এবং ২৪ মে বাংলায় হরতাল পালিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা জ্যোতি বসু এক তারবার্তায় পুলিশের এই আক্রমণ ও গুলিচালনার তীব্র নিন্দা করেন। ২০ মে(১৯৬১) আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বিরাট হেডলাইনে লেখা হয়–

” কাছাড়ে বাঙালি নিধন: আসাম সরকারের বীভৎস চণ্ডনীতি”…

২৯ মে ভাষা শহিদদের তর্পণের দিনে কাছাড় জেলাজুড়ে  সর্বাত্মক বন্ ধ ও অরন্ধন দিবস পালিত হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন ধর্মীয় স্থানে প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

610519_Borak_Language Movement02

বরাকের ভাষা আন্দোলনকারীদের মিছিল।

বেসরকারি তদন্ত কমিশন গঠন

শিলচরে পুলিশের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে আসামের কমিউনিস্ট নেতা বীরেশ মিশ্রের উদ্যোগে বিশিষ্ট কমিউনিস্ট আইনজীবী স্নেহাংশুকান্ত আচার্যের মাধ্যমে একটি বেসরকারি তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশনের নেতৃত্বে ছিলেন বিখ্যাত ব্যারিস্টার এন সি চ্যাটার্জি। ১৯৬১ সালের ১২ জুন এই তদন্ত কমিশন শিলচরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তাদের প্রতিবেদন পেশ করেন। সেই প্রতিবেদনে স্পষ্টতই উল্লেখিত হয় যে,মাতৃভাষার দাবিতে আন্দোলন  সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ছিল। সে ক্ষেত্রে আসাম সরকারের পক্ষে বল প্রয়োগের দ্বারা আন্দোলন দমন করার কোনো যৌক্তিকতা ছিলনা। সাক্ষ্য প্রমাণে এটাই প্রতিভাত হয় যে, স্থানীয় প্রশাসনিক কতৃপক্ষ শিলচরে শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহীদের উপর গুলিচালনা এবং শিলচর ও করিমগঞ্জে লাঠিচালনা ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপের জন্য দায়ী। তারা ফৌজদারি আইন বা পুলিশ আইনের বিধান গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করেছেন। কমিশনের তদন্তে এটাও স্পষ্ট হয়েছে যে,প্রায় সব ক্ষেত্রে হতাহতদের কোমরের উপর গুলি লেগেছে। এর দ্বারাই প্রতিভাত হয় যে হত্যার উদ্দেশ্যেই গুলি চালানো হয়েছিল।

কমিশন তদন্তকালে এটাও জানতে পারে যে, সত্যাগ্রহ আন্দোলনের মধ্যে যাতে সাম্প্রদায়িক বিভেদ তৈরি হয় তারজন্য সরকারি প্রশাসন সক্রিয় ছিল।

আসাম সরকার যেভাবে আসামের ভাষা আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা করেছে এবং আসামের একশ্রেণির লোক যেভাবে অসমিয়াকরণের প্রচেষ্টায় উদ্যোগী হয়েছিল, তা বিশ্লেষণ করে কমিশনের এই ধারণা হয় যে,এই প্রচেষ্টা শুধু যে আসামের ভাষাগত সংখ্যালঘুদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করেছে তাই নয়, এর দ্বারা মানবিক অধিকারও লঙ্ঘিত হয়েছে। কমিশনের মতে কাছাড়ের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ আইনের সীমা এমনভাবে লঙ্ঘন করেছে যে, তারা আইনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থার আওতায় পড়তে পারেন। এই বেসরকারি তদন্ত কমিশন পুলিশের গুলিতে যারা হতাহত হয়েছেন,পঙ্গু হয়েছেন তাঁদের ও তাঁদের পরিবারবর্গকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত বলে অভিমত ব্যক্ত করে।

প্রসঙ্গত, ১৯ মে শিলচরে পুলিশের গুলি চালানোর ঘটনার তদন্তের জন্য বিচারপতি জি মেহেরোত্রাকে চেয়ারম্যান করে আসাম সরকার মে মাসের(১৯৬১) শেষে একটি তদন্ত কমিশন গঠনের ঘোষণা করে। কিন্তু তার রিপোর্ট পুরোপুরি চেপে গেলেও বেসরকারি তদন্ত কমিশন কাছাড়ের ভাষা আন্দোলনকারীদের উপর কংগ্রেস সরকারের প্রশাসন ও পুলিশের নৃশংস অত্যাচারের বীভৎসতা ও নির্মম সত্যকে উদঘাটিত করে দেয়।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, কেবল ১৯৬১ সালের ১৯ মে’র শহিদরাই নন, ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে এর পরেও বরাক উপত্যকায় রক্ত ঝরে, শহিদ হন। ভাষা আন্দোলনের ১২ তম শহিদ বিজন চক্রবর্তী (বাচ্চু), প্রাণ দেন ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট। এরপর ১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই প্রাণ দিতে হয় দিব্যেন্দু দাস(যিশু) এবং জগন্ময় দেব(জগন)-কে। যাঁরা যথাক্রমে  ১৩ ও ১৪ তম শহিদ। ভাষা আন্দোলনে বরাকের ১৫ তম শহিদ হলেন সুদেষ্ণা সিংহ। তিনি অসমিয়া ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষার অধিকারের জন্য প্রাণ দেন ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ বরাক উপত্যকার পাথারকান্দির  কলকলিঘাট স্টেশনে। এই পঞ্চদশ শহিদের প্রতি কেবল বরাক উপত্যকার মানুষরাই নন, দেশ তথা বিশ্ববঙ্গভাষীরা আনত শ্রদ্ধায় তাঁদের স্মরণ করে,তাঁদের ত্যাগ ও আত্মবলিদান থেকে শিক্ষা গ্রহণের চেষ্টা করেন।

ভাষা আন্দোলন ও আজকের প্রেক্ষিত

১৯৫২- র ২১ ফেব্রুয়ারি ও ১৯৬১-র ১৯ মে’র ভাষা আন্দোলনের রক্তরঞ্জিত ইতিহাস শুধু বাংলাদেশ বা আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালিদেরই নয়, সমগ্র বিশ্বে বাংলাভাষী মানুষ এবং মাতৃভাষার মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে ব্রতী সংগ্রামীদের আজও চেতনাদীপ্ত করে। এই দু’টি ঐতিহাসিক সংগ্রামেরই একটি অভিন্ন উজ্জ্বলতম দিক ছিল — দু’টি আন্দোলনই মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার আলোকে প্রবহমান ছিল। যদিও এখানে একুশের ভাষা আন্দোলনের সূত্রে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা আলোচনার অবকাশ  নেই এবং এক্ষেত্রে আলোচনার ধৃষ্টতা নেই এই লেখকের, জ্ঞানের পরিধিও সীমিত; তবুও সেখানকার রাজনৈতিক  ও সামজিক গতি প্রকৃতির দূরবর্তী পর্যবেক্ষণে প্রশ্ন জাগে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে বাংলাভাষার ব্যবহার ও মর্যাদা সঠিকভাবে রক্ষিত হচ্ছে কিনা এবং ঐতিহাসিক একুশের আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মাটিতে মৌলবাদী তৎপরতা বৃদ্ধিতে অসাম্প্রদায়িক-ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে কিনা এবং সংখ্যালঘুদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা কিছুটা হলেও বিঘ্নিত হচ্ছে কিনা তা নিয়ে কি প্রশ্নের অবকাশ থাকছে না?

610519_Borak_Language Movement03

শিলাচর রেল স্টেশনের সামনে ভাষা শহিদ স্মারক।

এই সূত্রে আমাদের নিজের দেশ ভারতের দিকে দৃষ্টিপাত করলে সহজেই স্পষ্ট হবে, এখানে যে উগ্র সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট-ধর্মী সরকার চলছে তারা হিন্দুরাষ্ট্র গড়ার পরিকল্পনায় বৈচিত্র্যময় এই দেশে অন্যান্য নানা ক্ষেত্রের মতো ভাষা-সংস্কৃতির উপরও ভয়ংকর আক্রমণ নামিয়ে আনছে। বিজ্ঞানকে অন্ধকারে রেখে, অপবিজ্ঞান-কুসংস্কারকে আশ্রয় করে মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণাকে জনমানসে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। এই লক্ষ্যে ইতিহাসকে নির্বিচারে বিকৃত করে চলেছে। করপোরেট-বান্ধব এই সরকার জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০-তে ভাষা নিয়ে যে সুপারিশ করেছে, সেখানে বহু ভাষাভাষীর এই বৈচিত্র্যময় দেশে ‘এক জাতি-এক দেশ-এক ভাষা’ র নামে হিন্দিকে চাপিয়ে দিতে চাইছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে সরকারের এই পদক্ষেপ দেশের ঐক্য ও সংহতির পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।

আসামেও চলছে এদেরই শাসন। এই রাজ্যে কট্টর হিন্দুত্ববাদী শাসনে গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকার, বিশেষ করে ভাষিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার পদে পদে হরণ করা হচ্ছে। বিশেষকরে বরাক উপত্যকায়  ৮০ শতাংশ মানুষ বাংলাভাষী। কিন্তু সেখানে দেখা যাচ্ছে, ১৯৬১ সালে ভাষা আন্দোলনের পর গৃহীত সংশোধিত ভাষা আইনকে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। এই আইনে বলা ছিল,এই অঞ্চলে সমস্ত সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহার বাধ্যতামূলক হবে। অথচ বিভিন্ন সরকারি নির্দেশিকা,প্রপত্র,নিয়মাবলি, সরকারি বিজ্ঞাপন, হোর্ডিং ইত্যাদিতে,নিযুক্তির পরীক্ষায় এবং সরকারি প্রশাসনিক কাজকর্মে ভাষা আইনকে অমান্য করার প্রবণতা প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই অপচেষ্টা ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। এভাবে বরাক উপত্যকায় ঐতিহাসিক ১৯ মে-র ভাষা আন্দোলনের ঐতিহ্য, বাংলা ভাষার অধিকারকে খর্ব করার কৌশলী প্রয়াস চলছে। লক্ষ করা গেছে এই আইন প্রয়োগের দাবি তোলার জন্য অনেককে ‘দেশদ্রোহী’ তকমা দিয়ে হেনস্তা পর্যন্ত করা হয়েছে। এছাড়া জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এন আর সি)-র নামে সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ ও তাদের বিপাকে ফেলার নানা রকম ছক কষা চলছে।’বিদেশি’-‘বাংলাদেশী’ তকমা দিয়ে এই অংশের গরিব শ্রমজীবী মানুষকে তাঁদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। একই সঙ্গে সংকীর্ণ রাজনীতির স্বার্থে ধর্মের নামে বিভাজনের সুড়সুড়ি দিয়ে পরিস্থিতিকে জটিল করার অপচেষ্টা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। রাজ্যের বিরোধী দল,বিশেষত বামপন্থী দলগুলি রাজ্যের ধর্মীয় ও ভাষিক সংখ্যালঘু বিরোধী, গণতন্ত্র বিরোধী সাম্প্রদায়িক সরকারের এই সমস্ত কার্যলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-আন্দোলন জারি রেখেছে।

 ১৯ মে-র অবিস্মরণীয় সংগ্রামের ৬২ বছর অতিক্রান্ত। তবু্ আজও  সোচ্চার দাবি ধ্বনিত হচ্ছে– মেহেরোত্রা কমিশনের রিপোর্ট সম্পর্কে সরকারকে তার বক্তব্য উপস্থাপিত করতে হবে; শিলচর রেল স্টেশনকে নামাঙ্কিত করতে হবে  ‘ভাষা শহিদ স্টেশন’ হিসেবে এবং ‘৬১-র সংশোধিত ভাষা আইন অনুযায়ী বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা সরকারের প্রশাসনিক সমস্ত কাজকর্মে চালু রাখতে হবে।

আজকের এই জটিল ও বিপন্ন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি হয়ে উঠেছে, ১৯ মে-র ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মরণে রেখে, এই আন্দোলনের চেতনাকে শানিত করে মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় সমস্ত প্রতিক্রিয়ার চক্রান্ত ও সাম্প্রদায়িক বিভেদ-বিচ্ছেদের বিরুদ্ধে একতার বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করা,একুশ-উনিশের সংগ্রামী চেতনাকে ধারণ করেই জনমানুষের প্রগতির অভিযাত্রাকে অগ্রগামী করা। 

প্রাসঙ্গিক তথ্য

* “বরাক উপত্যকার রক্তস্নাত বহমান ভাষা আন্দোলনের এক সৈনিকের ডায়েরি”, নিশীথ রঞ্জন দাস, সাবিত্রী পাবলিকেশন, ২০১২,করিমগঞ্জ।

* ” ভাষা সংগ্রামের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস”, সনৎ কুমার কৈরি, শিলচর, ১৪ মে, ২০০৮।

লেখক:
Sandeep Dey
সন্দীপ দে, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

*প্রকাশিত লেখার মতামত ও বানানরীতি লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই প্রকাশিত এ লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই। – সম্পাদক

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট