দার্শনিক প্লাটো নাটককে ভয় পেতেন। তিনি মনে করতেন নাটক মানুষকে বিদ্রোহ করতে শেখায়। তিনি মনে করতেন যা বার্তা দিতে পারে তা বিদ্রোহ শেখাতে পারে। তিনি নাটক নিষিদ্ধই করতে চেয়েছিলেন। তিনি নৃত্য পছন্দ করতেন। কারণ নৃত্য বার্তা দেয় না, বিদ্রোহ করতে শেখায় না। নৃত্য তখন ছিলো, মানব মনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। কিন্তু পরবর্তীকালে নৃত্য আর সেখানে স্থির থাকলো না। নৃত্যের সঙ্গে বাণীর মিলন ঘটলো, নৃত্য তখন বিদ্রোহ ছড়াবার কারণ হলো। শাসকরা ধ্রুপদী সঙ্গীতকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, কিন্তু বাণী প্রধান গান নিয়ে আপত্তি তুলেছে। কারণ বাণী প্রধান গানের বিদ্রোহ ছড়াবার সম্ভাবনা রয়েছে। কথা হলো, অক্ষরের প্রতি শাসকদের ভয়। কারণ অক্ষর বার্তা পাঠাতে পারে, বার্তায় বিদ্রোহ থাকতে পারে। সেজন্য শাসকরা সংবাদপত্রের উপর কালাকানুন জারি করে আসছে যুগ যুগ ধরে। কারণ সংবাদপত্র বার্তা দেয়, সেখান বিদ্রোহ প্রচারের সম্ভাবনা থাকে।
নৃত্যে, সঙ্গীতে আগে বিদ্রোহ প্রকাশের সুযোগ ছিলো না, পরে হয়েছে। আর নাটকে বিদ্রোহ প্রায় জন্মলগ্ন থেকে। নাটক, গণসঙ্গীত বা যা শাসকদের বিরুদ্ধে কথা বলে তাকে সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করতে রাজি নয় পুঁজিবাদী দেশে। কিন্তু খেলাধূলা যা শুধু বিনোদন জোগায়, বিদ্রোহ শেখায় না তাতে টাকা ঢালতে কোনো দেশের সরকারের আপত্তি নেই। সেজন্য বিশ্বজুড়ে ফুটবল খেলা আর ক্রিকেট খেলা আর যত রকম খেলা সব সরকারের, ব্যবসায়ীদের কিংবা ধনীদের পৃষ্ঠপোষকতা পায়। কারণ পুঁজিবাদের গণমাধ্যম এই সব খেলাধুলার প্রচারে ব্যস্ত। কারণ দার্শনিক প্লাটোর মতোই এরা বিদ্রোহকে ভয় পায় আর খেলা বিদ্রোহ শেখায় না। সরকারের কিংবা ধনীদের বিরুদ্ধে গরীবদের বা দর্শকদের বিদ্রোহ করতে বলে না। কারণ খেলা কোনো বার্তা দেয় না, শুধু মাত্র বিনোদন দেয়। মানুষকে বিচার বিবেচনাহীন ধর্মান্ধদের মতো প্রায় উন্মাদনা দেয়। খেলার নেশায় মানুষ যত মেতে থাকে, সরকার, পুঁজিপতি আর তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা ততই খুশি। খেলার এই উন্মাদনা, ধর্মান্ধদের চেয়ে কম কিছু নয়। ধর্মান্ধদের মতো প্রতিপক্ষকে এরা গুড়িয়ে দিতে চায় পরম গর্ব নিয়ে।
স্বভাবতই খেলার পিছনে টাকা ঢালার মতো ধনী লোকের অভাব নেই, আবার গণমাধ্যমের এর প্রচারে অনীহা নেই। ধনীরা খেলাধূলাকে এত পৃষ্ঠপোষকতা দেয় কেন? কারণ খেলাধূলা বিদ্রোহকে উস্কানী দেয় না, নাটক শিল্প সাহিত্য যা দিয়ে থাকে। বরং খেলা মানুষকে বিদ্রোহ করা থেকে নিরুৎসাহিত করে। পাশাপাশি সকল ধরণের প্রচারের ফলে সেখানে এত মানুষের জমায়েত হয় যে, তা থেকে প্রচুর টাকা মুনাফা করা যায়। ঢিল একটাই কিন্তু পাখি মারা পড়ছে দুটা। মুনাফা হচ্ছে প্রচুর আবার বিদ্রোহ ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে। রাশিয়ার শ্রমিকদের সম্পর্কে, চা বাগানের কুলিদের সম্পর্কে এক সময় পড়তাম, কাজের শেষে নানারকম নেশায় মাতাল করে রাখা হতো তাদের, যাতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করতে শেখে। যেন বিচার বিবেচনা হারিয়ে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। খেলা এখন এমন একটা মাধ্যম যা দিয়ে ভদ্রলোক, ছোটলোক, শিক্ষিত, মুর্খ, বিদগ্ধ এমনকি বিপ্লবীকেও নেশাগ্রস্ত করে তোলা যায়। বিদ্বান, বিদগ্ধ আর বিপ্লবীরাও খেলা দেখতে দেখতে খুব ভালো একজন উগ্র জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠতে পারে। হিটলার যা প্রচার করেছিলো, খেলাও তাই প্রচার করে। আমরা শ্রেষ্ঠ, আমরাই আর্য, জয় চাই জয়। আর কিছু নয়। জয়ের জন্য শঠতা, নীচতা সব করতে রাজি। শত্রুপক্ষের প্রতি সামান্য করুণা বা সহানুভূতি নয়; মাঠে নিশ্চিহ্ন করে নিজেদের বিজয় রথ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি কর্মীরা দাবি করেছেন, বাজেটে তাদের কম টাকা দেওয়া হয়েছে। সাংস্কৃতিক কর্মীরা তাই আন্দোলন করছেন। শুনলাম তাতে নাকি টাকা কিছুটা বাড়বে। কিন্তু সাংস্কৃতিক কর্মীরা কি কখনো পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় খেলার সমান মর্যাদা বা গুরুত্ব পাবে? খেলায় জিতলেই নাকি খেলোয়ারদের গাড়ি বাড়ি সম্বর্ধনা এসব দেওয়া হয়। বাংলাদেশের নাট্যকর্মী বা সংস্কৃতি কর্মী বা শিল্পী সাহিত্যিকরা এমন সম্বর্ধনা পান কখনো ভালো কিছু সৃষ্টি করার জন্য। তাদের ভালো কোনো অবদানের জন্য। ক্রিকেট খেলোয়াররা সরকারে টাকায় খেলে, আবার বহু খেলায় হেরে মাত্র দু একটা খেলায় জয়ী হবার জন্য শুধু সরকার নয়, সকলের সম্বর্ধনা পান। কিন্তু সৃষ্টিশীল অন্যদের ক্ষেত্রে তা হয় না কেন? নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে দেশের জন্য মহৎ কিছু সৃষ্টির জন্য শিল্পী সাহিত্যিকরা ক’জন এমন পেয়েছেন? ধরা যাক, একজন বিজ্ঞানী বা চিকিৎসক নিজ ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য এমন সম্মান পাবেন কখনো? বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলোয়াররা যখন খেলেন, তাতে দেশের উন্নয়নে কি কিছু যোগ হয়? কিন্তু চিন্তাবিদদের বহু সৃষ্টি রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে অবদান রাখে।
বহুজন ভাবতে পারেন, আমার এ লেখাটা খেলার বিরুদ্ধে। আসলে মোটেই তা নয়। সত্যি বলতে আমি খেলার বাণিজ্যিকীকরণ আর এটাকে আত্মপরিচয়ের প্রতীক করে তোলার বিরুদ্ধে। খেলার হার জিতের সঙ্গে ব্যক্তি মর্যাদার হারজিতের কিছু নেই। খেলা হচ্ছে বহু মানুষের একটা মিলন কেন্দ্র। প্রাচীন যুগে অলিম্পিক সৃষ্টি সে উদ্দেশ্যে, চার বছর পর পর গ্রীসের মানুষকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে বাঁধা। সকলের মধ্যে চার বছর পর পর যোগাযোগ গড়ে তোলা। কিন্তু বর্তমানে খেলা তো একটা পণ্য, সম্পূর্ণ পুঁজিবাদের দখলে থাকা একটা মানসিক উন্মাদনা। ধনী শাসকশ্রেণীর কাছে এটা একটা হাতিয়ার, যা মানুষকে সুস্থ্যচিন্তা থেকে দূরে সরিয়ে রাখবার কাজে ব্যবহার করা হয়। তারা তাদের প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে উন্মাদনার মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা চালায়। সে কারণে ভিন্ন দেশের ফুটবল খেলায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের মানুষ ভিন্ন ভিন্ন দলের সমর্থক হিসেবে নিজেরা অশ্লীল যুদ্ধে লিপ্ত হয়। খেলার পরিবেশ তো তেমন হবার কথা ছিলো না। মানুষ খেলা দেখবে আনন্দ লাভের জন্য। কিন্তু মানুষ কি এখন খেলা দেখে সত্যিই আনন্দ পায়? নাকি একধরনের উত্তেজনার মধ্যে সময় পার করে? বাংলাদেশের একজন খুব পরিচিত বিবেকমান মানুষ বলেছেন, তিনি খেলা দেখার আগে সেডিল বা ডায়াজিপাম ওষুধ খান নিজের উত্তেজনা প্রশমিত করার জন্য। কী ঘটছে তাহলে? তিনি কি খেলার আনন্দ নিচ্ছেন! নাকি এটাকে মরণপণ যুদ্ধ মনে করছেন? বহুজন বাংলাদেশ হারতে বসলে আর খেলা না দেখে টেলিভিশন বন্ধ করে দেন। তার মানে তিনি নিজের জয়টুকু দেখতে চান, খেলার মাঠে অন্যদের নৈপূণ্য প্রদর্শন তিনি দেখতে চান না। অন্যদের খেলা তাকে আনন্দ দেয় না, দুপক্ষের খেলাটা তিনি উপভোগ করেন না, নিজ পক্ষের জয় দেখার জন্য বসে থাকেন। বহুজন হিসাব করেন কে হারলে তার দল চূড়ান্ত পর্বে খেলতে পারবে বা কখন কে জয়ী হলে তাতে তার দলের লাভ। বহুজন মনে করেন বৃষ্টি হয়ে খেলা বন্ধ হলে আজ আমার দলের লাভ। সবটাই লাভালাভ তাহলে, খেলা কোথায়? নির্দোষ আনন্দ কোথায়?
খেলা নিয়ে অদ্ভুত একটা অবস্থা প্রায় সকলের। অথচ এরকম খেলার জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব নেই, প্রচারের অভাব নেই। বরং বাড়াবাড়ি রকমের সাহায্য সহযোগিতা রয়েছে। সংস্কৃতির দিকে নজরটা কম কেন তবে? শিল্প সাহিত্য বা নাটক শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ শেখায় তাই কি? প্লাটোর মতো শাসক মাত্রই কি নাটককে ভয় পাচ্ছে? সকল সরকার স্মরণ রাখতে পারে যে, সকলেই বিদ্রোহী হয় না, সুবিধা লাভের জন্য সরকারের পক্ষেও অনেকে থেকে যায়। সাংস্কৃতিক কর্মীদের স্মরণে রাখা দরকার জনগণ কি আশা করে তার কাছ থেকে? খেলা, সংস্কৃতি শিক্ষা কেমন হবে তা নিয়ে নতুন করে ভাবা দরকার যুক্তিবাদী একটা সমাজের মধ্যে বসবাস করার জন্য।
লেখক পরিচিতি:
রাহমান চৌধুরী, লেখক, শিল্প সমালোচক