সময়ের সাহস কামাল লোহানী – শেষ পর্ব । সাগর লোহানী

Comments
ক্লাস ওয়ানে পড়বার সময় আমার স্কুলের এক অনুষ্ঠানের নৃত্যাংশে আমার নাম দিয়েছিলে আমাদের গানের আপা জাহানারা ইসলাম। আমি তো অবাক, আমি নাচবো কিভাবে তাও আবার মেয়েদের সাথে! ক্লাসমেট আসমা হবে আমার বাইদানী। ‘বাবু সেলাম বারেবার’ গানের সাথে নাচতে হবে। আমি তো লজ্জায় মাথা তুলতেই পারছি না। গানের আপা হেসে বলেছিলেন ‘তোমার বাবা এত ভাল নাচেন আর তুমি লজ্জা পাচ্ছো?” সেই প্রথম জেনেছিলাম নৃত্যশিল্পী বাবার পরিচয়।
হঠাৎ করে কামাল লোহানী নৃত্যশিল্পী হয়ে ঊঠেছিলেন। কিন্তু কিভাবে তিনি বাফার নৃত্যদলে যুক্ত হয়ে পড়লেন! বাবা তাঁর স্মৃতি কথায় এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত লিখেছেন। তাঁকে নির্বাচনের কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন:
“জি এ মান্নান নাচের জন্য ছেলেমেয়ে সংগ্রহ করলেন। কিন্তু দেখা গেল প্রয়োজনীয় সংখ্যক ছেলে পাওয়া যাচ্ছে না। তখন তিনি তাঁর জ্ঞাতিভাই একজনকে দিয়ে একটি ছেলের জায়গা পূরণ করলেন। একাডেমি থেকে নিয়মিত শিক্ষার্থী দুজনকে পেলেন। আরও যে প্রয়োজন। কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। একদিন আমাকে তিনি ডেকে পাঠালেন। তাঁর সাক্ষাতকার এবং তাঁর নৃত্যকর্ম সম্পর্কে আমার যে দুটি দীর্ঘ লেখা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তা থেকে তাঁর ধারণা হয়েছিল আমার বোধহয় নাচের প্রতি আগ্রহ আছে। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে আমি ওয়াইজঘাটের বুলবুল একাডেমির ভবনে উপস্থিত হলাম। তিনি তখন বুলবুল একাডেমি ভবনের দক্ষিণ পূর্ব কোণের ছোট্ট একটি ঘরে বাস করতেন। আমি গিয়ে পৌছলাম যখন দেখলাম জি এ মান্নান নাইট গাউন পড়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন।
ঘরে ঢুকতেই তিনি আমাকে বললেন, “দাঁড়াও তো দেখি”।
আমি চমকে দাঁড়িয়ে গেলাম।
তারপর তিনি আপাদমস্তক তাকিয়ে দেখে বললেন, ‘হবে।’
আমি বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হবে।”
জবাবে তিনি বললেন, “আমার নাচের একটি ছেলে দরকার, তোমার ফিগার সুন্দর এবং যা চাইছিলাম সেটাও ঠিক আছে। সুতরাং তোমাকে নাচতে হবে।”
আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। বসতেও ভুলে গেছি। এবার তিনি বললেন, ‘বসো’। যখন জিজ্ঞেস করলাম বিস্তারিত তখন জানতে পারলাম নাচের যে মৌলিক চাহিদা আমাকে দাঁড় করিয়ে সেটাই তিনি পরখ করলেন।
আমি তাঁকে বললাম, “আমি তো কোনওদিন নাচ শিখিনি, কী করে নাচবো।”
তিনি বললেন, “ওটা আমার ব্যাপার।”
অবশেষে সাংবাদিক কামাল লোহানী, ‘নকশীকাঁথার মাঠ’ ব্যালে’তে অংশগ্রহণের জন্য মনোনীত হলো। কিন্তু আমার ভয় তাল, লয়, ছন্দ, নাচের ভঙ্গীমা, অভিনয় এসব কোনও কিছুই তো আমার জানা নেই। আমি ছাত্র রাজনীতি থেকে জেল খেটে সবে সাংবাদিকতা শুরু করেছি। মনের কোণে একটা আত্মসম্মানবোধও আমাকে খোঁচাতে থাকল। আমি তো সাংবাদিক নাচিয়ে হবো কী করে, তাতে সামাজিক মর্যাদা কী ক্ষুন্ন হবে না? যা হোক অবশেষে লজ্জা এবং মর্যাদাবোধ কাটিয়ে দলে ভিড়ে গেলাম। বুলবুল একাডেমির নাচের নিয়মিত ছাত্র অজিত দে, জ্যাকব পিউরিফিকেশন ও দুলাল তালুকদার ওরা তো ইতিমধ্যেই অনেককিছু শিখে ফেলেছেন। এঁদের সাথে আমি এবং আনোয়ার একেবারে নবিশ। আর নকশীকাঁথার মাঠে ঘটকের চরিত্রে মহিউদ্দিন আহমেদ নামে এক বয়োজেষ্ঠ ব্যক্তিকে জি এ মান্নান হাজির করলেন। ভদ্রলোকের স্টিফ বডি। ছেলেদের মধ্যে আমরা এই ক’জন আর মেয়ে ঝুনু, কচি, নার্গিস, শিলা এঁরা নাচে সিদ্ধহস্ত। রিহার্সাল যখন শুরু হল আমার আর আনোয়ারের না পারাটা ওদের হাসির খোরাক হয়ে দাঁড়াল। জি এ মান্নান নাছোড়বান্দা আর আমারও জেদ চেপে গেল, কেন পারব না। আমি তখন দৈনিক আজাদে চাকরি করতাম। জি এ মান্নান আমাকে বুলবুল একাডেমিতে থাকার ব্যাবস্থা করলেন। কারণ আমার রিহার্সালটা বেশি করা দরকার। কুমিল্লা থেকে সুবল দাসগুপ্তকে নিয়ে আসলেন, ‘নকশীকাঁথার মাঠ’-এর তালযন্ত্রের বাদক হিসেবে। হ্যাংলা-পাতলা লম্বা মানুষটি আমাকে এবং পরে যোগ দেওয়া আলতামাস আহমদকে রাত্রি দুটো আড়াইটা পর্যন্ত তালযন্ত্রের সাথে প্রাকটিস করাতে থাকলেন। খুব বেশিদিন লেগেছিল বলে মনে হয় না। আমরা পুরনোদের সঙ্গে একইভাবে দাড়িয়ে গেলাম। ……..  মজার ব্যাপার হল এক ঘন্টা দশ মিনিটের ব্যালের সম্পূর্ণ সংগীতাংশ, টাইম মিউজিকসহ সুবলদার একেবারে মুখস্থ ছিল। একটি বিটও তাঁর ভুল হতো না। অদ্ভুতভাবে আমরা লক্ষ করেছি সুবল দাসগুপ্ত যেখানে বসতেন তাঁর আশেপাশে তবলা, বাংলা ঢোল, ঢোলক, ড্রাম, ঝাঁজ, মন্দিরা, খঞ্জনি, করতাল, খমক এসবগুলো থাকত। ব্যালের বিভিন্ন দৃশ্যের প্রয়োজনে সুবলদা একেকটি যন্ত্রে তাঁর জাদু দেখাতেন। অসীম ক্ষমতাধর এই মানুষটি সংগীতের পবিত্রতা কখনই নষ্ট হতে দেননি। অথচ ভীষণ রসিক এবং তীক্ষ্ণ সমালোচক ছিলেন। আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ, কারণ তিনি আমাকে তাল এবং ছন্দের প্রশিক্ষণ দিয়ে অল্প দিনের মধ্যেই চৌকষ করে তুলেছিলেন।“
ফিরে আসি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের এক সন্ধ্যায় মতিঝিল কলোনীর আইডিয়াল স্কুল গেটের মুদি দোকান থেকে কিছু একটা কিনে আমি ফিরছি, হঠাৎই পথে শুনতে পেলাম কোন এক বাড়ীতে অনবধানতায় একটু জোরে বাজানো স্বাধীন বাংলা বেতারের খবর। গলাটা খুব পরিচিত মনে হলো তবে নাম শুনতে পারিনি। কিছুক্ষণ শুনে বাসায় ফিরে চুপিচুপি নানীকে বললাম, ‘বাপি স্বাধীন বাংলা বেতারে গেছে, তাই না?’ নানী কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, না না তুই ভুল শুনেছিস, দুলাল তো গ্রামের বাড়ী গেছে।‘ নানী তখন আমার কাছে এড়িয়ে গেলেও রাতে মার সাথে ফিসফিস করে এ প্রসঙ্গে কথা বলতে শুনলাম।
এর কিছুদিনের মধ্যেই এক সকালে বড় মামা আমাকে, আমার পিঠাপিঠি ছোট বোন বন্যাকে আর আমাদের নানী বেলা মজিদকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন সঙ্গে আরও কয়েকজন। এদের মধ্যে মনে আছে দ্বিতীয়বারের মত আগরতলা গেলেন বাদল রহমান, মেসবাহউদ্দিন সাবু, আরও মনে পড়ে সঙ্গে ছিলেন খিজির ভাই।
বড় মামা এপ্রিলের শেষ দিক থেকেই বিভিন্ন পথে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের আগরতলা পৌঁছে দেবার কাজটি করতেন খুব সফলতার সাথে। বড় মামা সৈয়দ মঞ্জুর হোসেনের ঢাকা স্টেডিয়ামে একটা দৈনিক পত্রিকা ও সাময়িকীর দোকান ছিল, থাকতেন নবাবপুর রোডে আরজু হোটেলের পিছনে। তিনি ছিলেন প্রায় ৬ ফুট লম্বা মেদহীন শরীরের অধিকারী, চেহারাটা দেখলে অবাঙালী বলেই মনে হত আবার চোস্ত উর্দূতে অনর্গল কথা বলতে পারতেন। তিনি সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালে অসংখ্য মানুষকে সীমান্তের ওপারে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে বা আশ্রয় শিবিরে পৌঁছে দিয়েছেন, ক্যাম্প থেকে চিঠি, তথ্য আর ঢাকা থেকে চিঠি, ম্যাপ, টাকা-পয়সা আনা নেয়া করতেন। আমাদের বাড়ীটা ছিল ট্রানজিট ক্যাম্প।
আমাদের বলা হলো গ্রামের বাড়ীতে যাচ্ছি। তবে মামা একটা ভিন্ন গ্রামের নাম শিখিয়ে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন কেউ জিজ্ঞেস করলে ঐ গ্রামের নাম বলতে। আমাদের বাসায় ‘পানি’ বলার চল ছিল না, বলতাম ‘জল’। মামা পথে কখনও জল যেন না বলি সে নির্দেশও দিয়েছিলেন। প্রথমে বাসে কিছুদূর তারপর নৌকা, হাঁটা আবার নৌকা, হাঁটা পথে আগরতলা পৌঁছে কিছুদিন সেখানে থেকে মামা কলকাতা পৌঁছে দিয়ে বাবাকে খবর পৌঁছে ফিরে গেলেন ঢাকায়। উঠলাম আমহার্ষ্ট স্ট্রিটে প্রতাপ হাজরার আত্মীয়ের বাড়ীতে, তিনি ছিলেন কলকাতা পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বাড়ীর কেউ আমাদের অবস্থান পছন্দ করছিলেন না বুঝতে পারতাম। আমাদের থাকতে দেয়া হল বিশাল বাড়ীর বিশাল রান্নাঘরের পাশে ছোট্ট একটা ঘর সম্ভবত ষ্টোররুমে। মেঝেতে সতরঞ্চি বিছিয়ে বালিশ ছাড়া নিজেদের কাপড় মাথায় দিয়ে আমরা শুতাম। দ্বিতীয় দিনে আমার খুব জ্বর এলো, হাই টেম্পারেচার ১০২-৩ ডিগ্রির নিচে নামতো না। মনে আছে সারাক্ষণ নানী আর বন্যা মাথায় জলপট্টি দিত। যা হোক ২ দিন পরে বাবা এলেন আমার ঐ অবস্থা দেখে বেরিয়ে গেলেন এবং পরদিন সকালে একটি বাসা ভাড়া করে এসে আমাদের নিয়ে ওঠালেন ‘বন্ডেলগেট’ এ। ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধপত্র দিয়ে তিনি আবার চলে গেলেন। সপ্তাহে এক দু’বার বাবার দেখা পেতাম, আমাদের সাথে দেখা করতে এলে।
এদিকে পাক আর্মি মাকে খুঁজতে স্কুলে হানা দিল, হেডমিস্ট্রেস রওশন সালেহা মাকে বললেন, ‘ওরা যখন তোমার খোঁজ শুরু করেছে নিশ্চয়ই বাসাতেও যাবে তুমি এখনই বাসা ছেড়ে সরে যাও আর যত দ্রুত পারো লোহানী সাহেবের কাছে চলে যাও’। ততদিনে মা’র খুব কাছের কয়েকজন কলিগ, মীরা খালাম্মা (রওশন আরা খান), সাহেদারা খালাম্মা (সাহেদারা কামাল, রাজনীতিক মোস্তফা কামাল হায়দারের স্ত্রী) সেলিনা খালাম্মা (সেলিনা মান্নান, এসিটেন্ট হেডমিসট্রেস), সেলাই আপা (আনোয়ারা বেগম, আমরা মামীমা বলতাম) এঁরা জানতেন যে বাবা স্বাধীন বাংলা বেতারে কাজ করছেন। মা ঢাকায় চাকরিরত বাবার এক ফুপু আমাদের নুরী দাদীকে বাসায় রেখে কিছুদিন মগবাজারে ক্রান্তির সদস্য ফেরদৌস মামাদের (সৈয়দ ইকবাল নাজমী, মুক্তিযোদ্ধা) বাড়ীতে আত্মগোপনে থেকে আগষ্ট মাসে উর্মিকে নিয়ে বড় মামার সঙ্গে কলকাতা পৌঁছলেন। ফেরদৌস মামার দুই বোন, আনজুম, কুসুম, ওদের বাড়ীটা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সেফহাউজ। মাকে পেলাম কিন্তু বাবাকে সেই সপ্তাহে দু’একবার। অবশ্য পরে নভেম্বরের দিকে বাবা রাতে বাসায় ফিরতেন এবং সকালেই বের হয়ে যেতেন।
স্বাধীন বাংলা বেতারে নিজের লেখা কথিকা পাঠ করতে মা প্রায়ই যেতেন বালীগঞ্জের অফিসে। সেসময়ে আমার সুযোগ হতো মা’র সাথে যাবার। সে বয়সে আমার রাস্তা চিনবার একটা বিশেষ গুণ থাকায় এই বাইরে যাবার সুবিধাটা আমার ছোট দু’বোনের তুলনায় আমি বেশী পেতাম। মা এবং নানী দীর্ঘকাল কলকাতায় বসবাস করেও মনে করতেন ২০/২২ বছরে কলকাতা অনেক পালটে গেছে। তাই আমায় সঙ্গে রাখতেন তাঁরা। যা হোক সেভাবেই আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে যাবার এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে খুব কাছ থেকে দেখবার। যেমনভাবে বাবাকে দেখেছিলাম তাঁর কর্মস্থল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে, দেখেছিলাম তাঁরা বেতার কর্মীরা কিভাবে মেঝেতে খবরের কাগজ পেতে ঘুমোতেন কিম্বা বিশ্রাম নিতেন।
তিনি যে তাঁর সংগ্রাম ও লড়াইয়ে কতটা একনিষ্ঠ ছিলেন এখন তা বুঝতে পারি। যখন কোন কাজে একবার ঢুকে পড়তেন তখন তাতে একেবারে মগ্ন হয়ে নিজের সবটুকু সাধ্য ঢেলে দিতেন। এক্ষেত্রে আমার মা ছিলেন তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তি। সেকারণেই বাবা মার উপর পুরো পরিবারের ভার দিয়ে ঢাকা ছেড়েছিলেন আবার ৭১ এর ২১ ডিসেম্বর রাতে কলকাতায় আমাদের রেখে এক কাপড়ে ঢাকা ফিরতে বাসা ছেড়েছিলেন। আমাদের কি হবে ভাবেননি শুধু মাকে বলেছিলেন, ‘স্বাধীন বাংলা বেতারে যোগাযোগ ক’রো ওরাই ঢাকা ফেরার সব ব্যবস্থা করবে’। আমরা ফিরেছিলাম প্রায় দেড় মাস পরে, জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহে।
ঢাকা ফিরলাম গোয়ালন্দ হয়ে লঞ্চ আর বাসে। ঢাকায় ফিরে উঠলাম বড় মামার গুলিস্তান রেল কলোনীর বাসায়। এখন যেটা ওসমানী উদ্যান সেখানেই তখন উপরে টিন পাশে বেড়াঘেরা রেল কলোনী ছিল। শুনলাম মতিঝিল কলোনীর আমাদের বাসায় মা ঢাকা ছাড়বার সময় আমাদের যে দাদীকে রেখে গেছিলেন, পাশের বাড়ীর এস্টেট অফিসার গোফরান ভূঁইয়া দাদীকে উৎখাত করে আমাদের জিনিষপত্র লুট করে বাড়ীটা অন্যের নামে এলট করে দিয়েছে। ১৬ ডিসেম্বরের পরে মুক্তিযোদ্ধারা গোফরান সাহেবকে ধরে নিয়ে উত্তমমধ্যম দিয়ে কলোনীর ব্যায়ামাগারে আটকে রেখে বাবাকে খবর দেয়। বাবা তখন ঢাকা এসে সরকার নির্ধারিত পূর্বাণী হোটেলে থাকতেন। বাবা মুক্তিযোদ্ধাদের গোফরান সাহেবকে ছেড়ে দিতে বলেছিলেন আর গোফরান সাহেবকে বলতে বলেছিলেন বাড়ীটা যেন মার নামে ফিরিয়ে দেয়। শুনে আমাদের খুব রাগ হয়েছিল বাবার উপর। তাঁদের এত কষ্টে তৈরী সংসারের খাট, আলনা, হাঁড়িপাতিল এমন কি দরজার ‘হুড়কা’ পর্যন্ত লুটে নিয়েছিল গোফরান সাহেব। আমার কষ্ট হয়েছিল, রাগও হয়েছিল আমার ফুটবল আর ব্যাডমিন্টন র‍্যাকেটের জন্যে। অনেকদিন পরে বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলাম কেন গোফরান সাহেবকে সেদিন শাস্তি দিলেন না। বাবা বলেছিলেন, ‘দেশটা তো পেয়েছি, খাট পালং আবার হবে জানতাম কিন্তু দেশের প্রত্যেক মানুষ যদি মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের উপরে হওয়া অন্যায়ের বিচার নিজেই করতে শুরু করে তাহলে স্বাধীন দেশটা অরাজকতায় সবই তো হারাবে।‘
এতটা মানবিক দেশপ্রেমিক কি আমরা হতে পারবো? একারণেই বোধহয় তিনি জীবনের শেষদিন তক যে কোন মানুষের বা জনগোষ্ঠীর আর্তনাদে বন্ধুর হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সে বন্যা, ঘুর্ণিঝড়, খরা, মন্দা হোক আর মানুষের স্কুল কলেজে ভর্তি, চাকরি, থাকবার জায়গা, খাবার ব্যবস্থা হোক বাবার কাছে সাহায্য চেয়ে পাননি এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর হবে। দুর্গত মানুষের সাহায্যে ছুটে গেছেন দুর্গত এলাকায়, ঢাকার রাস্তায় ‘ভিক্ষা দাও গো পুরবাসী’ গেয়ে চাঁদা তুলেছেন তাদের জন্যে মিছিল করে।
পড়ুন
সময়ের সাহস কামাল লোহানী – প্রথম পর্ব 
বাবাকে আজীবন দেখেছি এক অসমসাহসী মানুষ হিসেবেই। কখনো কখনো মনে হতো একেই বোধহয় বলে দুঃসাহস। শোষণ, অন্যায়-নিপীড়ন, সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী আস্ফালন, সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন উচ্চকন্ঠ। শোষণহীন সমাজ গঠন ও সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে জনগণের অধিকার আদায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমলের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৫৪ ধারা, চতুর্থ সংশোধনী, সংবাদপত্র অ্যানালমেন্ট অ্যাক্ট, জেনারেল জিয়া আমলের ইন্ডেমনিটি অ্যাক্ট, ৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল অ্যাক্ট বাতিল, পঞ্চম সংশোধনী, যুদ্ধাপরাধী শিরোমণি কুখ্যাত গোলাম আযমের বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রবর্তন, রাজনীতিতে জামাত পুনর্বাসন, সামরিকবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা বিনাশ, খালেদ মোশাররফ, এটিএম হায়দার, তাহের, মঞ্জুর হত্যা, সামরিক জেনারেল এরশাদ আমলের অষ্টম সংশোধনী, জিয়া হত্যা বিচারের নামে মুক্তিযোদ্ধা সামরিক অফিসার হত্যা, মুজিব হত্যাকারীদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসন, খালেদা জিয়া আমলে গোলাম আযমের নাগরিকত্ব দান, যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানানো, ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলা, শেখ হাসিনা আমলে জঙ্গিবাদের উত্থান, উদীচী-সিপিবি-ছায়ানট সমাবেশে বোমা হামলা, ব্লগারহত্যা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্বে ৫৭ ধারা ও ডিজিটাল আইন, দুর্নীতি, ইত্যাদি কিম্বা রাজনৈতিক-সামাজিক কলুষতার বিরুদ্ধে কামাল লোহানীর কলম এবং কন্ঠ ছিল দুর্বিনীত। তিনি শাসকের রক্তচক্ষুর তোয়াক্কা করেননি, অন্যায়ের বিরূদ্ধে আপোস করেননি।
ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দীন সামরিক শাসনে যখন রাজনৈতিক নেতারা কেউ জেলে, কেউ গর্তে, কেউবা গোয়েন্দা দপ্তরের ছুঁড়ে দেয়া রুটির অপেক্ষায় লালায়িত, যখন তথাকথিত “বুদ্ধিজীবী”রা টুঁ শব্দটি করছেন না তখন বিভিন্ন ‘ঘরোয়া’ সমাবেশে কামাল লোহানী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে একের পর এক জোরালো বক্তৃতা দিচ্ছেন। আমার মনে আছে ‘উদ্দীন’দের শাসনামলে কাকরাইলের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ নামে জামাতের প্রহসনের আয়োজনে মুক্তিযোদ্ধার পিঠে লাথি মারা হয় তখন আমরা তার প্রতিবাদে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এক সমাবেশের আহ্বান করি, আলোচনায় অংশ নেন রাজনীতিক অজয় রায়, শহীদ জায়া মিলি রহমান, সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ, কামাল লোহানীসহ আরও কয়েকজন জেষ্ঠ্য ব্যক্তি। আলোচনা সভা শেষে আমরা অপেক্ষাকৃত তরুণেরা বিক্ষোভ মিছিলের আহ্বান জানালে অনেকেই সামরিক আইনে নিষিদ্ধ মিছিলের জোরালোভাবে বিরোধিতা করেন কিন্তু আমরা বিক্ষোভ মিছিল শুরু করি এবং প্রেস ক্লাবের দিকে অগ্রসর হই, সেখানে পুলিশের বাধার মুখে কিছুক্ষণ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে আমাদের মিছিল শেষ করি। সেদিন সেই বিক্ষোভ মিছিলে যে দুই চিরতরুণ আমাদের সাথে ছিলেন তাদের একজন ফয়েজ আহমদ আরেকজন কামাল লোহানী।
সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়ার নাকের নীচে বসে ১৯৭৬ এ তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সাংস্কৃতিক জোট ‘সংযুক্ত একুশে উদযাপন কমিটি’। যুক্ত করেছিলেন নিজামুল হক, এডভোকেট গাজীউল হক, আবদুল লতিফদের। রাজনীতির সেই বন্ধ্যা সময়ে ৭৬ এর ফেব্রুয়ারীকে উপলক্ষ্য করে তিনি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনে ছুটে বেড়ালেন হাজারীবাগ থেকে টঙ্গি, নারায়ণগঞ্জ থেকে চট্টগ্রাম। ধারাবর্ণনা আবৃত্তি, গণসঙ্গীত আর নৃত্যের মধ্য দিয়ে ৭৫ এর হত্যাকাণ্ড, সামরিক শাসন, মৌলবাদের উত্থানকে অঙ্গুলিনির্দেশ করলেন। মানুষকে জাগাতে গাইলেন ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে সেই জনতা’, মানব না এ বন্ধনে’, ‘কমরেড লেনিনের আহ্বান চলে মুক্তিসেনাদল’, ‘কারার ঐ লোহ কপাট, ভেঙে ফেল কররে লোপাট’, ‘রক্তে আমার আবার প্রলয় দোলা’, ‘বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও’, ‘বিপ্লবের রক্ত রাঙা ঝান্ডা ওড়ে আকাশে’।
বাবা জীবনে একটি বিষয় জানতেন না, অন্যায়ের কাছে মাথানত করা। কত প্রলোভন আর ভীতি, কিন্তু আমার জ্ঞান হওয়া থেকে ওনাকে দেখেছি এক্ষেত্রে তিনি বজ্র কঠিন দৃঢ়। একদিনের কথা মনে পড়ছে। ক্লাস সিক্সে পড়ি, মতিঝিল কলোনীর বি ৪৪, এফ ৫ এর তিনতলা বাসায় থাকি। বাবা দৈনিক জনপদে কাজ করেন। এক ভদ্রলোক বাসায় দু’ হাঁড়ি বগুড়ার দই নিয়ে এলেন, বাবা-মা বাসায় ছিলেন না আমাদের নানীকে তিনি দই দিয়ে চলে গেলেন। আমরা তো মহা খুশী দই খাওয়া যাবে! কিন্তু নানী বললেন, ‘খুকু-দুলাল আসুক তারপর খাবি’। দুপুরে বাসায় ফিরে নানীর কাছে শুনে বাবা তো নানীর উপরে মহা হম্বিতম্বি করলেন। বুঝলাম দই খাওয়া হবে না। বাবা দুপুরের ঘুম হারাম করে কাকে কাকে ফোন করে সেই ভদ্রলোককে বাসায় আসতে বললেন আর নানীকে বললেন দই ফেরৎ দিয়ে দিতে। পরেরদিন সেই ভদ্রলোক এসে দইয়ের হাঁড়ি নিয়ে গেলেন। পরে জেনেছিলাম তার জমি দখলের একটি নিউজ করেছিলেন বাবা, সেই নিউজের জেরে স্থানীয় প্রশাসন প্রভাবশালীদের কাছে থেকে তার জমি উদ্ধার করে দেয়, তাই তিনি কৃতজ্ঞতাবোধের উপহার হিসেবে দইয়ের হাঁড়ি নিয়ে এসেছিলেন। বাবা তা ফিরিয়ে দেয়ায় আমাদের খুব মন খারাপ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু আমরা আমাদের জীবনপথে পেয়েছিলাম সততার এক অনন্য দৃষ্টান্ত, পেয়েছিলাম বাবার দৃঢ় নীতিনিষ্ঠ পরিচয়।
খুব ছোটবেলা থেকেই আমার সাথে নানীর সম্পর্ক ছিল অসম্ভব ঘনিষ্ট, বন্ধুর মত। তারই আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে আমার যত দুষ্টুমিভরা দিন কেটেছে। তিনি ছিলেন আমার পরম বন্ধু, সব আব্দারের আধার আর মা-বাবার চোখ এড়িয়ে সেসব আবদার পূরণের সমাধান ক্ষেত্র। তাঁর কাছ থেকে কত গল্প বা সাংসারিক গোপন কথা যা বাচ্চাদের সাথে আলোচনা করা হতো না তা শুনে নিতাম। ৭২ সালের এক ঘটনার কথা বলি, বাবা-মা-নানীসহ আমরা তিন ভাইবোন বেড়াতে গেছি শান্তিবাগের অভিজাত এক পরিবারের আমন্ত্রণে তাদের বাসায়। বিশাল এলাকা জুড়ে (আজ যেখানে জাতীয় স্কাউট ভবন তার ঠিক পূর্ব পাশে) একতলা বাড়ী সঙ্গে একটা ছোট্ট পুকুর আর বাগান। অনেকটা সময় সেখানে ছিলাম। পরে নানীর কাছে শুনলাম ঐ পরিবারটির সকলে লন্ডন চলে যাবেন স্থায়ীভাবে তাই তারা বাবাকে অনুরোধ করেছিলেন অত্যন্ত কম মূল্যে ঐ বাড়ী ও জায়গাটি কিনে নিতে। বাবা তা করেননি, বলেছিলেন, আমি এখন যত টাকা দিয়েই কিনি না কেন সকলে ভাববে আমি ওনাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে জায়গাজমি দখল করেছি। নানী খুব রাগ করে বলেছিলেন, “তোর বাপ কোনদিন সংসারী হলো না”।
আর এসব কারণেই হয়তো এই লোভ-লিপ্সা-হিংসা-দ্বেষহীন মানুষটাকে আমরা খুব সমীহ করে চলতাম। দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী শিক্ষয়িত্রী মায়ের কড়া শাসন আর খবরদারীর মধ্যে বড় হয়ে উঠেছি। তবে ভয় বাবা-মা দু’জনকেই পেতাম প্রচণ্ড। মায়ের কাছে প্রায় প্রতিদিনই বকা আর সপ্তাহে এক-দু’দিন পিটুনি নিশ্চিত ছিল আমার। বাবা আমাকে পিটিয়েছেন খুব ছোটবেলায় সম্ভবত ক্লাস ওয়ানে পড়ার সময় একদিন স্কুলে না যাবার নানা বাহানায় বিরক্ত হয়ে। ঐ একবারেই হয়ে গেছিল আমার শিক্ষা, আর কোনদিন স্কুল না যাবার কথা মুখে তো দূরের কথা মাথায়ই আসেনি। আমরা বাবাকে ‘বাপি’ বলে ডাকি। বাপি আমাকেও আদর করে ‘বাপি’ বলে ডাকতেন তবে যখনই ভরাট গলায় ‘সাগর’ নাম ধরে ডাকতেন বুঝে যেতাম কপালে দুঃখ আছে।    
৬৮ কি ৬৯ সালে স্কুলের একটা ছোট্ট একাঙ্কিকায় আমি আর ক্লাসমেট ভাস্কর অভিনয় করেছিলাম আইইআর-এর মঞ্চে। মনে আছে, বাপি একবার দেখিয়ে দিয়েছিলেন কিভাবে করতে হবে। স্বাধীন বাংলা বেতারের কোন একটা নাটক বা কিছুতে একবার আমাকে কন্ঠ দিতে হয়েছিল অবশ্য সেবার আমাকে কিভাবে কি করতে হবে তা দেখিয়ে দিয়েছিলেন সৈয়দ হাসান ইমাম। সম্ভবত সে কারণেই ৭২-এ ঢাকা বেতারে মোস্তফা আনোয়ারের একটি নাটকে তিনি আমাকে অভিনয় করতে ডাকলেন কিন্তু বাপি রাজি হলেন না। তিনি তখন ঢাকা বেতারের পরিচালক, তাঁর কথা ‘সবাই ভাববে আমার কারণে সাগর সুযোগ পেয়েছে’। কিন্তু বাবার বন্ধু মোস্তফা আনোয়ারের জোরালো যুক্তি আর চাপের কারণে শেষ পর্যন্ত আমি সুযোগ পেইয়েছিলাম। এরপরে বেতার নাটকে অভিনয় না করলে ৭৭ সাল পর্যন্ত নিয়মিত আবৃত্তি আর স্কুল ব্রডকাস্টিং প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছি। বাপি আমাকে আবৃত্তি করতে উৎসাহ দিয়েছেন। শিখিয়েছেন আবৃত্তি কিভাবে করতে হবে, কোলকাতা থেকে কাজী সব্যসাচী, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত আর দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবৃত্তির ৪৫ আরপিএম রেকর্ড এনে দিয়ে বলেছেন, কিভাবে আবৃত্তি করছেন শোনো তবে নকল করো না।
বাবার ছায়ানটের কোন স্মৃতি আমার নেই তবে ৬৭ সালে ক্রান্তির প্রথম অনুষ্ঠানে পল্টন ময়দানে আমরা নানীর সাথে গেছিলাম তা মনে পড়ে। সেই প্রথম অতো বড় মঞ্চ আর অতো দর্শক দেখলাম। এরপরে এমন কি স্বাধীনতার পরেও ‘ক্রান্তি’ কিম্বা ৭৫ পরবর্তী ‘সংযুক্ত একুশে উদযাপন কমিটি’-র বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাবার সাথে থেকেছি কিন্তু কখনই উনি আমাকে সেসবে যুক্ত করেননি। কিন্তু আমার সুযোগ হয়েছে একজন কামাল লোহানীর সাংগঠনিক দক্ষতা অবলোকন করবার।
আমাদের ৬৮-৬৯ সালের নয়া পল্টনের বাড়ীর সামনে থাকতেন এক উকিল সাহেব, রাস্তা থেকেই ওনার চেম্বারের সারবাঁধা বইয়ের আলমারী ছিল আমার কাছে বিস্ময়। আমাদের বাড়িতেও প্রচুর বই ছিল তবে অতো বড় বড় বইয়ের আলমারী ছিল না, তখন ছোট ছোট বাঁশের তৈরি র‍্যাক বা বুক শেলফ পাওয়া যেত, তাতেই আমাদের বই রাখা হতো। যাই হোক সেই বাড়ীর ছেলে মানিক, যার সাথে আমাদের বাসায় কয়েকবার দেখা হয়েছে, আমাকে কয়েকবার লজেন্স দিয়েছিলেন মনে আছে। ৭২-এ দেশে ফেরার পর জানলাম সেই মানিক মামা যুদ্ধে মারা গেছেন। যুদ্ধকালে ১৪ নভেম্বর ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জের কাছে ভায়াডুবি ব্রিজের উপর পাকসেনাদের সাথে এক দুঃসাহসিক সম্মুখযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন মানিক মামা অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ রেজাউল করিম মানিক বীর প্রতীক। তাঁর প্রথম শাহাদাৎবার্ষিকীতে নয়া পল্টনের মূল সড়কে এখন যেখানে বিএনপি অফিস ঠিক সেখানে আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সে অনুষ্ঠানে শহীদ মানিকের ছোট বোন সুলতানা নাজনীন “মা গো তোমার সোনার মানিক ফিরবে না আর ফিরবে না” গানটা গেয়েছিলেন যার সাথে তবলায় সংগত করেছিলাম আমি। অনুষ্ঠানে সেই প্রথম তবলা বাজানো সেই শেষ। তবে বাপির উপস্থিতিতে আমার প্রথম মঞ্চ অনুষ্ঠান ছিল সেটা। এরপরে বিশেষ করে স্বরশ্রুতির কার্যক্রম শুরু হলে বিভিন আয়োজনে বাপি-মা এসেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন বিভিন্নভাবে।
আমাদের সাংস্কৃতিক কোন কাজে বাধা দেননি তাঁরা দুজনেই। মনে আছে বাহাত্তরে যখন ছাত্র ইউনিয়নে যুক্ত হলাম তার কিছুদিন পরে তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি বর্তমানে সিপিবি-র সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম স্বাক্ষরিত সদস্য কার্ড হাতে পেয়ে বাড়ীতে নানীকে বলেছিলাম, বাপি-মাকে না জানাতে বললেও তিনি জানিয়ে দিলেন, ভয়ে ছিলাম না জানি কি ধোলাইটাই কপালে আছে, কিন্তু ওনারা কেউ একটি কথাও বললেন না। পরে নানী একটু বিরক্তি নিয়েই বলেছিলেন, ‘বলবে কোন মুখে, দুজনেই তো একাজ করেছিল’। তখন জানতে পারলাম যে আমার বাবা-মা দুজনেই ছাত্র ইউনিয়ন করতেন সেই প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই। এমনকি পরবর্তী কালে জিয়ার খালকাটা কর্মসূচীতে যোগ দেয়ায় রাগে বাবার সামনেই সদস্য কার্ডটা ছিঁড়ে ফেললেও কিছু বললেন না তিনি।
আমি জানি না রাজনীতি, সংগ্রাম, আন্দোলনে সন্তানের অংশগ্রহণকে আর কোন বাবা-মা এমন তরো নীরব সমর্থন দেয় কিনা, তবে আমি পেয়েছি। আঘাতে রক্তাক্ত হ’য়ে আমার গ্রেফতারেও ওনাদের কোন উচ্চবাচ্য দেখিনি। ছাত্র শিবির বিরোধী, এরশাদ বিরোধী কিম্বা যুদ্ধাপরাধী বিচারে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনেও তাঁদের ‘সাবধানে থাকিস’ ছাড়া আর কোন বাক্য ব্যয় করতে শুনিনি।
তাঁরা এমনই এক মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ ছিলেন যারা আমাদের তিন ভাই-বোনকে লেখাপড়া থেকে শুরু করে পারিবারিক ও সামাজিক এমনকি রাজনৈতিক জীবনের কোন ক্ষেত্রে কখনই নিয়ন্ত্রণ করেননি, চাপিয়ে দেননি তাদের চিন্তা চেতনা। আজ জীবনের ষাট বছর পেরিয়ে যখন পেছনে তাকাই তখন বুঝতে পারি শেকলহীন এমনতরো জীবনে আমাদের বাড়তে দিয়ে আমাদের মেধা, মনন, চেতনাকে শাণিত করেছেন তারই শক্তি, চিন্তা আর চেতনায়। আমাদের চিন্তার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন বলেই আমরা যেমন নিজেদের চিনেছি, তেমনই আশেপাশের মানুষকে চিনে নিয়েছি অবলীলায়। বাঁধনছাড়া আমাদের এ জীবন পেয়েছে উদ্দামতা, হারায়নি উচ্ছৃঙ্খলতায়। আমাদের করেছে সাহসী, প্রত্যয়ী আর দৃঢ় চিত্ত।
আমাদের বাবা এবং মা আমাদের জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে মূর্ত হয়ে আছেন আপোষহীন, সাহসী মানুষের প্রতীক হয়ে। বলিষ্ঠ, সত্যনিষ্ঠ, আদর্শিক ঋজুতায় বলীয়ান আমার বাবা পাকিস্তানী রক্ত চক্ষুকেও পরোয়া করেননি তেমনই স্বাধীনতা উত্তর স্বৈরশাসকদেরও ভ্রূক্ষেপ করেননি। প্রগতিশীল বিপ্লবী চেতনায় সঞ্জীবিত কামাল লোহানী সত্য প্রকাশে পিছপা হননি কখনো। শাসকের রোষানল পারেনি থামাতে। তিনি এগিয়েছেন তার অভীষ্ট পথে।

লেখক: সাগর লোহানী, কামাল লোহানী পুত্র, সম্পাদক, বাঙালীয়ানা

পড়ুন
সময়ের সাহস কামাল লোহানী – প্রথম পর্ব 

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট