সলিল চৌধুরী: গানের দূরন্ত ঘূর্ণির জাদুকর

Comments

সৃজনশীল শিল্পীর দুরকম বড় ভাগ। এক, যারা প্রতিভাবান, সাংঘাতিক নতুন কিছু আনমনেই তাঁদের মাথায় চলে আসে। আরেক, দুর্ধর্ষ পরিশ্রমী। যারা দিনের পর দিন ঘষেমেজে, মাথা খাটিয়ে একটা সাধারণ আইডিয়াকে অসামান্যের পালিশ দিতে পারেন। এই দ্বিতীয় পর্যায়ের আর্টিস্টরা ভালোবাসেন প্রশিক্ষিত হতে। প্রবল নিষ্ঠা ও কৌতুহলী গবেষণা তাঁদের অভিজ্ঞান। খুব ব্যতিক্রমী দলছুট তাঁরা, যারা দুটো দলেই পড়েন। চূড়ান্ত শিল্পশিক্ষা ও দূরন্ত নতুনত্বপণা, দুটোই তাঁদের গভীর আস্তিনে লুকনো, যেন জাদুকর।

সলিল চৌধুরী এই বিরল পথের অন্যতম পথিক। সঙ্গীতের নানা ঘরানায় তার অবাধ, সুশিক্ষিত হাঁটাচলা। আবার সেই সাধন তাঁকে দস্তুরবুড়ো করতে পারেনি। মাথায় খেলত তাঁর অভাবনীয় সব আন্দাজ, আর সেটার ওপর তিনি নির্ভরও করতেন। তৎকালীন লেখাপত্র পড়ে মনে হয়, সেই স্বপ্নে পাওয়া পাগল হাওয়ার জন্য তিনি অপেক্ষাই করতেন।

সাধারণত, যাঁরা বহু সাধনায় প্রাণপণে পান, তাঁরা কাজ এলে গুছিয়ে বসে, সময় নিয়ে, একবার না পারিলে শতবার দেখে সময়মত সে কাজে দাঁড়ি টানেন। ফ্লোরে যাবার কালে, তাঁরা প্রস্তুত। শেষমুহুর্তের জন্য, হঠাৎ আইডিয়া প্রপাত হলে,  বড়জোর দুয়েকটা আঁকিবুকি বাদ রাখেন। এর মানে আবার ফস করে এই ধরে নেবেন না যে দুর্দান্ত শৈল্পিক ফন্দী তাঁদের আসত না। প্রবলভাবে আসত। কিন্তু সেটা তাঁরা খুঁজে নিতেন কাজের ঘরে। স্টুডিওর পিছনের গুপ্ত সিঁড়িতে বসে নয়।

সলিল চৌধুরীর বহু অসামান্য কাজ ওই স্টুডিওয় পৌঁছে, শেষের শেষ মুহুর্তে। গুন্ডাপা বিশ্বনাথ, বা আজহারুদ্দিনের মত, তাঁর কাট গুলি হত লেট, স্লিপ ফিল্ডারকে হাঁ করিয়ে রেখে। এক্ষেত্রে অবশ্য ফিল্ডার তাঁর বিপক্ষ নয়। নিজের গানেরই গায়ক, সহবাদক ইত্যাদি। এরকম অজস্র ঘটনার কথা স্মৃতিকথায় পড়া যায় যেখানে অর্ধেক গানরচনা করে তিনি পাততাড়ি গুটিয়েছেন। শিল্পীর ঘনঘন নার্ভাস তাগাদায় পাত্তা দেননি। শেষমেশ স্টুডিওয় একলা কোণে তাঁকে আবিষ্কার করা গেছে তড়িঘড়ি গান শেষ করতে। হয়ত মনে হতে পারে এভাবে কি আর ভাল সৃষ্টি সম্ভব? আপনাকে গুটিকয় উদাহরণ দেয়া দরকার।

এক নম্বর কাহানিটি বিবৃত করেছেন গুলজার সায়েব। তখন তিনি বিমল রায়ের সহকারী। সলিলও কলকাতা থেকে সরে সংসারের দায় নিয়ে সবে ব্র্যাকেটে বোম্বে হয়েছেন। তখনও পুরোপুরি কিংবদন্তী হয়ে উঠেছেন, তা নয়। গুলজার পৌঁছে দেখেন, সলিল সহকারীদের সঙ্গে ক্যারমে মশগুল। এতটাই, মনে হচ্ছে ওইটিই অভ্যাস করতে তাঁর বোম্বে আগমন। অ্যাসিস্ট্যান্টসুলভ সিরিয়াসনেসে গুলজার দুয়েকবার কাজের তাগাদাও দিয়ে দেখলেন, মিউজিক ডিরেক্টর বাহ্যজ্ঞানশূণ্য। খানিক বাদেই রাশভারি ডিরেক্টর বিমল রায়ের আগমন। গুলজার সতর্ক করার আগেই সলিল ঝাঁপিয়ে পড়লেন পিয়ানোয়। ভাবটা এমন মনে হবে, সারাদিন ওতেই ডুবে আছেন। বাজাতে লাগলেন এক মনকাড়া ধুন।এই পদ্ধতিতে ভাল গান হওয়া সম্ভব নয় বলেই আপাতভাবে মনে হবে। হল কিন্তু ‘মধুমতী’। ‘সুহানা সফর’ বা ‘ আজা রে পরদেশী’ হয়ত।

দুই নম্বর আখ্যান, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বয়ানে। সলিল পুজোর গানের জন্য এসেছেন হেমন্তর বাড়িতে। নানান গান। একটু গণসঙ্গীত ঘেঁষা বলে হেমন্তবাবুর পসন্দ্ হচ্ছে না। উনি বলেও দিলেন, “তোমার ওইসব ‘ওদের ধরে রাখো, মারো রে’ গোছের গানগুলো বাদ দিয়ে কিছু শোনাও। ব্যাটেবলে হল না। বন্ধ্যা সিটিং এর শেষে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে আসতে সলিল চৌধুরী বললেন, “একটা অন্যরকম গান করেছি হেমন্তদা, কিন্তু অর্ধেক বানানো হয়েছে, শুনবেন”? আবার বাংলা গানের ইতিহাস সিঁড়ি বেয়ে উঠল। সলিল গেয়ে শোনালেন গান। হেমন্ত আধোখানি শুনেই মুগ্ধ। স্থির করলেন, জানিয়েও দিলেন, এটাই এবার পুজোয় করব, বাকিটা চটপট বানিয়ে ফেল”। রেকর্ডিং এর দিন হল, স্টুডিও, হ্যান্ডস্ সব বুকিং হল। হেমন্ত ব্যাকুল বাকিটুকু তুলতে। গানের আধখানা আর গজায় না, অনেকটা ব্যাকরণ শিং এর মেজমামার ঠিক উল্টো। সেই আদ্ধেকটা মারা গিয়েছিল, এই আদ্ধেকটা জন্মায়ই না। সেকালের ৭৮ আর পি এমের রেকর্ডের দুপিঠেই এই গানটা দুভাগে হবার কথা। রেকর্ড তো আর সিডি নয়, যে একটা অনুর্বর সাইড থাকবে! শেষমেষ রেকর্ডিং এর দিনে হয়রান হেমন্ত গীতিকার ও সুরকারকে আবিষ্কার করলেন এইচ এম ভি স্টুডিওর পিছনের এক প্রায় অনাবিষ্কৃত সিঁড়িতে, রেকর্ডের অন্যপিঠটা পড়িমড়ি করে বানাচ্ছেন। তারপর গান হল, তোলা হল, অ্যারেঞ্জ হল, মনিটর হল, রেকর্ড হল। কি গান? মধ্যমেধার আপ্রাণ পরিশ্রম সাতজন্মে তা পয়দা করতে পারত না, “গাঁয়ের বধু”।

তৃতীয় কিস্যাটি আর গোটাটা বলার দরকার নেই। গঠন একই রকম, খালি পাত্র পাল্টে জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় বসিয়ে নিতে হবে। বড় তফাতের মধ্যে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের এক আধটি গান খারাপ হলে এসে যেত না, জনপ্রিয়তা ও বিক্কিরিও বড়জোর সতের-বিশ হত, কিন্তু জটিলবাবুর এ এক্কেবারে গোড়ার দিক। একেকটা গানের সাফল্য শিল্পী হিসেবে মরণ-বাঁচন বাজি। এক্ষেত্রে জেতা বাজি তিনি  হারতে চাইতেন না নিশ্চয়। ঘটনার গতিপ্রকৃতি সেই একই। সেই একই কালজয়ী সিঁড়িপ্রয়াস জন্ম দিল পাগল-করা, “পাগল হাওয়া”র।

এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য এটা প্রমাণ করা নয় যে অপ্রস্তুতিই একমাত্র মহৎ শিল্পের জন্ম দিতে পারে বা সেটাই সলিলের আসল শক্তি। বরং ঠিক উল্টোটাই। সলিল চৌধুরীর সঙ্গীত জীবন চূড়ান্ত লার্নিং এর পরও ঠিক যথাযথ আনলার্নিং এর অনবদ্য উদাহরণ, যা খুব ভাল, চমৎকার আর যুগন্ধরের সূক্ষাতিসূক্ষ তফাৎ চিহ্নিত করে। এমন শিক্ষণ, যিনি ওয়াশিংটন ডিসিতে কবীর সুমনের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে একটি মিউজিক শপে যন্ত্র বাজিয়ে দেখতে লোক্যাল জ্যাজ ও ব্লুজ আর্টিস্টদের হাঁ করে দিতে পারেন, এমন অভ্যাস যে বোম্বের দুঁদে প্রোফেশন্যাল বাজিয়েদের নোটেশন কষে ভাবনায় ফেলে দিতে পারেন অথচ মহৎ সৃষ্টির অমোঘ মুহূর্তটির জন্য শেষানুশেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারেন নিজের প্রতিভার ওপর আর্টিস্টিয় আস্থায়। মধ্যবিত্ত গোছানেপনার বাইরে, এ-ই শিল্পীর প্রত্যয়ী সিগনেচার।

বাঙালীয়ানা/এমএ/এসএল

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.