সা’দ জগলুল আববাসের কবিতা

Comments

মিছিল শেষে ঘরে ফেরা

মিছিল শেষে ঘরে ফিরতে রোজ মধ্যরাত,
সেই তো চেনা গলির মুখ
আলোছায়ার কেয়ারিতে চুপচাপ রাস্তা চওড়া দশ ফিট।
ঘামে ভেজা চেক শার্ট,
আধোয়া স্যান্ডো, বন্ধুর দেয়া স্যান্ডেল,
বুকপকেটে সদ্য পুরনো পার্টি ইশতেহার;
পাঁজরের মাঝে চিরে ওঠা সেই পুরনো অম্ল,
সেই অকারণ বুক ধুকপুক,
চশমার পিছনে পঁচিশ বছরের বিষণ্ণ চোখ।

পথের পাশে দাঁড়ানো সেই ছায়া-ছায়া আমগাছ,
বন্ধ দু’টো মনোহারী, একটা বেকারী
ওষুধের দোকানটির তখনো শাটার খোলা
গলির দুপাশে গভীর ঘুমে
ভ্যানগাড়ি আর দালানের সারি।

গলির শেষে ছায়ার মতো পুরনো সেই মেস বাড়ি
রং চটে যাওয়া নম্বরহীন নীলচে কাঠের ফটক।
সেই ঘর, কোণে পড়ে থাকা একই চৌকি
মলিন চাদর, সিগারেটে পোড়া জীর্ণ তোষক!
ঐ পাশে টেবিল-
খুচরো পয়সার মতো ছড়ানো বই
বাসি পত্রিকা, ঠাসা ছাইদানি।

রাত বাড়ে গলির রাস্তায়
জড়ানো কণ্ঠ, সেই পুরনো খেউর,
অন্য পাড়ার ফালতু মাতাল, বাসের হেল্পার
অথবা হঠাৎ কোন আদমখোর,
তরুণ হাতগুলো দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার মারে!
তারা ঘুম-ঘুম চোখে হেঁটে যায় রাতের গভীরে
অন্ধকারে জ্বলে সিগারেটের আগুন, কুকুরের চোখ;
হঠাৎ কোন রাতে নির্জনতা ভেঙে
গলির মুখে গাড়ির শব্দ
পুলিশের বাঁশি,
দেয়াল টপকে ধুপধাপ সব চেনা পলায়ন!

হেঁয়ালির মতো সেই বারোয়ারি আলো,
রাতভর জ্বলে কাটে না কালো;
অন্ধকারে কাত হয়ে থাকে
জানালা পেরিয়ে দেয়াল জুড়ে।

দ্রোহে পোড়ানো সেই নির্ঘুম চোখ অন্ধকারে-
যুবকের সেই একঘেঁয়ে রাত
পুরনো কাঁথার ওমে মুড়ে রাখে
কোন এক মিছিলে দেখা প্রিয়ার মুখ।

বিবর

সময় থেমে আছে, জরাগ্রস্ত সময়-এখন
হাতের চেটো যেন রঙচটা মলাট
দরজায় টোকা দেয় গল্পের প্লট
অথচ বুক-পকেটে পুরনো গল্পরা নড়ে।

কালিন্দীতে জমেছে পলি
হাওয়ায় কবিতার পংক্তি ওড়ে।
চর জেগে থাকে কুয়াশার মতো
নদীর ছাত ছেড়ে যাচ্ছে উবে।

সমুদ্রের সাথে লেনদেন শেষ করে
পাহাড়ে গিয়েছিলাম একদিন,
উন্মুক্ত স্তনের মতো সবুজ পাহাড়।
দিনের ছায়াগুলো বড়ো হতে হতে
রাতের শরীরে মিশে যায়,
মাঝেমাঝে পাতা ওড়ার শব্দ ওঠে
বুকের মাঝে গল্পরা ভিড় জমায়।

নক্ষত্রালোকে পৃথিবীর ছায়া পড়ে
গ্রহণ লেগে যায় এন্ড্রোমিডায়।
কৃষ্ণবিবরে ওটা কিসের ছায়া,
রাতভর পড়ে থাকে!
একঘেঁয়ে ধ্রুবতারা জায়গা ছাড়ে না কেন!

ঈশ্বরের দোহাই লাগে
তোমাকে একটিবার ছুঁতে দাও।
রাতগুলো সব ঘাসের মতো বেড়ে যাচ্ছে
হিমে ভিজে একাকার
দিনগুলো অপেক্ষায়, গাছের শরীর রোদে পোড়ে;
হিমবাহ কতবার গেছে গলে,
কতবার দাবানলে উজাড় হয়েছে বন,
কতবার শঙ্কিত হাত নানান ছুঁতোয়
নতুন চারার মতো গজিয়ে ছুঁয়েছে আকাশ;
তবু তোমাকে পারি না ছুঁতে-
মহীরুহ কী দম্ভে মাটি ছেড়ে উলম্ব হয়ে যায়!
ঝরা পাতাদের পা চেপে ধরা কী আকুতি-
একবার নত হও,
একবার ছুঁতে দাও!

আমি ফিরে যাওয়ার আগেই
তুমি একটি বার ধরা দাও, ছুঁতে দাও –
হে অনাদি কাল।
যেদিন চলে গিয়েছিলে শুকনো পাতা মাড়িয়ে
তুমি তো কথা দিয়েছিলে—ফিরে আসবার,
শেষ করে দিতে বাকি যেটুকু ছিলো ছোঁয়াছুঁয়ি কানামাছি খেলায়।

তোমার মৌষল কাল

তোমার খোঁজে এসে দেখি,
উৎসবমুখর তোমাদের শহর আজ!
রাস্তা জুড়ে কাকের মাইকিং ভীষণ জটলা
চিৎকারে কান পাতা দায়।

ম্যাজিকের মতো তোমার শহরে আজ
বর্ষার জমা জল চুঁইয়ে নেমেছে পাতালে
রাস্তায় ধূলো যেটুকু ছিলো, টুকরো কাগজগুলো
গত রাতের বাতাসের তোড়ে গেছে উড়ে।
বৃষ্টিতে ধুয়ে বিষ্ঠাহীন বিলবোর্ড
মডেলের গায়ে উঠেছে নতুন কুর্তা-কামিজ।

সারিবদ্ধ সুবেশী তরতাজা ছুঁচোগুলো
ফুটপাথে উদ্বাহু হয়ে পতাকার মতো হাত নাড়ে
ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারে চকচকে বাদশাহী আশরফি,
কাকগুলো যেন শকুন, ঠোঁটে তুলে জমা করে গাছে।
দূরে দালানের ছাদে দাঁড়িয়ে বিশাল এক হুলো
ভাবে, আহা! কী সুযোগটি গেল!

শহরটি আজ উৎসবে উত্তাল
প্রজ্ঞাপন বিলি হয়েছিল গতকাল
এ শহরের দেয়ালে সেঁটে গেছে স্বাগত পোস্টার।
আমাদের শহরও জেনে গেছে
তোমাদের এসেছে নতুন নগরপাল।

তোমাকে খোঁজ-কালে তোমার শহরে
হঠাৎ চোখ পড়ে যাত্রী ছাউনির আধো অন্ধকারে
ও পাড়ার রমজান পাগল,
ঘন ঘন মাথা নাড়ে ডানে-বায়ে
আমাকে দেখে আঙুল তুলে হাঁক দিয়ে ওঠে-
‘হক মাওলা! দেখিস এবার নিশ্চয় আমার ভোটার কার্ড হবে’!

অভিক্ষেপ

অথচ মনে হয় কিছু একটা খুঁজছি দিনরাত।

কোন খেয়ালে বিছানায় দেয়ালে আর চিনির কৌটায়
পিঁপড়েরা মুসাফির হয়ে যায়,
আমার খোঁজ চলে অবিরাম।
হয়তো বোকা লাইটহাউজের মতো রাতের কালোয়
নাবিকের দু’চোখে জাহাজের কাটিম খুঁজি।

রোদচশমার দেয়াল পেরিয়ে
সূর্যের আলো বন্ধক পাটে সপাটে আছাড় খায়
আলস্যে থাকে পড়ে নদী-নালা-বনানী-প্রান্তরে
এবং তোমার বন্ধ দু’চোখের পাতায়—
সে উজ্জ্বল বলয়ে আমি জোনাকির বসতি খুঁজি
মেঘের বিন্যাসে বিভোর আকাশে দিনভর গ্রহ-তারা খুঁজি।

জানিনা, এটি কোন্ অকারণ অভিলাষ, কোন্ অভিপ্রায়
সে-কি আরম্ভের প্রারম্ভ নাকি শেষ-
অরুণিমা, তুমি কি জানো?

সেই কবে বিদগ্ধ এক শ্মশ্রুল কবি
খুঁজে খুঁজে অবশেষে
আক্ষেপে বলেছিলেন-
‘খ্যাপা খুঁজে ফিরে পরশ পাথর…’
আমি তাহলে খুঁজছি কী; ধরার এই শোকেসে
সে কোন পাথর?

প্রশ্নটা গিলে ফেলো, অরুণিমা—
তুমি জানো এ আমার অভিক্ষেপ;
আসলে কিছুই খুঁজছি না আমি।

স্থানান্তর

কুকুরের মতো গন্ধ শুঁকে শুঁকে
বহুদিন হলো প্রিয় শহর ছেড়ে গেছি।
বাহানার ফাঁদে খোঁজ নেয়া হয়নি বহুকাল…

তুমি নাকি এখন এ-শহরেই থাকো।
একদিন কাক আর শালিকেরা শলা করে
তোমাকে ডেকেছিলো, তোমার শহর ছেড়ে আসোনি তুমি।

সেই তো এলেই…

বলতো কেমন আছো—আগের মতোই বাহানায় ছাদে আসো?
চোখ দুটো অভ্যাসে কাউকে কি খোঁজে?
সেই এক থেমে যাওয়া দুপুরের মতো
এখনও কি শহরে রোদেরা ঘামে?
জানালার গরাদে হয়তো-বা আলগোছে পড়ে থাকে ডোরাকাটা রোদ।
শালিকগুলো…

শহরটা ঘিরে রাখা ক’টা নদী
ধমনীর মতো ছড়ানো কিছু খাল—
হাড়গিলে নদীর পিঠে চেপে নৌকারা এখনও নাকি
ঘাটে ভিড়ে কোনমতে—অভ্যাসে।
শুনেছি খালগুলো হয়েছে নাকি নগরীর রেইনড্রেন!

আমার এখানে কদাচিৎ খবর আসে—
জামাইর পাতে তুলে দেয়া সুস্বাদুব্যঞ্জন, কষ্টের ঘ্রাণ থাকে না তাতে।

আমার গলায় ডগ-কলার, তুমি কিন্তু ভালো থেকো নিয়মিত।

লেখক:
Sa'ad Zaglul Abbas
সা’দ জগলুল আববাস, কবি

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট