সাম্প্রতিক পোশাক বিতর্ক । রাহমান চৌধুরী

Comments

কিছুদিন ধরেই পোশাক নিয়ে বিতর্ক চলছে বাংলাদেশে। বিতর্কের দুটি পক্ষ রয়েছে। বিতর্কে এক পক্ষ বলছেন, পোশাকের প্রভাব রয়েছ মানুষকে প্রলুব্ধ করার। ভিন্ন পক্ষ তা মানছে না। কিন্তু এটা সত্যি, পোশাকের নিশ্চয় প্রলুব্ধ করার ক্ষমতা রয়েছে, না হলে নৃত্যশালার পোশাক ভিন্ন রকমের হবে কেন? মানুষের উপর প্রভাব সৃষ্টি করার ব্যাপারে পোশাকের বিরাট প্রভাব থাকে। সেজন্য রাজা-বাদশাহ, পুরোহিতরা ভিন্ন ধরনের পোশাক পরিধান করে সাধারণ মানুষ থেকে। মধ্যযুগ পর্যন্ত রাজারা পরিধান করতেন জমকালো পোশাক। মানুষ পোশাকের দ্বারা প্রলুব্ধ হয়, সেই যুক্তিকে অনেকে বলছেন, নারীর সংক্ষিপ্ত পোশাক পুরুষকে প্রলুুব্ধ করে। কথাটা হলো শুধুমাত্র পোশাক কেন, প্রতিটি বস্তু এবং প্রতিটি ঘটনাই মানুষের উপর প্রভাব ফেলে। বিশেষ বিশেষ খাবারের দোকানে পোড়ানো মাংস ঝুলিয়ে রাখা হয়, খাদ্য-রসিককে প্রলুব্ধ করার জন্যই। কথাটা মিথ্যা নয়, বহু মানুষ বা শিশুরা তার দ্বারা প্রলুব্ধ হয়। কিন্তু যিনি নিরামিশ ভোজী, তিনি কি প্রলুব্ধ হবেন খাবারের দোকানে ঝুলানো মাংস দেখে? প্রশ্নই ওঠে না। বরং নিরাভোজীর ক্ষেত্রে তার ফল বিপরীত হতে পারে। কথাটা হলো, প্রলুব্ধ হবার মতো অভিজ্ঞতা বা মানসিকতা নিয়ে বড় না হলে, নারীর সংক্ষিপ্ত পোশাক কাউকে প্রলুব্ধ করতে পারে না।

বহু বছর আগে, সেই আশির দশকের শুরুতে যখন আমরা চলচ্চিত্রের উপর চারমাসের সংক্ষিপ্ত একটি প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলাম, তখন আমাদের দীর্ঘ একটি প্রমাণ্যচিত্র দেখানো হয়েছিল। প্রামাণ্যচিত্রটি ছিল বাইরের একটি নৃগোষ্ঠীর জীবনযাপন, যারা ছিল সম্পূর্ণ উলঙ্গ। শরীরে তাদের পোশাক বলে কিছুই ছিল না। কিন্তু সকলেই তারা নিজ নিজ কাজ করে যাচ্ছিলো স্বাভাবিকভাবেই। সম্পূর্ণ উলঙ্গ মা সম্পূর্ণ উলঙ্গ শিশুকে কোলে নিয়ে তার স্বামী আর অন্যান্য পুত্র-কন্যাদের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। চারপাশের প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজনরা সবাই সেখানে উলঙ্গ। পুরো একটা জনগোষ্ঠী যে উলঙ্গ সে ধারণাটা আমাদের, কিন্তু তাদের এ বোধটুকুও নেই যে তারা উলঙ্গ। কারণ বছরের পর বছর তারা এভাবেই জীবনযাপন করে আসছে, নিজেরা কখনো তার মধ্যে সামান্য অসঙ্গতি খুঁজে পায়নি। দূরে বসে আমরা ভাবতে পারি তারা উলঙ্গ, অসভ্য। তাতে তাদের কিছু যায় আসে না। ভারতের আন্দামানে এমন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী এখনো আছে বলে জানা যায়। যদি তারা এরকম জীবনযাপন করতে অস্বস্তি বোধ না করে, বাকিদের তবে কী যায় আসে?

সভ্যতার আদিম যুগে মানুষ উলঙ্গই ছিল, কিন্তু তখন ধর্ষণ বলে কোনো শব্দ চালু ছিল না। যখন মানুষ সভ্য হয়েছে, বহুরকম নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে, নানারকম অহঙ্কার দানা বাঁধছে মানুষের জীবনে, মানুষ যখন তার শরীরে পোশাক চাপিয়েছে; বাস্তবিকভাবে নারীরা তখন থেকেই ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন ধর্ষণ কথাটার সঙ্গে মানুষের পরিচয় ঘটছে। ধর্ষণের সঙ্গে মূল সম্পর্কটা আসলে পোশাকের নয়, ক্ষমতার। ক্ষমতা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে তার অপব্যবহার হয়। যদি প্রাচীন যুগের নানাধরনের উপকথা বা সাহিত্য বিচার করা যায়, সেখানে দেখা যাবে নানাভাবে ক্ষমতাবান দেবতাদের ধর্ষণের শিকার হচ্ছে দেবী বা মানবীরা। যদি ইতিহাস অনুসন্ধান করা যায়, দেখা যাবে যুদ্ধের মাঠেই ধর্ষণের ঘটনা বেশি ঘটতে দেখা গেছে। শুধুমাত্র নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নারীরাই সেখানে ধর্ষণের শিকার হয়েছে এমন তো নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কী ঘটেছিল? যারা নিষ্ঠুরভাবে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তাঁরা কি অর্ধনগ্ন হয়ে বসে ছিলেন?  নাকি ক্ষমতার আর অস্ত্রের দৌরাত্ম্যে ঘটেছে ঘটনাগুলি?

নুসরাত নামে এক মাদ্রাসার ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছিল মাদ্রাসার এক শিক্ষকের দ্বারা, পোশাকের সেখানে কি অপরাধ ছিল? নুসরাত কি সংক্ষিপ্ত পোশাক পরেছিল? পাশ্চাত্যে বিকিনি পরিধান করে সমূদ্র সৈকতে নারীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেখানে কি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে? সংক্ষিপ্ত পোশাক যদি ধর্ষণের কারণ হয়, তাহলে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ সেখানে ঘটার কথা। বাস্তবে কী ঘটছে? ধর্ষণের ঘটনা সেখানেই ঘটতে দেখা যায় যেখানে রাষ্ট্র এবং প্রশাসন সেটাকে মদত জোগাচ্ছে বা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। সিলেটে ছাত্র নামধারী কিছু পেশীশক্তি যখন স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে ধরে নিয়ে গিয়ে বলৎকার করে, সেই নারী কি অর্ধ নগ্ন ছিল? ভিন্ন দিকে দৃষ্টি ফেরানো যেতে পারে তালিবানদের দিকে। যতোরকম অভিযোগ থাক তাদের বিরুদ্ধে, ধর্ষণের সামান্য অভিযোগ নেই। কারণ সেরকম শিক্ষার বিপরীত শিক্ষাই তারা পেয়েছিল। তালিবান নেতৃত্ব ধর্ষণকে দেখেছে বিরাট অপরাধ হিসেবে। কর্তৃপক্ষের ধর্ষণের পক্ষে মদত ছিল না, মদত না থাকলে খুব বেশি এসব ঘটতে পারে না।

বাংলাদেশে হঠাৎ কিছুদিন ধরে পোশাক পরিধান নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে যেসব প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, সেগুলি খুবই অবান্তর। নতুন একটা বিতর্ক তোলা হয়েছে জল ঘোলা করার জন্য। মানুষ কী খাবে, কী পরিধান করবে সেটা তার ব্যক্তিগত রুচি। বাকি কারো তাতে নাক গলাবার কিছু নেই। বিশ্বের জনসংখ্যা প্রায় আটশো কোটি। সেই আটশো কোটি মানুষ কী খাবে, কী পরিধান করবে, কোন ভাষায় কথা বলবে, কোন ধর্ম পালন করবে, বর্তমান বিশ্বের বিয়াল্লিশশো ধর্মের মধ্যে কোনটাই পালন করবে কি না; সেটা নির্ধারণ করবার অধিকার কারো আছে কি?

ভারতবর্ষে অনেক প্রদেশে যেমন গো-হত্যা করা নিষিদ্ধ। বিশেষ ধর্মের পক্ষে গো-হত্যা নিষিদ্ধ করাটা গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না, মানুষের অধিকার হরণ করা হয়েছে এর মধ্য দিয়ে। কারণ বিশেষ ধর্মের পক্ষে সকল মানুষের গো-মাংস খাওয়ার স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছে এই নির্দেশ জারি করে। ঠিক সেইভাবেই অন্যের পোশাক পরিধান করার স্বাধীনতা কেউ হরণ করতে পারে না। বোরকা যার পরিধান করার করবে এটা তার স্বাধীনতা, কিন্তু অন্য কাউকে জোর করে বোরকা পরিধান করতে বাধ্য করা যায় না। অন্যের পোশাক নিয়ে কথা বলা যায় না। নিশ্চয় কেউ তার নিজের মালিকাধীন গৃহের অভ্যন্তরে তার আইন চাপাতে পারে। একটি প্রতিষ্ঠান তার প্রতিষ্ঠানের চত্ত্বরে তার আইন চাপাতে পারে, তার প্রতিষ্ঠানের বাইরে সে আইন কিছুতেই চাপাতে পারে না। যখন চাপানো হয়, তখন সেটাকেই বলা হয় অন্যের অধিকার হরণ করা; ক্ষমতার অপব্যবহার বা জোরজবরদস্তি ।

যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য শক্তি আফগানিস্তানের মহিলাদের মধ্যে প্রচলিত বোরকা তুলে দিতে চায়, তখন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশুনা করছে তেমন এক চৌকষ আফগান তরুণী যুক্তরাষ্ট্রের এক সেমিনারে গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আফগান নারীরা বোরকা পরিধান করবে কি করবে না, সে সিদ্ধান্ত নেবে আফগান নারীরা। যুক্তরাষ্ট্রের বা বাইরের কারোরই এতে নাক গলাবার কিছু নেই। পাশ্চাত্য যেমন বোরকাকে মনে করে পশ্চাদপদতা, আফগানিস্তানের মানুষ তেমনি পাশ্চাত্যের বিকিনি পরিধানকে পছন্দ করে না। কিন্তু আফগানিস্তানের সরকার কি পাশ্চাত্যের এসব ব্যাপারে নাক গলাতে এসেছে?’ প্রশ্নটা সেখানেই, যার যা ব্যক্তিগত অভিরুচি। কাউকে বাধ্য করবার কিছু নেই। সারা বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নানারকম পোশাক পরিধানের রেওয়াজ রয়েছে, সেইগুলিকে কি কারো একক বা গোষ্ঠীগত ইচ্ছায় নিষিদ্ধ করে, সবার শরীরে একই রকম ‘ইউনিফর্ম’ চাপিয়ে দিতে হবে?

বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে পোশাক প্রশ্নে প্রগতিশীল নামধারীরা পর্যন্ত বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিয়ে থাকেন। মুসলমানরা ইদানিং ব্যাপকভাবে যে হিজাব পরিধান করে থাকে সেটাও তাদের চোখে সমালোচনার বস্তু। হিজাব মানে মাথা ঢাকার জন্য এক টুকরো কাপড়। নারীর মাথার চুল কাঁধ গলা ঢেকে রাখার সংস্কৃতি অনেক দিনের। পাশ্চাত্যের নারীরা যখন বড় বড় ফ্রক পরিধান করতেন তখনো তারা মাথায় একটা গলবস্ত্র বা স্কার্ফ বাঁধতেন। ব্রিটেনের প্রয়াত নারীর মাথায় এরকম স্কার্ফ বাঁধা অনেক ছবি দেখতে পাওয়া যাবে। মাথা ঢাকবার সংস্কৃতিটা শুধুমাত্র মুসলমানদের নয়, সকল ধর্মেরই। খ্রিস্টান নানরা বা সেবিকারা মাথা ঢেকে রাখেন। সেক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যেতে পারে মাদার তেরেসার পোশাক। মুসলমানদের মধ্যে অনেক ধার্মিকরা লম্বা পোশাক পরিধান করার জন্য ব্যাঙ্গ-উপহাসের শিকার হন। কিন্তু ভুলে যান খ্রিস্টান পাদ্রীরা লম্বা একটা আলখাল্লা পরিধান করে থাকেন। লম্বা আলখাল্লা পরিধান করতেন মধ্যযুগের পাশ্চাত্যের রাজা বাদশাসহ অভিজাতরা। মুসলমানদের ক্ষেত্রে তাহলে সেক্ষেত্রে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা হবে কেন?

মরুভূমির মানুষদের মধ্যে লম্বা কুর্তা আর পাগড়ি পরিধান করার সংস্কৃতি ইসলামের আবির্ভাবের আগেই। ফলে এটাকে ইসলামী পোশাক ভাবার সামান্য কারণ নেই। মানুষের পোশাক পরিধান করার প্রথম সংস্কৃতি চালু হয়েছে স্থানীয় ভৌগলিক অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। কারো পোশাক নিয়ে হাস্যরস করাটা তাই ভব্যতার লক্ষণ হতে পারে না। মুসলমানদের মধ্যে হিজাবের বাড়াবাড়ি আরম্ভ হয়েছে, বুশ যখন ওয়ান-ইলেভেনকে কেন্দ্র করে ক্রুসেড ঘোষণা করেছিল আর মুসলিম জগতের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করতে আরম্ভ করে। যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষিত মুসলমানরা অনেকেই তখন নিজের স্বতন্ত্র পরিচয় ধারণ করবার জন্য হিজাবের আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই হিজাবের অনুকরণ চলছে এখন বাংলাদেশে। মাত্র দু-দশকের কথা।

বাংলাদেশের আদালতে আইনজীবীরা গরমের দিনেও যে একটা কালো কোট গায়ে দেন, দুশো বছরের বেশি সময় ধরে সেটাও ব্রিটিশ শাসকদের একধরনের অনুকরণ। বিচারব্যবস্থা বা আইনের তাতে উনিশ-বিশ কিছু আসে যায় না। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন মানুষ শাসকদের দিয়ে যাওয়া বিভিন্ন পোশাক অনুসরণ বা অনুকরণ করে চলেছেন। সারা বিশ্ব জুড়েই তা ঘটছে। বুদ্ধের অনুসারী ভিক্ষুরা এখনো অনেকে পরিধান করেন গেরুয়া, তা একইভাবে অনুসরণ করেন অনেক হিন্দুরাও। ধর্মীয় পোশাক পরিধান বা অনুসরণ করা নিয়ে খ্রিস্টান, হিন্দু, ইহুদি আর অন্যদের সমালোচনা করা না হলেও; সমালোচনা হতে থাকে মুসলমানদের। ব্যাপারটা খুব একপেশে আর অন্যায়। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সেই অন্যায়ের ফলেই মুসলমানরা নিজেদের পোশাকের সম্ভ্রম রক্ষায় আরো কট্টর হয়ে উঠেছে। মূলত তাতে মুসলমানদের বৃহত্তর লাভের চেয়ে ক্ষতিই হচ্ছে বেশি। বিভিন্ন ঘটনা বা তাদের উপর আক্রমণের কারণেই বহু মুসলমানদের কাছে পোশাক একটা গোঁড়ামির পর্যায়ে চলে গেছে। সত্যি বলতে ইসলামের নবীকে পোশাকের ক্ষেত্রে অনুসরণ করাটা আবশ্যক বা ফরজ নয়, সুন্নত। চাইলে কেউ অনুসরণ নাও করতে পারেন।

যারা সংক্ষিপ্ত পোশাক পরা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আর নিজেদের ইচ্ছা জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইছে তাদেরকে মনে রাখতে হবে, শক্তি প্রয়োগের প্রশ্ন উঠলে বিশ্বের চারদিকে বসবাসকারী অন্যরা অনেক বেশি ক্ষমতাশালী। ধরা যাক, পাশ্চাত্য যদি মনে করে সেখানে বসবাসকারীরা চার্চের ইচ্ছার বাইরে ভিন্ন কোনো পোশাক পরিধান করতে পারবে না, তখন কী ঘটবে? সারা বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের মানুষ রয়েছে। যদি ইসলাম ধর্মের লোকরা পোশাকের ব্যাপারে নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে চায়, বাকি ধর্মের মানুষরা তাদের নিজের নিজের রাষ্ট্রে সেটা চাপিয়ে দেয়ার অধিকার রাখে। স্মরণ রাখতে হবে, মতাদর্শগত লড়াই এক ধরনের ব্যাপার আর কারো ব্যক্তিগত রুচির উপরে আক্রমণ করা ভিন্ন প্রসঙ্গ। যারা গরুর মাংস খাবে তাদের যেমন গরুর মাংস খেতে বাধা দেয়া যায় না, যারা শুকরের মাংস খাবে তাদেরকেও তা খেতে বাধা দেয়া যায় না। যার যা ইচ্ছা খাবে, যার যা ইচ্ছা খাবে না। যার যা ইচ্ছা পরিধান করবে, যার যা ইচ্ছা পরিধান করবে না। যদি একপক্ষ কর্তৃত্ব করতে চায়, তাহলে অপরপক্ষও কর্তৃত্ব করতে চাইবে। তখন অহেতুক রক্তপাত ঘটবে।

বর্তমানে পোশাক নিয়ে শিক্ষক হিসেবে আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বহু ছাত্রী হিজাব আর বোরকা পরিধান করে আসে। কয়েকজন এমনভাবে বোরকা পরিধান করে, যাদের চোখ দুটো ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। যখন তারা আমাকে সালাম দেয়, বুঝতেই পারি না যে তারা আমার ছাত্রী। সাধারণত আমি আমার সকল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেখা হলে কথা বলি। কিন্তু তাদের সঙ্গে কথা বলা হয় না। কারণ তাদেরকে আমি চিনতে পারি না; শুধু চোখ দেখে ক্লাসের অনেক ছাত্রীকে কি মনে রাখা সম্ভব? কয়েকদিন আগে দুজন ছাত্রী করিডোরে দাঁড়িয়ে অভিযোগ করলো, ‘স্যার, আপনি কিন্তু আমাদের এড়িয়ে যান’। যখন বুঝলাম দুজনেই আমার ছাত্রী, তখন বললাম শুধু চোখ দেখে কেমন করে চিনবো আপনাদের। দুজনেই হাসলো। বললো, ‘ঠিক বলেছেন স্যার’। তখন মনে পড়লো, ভারতের সন্ত্রাসী আন্দোলনের যুগে বহু বিপ্লবী বোরকা পরে নারী সেজে পুলিশের চোখে ধোকা দিয়ে পালিয়েছিল। ফলে বোরকা অনেকদিন ধরেই কিছুটা সন্দেহজনক পোশাক বিভিন্ন রাষ্ট্র এবং মানুষের কাছেই। বিশ্বের অনেক প্রতিষ্ঠানে তাই বোরকা পরা নিষিদ্ধ। নিশ্চয় সেটা ধর্মীয় কারণে নয়; বোরকা পরিধান করে মানুুষকে বা প্রশাসনকে বিভ্রান্ত করা যায় সে-কারণেই।

বাংলাদেশে এখন মানুষ যে খুব বোরকা পরিধান করছে এর কারণ ধর্মীয় মনে হলেও, আসলে এখানে বাণিজ্যও রয়েছে। বহু বোরকা বিক্রি হচ্ছে, ফলে এটাকে দেশবিদেশের অনেক ব্যবসায়ীরাও ইন্ধন জোগাবে। শত শত বাচ্চা মেয়েরা আমার আশে পাশে বোরকা পরিধান করে যাদের পুতুল খেলার বয়স পর্যন্ত শেষ হয়নি। বিরাট ব্যবসা আছে এখানে। ধরা যাক আফগানিস্তানে যদি বোরকা পরিধান কখনো ত্যাগ করা হয়, কী বিশাল ব্যবসা হারাবে সেখানকার ব্যবসায়ীরা।

মনে রাখতে হবে বোরকা ইসলাম ধর্মের পোশাক নয়। নবীর সময়ে বোরকার খবর পাওয়া যাচ্ছে না। পর্দার বাড়াবাড়ি ইসলাম ধর্মে ছিল না। ইসলামে বলা হয়েছে মার্জিত রুচির কথা। নারীদের শালিনতার কথা। ইসলামে নবীর স্ত্রীসহ বহু নারীকে দেখা গেছে যুদ্ধ করতে। পর্দা আর বোরকা পালন করে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সম্ভব না। বিভিন্ন তথ্যসূত্রে দেখা যাচ্ছে, মুসলমানদের মধ্যে পর্দার বাড়াবাড়িটা এসেছে মধ্যযুগের বাইজানটাইন সভ্যতা থেকে। মুসলমানরা বাইজানটাইন দখল করার আগে তার আশপাশের অনেক অঞ্চল নিজেদের দখলে নিয়ে এসেছিল। প্রথম পর্বের মুসলমানদের স্বভাবের বড় একটা দিক ছিল, খুব দ্রুত অন্যের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করা।  না হলে আজও তারা তাঁবুতেই বাস করতো। মরুভূমির মানুষদের কঠিন সংগ্রামী জীবনে লেখাপড়ার চর্চা ছিল না। ইসলামের নবী তাই লেখাপড়ার প্রতি প্রথম জোর দিলেন। প্রথমেই বললেন, ‘রাব্বি জিদনী ইলমা’ প্রভু আমাদের জ্ঞান দাও, মানে চেতনা দাও। নবী তখন ইহুদী অনেক যুদ্ধবন্দীকে মুক্তি দিয়েছিলেন এই শর্তে যে, তারা মরুভূমির শিশুদের লেখাপড়া শেখাবে। নবীর শিক্ষালাভের প্রতি এই নির্দেশের কারণেই মুসলমানরা সবার আগে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করে। এ ব্যাপারে প্রথম বিরাট ভূমিকা রাখেন মুয়াবিয়ার পুত্র খলিফা ইয়াজিদ। সেকারণেই গ্রীসের সকল জ্ঞানবিজ্ঞান তারা আরবি ভাষায় অনুবাদ করে নেয়। দ্বাদশ শতক পর্যন্ত জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় মুসলমানদের অবদান ছিল বিস্ময়কর।

ইসলাম কট্টর ধর্ম নয়। কট্টর ছিল প্রথম পর্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কালে। টিকে থাকার জন্য।  ইসলাম ধর্ম ছিল বাণিজ্যের পক্ষে। মরুভূমির মানুষকে নবী দস্যুর পেশা বাদ দিয়ে বাণিজ্যে উৎসাহী করে তোলেন। ধর্মের  ক্ষেত্রে তার কথা স্পষ্ট “লা কুম দীনু কুম”। নবীর প্রথম স্ত্রী ছিলেন একজন বড় ব্যবসায়ী। ফলে ইসলামে নারীদের ব্যবসা-বাণিজ্য আর চাকরি-বাকরি করার বাধা নেই। ইসলামে নর ও নারীর জন্য শিক্ষালাভ আবশ্যক বা ফরজ করে দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে বিভিন্ন ধর্মের ক্ষেত্রে যা ঘটে, ইসলামের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। বহু রকম কট্টর ধ্যান ধারণা যুক্ত হয়েছে। ইসলাম ধর্মের মানুষ শুরুতেই বহুভাগে বিভক্ত হয়ে নিজেদের মধ্যে যুগের পর যুগ, শতকের পর শতক ধরে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। কারবালার ঘটনা কে না জানে। কিন্তু ইসলাম ধর্মের শাসকরা সেইসঙ্গে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চাকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন প্রশ্নাতীতভাবে। দ্বাদশ শতক পর্যন্ত এই ধারা বজায় ছিল বাগদাদ, কর্ডোভা,  গ্রানাডা, মালাগা প্রমুখ শহরে। ইসলাম ধর্মের চিন্তাভাবনার ভিতর নানারকম গোঁড়ামি ঢুকে পড়েছে দ্বাদশ শতকের পর, মুসলমানরা তারপর ঠিক উল্টো রাস্তায় হাঁটতে আরম্ভ করে। পনেরো শতক পর্যন্ত মুসলমানদের ইতিহাস ছিল দেশ জয়ের ইতিহাস। কিন্তু এরপর থেকে গোঁড়ামির জন্য সবরকম অগ্রগতি বন্ধ হয়ে যায়। ইসলাম ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষরাই একদা জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিক্ষার ক্ষেত্রে বিরাট বিরাট সব অবদান রেখেছিলেন। প্রায় পাঁচশো বছর ছিল সেই অগ্রগতির কাল। তারপর গত এক হাজার বছরে আর জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় তেমন কোনো অবদান নেই মুসলমানদের। মুসলমানদের মধ্যে যেন পোশাকি ব্যাপারটা প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশ ত্রিশ বছর আগেও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রীদের বোরকা পরিধান করতে দেখা যায়নি, পাকিস্তান আমলেও না। সার্বিকভাবে নারীরা কি তখন এখনকার চেয়ে কম ধার্মিক ছিলেন? শ্রমজীবীরা মানুষদের কখনোই পর্দার বাড়াবাড়ি মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না, বাস্তব কারণেই। সত্যি বলতে সেটা এখনো সম্ভব নয়। যখন বাংলাদেশে পর্দার বাড়াবাড়ি চলছে, সৌদি আরব নতুন পথে হাঁটছে। ইসলামের সূতিকাগার সৌদি আরবে কিছুদিন ধরে রাজ-পরিবার নারীদের  যেসব সুযোগ সুবিধা দিয়েছে, বাংলাদেশের মুসল্লিরা কি তাতে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে? সত্যিকার অর্থে পোশাক মানুষের মূল কোনো পরিচয় নির্ধারণ করে না। মানুষের ভালোমন্দ পোশাক দিয়ে নির্ধারিত হয় না। ধর্ম দিয়েও নয়। বংশ মর্যাদা বা পেশার দ্বারাও নয়। মানুষের মূল পরিচয় নির্ধারিত হয় তার কর্মদ্বারা। মনে রাখতে হবে, পোশাক মানুষকে বিভ্রান্ত করে। সম্মানিত পুরোহিতের পোশাক পরিধান করে মানুষ কুকর্মে অংশ নিতে পারে। মানুষের নিজেকে পাল্টাতে সময় লাগে, শরীরের পোশাক পাল্টাতে সময় লাগে না। মুখোশধারী মানুষের মতো, পোশাক একটা মুখোশ হয়ে উঠতে পারে। নানারকম ভদ্রলোকের পোশাকের আড়ালে যেমন দুর্নীতি-কুকর্ম হচ্ছে, ধর্মীয় লেবাসের আড়ালেও হচ্ছে প্রতিদিন।

মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার হরণ করতে গেলে, পরস্পরের মধ্যে বিরোধ লাগবেই। নানা রকম সংঘাত দেখা দেবে, যার পরিণতি কারো জন্যই ভালো হবে না। প্রত্যেকের ব্যক্তিগত রুচি এক হতে পারে না। প্রত্যেকের খাওয়ার পরিমাণ যেমন সমান নয়। ফলে অন্যের ব্যক্তিগত অধিকার নিয়ে কথা না বলে, সকলের নিজ নিজ ব্যক্তিগত অধিকারগুলো সংরক্ষণ করাটাই হোক তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। আর একজনের স্বাধীনতা নষ্ট করে নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দিলে সেটা হয় গোয়ার্তুমি আর গুণ্ডামীর নামান্তর।

লেখক পরিচিতি:
রাহমান চৌধুরী, লেখক, শিল্প সমালোচক
Raahman Chowdhury

ফিচার ফটো সৌজন্য: প্রতিদিনের সংবাদ

*প্রকাশিত লেখার মতামত ও বানানরীতি লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই প্রকাশিত লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই। – সম্পাদক

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট