।। মাল্যবান আশ ।।
সমাজ সংস্কারক, রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ হিসেবে আনন্দমোহন বসুর অবদান আমরা আজ প্রায় ভুলতে বসেছি। অথচ বাংলা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
আনন্দমোহন বসু তৎকালীন ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ জেলার জয়সিদ্ধি গ্রামের এক ভূস্বামী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে মেধা তালিকায় ৯ম স্থান অধিকার করে এনট্রান্স পরীক্ষা পাশ করেন, পড়তে আসেন কলকাতায়, প্রেসিডেন্সী কলেজে। বি এ পরীক্ষায় প্রথম হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে ইংল্যান্ড যান তিনি। সেখানে কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজ থেকে উচ্চতর গণিত বিষয়ে পড়াশোনা করেন। অনার্সসহ ডিগ্রি পরীক্ষা বা ট্রাইপসে প্রথম শ্রেণীতে পাস করে এশিয়ার প্রথম র্যাংলার হন তিনি। এই প্রসঙ্গে র্যাংলার উপাধিটির কথা একটু বলে রাখা ভাল, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রদত্ত হায়ার ম্যাথম্যাটিকসে সর্বোচ্চ ডিগ্রি। এরপর তিনি ব্যারিস্টারি পাস করেন, এবং দেশে ফিরে ১৮৭৪ সাল থেকে তিনি আইন ব্যবসা শুরু করেছিলেন।
ছাত্রজীবন থেকেই আনন্দমোহন ব্রাহ্ম ধর্মের সমর্থক ছিলেন। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর বোন স্বর্ণপ্রভা দেবীকে বিয়ে করেন তিনি। পরে কেশবচন্দ্র সেনের নাবালিকা কন্যার বিয়ে নিয়ে ব্রাহ্মসমাজের তরুণ সদস্যরা ভিন্নমত পোষণ করলে ১৮৭৮ সালে তিনি, শিবনাথ শাস্ত্রী, শিবচন্দ্র দেব এবং উমেশচন্দ্র দত্তকে নিয়ে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। তেরো বছর ধরে তিনি এর সভাপতি হিসেবে কাজ করেন এবং এ সময়কালে তিনি ব্রাহ্ম সমাজের জন্য কলকাতায় অনেকগুলি ব্রাহ্ম প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। একই সঙ্গে ১৯৭৯ সালে ছাত্রসমাজ নামে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের একটি ছাত্র সংগঠন চালু করেন। তিনি উপলব্ধি করেন যে, উপনিবেশিক পরিমন্ডলে সমাজের সচেতন শ্রেণি ছাত্রসমাজকে অবশ্যই দেশের সামাজিক এবং রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে এবং তাদের নিজস্ব একটি সংগঠন থাকা উচিত। বসু ১৮৭৫ সালে ‘ক্যালকাটা স্টুডেন্টস্ অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং একে মর্যাদা দেওয়ার জন্য তিনি নিজেই এর প্রথম সভাপতি হন।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বসু ১৮৭৬ সালে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন (Indian Association) নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, এর উদ্দেশ্য ছিল উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন সংগঠিত করা। ১৮৮৩ সালে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন একটি জাতীয় আলোচনা সভা আহবান করে। পরে এর থেকেই ১৮৮৫ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস জন্ম নেয়। যার সভাপতি হন উমেশচন্দ্র বনারজি। ১৮৯৮ সালের মাদ্রাজ অধিবেশনে আনন্দমোহন বসু কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন।
সমাজ সংস্কারক ও শিক্ষাবিদ হিসেবে আনন্দমোহন বসুর অবদান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। নারীশিক্ষার উন্নয়নের জন্য এবং সমাজ থেকে নিরক্ষরতা দূর করার জন্য সামাজিক কর্মসূচি প্রণয়ন করতে তিনি সকলকে আহবান জানান। ১৮৭৬ সালে তিনি কলকাতায় ‘বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তিনি বিদ্যালয়টিকে বেথুন স্কুলের সাথে সংযুক্ত করেন। তিনি কলকাতা সিটি স্কুলেরও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ১৮৭৯ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন সিটি কলেজ। যে কলেজ এখনও বর্তমান, এই কলেজের প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি বিপুল অর্থ সাহায্য করেন। ময়মনসিংহে তাঁর নিজের বাড়িতেও সিটি কলেজের একটি শাখা খোলা হয়। সিটি কলেজিয়েট স্কুল নামে প্রতিষ্ঠানটি এখনও বর্তমান। পরে এই কলেজের নাম হয় আনন্দমোহন কলেজ।
ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ইন্ডিয়ান এডুকেশন কমিশন বা হান্টার কমিশনের সদস্য মনোনীত করে। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেটেরও সদস্য এবং হন। তাঁর প্রচেষ্টার ফলে ‘Calcutta University Act of Incorporation’ এমনভাবে সংশোধন করা হয় যাতে এটি কেবলমাত্র পরীক্ষা নেওয়া ও ডিগ্রি দেওয়ার ভূমিকা থেকে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারে। ১৮৯২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গীয় আইন পরিষদে একজন সদস্য নির্বাচন করার অধিকার লাভ করে, যে সদস্যপদে নির্বাচিত হন আনন্দমোহন বসু। জাতীয়তাবাদী কগ্রেস নেতা হিসেবে বসু তীব্রভাবে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেন। ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর তিনি বঙ্গভঙ্গবিরোধী এক সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং নিজের পক্ষাঘাত জনিত অসুস্থতা উপেক্ষা করে জনসমাবেশে ভাষণ দেন। ১৯০৬ সালের ২০ আগস্ট জগদীশ বসুর বাড়িতে আনন্দমোহন বসুর মৃত্যু হয়।
লেখক:
মাল্যবান আশ
বাংলা সাহিত্যের ছাত্র মাল্যবান লিটল ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখালিখি এবং চলচ্চিত্র নির্মাণে সমান উৎসাহী।