অসুর বধের সুরযোদ্ধা সমর দাস

Comments

‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে
রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল
জোয়ার এসেছে জন-সমুদ্রে
রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল।।’

লাইনগুলো চেনা চেনা লাগছে? কানে বেজে উঠছে চিরচেনা সুরটি? শরীরে শিহরণ জাগছে? রক্ত কি টগবগ করছে? ভেতরে ভেতরে একটা কিছু নিশ্চয়ই হচ্ছে? জন্মযুদ্ধের গান কি সহজে ভোলা যায়! হ্যাঁ, জন্মযুদ্ধের গান, যে যুদ্ধ আমরা অনেকেই দেখিনি, তবু ১৯৭১ মানেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বছর, একটি স্বাধীন দেশের জন্মের বছর। কিভাবে ৭১’র সাথে আমরা নিজেদের এত তীব্র বন্ধন অনুভব করি? উত্তরে ফিরে যেতে হবে রক্ত টগবগ করা গানে,

‘শোষণের দিন শেষ হয়ে আসে
অত্যাচারীরা কাঁপে আজ ত্রাসে।।
রক্তে আগুন প্রতিরোধ গড়ে
রক্তে আগুন প্রতিরোধ গড়ে
নয়া বাংলার নয়া সকাল,
নয়া সকাল, নয়া সকাল।’

Samar Das03

সমর দাস

আমাদের শোষণের দিনগুলো শেষ হলেও মুক্তিযুদ্ধের সময়ে রচিত গানগুলো রয়ে গেছে প্রেরণার উৎস হয়ে। কি কঠিন সময় পেরিয়ে এই স্বাধীনতা এসেছে তা আমরা অনুভব করতে পারি মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গানের কথা আর সুরে সুরে। সেই সব গান প্রতিবাদের বীজ বুনে দিয়েছে আমাদের ভেতরে কোথাও। মাথায় গেঁথে থাকা সুর রক্তাক্ত একাত্তরকে ভুলতে দেয় না। কিন্তু আমরা কি তাদের চিনি, যারা লিখেছিলেন সেসব গান? কিংবা সেই সুর স্রষ্টাদের, যারা দুর্দান্ত সব গানের কথায় প্রাণ দিয়েছিলেন? যে প্রাণের টানে নতুন উদ্যমে জীবন বাজী রাখত মুক্তিযোদ্ধারা, বুলেটের সামনে বুক পেতে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে তৈরি করত নতুন করে সূর্য ওঠার পথ?   সমর দাস, তাদেরই একজন। বাংলা গানের অমর সুরস্রষ্টা তিনি।সঙ্গীত জীবনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় তিনি সৃষ্টি করেছেন অজস্র গান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর থেকে পরিচালিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক ও প্রধান সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সুরসৈনিক ও উপমহাদেশের খ্যাতিমান সঙ্গীত পরিচালক সমর দাসই গীতিকার গোবিন্দ হালদার রচিত মর্মভেদী কথাসমৃদ্ধ ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’ গানের সুরকার। তার সুর করা গান যুদ্ধকালীন মুক্তিবাহিনী এবং সাধারণ মানুষকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করত। ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’, ‘নোঙ্গর তোলো তোলো’, ‘চিরদিন আছে মিশে’ এবং ‘ভেবো না গো মা তোমার ছেলেরা’ গানগুলো  তাদের মধ্যে অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে সুরবিন্যাস করে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ মূল গানটি বিবিসি লন্ডন থেকে সামরিক ব্রাশ ব্যান্ডের পরিবেশনায় রেকর্ড করার দায়িত্বও পালন করেন তিনি।

বিখ্যাত যন্ত্রশিল্পী, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক সমর দাস ১৯২৯ সালের ১০ ডিসেম্বর,পুরানো ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে নবদ্বীপ বসাক লেনে এক সঙ্গীতশিল্পী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা জিতেন্দ্রনাথ দাস এবং মাতা কমলিনী দাস। পারিবারিকভাবে সঙ্গীতের আবহে বেড়ে ওঠেন সমর দাস। পিতার ছিল বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসা আর মা ছিলেন শিক্ষিকা। ঠাকুরদাদা রামদয়াল দাস এবং ঠাকুরমা মেঘমালা দাস। পূর্বপুরুষদের বসতভিটা বরিশাল জেলার গৌরনদীর ছবিখাঁরপাড়ে। বাদ্যযন্ত্র ব্যবসায়ের কারণেই পিতা জিতেন্দ্রনাথ ঢাকা লক্ষ্মীবাজারে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। পিতা ছিলেন সেই সময়ের নামকরা পিয়ানো টিউনার।

Samar Das06

সমর দাস

ছোটবেলা থেকেই তিনি ঝুঁকে পড়েছিলেন সুরের ভুবনে। প্রথমে পিতার কাছেই বেহালা বাদন শেখেন। পরে নর্থ ফিল্ড নামের এক মিশনারীর কাছে শেখেন পিয়ানো, গিটার এবং বাঁশি। সেই সঙ্গে অন্যান্য যন্ত্রসঙ্গীতেও দক্ষতা অর্জন করেন। অল্প বয়সেই গিটার ও পিয়ানো বাজানোর কারণে চারদিকে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল।সমর দাস যখন গিটার বাজাতে শেখেন, তখন তার নিজের কোনো গিটার ছিল না। জেঠতুত ভাই রবীন্দ্রনাথ দাস হাওয়াইন গিটার বাজাতেন, সেই বাজনা দেখেই তিনি এই বিষয়ে উৎসাহিত হয়ে ওঠেন। কিন্তু আনাড়ি হাতে এই গিটার ধরার জন্য ভাইয়ের অনুমতি ছিল না। বিষয়টি জিতেন্দ্রনাথ লক্ষ্য করেছিলেন এবং ছেলেকে কথাও দিয়েছিলেন একটি গিটার তিনি ছেলেকে কিনে দেবেন। সেই কথা তিনি রেখেছিলেন। বেশ কিছু বছর পর হলেও তিনি ছেলেকে কিনে দিয়েছিলেন গিটার। সংগীতপিপাসু বাবার ৪ সন্তানের মধ্যে কেবল সমর দাসই ছিলেন সংগীত-অন্তঃপ্রাণ। তবুও অন্যান্য পিতার মতো তিনিও চাইতেন সমর দাস পড়াশোনা করে সম্মানজনক কাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করুক। কিন্তু সমর দাসের মন পড়ে থাকত পিয়ানোর রিডে আর গিটারের সুমধুর তারে। সে সুরের টানে তিনি বুঁদ হয়ে থাকতেন দিবারাত্রি।

১৯৪৫ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি তৎকালীন অল ইন্ডিয়া রেডিও’র ঢাকা কেন্দ্রে বংশীবাদক হিসেবে সংগীত জীবনের সূচনা করেন এবং কলকাতা বেতারসহ কলকাতা এইচ.এম.ভি গ্রামোফোন কোম্পানিতেও যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে কাজ করেন। এ গ্রামোফোন কোম্পানিতে তিনি কমল দাসগুপ্ত, অনুপম ঘটক, কালিপদ বসু প্রমুখ সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পীর সান্নিধ্য লাভ করেন যা তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে ঢাকা কেন্দ্রিক নাগরিক সঙ্গীত ঐতিহ্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সঙ্গীত পরিচালক ও সুরকার সমরদাসের অবদানকে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বেতারে এবং ১৯৬১ সালে তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রে রেডিওর নিজস্ব শিল্পী হিসেবে যোগদান করেন তিনি। ১৯৬৬ সালে তিনি কিছুকাল করাচীতে পিআইএ সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গীত বিভাগের প্রধান ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র শিল্প গড়ে উঠলে তিনি সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে এর সঙ্গে যুক্ত হন। এখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত কাজ করেন। রেডিও-টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের জন্য তিনি অসংখ্য বাংলা গানের সংগীত পরিচালনা করেন।বাংলাদেশ সংগীত পরিষদ, শিল্পকলা একাডেমীসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সমর দাস।

মুখ ও মুখোশ

মুখ ও মুখোশ চলচ্চিত্রের পোস্টার

বাংলা ছায়াছবির সংগীত পরিচালক হিসেবেও সমর দাসের নাম স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি মুখ ও মুখোশ, লটারী, মাটির পাহাড়, আসিয়া, গৌরী, ধীরে বহে মেঘনা, রাজা এলো শহরে প্রভৃতি ছবির সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। নদীর সন্তান, নবারুণ, বীরাঙ্গনা সখিনা, সোনার সবুজ গাঁয়ে ছবির নৃত্যনাট্যের সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি। লাহোরে অনুষ্ঠিত আফ্রোএশিয় সঙ্গীত সম্মেলনে (১৯৬৪) উপস্থাপিত সোনার সবুজ গাঁয়ে নৃত্যনাট্যের প্রযোজনা ও সঙ্গীত পরিচালনা এবং লন্ডনে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ উৎসবে (১৯৬৬) সানস অব রিভার নৃত্যনাট্য পরিবেশিত হয় সমর দাসের পরিচালনায়। সমর দাসের মধ্যে মানবিক গুণেরও পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯৭০ সালে বঙ্গোপসাগরের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস হলে দুর্গত মানুষকে সহায়তা করার জন্য পল্টন ময়দানে ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো’ নামে একটি সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সমর দাস ছিলেন এর প্রধান উদ্যোক্তা।

১৯৭২ সালে কলকাতার এইচ.এম.ভি কোম্পানি ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ নামে একটি লংপ্লে রেকর্ড প্রকাশ করে যাতে রয়েছে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ২৬টি গান। সমর দাস ছিলেন এ রেকর্ডের সঙ্গীত পরিচালক। নবগঠিত বাংলাদেশ বেতারের সিগনেচার টিউন বা সূচনা সঙ্গীত সমর দাসের কম্পোজ করা। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ নামে দুটি এল.পি ডিস্ক প্রকাশ করার উদ্যোগ নিলে একজন সংগঠক ও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সমর দাস সেটাকে সফল করে তোলেন। ১৯৯৩ সালে ঢাকায় সাফ গেমসের সূচনা ও সমাপনী সঙ্গীত তিনি রচনা করেন।

তার সুরারোপিত আধুনিক গান, যেমন—‘তন্দ্রাহারা নয়ন আমার’ (হাসিনা মমতাজ), ‘পুরোনো আমাকে খুঁজে’ (শাহনাজ রহমতউল্লাহ), ‘লাজুক লাজুক চোখ মেলে ওই’ (ফেরদৌসী রহমান), ‘কাঁকন কার বাজে রুমঝুম’ (বশির আহমেদ), ‘কত যে ধীরে বহে মেঘনা’সহ (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়) বহু গান আমাদের এক অনির্বচনীয় সুর-সৌকর্যের জগতে নিয়ে যায়। প্রবীণ সঙ্গীতশিল্পী খুরশিদ আলম এক সাক্ষাৎকারে বলেন,

Samar Das02

‘১৯৬৬ সালে বেতারে অডিশন দিই। অডিশন নেন গুণী সুরকার রবীন্দ্রসংগীত বিশেষজ্ঞ আবদুল আহাদ সাহেব। শান্তিনিকেতন থেকে পাস করা। ছিলেন সমর দাস, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম পিলার তিনি। আর ফেরদৌসী আপা। গান শোনার পর সমর দাস বললেন, গলা খুব ভালো, কিন্তু তুমি একজনকে নকল করো। আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, ওই শিল্পী যত দিন আছে, তোমার গান কেউ শুনবে না। সবাই বলবে, খুরশিদ আলম গান গায় অমুক শিল্পীর মতো। সেদিন তাঁরা বললেন, গলা খুব ভালো।

পাস-ফেল বললেন না। সমর দাস বললেন, কোথায় থাকো? বললাম কাজী আলাউদ্দিন রোড। তিনি লক্ষ্মীবাজার থাকতেন। প্রতিদিন সকাল সাতটায় তাঁর বাসায় যেতে বললেন। বললেন, হাফ অ্যান আওয়ার আমি তোমাকে শেখাব। তিনি পিয়ানোতে ‘সা’ ধরে থাকতেন। ……. প্রথমে ৫ সেকেন্ডে, পরে ১০, ১৫, ২০ সেকেন্ড। করতে করতে ১ মিনিট, ২ মিনিট, ৫, ১০ মিনিট করে ধরে রাখতে লাগলেন।’

তিনি ছিলেন পূর্ণমাত্রায় শুদ্ধতা অর্জনে বিশ্বাসী। অত্যন্ত ধৈর্য নিয়ে তিনি গানের সুর তুলতেন, যন্ত্রবাদনের সঙ্গে সাযুজ্য আনতেন এবং কঠোরতার সঙ্গে শিল্পীর কাছ থেকে কাজ আদায় করতেন।

Samar Das05

সমর দাস একুশে পদক এবং ১৯৯৭ সালে স্বাধীনতা পদকসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত হন। এছাড়া সঙ্গীতে অবদানের জন্য তার কর্মবহুল জীবনে দেশে-বিদেশে বহু সম্মান পেয়েছেন। ঢাকায় ২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন তিনি। মৃত্যুর পরে তাকে ঢাকার ওয়ারীস্থ খৃষ্টান গোরস্থানে সমাহিত করা হলেও স্বাধীনতাকামী মানুষের চেতনায় যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন তিনি।

ফিচার ফটো গ্রাফিক্স: সৈয়দ মাহদী ইসলাম অয়ন

বাঙালীয়ানা/এজে

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.