দেশভাগের অজানা অধ্যায় পর্ব: পাঁচ । ফরায়েযী আন্দোলন

Google+ Pinterest LinkedIn Tumblr +
ভারতবর্ষে যতগুলো ধর্মীয়, রাজনৈতিক-গনতান্ত্রিক, কৃষক আন্দোলন হয়েছে তার মধ্যে ফরায়েযী আন্দোলন একটি ব্যাপক প্রভাবশালী এবং সামাজিক পরিবর্তন সৃষ্টিকারী আন্দোলন। এই আন্দোলন তদানীন্তন সময়ে প্রভাব বিস্তার করেই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে তা নয়, এদেশের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির এক বিরাট পরিবর্তনও সাধন করেছে। সেই পরিবর্তন আজও আমাদের বাংলায় তথা ভারতবর্ষের মুসলমান সমাজে বিদ্যমান এবং দিনে দিনে সেটা ব্যাপকভাবে ওয়াহাবীবাদের সাথে মিশে যাচ্ছে।
ফরায়েযী আন্দোলন নিয়ে আলোচনার আগে ‘ফরায়েযী’ শব্দের অর্থ জানাটা খুব জরুরী।
‘ফরায়েযী’ শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ ফরায়েদ থেকে। ফরায়েদ হল ফরীদ্বাহ বা ফরীদ্বাতুন এর বহুবচন তবে ফার্সি ভাষার অনুকরনে  বাংলায় এর উচ্চারন হয় ফরায়েজ এবং তা থেকে ফরায়েযী। ধর্মে অবশ্য পালনীয় কাজগুলোকে নির্দেশ করে। সুতরাং এই অবশ্যপালনীয় কাজের জন্য যারা আন্দোলন করছে তাদের ফরায়েযী বলে। [এই ব্যাখ্যা দিয়েছেন মুইন উদ-দিন আহমদ খান]
ফারায়েযী আরবী ফরিযাহ, বহুবচন ফারায়েয, অর্থাৎ ফরয শব্দ থেকে উৎপন্ন । তারা ইসলামের পাঁচটি বিধির মধ্যে প্রথম দুইটিকেই ফরজ অর্থাৎ মুসলমানের অবশ্য কর্তব্য হিসেবে গ্রহন করে, বাকী তিনটি কুরান বা হাদীস সমর্থিত নয় বলে অস্বীকার করে। ইসলামের এই পাঁচটি বিধি হলঃ ফরজ, ওয়াজিব, সন্নত, মুস্তাহাব এবং মুবাহ। [ এই ব্যাখ্যা দিয়েছেন ব্রিটিশ সিভিলিয়ান উইলিয়াম হান্টার]
আমরা বেশ ভালো করেই জানি ফরায়েযী আন্দোলন শুরু করেছিলেন হাজী শরীয়তুল্লাহ এবং সেটা ১৮১৮ সাল থেকে। যেটি একটি ধর্মীয় সামাজিক আন্দোলন ছিল। আবার একটু গভীরভাবে বললে এই আন্দোলনকে ইসলামের ‘শুদ্ধিবাদী আন্দোলন’ও বলা চলে।
হাজী শরীয়তুল্লাহর এই আন্দোলনকে অনেকেই কৃষক আন্দোলনের সাথে মিলিয়ে ফেলেন কারন তার জীবদ্দশায় তিতুমীরের একটি কৃষক আন্দোলন হয়েছিল। তিতুমীরের ধর্মীয় চিন্তা ভাবনা আর হাজী শরীয়তুল্লাহর চিন্তা ভাবনার মধ্যে যথেষ্ট ব্যাবধান ছিল। তাদের দুজনের চিন্তা ভাবনায় কি পার্থক্য ছিল সেই আলোচনায় আমরা যাবো না।
ফরায়েযী আন্দোলনকে আমরা কৃষক আন্দোলন হিসেবেও মাঝে মঝে চিহ্নিত করে থাকি। কিন্তু কেন? হাজী শরীয়তুল্লাহর মৃত্যুর পর এই আন্দোলনকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন তারই সন্তান হাজী দুদু মিয়া। দুদু মিয়া নেতৃ্ত্বে আসার পর এই আন্দোলন ব্যাপকভাবে জনসম্পৃক্ততা পায় এবং আস্তে আস্তে ‘কৃষক’ আন্দোলনে রূপ ধারন করে। সুতরাং এই আন্দোলনকে আমরা দুটি ফেইজে ভাগ করতে পারি। প্রথমত হাজী শরীয়তুল্লাহ’র জীবদ্দশার অংশ এবং তার মৃত্যু পরবর্তি অংশ।
এই বিবরনে যাওয়ার আগে তদানণীন্তন মুসলিম সমাজের ধর্মীয় রীতিনীতি জানাটা আমার মনেহয় বেশ জরুরী। সেই সময়ের অর্থাৎ ১৮১৮ সালের পূর্বের সমাজ বিশ্লেষন করলে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ঠ্যগুলো চলে আসেঃ
১। পীর তন্ত্র
২। সুফি তন্ত্র
৩। বিভিন্ন উৎসব
৪। সুফী সমাজে শিয়াদের প্রভাব
৫। স্থানীয়ভাবে আচার—আচরন গ্রহন।
পীর এবং সুফিতন্ত্র নিয়ে ড. আব্দুল করিমের বিবৃতিটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ…তিনি বলেন, ‘পীরতন্ত্র বাংলায় উৎপন্ন হয়নি। কিন্তু মুসলমানগণ দীর্ঘদিন এখানে বসবাস করার ফলে স্থানীয় জনগনের (যাদের অনেকেই ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে) কাছ থেকে পীরতন্ত্র গ্রহন করে। ধর্মান্তরিত ব্যক্তিরা পীরের মধ্যে তান্ত্রিক গুরুর প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়। এছাড়া দরগাহ ও সমাধি সৌধের মধ্যে দেখে ‘চৈত্য’ বা ‘স্তুপা’কে। তিনি বহু সুফি সাধকের সাক্ষাতকার গ্রহন করেন। তারমতে বাংলার এই সকল সুফী সাধকেরা ‘শাহ’ অথবা ‘শেখ’ উপাধী ধারন করেন পরে যা আস্তে আস্তে ‘পীরে’ রুপান্তরিত হয়। তিনি শেষ পর্যন্ত বলেন,’ পীরতন্ত্র বা সুফিবাদই বাংলা অঞ্চলে সবচে জনপ্রিয় শক্তির উপাদান’!
স্থাণীয় ধর্মগুলোর সাথে প্রাক্তন ইসলাম ধর্ম কতটা মিশে ছিল তার প্রমান পাওয়া যায়  পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের ‘সত্যভিটা’য় যখন মুসলিম সমাধীর সন্ধান মেলে।
তখন আরো কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান বেশ জনপ্রিয় ছিল। যেমনঃ
বেড়া উৎসবঃ খোয়াজ খিজিরের জন্য নিবেদিত ‘বেড়া’ উৎসব। অষ্টাদশ এবং উনিশ শতকের বাংলায় ভাদ্র মাসের শেষ বৃহাষ্পতিবারে ধণী-দরিদ্র সবাই এই অনুষ্ঠান পালন করতো। নবাব সিরাজ উদ্দৌলাকেও এই উৎসব পালন করতে দেখা গেছে।সিরাজ উদ্দৌলার মৃত্যুর পরেও মূর্শিদাবাদের নবাবদের এই উৎসব পালন করার প্রমান পাওয়া যায়।
ঈদ ই মিলাদুন্নবিঃ ইসলামের শেষ নবী’র মৃত্যুদিন উপলক্ষ্যে এই অনুষ্ঠান যেখানে উচ্চস্বরে কোরাস গাওয়া হয়। সেই কোরাসে ফাতিহা পাঠ করা হয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এবং শেষে খাসী যবেহ করে অতিথিদের ভোজের ব্যাবস্থা করা হয় এবং মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করা হয়। পীরের মৃত্যুর দিনে মুরীদগন মাজারে কয়েকদিন অবস্থান করেন এবং আধ্যাত্মিক  অনুশীলন এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠান করে থাকেন।( এই অনুষ্ঠানটি বা মিলাদ আজও ভারতীয় মুসলিম সমাজে প্রচলিত)
তাজিয়া মিছিলঃ একসময় এই মিছিলটি ব্যাপক ভাবে বাংলায় প্রচলিত ছিল। মহররমের দশ তারিখে এই অনুষ্ঠানটি করা হত। তাজিয়া সম্পর্কে জেমস ওয়াইজ লিখেছেন, ‘তাজিয়া’ প্রতিটি মুসলিম প্রধান গ্রামে নিয়ে যাওয়া হত। প্রতিটি গ্রাম প্রতিবেশী গ্রামের চেয়ে জাকজমক সহকারে তাজিয়া নির্মানের চেষ্টা করত।‘ [বর্তমান সময়ের চিত্র সম্পুর্ন ভিন্ন]
মাতৃ বা উম্ম ই সিবিয়ানঃ তখনকার দিনে হিন্দু-মুসলিম দু’টি সমাজই বিশ্বাস করতো  ‘মাতৃ’ বা ‘উম্ম ই সিবিয়ান’ ১৮ মাস বয়স পর্যন্ত শিশুকে মূর্ছা যেতে সাহায্য করে। এই সময়ের মধ্যে  শিশু মূর্ছা গেলে ওঝার সাহায্যে শিশুকে আরোগ্য লাভ করানো হত।
জেমস ওয়াইজ এর মতে , একজন শিশু জন্মগ্রহন করলে অনেকগুলো অদ্ভুত প্রথা পালনের রেওয়াজ ছিল। গরমের দিনে ছয়দিন, শীতের দিনে একুশদিন ‘অশুচি ঘর’ বা ‘চাটিঘর’ এর দরজায় শিশুর জন্ম উপলক্ষে বাতি জ্বালানোর ব্যাবস্থা রাখা হত। ওয়াইজ আরো লিখেছেন একজন হিন্দু মাতা ঐ ঘরে ৬ দিন এবং একজম মুসলিম মাতা ঐ ঘরে দশদিন আবদ্ধ থাকতেন।
এই ধর্মীয় কালচার কতটা ভালোছিল আর কতটা ধর্মীয়ভাবে সাংঘর্ষিক ছিল সেটা আমাদের ভাবার বিষয় নয় বরং সেটা নিয়ে গবেষনা করবেন ইতিহাসবিদগণ, কারন আমরা ইতিহাস পাঠ করতে চাই এবং ইতিহাসের গতিপথ ধরে হাটতে চাই। হ্যা আপনি ইতিহাসের পথ ধরে হাটতে চাইলেই দেখবেন হাজী শরীয়তুল্লাহ’র ফরায়েযী আন্দোলন শুরু হওয়ার পর তিনি আস্তে আস্তে এই ‘সনাতন ইসলাম’ ধর্মীয় কালচারকে বন্ধ করে দেন এবং সেকারনে অনেক প্রাক্তন মুসলিমদের( সনাতন পন্থী ,যাদেরকে জেমস ওয়াইজ বলেছেন ‘সাবিকি’) সাথে তার বা তার অনুসারিদের সংঘর্ষও হয়। শুধু তাইনা হাজী শরীয়তুল্লাহর আন্দোলন  শুরুর প্রায় তিরিশ বছর পরেও দেখা যাচ্ছে বাংলার সাধারন প্রজা শ্রেণী তাদের ঘোষিত ‘নয়া’ ধর্ম নীতি মেনে নিচ্ছেন না। এর প্রমান হিসেবে সেই সময়ের একটি পত্রিকার একটি কলাম জেনে আসা যেতে পারে…[ সম্ভবত এই সংবাদটিই সর্ব প্রাচীন সংবাদ যা ফরায়েযী আন্দোলন নিয়ে করা ]
‘ফেরাজী মত চালাওন উপলক্ষে দাঙ্গা হাঙ্গামা । ওই সম্বাদ দাতার লেখা প্রমানেই প্রকাশ করা যাইতেছে যে উক্ত জেলার অন্তর্গত থানা রায়গঞ্জের অধিকৃত গুনিয়ারগাতি পল্লি নিবাসী মৌলিবি নিরুদ্দীন নামক এক দুরাত্তনা অনুমান ৩০০/৪০০ দাড়িয়া ফেরাজী যবন সমবিব্যাহারে গোবিন্দগঞ্জের নিকটস্থ পদুমশহর ইত্যাদি গ্রামের দরিদ্র যবনগণকে ফেরাজি মতাবলম্বি করাওন মানসে গমন করিয়াছিলেন। তাহাতে তাহদের উদ্দেশ্য সফল না হইয়া উপদেষ্টা উপদেশ্য এই উভয় দলে দাঙ্গা হাঙ্গামা ও রক্তারক্তি পর্যন্ত হইয়া গিয়াছে।‘[রঙ্গপুর বার্ত্তাবহ;উদ্ধৃতি,সংবাদ পর্ণচন্যোদয় ৬,১২,১৮৫০]
এখন প্রশ্ন হল কোন মূহুর্ত থেকে এই ধর্মীয় আন্দোলন বা ইসলামের শুদ্ধিবাদি পূনর্জাগরণ আন্দোলন আর্থ-সামাজিক কৃষক আন্দোলনে রূপ নিল? এক্ষেত্রে আমরা ফরিদপুর জেলার একটি কর ও খাজনার রিপোর্ট দেখতে পারি। সেখানে দেখা যাচ্ছে শ্রাদ্ধ খরচা, জমিদারের আগমনী খরচা, পৈতা খরচা, ভূরা খরচা, বাইন সেলামী,রথ খরচা, পেয়াদা খরচা, ভেট খরচা( প্রজার পরিবারে অনুষ্ঠিত শ্রাদ্ধের জন্য জমিদারকে দেয় উপহার), পেওরা খরচা, গাজী খরচা, ইমাম খরচা, দুর্গাবৃত্তি খরচা সহ প্রায় ২৩ প্রকারের অবৈধ খরচার একটি তালিকা।
হাজী শরীয়তুল্লাহদের শুদ্ধিবাদী ধর্মীয় আন্দোলন এই ধরনের খরচাকে  মেনে নেয়নি। তাদের ভাষ্য হলো এই ধরনের ‘খরচা’র জন্য খাজনা বা কর দেয়ার অর্থ হলো ‘পৌত্তলিকতা’ বা ‘শিরক” কে মেনে নেয়া যা পুরোপুরি তাদের আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে খাজনা বা কর না দেয়ার এই সূত্র ধরেই আস্তে আস্তে জমিদার শ্রেণীর সাথে সংঘর্ষের শুরু।
এবার আমাদের জানা দরকার হাজী শরীয়তুল্লাহ কে ছিলেন? কি ছিল তার পরিচয়? তার ঠিকুজি কি? আসলে বাজারে হাজী শরীয়তুল্লাহর জন্ম সংক্রান্ত কিছু মিথ প্রচলিত আছে যার উৎস তদানীন্তন গ্রামের মানুষদের দ্বারা রচিত পুথিগুলো। আমরা সেই মিথে আর যাবো না বরং তার জন্ম ঠিকুজি কিভাবে একটি শিলালিপির মাধ্যমে জানতে পেরেছি সেই ইতিহাসই আপনাদের জানাবো এবং সেটা পরের পর্বে।
গ্রন্থ সহায়তাঃ
বাংলায় ফরায়েযী আন্দোলনের ইতিহাস- মুইন উদ-দীন আহমদ খান।
উনিশ শতকে বাংলায় সংবাদ সাময়িক পত্র- মুনতাসীর মামুন।
দি ইন্ডিয়ান মুসলিমস- উইলিয়াম হান্টার।
ইস্টার্ন বেঙ্গল- জেমস ওয়াইজ।
(তারুণ্যের ভাবনা বিভাগের লেখা সম্পূর্ণভাবে লেখকের নিজস্ব ভাবনা। এ বিভাগের মতামতের সাথে বাঙালীয়ানা’র ভাবনার কোন সম্পর্ক নেই এবং লেখার জন্য সকল দায় লেখকের – সম্পাদক)

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.