চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই যুগে যেখানে বাণিজ্য সংঘাত এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জটিল বিষয়গুলো মোটের ওপর আলোচনার বিষয়বস্তু, সেই সময়ে এসেও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকগণ সার্ক (দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা) কে নতুন ছাঁচে মুড়ে ফেলার ওপর জোর দিচ্ছেন যে সংস্থাটি তা ১৯৮৫ সালের ৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশের উদ্যোগে গঠিত হয়েছিল। তবে ২০১৪ সালের পর এই সংস্থাটির কোন ধরনের কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না।
দক্ষিণ এশিয়ার ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জগুলো যেমন সন্ত্রাসবাদ, পারমাণবিক দ্বন্দ্ব, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত হুমকি ইত্যাদি মোকাবেলা করার জন্য সত্যিকার অর্থে এই দেশগুলোর স্বতন্ত্র কোন প্ল্যাটফর্ম নেই।
বর্তমান সময়ে সার্কের ভূমিকা অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় অধিকতর জরুরী কারণ বিভিন্ন বাড়তি দুশ্চিন্তা যেমন চায়না-আমেরিকা বাণিজ্য যুদ্ধ বা বর্তমান কাশ্মীর পরিস্থিতি নিয়ে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের সম্মুখীন।
নিঃসন্দেহে ভারত এ অঞ্চলের সর্ববৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্র। তবে বর্তমানে ভারত শুধু আঞ্চলিকভাবে নয়, একটি বৈশ্বিক পরাক্রমশালী রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ইচ্ছা পোষণ করছে। এক্ষেত্রে সে তার প্রতিবেশী ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলোকে সুতোয় না বেঁধে কেমন যেন অসংলগ্ন অবস্থায় রেখে দিয়েছে। এজন্যই ছোট ছোট রাষ্ট্র গুলো যেমন বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা এসব দেশের অতি সত্বর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত সার্ককে কার্যকর করার ক্ষেত্রে।
দক্ষিণ এশিয়াতে প্রায় ১.৮ মিলিয়ন অধিবাসী আছে যা গোটা বিশ্বের প্রায় ২৫ ভাগ। তবে এই মানুষদের প্রায় ৪০ ভাগই দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে।
বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি যেখানে ২% সেখানে দক্ষিণ এশিয়ার প্রবৃদ্ধি ৬% , তবুও এই অঞ্চলে বৈষম্য এত প্রকট। এই প্রবৃদ্ধি কে বিশ্লেষকরা বলছেন কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি।
সার্ক প্রতিষ্ঠিতই হয়েছিল আঞ্চলিক সহযোগিতা উন্নত করার লক্ষ্যে। এই অঞ্চলের দেশ গুলো নিজেদের মধ্যে মাত্র ৫ ভাগ বাণিজ্য করে থাকে।
বর্তমানে সার্কের কোন কার্যক্রমই আমরা দেখছি না। ২০১৪ সালের পর কোন সার্ক সম্মেলন হয়নি। ভারত ১৯তম সার্ক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করে ২০১৬ সালে কাশ্মীরের উড়িতে সন্ত্রাসী হামলায় পাকিস্তানের জড়িত থাকার অভিযোগ জানিয়ে।
এই অঞ্চলটি পৃথিবীর সবচেয়ে কম মনোযোগ পাওয়া অঞ্চল গুলোর একটি যদিও এখানকার জনসংখ্যা বিশাল। এর মুল কারণ হচ্ছে নিজেদের মাঝে পারস্পরিক বিশ্বাসের ঘাটতি।
ভারত এখন বিমসটেক (বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টরাল, টেকনিক্যাল এন্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন) এর প্রতি বেশী মনোযোগী যেটার সদস্য বাংলাদেশ এবং ভারত ছাড়াও মায়ানমার, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড এবং ভুটান। তবে বিশ্লেষক রা মনে করেন সার্কের বিকল্প বিমসটেক হতে পারেনা।
এই সময়ে যেখানে প্রযুক্তিই সবকিছু পরিচালনা এবং নির্ধারণ করছে, সেখানে ভবিষ্যতে বেকারত্ব পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। এছাড়াও সন্ত্রাসবাদ ও পারস্পরিক দ্বন্দ্ব বেড়েই চলেছে যা অর্থনীতিতে সরাসরি প্রভাব ফেলবে। এসবের ফলে এই অঞ্চলে অর্থপ্রবাহ কমে যেতে পারে আর এজন্যই আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধি করা সময়ের দাবি। নীতিনির্ধারকদের এই বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করা উচিত।
দক্ষিণ এশিয়ার পক্ষে অন্যতম বৈশ্বিক শক্তিতে পরিণত হওয়া সম্ভব যদি নিজেদের মাঝে নিরাপত্তাজনিত উত্তেজনা কমানো সম্ভব হয়। পরমাণুশক্তি সমৃদ্ধ দুটি রাষ্ট্রই এই উত্তেজনা ক্রমশ বাড়িয়ে তুলছে।
আমাদের এই অঞ্চলের সক্ষমতা খুবই কম সকল ক্ষেত্রে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভবিষ্যতে লাখ লাখ অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অভিবাসন দেখা যাবে। পানি ও সীমান্ত বিষয়ক মতভেদগুলো এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। যদি আমরা আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে না পারি তবে কখনোই বৈশ্বিকভাবে আমাদের পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভবপর হবে না।
সার্ক হতে পারে আলোচনা শুরুর একটা মাধ্যম। সব ধরনের দ্বিপাক্ষিক সমস্যাগুলো নিয়ে এখানে আলোচনা হতে পারে। জনসংখ্যা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কৌশলগত ভূরাজনৈতিক অবস্থানের তুলনায় আমাদের এই জনবহুল অঞ্চলটি বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে তেমন নজরে আসতে পারছে না। সে তুলনায় চায়না, আসিয়ান, এমনকি আফ্রিকান ইউনিয়ন বৈশ্বিকভাবে এর চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ এর ক্ষেত্রে।
একদিকে পাকিস্তান আস্তে আস্তে চায়নার প্রতি নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে, আরেকদিকে ভারত আসিয়ান আর পশ্চিমের প্রতি। ভারত চায়নার আকাঙ্ক্ষিত বহু আলোচিত ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ (বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ) কে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। তারা মূলত জাপান এবং আমেরিকার প্রস্তাবিত অবাধ ও উন্মুক্ত (ইন্দো-প্যাসিফিক) কৌশলের প্রতি আগ্রহী। অবশ্য বাংলাদেশ এর দুইটাতেই অংশ নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
নিজস্ব অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্র গুলো যেভাবে জনতুষ্টবাদী নীতি প্রণয়ন করছে তা উদ্বেগজনক। আমাদের আসিয়ান থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত কারণ বিভিন্ন মতভেদের পরেও তারা পারস্পরিক সহযোগিতা বজায় রেখে চলেছে। সংকীর্ণ ভূরাজনৈতিক স্বার্থ পরিত্যাগ করতে না পারলে আমাদের পক্ষে এটা সম্ভব নয়।
এই শতাব্দী এশিয়ার এবং আমরা দক্ষিণ এশিয়াকে টুকরো টুকরো বিচ্ছিন্ন অঞ্চল হিসেবে দেখতে চাই না নিশ্চয়ই! ভারতীয় উপমহাদেশের একটি নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে যা আমাদেরকে একত্রিত করতে পারে। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই বিভেদ ভুলে একসাথে কাজ করে যেতে হবে।
শত বছর ধরে যুদ্ধে লিপ্ত থাকা ইউরোপ যদি একত্রিত হতে পারে তবে আমরা কেন নয়?
পঙ্কজ গোস্বামী
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক