সার্জেন্ট জহুরুল হক ও দুটি গুরুত্বপূর্ণ বই । আবুল হাসনাত

Comments

কোনো কোনো সুমুদ্রিত ও তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ যে শিকড়সন্ধানী হয়ে ওঠে এবং স্পন্দিত করে পাঠকের হৃদয়মন– একথা তো নতুন নয়। তবু বলছি, আমি প্রবলভাবে আলোড়িত হয়েছি সার্জেন্ট জহুরুল হককে নিয়ে একটি গ্রন্থ পাঠ করে– আগরতলা মামলার অনুচ্চারিত ইতিহাস ও শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক। গ্রন্থটি সম্পাদনা ও প্রাসঙ্গিক বিষয় গ্রথিত করেছেন নাজনীন হক মিমি ও ড. আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন। দু’জনের আন্তরিক প্রয়াসে এ হয়ে উঠেছে আগ্রহ উদ্দীপক একটি গ্রন্থ।

এই গ্রন্থটি পাঠ করে একদিকে আমি সমৃদ্ধ হয়েছি, অন্যদিকে স্বাধীনতার বেদীমূলে উৎসর্গিত একজন মানুষের ও পরিপার্শ্ব সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছি। সার্জেন্ট জহুরুল হকের এই জীবন উৎসর্গ সম্পর্কে অবহিত ছিলাম না তা নয়; সে সময়ের দৈনিক কাগজগুলো দেখলেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তবে সব নয়, এই গ্রন্থটিতে উন্মোচিত হয়েছে আদ্যপ্রান্ত ঘটনাবলি। সার্জেন্ট জহুরুল হক ও সহবন্দি ফজলুল হককে পাকিস্তানিরা ক্যান্টনমেন্টের বন্দিশিবিরে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করেছিল। ১৯৬৯ সালের এই ঘটনাবলি যেমন গণ-অভ্যুত্থান সম্ভব করেছিল, তেমনি স্বাধীনতা-আন্দোলনের পথও নির্মাণ করেছিল। এই গ্রন্থটি পাঠ করার সময় ষাটের দশকের ছাত্র ও রাজনৈতিক আন্দোলন যে কত সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করেছিল তা মনে পড়ল।

বইটির ভূমিকা বা প্রাক কলমে নাজনীন হক মিমি জানান, বইটির জন্য সাক্ষাৎকার গ্রহণে ২০১২ সালে তিনি উদ্যোগী হন। আগরতলা মামলার ৩৫ জনের মধ্যে ১০ জন অভিযুক্ত তখন জীবিত ছিলেন। তবুও তিনি নিরুৎসাহিত হননি। মামলার পটভূমিও প্রাসঙ্গিক বিষয় জানার আগ্রহ নিয়ে গবেষকের মতো অনুসন্ধানে উদ্যোগী হন। মৃত আসামিদের কয়েকজনের পরিবারের সদস্যদের খুঁজে বার করেন ও তাদের থেকে অজানা তথ্য সংগ্রহ করেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে এই মামলার অনুপুংক্ষ বিষয় ও আন্দোলন সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারেন এবং সংগৃহীত তথ্য সম্পাদিত করে এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করেন। এই কথোপকথনে তাঁদের স্বদেশ চেতনা ও অঙ্গীকার স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

এই গ্রন্থের মূল্য বৃদ্ধি করেছে তৎকালীন ছাত্র আন্দোলন ও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা তোফায়েল আহমেদের সাক্ষাৎকার। এটি ক্ষুদ্র হলেও তাৎপর্য বহন করে। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এদেশের ছাত্রসমাজ সামরিক শাসনবিরোধী যে-আন্দোলনের সূচনা করেছিল তা ইতিহাসের অন্তর্গত হয়ে আছে। এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র দেশে। একদিনের জন্যও আর থেমে থাকেনি। বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজকে দমন করার জন্য পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়েছিল। এ-আন্দোলনের মর্মের মধ্যে ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, স্বায়ত্তশাসন, সকল শোষণ ও বঞ্চনার অবসান মানবিক স্বাধীনতা অর্জন এবং বাঙালির স্বরূপচেতনার উজ্জীবন।

ধর্মীয় আবরণের সকল চিহ্নকে ধারণ করেও বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি পাকিস্তানিদের থেকে যে কত পৃথক পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে সে কথা তখন বলা হয়েছিল। এই যাত্রা সত্যিকার অর্থেই মুক্তিযুদ্ধের পথ নির্মাণ করেছে। নানা চড়াই-উতরাই পেরোনোর জন্য এদেশের ছাত্রসমাজকে বহু মূল্য দিতে হয়েছে। জেল ও জুলুম সহ্য করতে হয়েছে। বহু ছাত্র আত্মাহুতি দিয়েছে। স্বাধীনতার সড়কে এই উৎসর্গের তালিকাও বেশ দীর্ঘ।

উনিশশ’ বাষট্টি সালে যখন এই ছাত্র আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল তখন দেশে রাজনৈতিক কর্ম নিষিদ্ধ। বহু রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। ১৯৬২ সালের ছাত্র-আন্দোলন সূচনারও এক পটভূমি ছিল। অনেকের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, সকল রাজনৈতিক কর্ম নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ দুই নেতা ছাত্র-আন্দোলন গড়ে তোলার কর্মপন্থা ও কৌশল নির্ধারণের জন্য তৎকালীন খ্যাতনামা দুই সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও জহুর হোসেন চৌধুরীর উদ্যোগ ও মধ্যস্থতায় গোপনে এক বৈঠকে মিলিত হন।
এই বৈঠকের বিবরণ ধরা আছে কমিউনিস্ট নেতা খোকা রায়ের একটি স্মৃতিকথায়। বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক সংগ্রাম ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে এই অঞ্চলের মানুষের এতটুকু বনিবনা হবে না। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলাকে শোষণই করবে, কোনো রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার দেবে না। শোষণ, বঞ্চনা ও নিপীড়ন এবং কর্তৃত্ববাদী মনোভঙ্গি নিয়ে যেভাবে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে তা এই অঞ্চলের বাঙালিকে ষাটের দশকের প্রারম্ভেই নবীন উপলব্ধির জগতে নিয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তখন থেকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ছিন্ন করে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার স্বপ্নে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিলেন। খোকা রায় সেই বৈঠকের বিবরণ দেন এইভাবে : ‘আন্দোলনের দাবি নিয়ে আলোচনার সময় শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন যে, পাঞ্জাবের ‘বিগ নট বিজনেস’ যেভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করছিল ও দাবিয়ে রাখছিল তাতে ওদের সাথে আমাদের থাকা চলবে না। তাই এখন থেকেই স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে; আন্দোলনের প্রোগ্রামে ওই দাবি রাখতে হবে’ ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধুর এই উক্তি ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত করার জন্য তাঁর সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা কত তীব্র ও গভীর ছিল তা আমরা বুঝে নিতে পারি। ষাটের দশকের প্রারম্ভেই পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করা ছাড়া যে গত্যন্তর নেই এ কথা তিনি সে সময়েই ভেবেছেন। বাংলাদেশকে স্বাধীন করবার জন্য বঙ্গবন্ধুর বহুমুখী রাজনৈতিক তৎপরতার দিকে দৃষ্টিপাত করলে তাঁর প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক কর্মপ্রবাহ আমাদের কাছে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বিশেষত আজ যখন আমরা বঙ্গবন্ধু লিখিত অসমাপ্ত আত্মজীবনীটি পাঠ করি আমাদের কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে পঞ্চাশের দশক থেকেই– তাঁর রাজনৈতিক কর্মে স্বজাত্যবোধ অর্জনের লক্ষ্যে তিনি কতভাবেই না দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন। স্বাধীনতার আন্দোলন বিচ্ছিন্ন কোনো প্রয়াস ছিল না। খোকা রায় পূর্বে উল্লিখিত স্মৃতিচারণে বলেছিলেন, তখন আমরা (আমি ও মণিদা) শেখ মুজিবকে বুঝিয়েছিলাম যে, ‘কমিউনিস্ট পার্টি নীতিগতভাবে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের দাবি সমর্থন করে; কিন্তু দাবি নিয়ে প্রত্যক্ষ আন্দোলনের পরিস্থিতি তখনো ছিল না।’ স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান দাবি নিয়ে ওইসব আলোচনার পরের বৈঠকে শেখ মুজিব আমাদের জানিয়েছিলেন, ‘ভাই, এবার আপনাদের কথা মেনে নিলাম। আমাদের নেতাও (অর্থাৎ সোহরাওয়ার্দী সাহেব) আপনাদের বক্তব্য সমর্থন করেন। তাই তখনকার মতো সেটা মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমার কথাটা থাকল ইত্যাদি।’

শত পীড়ন সত্ত্বেও ১৯৬২ সালের ছাত্র-আন্দোলন সেই সময়ে রাজনৈতিক আন্দোলনকেও দীপ্ত করার জন্য প্রেরণা সঞ্চার করেছিল। গণবিরোধী শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের আন্দোলন ও বন্দিমুক্তিসহ স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছিল। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সমাজে শিক্ষিত বাঙালি ও কৃষক-শ্রমিকসহ সকল মানুষের মধ্যে জাগরণের এক মন্ত্র দেদীপ্যমান হয়ে উঠেছিল। এ নবজিজ্ঞাসায় আলোড়িত করেছিল সমাজকে। ঐতিহ্য ও স্বরূপ অন্বেষণে নবমাত্রা সৃষ্টি বাঙালিত্বের সাধনা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চায় বাঙালি স্বরূপ যে অবিচ্ছিন্ন এ কথাও গভীরভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিল।

’৬২ সালের ছাত্র-আন্দোলনের কিছুদিন পূর্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন খ্যাতিমান শিক্ষক, বিশেষত রেহমান সোবহান ও নূরুল ইসলাম সেমিনার ও লেখনীর মাধ্যমে এ অঞ্চলের মানুষকে দেখিয়েছিলেন বাঙালিকে কতভাবে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শোষণ ও বঞ্চনা করছে। তাঁরা জনগণকে ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই ধারণা সঞ্চারিত করেছিলেন যে, পাকিস্তানের দুই অংশে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে দুই অর্থনীতি সচল রয়েছে। এবং পূর্ব পাকিস্তান বহুভাবে প্রতারিত ও শোষিত হচ্ছে এবং পূর্ব বাংলার জনসাধারণ থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে সমৃদ্ধ করা হচ্ছে। রেহমান সোবহানের ও নূরুল ইসলামের আত্মজীবনী ও নানা লেখনীতে তাঁদের ঐকান্তিক প্রয়াসের উল্লেখ আছে। এই সময়ে বিভিন্ন লেখনী সেমিনারের মাধ্যমে তারা অঙ্গীকার নিয়ে যে প্রচার চালিয়েছিলেন তা পূর্ব বাংলার জনগণকে সচেতন করেছিল ও পাকিস্তানিদের শোষণ বঞ্চনার ধরন সম্পর্কে অবহিত করে যাচ্ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিমনা শিক্ষকবৃন্দ তাদের দুই অর্থনীতির এই তত্ত্বকে প্রবলভাবে সমর্থন করেছিলেন। এমনকি তাঁরা পাকিস্তানেরও বৃহত্তর অর্থনীতি সম্মেলনেও পূর্বাঞ্চলের বঞ্চনা বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন। তথ্য ও তত্ত্ব দিয়ে তারা প্রমাণ করেছিলেন, পাকিস্তানিদের শাসন ক্ষমতার আওতা থেকে না বেরোতে পারলে পূর্ব বাংলার বাঙালি সমাজের মুক্তি নেই। রাষ্ট্রীয় আনুগত্য সত্ত্বেও দুই অঞ্চলের অর্থনীতি এবং পূর্ব বাংলাকে বঞ্চনার স্বরূপ তাদের বিশ্লেষণে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। অর্থনীতিসহ এ অঞ্চলের প্রগতিশীল মানুষের মধ্যে এ নব্য ভাবনারও সঞ্চার করেছিল। মনে পড়ে, এই সময়ে আমরা ছাত্রসংগঠনের কর্মীরাও নানাভাবে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিলাম। উপলব্ধি করেছিলাম, পাকিস্তানের দুই অংশে বিদ্যমান আর্থনীতিক ব্যবস্থা পূর্ব বাংলাকে কীভাবে শোষণ করেছে। ছাত্র-আন্দোলন ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হয়ে উঠছে তখন, সঙ্গে রাজনৈতিক আন্দোলনও জনগণকে শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ থেকে মুক্তির জন্য নানাভাবে প্রয়াসী হয়ে উঠেছিল। পীড়ন সত্ত্বেও ছাত্রসমাজের ও রাজনৈতিক দলগুলোর ধারাবাহিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্রমে এদেশের মানুষও রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠছিল।

এই পটভূমিতে ঘোষিত হয়েছিল ছয় দফা। ছয় দফা শুধুমাত্র স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছিল না। এই অঞ্চলে বাঙালির স্বাতন্ত্র্য, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে পাকিস্তানিদের কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণ অবসানের লক্ষ্যে এই দাবি উত্থাপন করা হয়েছিল।

ছয় দফা আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলন। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৬ দফা দাবি পেশ করেন।

১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায়ও ছয় দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিরোধীদলীয় সম্মেলনে ছয় দফা পেশ করেন। এরপর ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে আমাদের দাবি : ছয় দফা কর্মসূচি শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রচার করা হয়। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ছয় দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী তীব্র গণ-আন্দোলনের সূচনা হয়। এই দিনে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হক, মুজিবুল হকসহ মোট এগারোজন বাঙালি শহিদ হন। ছয় দফা আন্দোলনের প্রথম শহিদ ছিলেন সিলেটের মনু মিয়া।

ছয় দফা বাঙালিকে উদ্দীপিত করে তোলে; বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সমগ্র দেশে এই দাবির সমর্থনে সমাবেশ করতে থাকে। প্রতিটি সমাবেশে উচ্চারিত হতে থাকে এই দাবির সমর্থনে ধ্বনি। এই দাবি হয়ে ওঠে এই অঞ্চলের বাঙালির মুক্তির সনদ।
পরবর্তীকালে বহু ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ করেছেন যে, ছয় দফার মধ্যেই নিহিত ছিল এই অঞ্চলের বাঙালির স্বাতন্ত্র্য ও রাজনৈতিক মুক্তির দিকদর্শন।

ছয় দফা দাবির সমর্থনে যে জাগরণ সৃষ্ট হয়েছিল তা দিনে দিনে এ অঞ্চলের মানুষকে বৃহত্তর সংগ্রামে উজ্জীবিত ও জাতীয় স্বরূপচেতনায় এনে দিয়েছিল বৃহত্তর মাত্রা। ছাত্রসমাজের এগারো দফা দাবিও ঘোষিত হলো। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমর্থন ও উদ্যোগে এই এগারো দফা দাবিও ব্যাপকতা নিয়ে ছাত্র-আন্দোলনকে করে তুলেছিল দীপ্ত। সেজন্য পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা বঙ্গবন্ধুকে বারংবার কারাগারে বন্দি করেছে। মুক্তি পাওয়ার পর আবার গ্রেফতার হয়েছিলেন তিনি, এমনকি জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর জেলগেট থেকেও গ্রেফতার হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু তখন হয়ে উঠছিলেন এ অঞ্চলের বাঙালির মুক্তির একক দিশারি ও দাবি আদায়ের লক্ষ্যে দৃঢ় ও অনমনীয়। তিনি যে জাতীয় জাগরণের সৃষ্টি করছিলেন এবং স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের আপামর জনগণকে দীপিত করছিলেন তা পাকিস্তানি শাসকদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল।

দেশের সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতাকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্য নিয়ে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকেরা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। বঙ্গবন্ধু ও ৩৫ জন দেশপ্রেমিক নাগরিকের বিরুদ্ধে এই মামলা যখন ঘোষিত হলো- বন্দি হলেন ৩৫ জন। এই মামলা দায়েরের ঘটনায় একদিকে মানুষ হতবাক হয়েছিলেন। অন্যদিকে পাকিস্তানিদের রাজনৈতিক অভিসন্ধি সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দেশের মানুষ ও ছাত্রসমাজকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। প্রতিবাদের ধ্বনি উঠেছিল রাজপথে। এই আন্দোলন ও মামলা চলাকালে ক্যান্টনমেন্টে সার্জেন্ট জহুরুল হক ও আরেকজন বন্দি ফজলুল হককে ক্যান্টনমেন্টে বন্দি অবস্থায় গুলি করে পাকিস্তানি বাহিনী। হাসপাতালে নিলেও বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখা হয় দীর্ঘক্ষণ। বিনা চিকিৎসায় অত্যধিক রক্তক্ষরণে মারা যান সার্জেন্ট জহুরুল হক। এই হত্যার কথা দাবানলের মতো ছড়িয়ে যায় বাংলার সর্বত্র।

এই মামলা ও সার্জেন্ট জহুরুল হকের আত্মাহুতি তৎকালের রাজনৈতিক প্রবাহে যে স্পন্দন তুলেছিল তা বাঙালি সমাজকে বৃহত্তর সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং বাঙালি বোধে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, পাকিস্তানিদের সঙ্গে থাকা অসম্ভব।

আসলে ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের অভিঘাত দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনকে সঞ্জীবিত করেছিল। ছয় দফা যেভাবে দেশের গণমানুষ, শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনকে সঞ্জীবিত করেছে। পেছন ফিরে তাকালে খুবই আলোড়িত করে হৃদয় ও মনকে। ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে মওলানা ভাসানীর গভর্নর ভবন ঘেরাও কর্মসূচি ও পরবর্তীকালে আইয়ুববিরোধী রাজনৈতিক আন্দোলন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াসী বৃহৎ রাজনৈতিক প্লাটফরম সরকারবিরোধী আন্দোলনে আশার সঞ্চার করেছিল। ছয় দফাকে আরও প্রসারিত করার আকাঙ্ক্ষা থেকে ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি এগারো দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ও ডাকসু নেতৃবৃন্দ এই আন্দোলনকে গণমুখী করার জন্যও ব্যাপকভিত্তিক ছাত্র গণসংগ্রাম গড়ে তোলার লক্ষ্যে দেশব্যাপী নানা কর্মসূচি দিতে থাকেন। ছয় দফার সঙ্গে শ্রমিক কৃষকদের দাবি সম্বলিত আরো কয়েক দফা দাবি সংযোগ করায় এই এগারো দফা হয়ে ওঠে সকল মানুষের হৃদয়ের কথা। এই আন্দোলন ঘোষণার পর হয়ে ওঠে সমউপযোগী। এ দাবির সঙ্গে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিও আরো সচল ও গহীন হয়ে ওঠে। মামলার বিবরণে পূর্ব বাংলার গণমানুষ একদিকে বিচলিত হয় ও অন্যদিকে বিক্ষুব্ধ হয়।

২০১৫ সালের বইমেলায় নাজনীন হক মিমি ও ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন আগরতলা মামলার অনুচ্চারিত ইতিহাস ও শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক শীর্ষক একটি সম্পাদিত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল জার্নিম্যান বুক্স থেকে। স¤প্রতি আমি এ গ্রন্থটি পাঠ করে আন্দোলিত হয়েছি। ফিরে গেছি সেই উত্তাল দিনগুলোতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর রেস্তোরাঁয় আর ইকবাল হলের বৈকালিক ছাত্রসংগঠনগুলোর যৌথ সভায়– পরবর্তীকালে (জহুরুল হল) অগ্নিঝরা দিনগুলোতে। ছাত্র-আন্দোলনের একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে এই আগরতলা মামলা ও সার্জেন্ট জহুরুল হকের এই আত্মাহুতি যে কত তাৎপর্যময় ছিল পেছন ফিরে তাকালে তা আজ উপলব্ধি করি। সার্জেন্ট জহুরুল হকের এই আত্মাহুতির পরই দেশের রাজনৈতিক পট সম্পূর্ণ পালটে যায়। পাকিস্তানি স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সরে আসেন এবং বাধ্য হন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করতে। বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন এই অঞ্চলের মানুষের অবিসংবাদী নেতা।

বঙ্গবন্ধুর এই অদম্য ও অপ্রতিরোধ্য রাজনৈতিক কর্মকে প্রতিহত করার জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগ নেতা ও পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করেছিল। ১৯৬৮ সালের প্রথম ভাগে দায়ের করা এই মামলায় অভিযোগ করা হয় যে, শেখ মুজিব ও অন্যরা ভারতের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এই মামলাটির পূর্ণ নাম ছিল রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান গং মামলা। তবে এটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে বেশি পরিচিত। কারণ মামলার অভিযোগে বলা হয়েছিল যে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় কথিত ষড়যন্ত্রটি শুরু হয়েছিল।

মামলা নিষ্পত্তির চার যুগ পর মামলার আসামি কর্নেল শওকত আলী ২০১১ সালে প্রকাশিত একটি স্বরচিত গ্রন্থে এ মামলাকে সত্য মামলা বলে দাবি করেন। এছাড়া আগরতলার এক খ্যাতনামা সাংবাদিক বিকচ চৌধুরীও একটি নিবন্ধে জানান যে, বঙ্গবন্ধু ভারত সরকারের সর্বাত্মক সাহায্যের জন্য গিয়েছিলেন।

শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক ও মুক্তিযুদ্ধ গ্রন্থটির লেখিকা নাজনীন হক মিমির কাকা ছিলেন সার্জেন্ট জহুরুল হক। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি অবস্থায় ১৯৬৯ সালে ১৫ জানুয়ারি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁকে গুলি করায় তিনি ও সহবন্দি ফজলুল হক আহত হন। তাঁদের দুজনকে ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতালে নেওয়া হলেও বিনা চিকিৎসায় জহুরুল হক মারা যান। অত্যাধিক রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু ঘটে।

জহুরুল হককে হত্যার খবর এসে বাড়ির অন্দরমহলে পৌঁছলে মিমির বাবা ও কাকাদের মধ্যে যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ও শোক আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তা নাজনীন হক মিমির ছোট্ট হৃদয়ে গেঁথে যায়। তিনি তখন খুব ছোটো হলেও পরিবারের অভ্যন্তরে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা হৃদয়ে দীর্ঘদিন ধারণ করে রেখেছিলেন। কাকার ভালোবাসা ও স্নেহ পেয়েছিলেন তিনি। এ সময়ের যৌথ পরিবারের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্মৃতি তার মনে গেঁথে গিয়েছিল। পরিবারের সদস্যদের দেশচেতনায় আত্মত্যাগ, রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও দেশপ্রেমের কথা শুনে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। তাঁর মানস গঠনের পর্বে বাবা ও কাকা দেশের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা বাস্তবে রূপ দেবার জন্য প্রাণন্তর প্রচেষ্টায় ছিলেন। সেই সব দিনে কাকা সার্জেন্ট জহুরুলের স্নেহ কতভাবে লেখিকাকে প্রাণোচ্ছল করত তা তার মনে পড়ত। এই বইয়ে পারিবারিক বৃত্তের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ও তা তিনি গ্রথিত করেছেন ভালোবাসা নিয়ে। এ হত্যাকাণ্ড তৎকালীন বাঙালি সমাজকে শুধু স্তব্ধ করেনি; পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল এবং দেশের রাজনৈতিক প্রবাহকে পালটে দিয়েছিল। প্রতিবাদের ঢেউ আছড়ে পড়েছিল সমগ্র দেশে। জেল, জুলুম বা কারফিউ দিয়েও এ প্রতিবাদ ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। মিথ্যা প্রেসনোট দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াসী হয়েছিল। তখন আগরতলা মামলার পাকিস্তানি বিচারকদের বাসভবন আক্রান্ত হওয়ায় তাঁরা পালিয়ে যান ঢাকা থেকে। শুধু তাই নয়, প্রতিবাদ ও আন্দোলনের তীব্রতায় আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। শাসকরা ও স্বৈরশাসক লৌহমানব আইয়ুব খান বাধ্য হন পদত্যাগ করতে। সেদিক থেকে দেখলে সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যু কত মহৎ ও পবিত্র হয়ে উঠেছে আমাদের কাছে, একথা বলে শেষ করা যায় না। ১৯৬৯ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি জহুরুল হক ও সঙ্গী কারাবন্দি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি ফজলুল হককে গুলি করে। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে মারা যান। তখন লেখিকার বয়স ছিল পাঁচ বছর। এই সেই সার্জেন্ট জহুরুল হক, যার দেশপ্রেম শিখরস্পর্শী এবং বাঙালি সমাজকে শোষণমুক্ত করার অভিপ্রায়ে পাকিস্তানিদের সকল পীড়ন অগ্রাহ্য করে মুক্ত স্বদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীতে কর্মরত দেশপ্রেমী বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন দেশকে শত্রুমুক্ত করার অভিপ্রায়ে দেশাত্মচেতনায় প্রাণিত বিপ্লবী পরিষদ গঠন করে- স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁরা। এই স্বপ্ন দেখা এবং দেশকে পাকিস্তানিদের হাত থেকে রক্ষা করার এই আকাক্সক্ষা যে কতভাবে অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছিল এবং সশস্ত্র যুদ্ধ ছাড়া বাঙালির যে মুক্তি নেই এ তাঁদের আদর্শ ও ধমনিতে মিশে গিয়েছিল। সমস্ত মুক্তিযুদ্ধে তা প্রমাণিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনকে আসামি করা হয়েছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়।

জহুরুল হক ছিলেন এই ৩৫ জনের মধ্যে সর্বাধিক সক্রিয়। প্রাণবন্ত মানুষ। ক্যান্টনমেন্টে বন্দি অবস্থায় সহযোদ্ধাদের সর্বদা বৃহত্তর যুদ্ধে প্রাণিত করতেন এবং সকলকে নিপীড়নের মধ্যেও প্রফুল্ল থাকতে বলতেন। লেখিকা বর্তমানে পরিণত বয়স্ক একজন মানুষ; এই বয়সে এসে কাকা স্বাধীনতা আন্দোলনে যেভাবে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এ নিয়ে তাঁর শিশু বয়সের স্মৃতি তাড়িত করেছে প্রকৃত ঘটনাবলি জানার জন্য। শুধু কৌতূহল বা অনুসন্ধিৎসা তাঁকে প্রণোদিত করেনি এমন হৃদয়গ্রাহী গ্রন্থ রচনায়। বিচ্ছিন্নভাবে সার্জেন্ট জহুরুল হক ও আগরতলা মামলা নিয়ে নানা লেখা পাঠ করেছেন তিনি। তা তাঁকে তৃপ্ত করেনি, আরো বিস্তারিত জানার আকাঙ্ক্ষা তাঁকে প্রণোদিত করে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অনুপুক্সক্ষ জানার জন্য, তিনি ব্যাপৃত হন অনুসন্ধানে। প্রকৃত ঘটনা এবং মামলার বিবরণ জানার জন্য বই পড়েন। সন্ধান করেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের। তাদের সঙ্গে কথা বলেন। প্রকৃত ঘটনাবলি জানার দুর্নিবার আকাংখা লেখিকাকে অদম্য করে তোলে। যদিও এই সন্ধানী আলো ফেলবার কালে তিনি জেনেছেন অনেকেই প্রয়াত।

লেখিকা নাজনীনের পরিবারের সকলেই স্বাভাবিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন সেদিন। জহুরুল হক যখন আহত এবং ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় তখন পরিবারে সে খবর এসে পৌঁছলে বাবা ও কাকা ছুটে গিয়েছিলেন ক্যান্টনমেন্টে। সেদিনের উত্তেজনা, অনিশ্চয়তা, উদ্ভ্রান্তি ও উদ্বেগের বিবরণ দেন তিনি এই গ্রন্থে। তখন তাঁদের বৃহত্তর পরিবার, সমাজ ও রাজনৈতিক অঙ্গন কীভাবে স্পন্দিত ও প্রতিবাদী করে তুলেছিল রাজনৈতিক অঙ্গন ও সমাজ জীবনকে– তিনি হৃদয়গ্রাহী ভাষায় তা বর্ণনা করেছেন। আসামি জহুরুল হক ও ফজলুল হককে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সে সময় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। হাসপাতাল তখন প্রায় চিকিৎসক শূন্য; একজন হৃদয়বান চিকিৎসক ছিলেন। তিনি দু’জনকে এক সঙ্গে চিকিৎসা দিতে পারছিলেন না, আহত স্থান থেকে প্রয়োজন গুলি অপসারণের। সেটা সম্ভব হয়নি। প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে দেশচেতনায় উদ্বুদ্ধ এই মানুষটি মারা যান। কিছুক্ষণের মধ্যে হত্যার খবর রাজনৈতিক ও ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে প্রচারিত হয়ে যায়। উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল সে সময়। অথচ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা তাঁরা পাননি। সে সময় তিনি ছোটো, সেদিনের ঘটনাবলি তাঁর জীবনে ম্লান ও ধূসর হয়ে যায়নি। পরিণত বয়সে নাজনীন– জহুরুল হক ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার অভিপ্রায় নিয়ে গবেষকের মতো কৌতূহলী ও অনুসন্ধিৎসু হয়ে পড়েন। তাঁর মা-কাকি, বাবা-কাকার কাছ থেকে ১৯৬৯ সালের ১৫ জানুয়ারি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে কী হয়েছিল এবং বাবা ও কাকা এই ঘটনা জানার পর কীভাবে ছুটে গিয়েছিলেন ক্যান্টনমেন্টে, তা জানেন। সবিস্তারে তা বর্ণনা করেন। তিনি শোনেন সেই হৃদয়বিদারক ঘটনা, কখনো শোনেন জহুরুল হকের ব্যক্তিত্ব ও দেশচেতনা। এছাড়া তৎকালীন রাজনৈতিক আন্দোলন, জহুরুলের জীবন উৎসর্গ কীভাবে সমগ্র দৃশ্যপটকে একদিনেই পালটে দিয়েছিল তার বর্ণনায় এ বিষয়টি সজীব হয়ে ওঠে। কেন জহুরুল হক গ্রেফতার হয়েছিলেন, কীভাবে জহুরুল হকের দেশচেতনা ও স্বদেশভাবনা প্রণোদিত করেছিল পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের হাত থেকে দেশকে রক্ষার জন্য– এ হয়ে ওঠে এক দলিল। আমাদের কাছে আজ স্পষ্ট, বঙ্গবন্ধুসহ এই ৩৫ জনকে মুক্তির জন্য আপামর বাঙালি যেভাবে অদম্য ও অসম সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন তা আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিশেষ অধ্যায় হয়ে আছে। অল্প বয়স হলেও নিজস্ব স্মৃতিও তাকে অনুসন্ধানে অনুপ্রাণিত করে প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য। বাবা ও দুই কাকার রাজনৈতিক সচেতনতায় তিনি বড়ো হয়ে উঠেছিলেন। সার্জেন্ট জহুরুল হকের এই আত্মাহুতির পর এই বেড়ে ওঠা ও মানস গঠনের পর্বে বারংবার মনে পড়ত। ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির সেই দিনটি কোনোভাবে ধূসর হয়ে যায়নি জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পরও। এই গ্রন্থটি পাঠ করার পর আমার তো কেবলই মনে হয়েছে, এই পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো তারও দেশভাবনা প্রখর এবং সেই অঙ্গীকার ও দায়ই তাকে অনুপ্রাণিত করেছে এই গ্রন্থ রচনায়। তিনি এ কাজে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কয়েকজন আসামি ও সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের কর্তব্যরত এক বাঙালি ডাক্তারের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের। তাঁদের জবানিতেও উঠে এসেছে এই মামলার পূর্বাপর বৃত্তান্ত। যখন এই কর্মে ব্যাপৃত হয়েছিলেন তখন এই ৩৫ জনের মধ্যে অনেকেই পরলোকগমন করেছেন। তবু আশা না ছেড়ে তাঁদের স্ত্রী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তাঁরা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের ব্যক্তিত্ব, দেশচেতনা এবং সেই সময়ে বন্দিদের ওপর কী কত ধরনের পীড়ন চালিয়েছিল সে সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছেন। সেজন্য এই গ্রন্থটি হয়ে উঠেছে নানাদিক থেকে তাৎপর্যময়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস এমন ছিল, ডাক্তারের অনুরোধ সত্ত্বেও পাকিস্তানি সেনারা সেদিন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এই দুজনকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কল করেননি।
আগরতলা মামলা যখন চলছিল, শত বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে কয়েকটি সংবাদপত্রে এ মামলার বিবরণী প্রকাশিত হয়েছিল। এই বিবরণ থেকে দেশবাসী জানতে পারে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের প্রায় সকলকে কতভাবেই না শারীরিক ও মানসিক পীড়ন সহ্য করতে হয়েছে। স্বীকৃত আদায়ের জন্য অনেক বন্দিকে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়েছিল। কয়েকজনের ওপর শারীরিক নির্যাতনের সকল মাত্রাও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

আগরতলা মামলার অনুচ্চারিত ইতিহাস ও শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক গ্রন্থটিতে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হকের একটি সাক্ষাৎকার পত্রস্থ হয়েছে। আমিনুল হক ছিলেন সার্জেন্ট জহুরুল হকের ভাই, সেদিনের কথা তাঁর জবানিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। খবর পাওয়ার পর আমিনুল হক ছুটে গিয়েছিলেন ক্যান্টনমেন্টের প্রকৃত ঘটনা জানার পর কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল এবং জহুরুল হকের এই আত্মাহুতি কেমন করে পাল্টে গিয়েছিল রাজনৈতিক পট- তিনি সে কথা বলেছেন। গ্রন্থটিতে জহুরুল হকের ভ্রাতুস্পুত্র ডা. মাইনুল হকের সাক্ষাৎকারও গুরুত্বপূর্ণ।

উল্লিখিত গ্রন্থে অভিযুক্ত কর্নেল খোন্দকার নাজমুল হুদার স্ত্রী দিল আফরোজ হুদার একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন গ্রন্থের প্রণেতা ড. আবু মো. দেলোয়ার হোসেন ও নাজনীন হক মিমি। অভিযুক্তের ব্যক্তিত্ব ও দেশাত্মবোধের সঙ্গে এই সাক্ষাৎকারে রাজনৈতিক আন্দোলনের পটভূমি ও জহুরুল হককে হত্যার পর রাজধানী ঢাকা শহরসহ সমগ্র দেশের মানুষ কীভাবে প্রতিবাদমুখর ও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল তা বর্ণনা করেছেন তিনি। এছাড়া বন্দি থাকাকালীন তিনি চিঠি লিখেছিলেন স্ত্রী নিলুফার হুদাকে। একটি চিঠি পত্রস্থ হয়েছে গ্রন্থে। চিঠিটি আবেগে দীপ্ত। অনেকগুলো সাক্ষাৎকার আছে। সবগুলোই অভিযুক্তদের নয় তাদের স্ত্রীর। আন্দোলনের মুখে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সফল পরিণতিতে বহু মানুষের আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে এই মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছিল।

বিচারকার্য শুরু হয়েছিল ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন সকাল নয়টায়। ঢাকা সেনানিবাসের সিগন্যাল অফিসার্স মেসে তিন বিচারপতি সমন্বয় গঠিত ট্রাইব্যুনালে বিচারকার্য শুরু হয়। প্রধান বিচারপতি এস এ রহমান, বিচারপতি এম আর খান ও বিচারপতি মকসুমুল হাকিম সমন্বয়ে এই ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। এই অভিযুক্তদের পক্ষে ২৬ জন আইনজীবী নিযুক্ত হয়েছিলেন। এই বইয়ে এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত বিবরণ আছে। ট্রাইব্যুনালের বৈধতা সম্পর্কে রিট পিটিশন দায়েরের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে ইংল্যান্ড থেকে আনা হয়েছিল সে দেশের প্রখ্যাত আইনজীবী সিনেট সদস্য টমাস উইলিয়ামকে।

এ ছাড়া সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের রচনাবলি থেকে একটি অংশ গ্রন্থে অধিভুক্ত হয়েছে। আমরা সকলেই জানি, প্রতিকূলতা ও নানা বিধিনিষেধ সত্ত্বেও ফয়েজ আহমদ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে আজাদ পত্রিকায় আগরতলা মামলার যে রিপোর্ট লেখেন তা আগরতলা মামলার অন্যতম দলিল হয়ে আছে। এ ছাড়া প্রাসঙ্গিক সাক্ষাৎকার আছে সাংবাদিক আবেদ খান ও শাহরিয়ার কবিরের। গ্রন্থটির সম্মান বৃদ্ধি করেছে বিরল কিছু ছবি। আমার খুব ভালো লেগেছিল ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সাক্ষাৎকার। তিনি তখন বঙ্গবন্ধুর নিত্যদিনের সহচর ছিলেন ও আগরতলা মামলার পক্ষে অন্যতম আইনজীবী। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দীর্ঘদিন এ মামলার ও আসামিদের সম্পর্কে খুব বেশি লেখা হয়নি। তাঁরা রাজনৈতিক পাদ-প্রদীপের আড়ালে চলে যেতেও বাধ্য হন। আদর্শ ও নীতি ধর্মে দেশ তখন পশ্চাতে হেঁটেছিল। পরবর্তীকালে কিছু সাহসী গবেষক লেখনির মাধ্যমে এই মামলা যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে কত সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখেছে তা নিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। প্রকৃত ঘটনাবলি উন্মোচনে প্রয়াসী হন। নাজনীন হক মিমির এই গ্রন্থটিও এরই ধারাবাহিকতায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হয়ে উঠেছে। আগরতলা মামলার প্রসঙ্গ উঠলেই আমার ১৯৬৯ সালের ছাত্র-আন্দোলন এবং এই আন্দোলনের পটভূমি এতদিন বাদে মানসপটে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

লেখক:
Abul Hasnat_FP
আবুল হাসনাত, কবি ও সাহিত্য সম্পাদক, ‘গণসাহিত্য’, ‘সংবাদ সাময়িকী’ এবং ‘কালি ও কলম’

বাঙালীয়ানা/এসএল

*প্রকাশিত এ লেখার তথ্য, মতামত, ভাষা ও বানানরীতি লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই প্রকাশিত এ লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই। – সম্পাদক

পড়ুন
মুক্তির পথ কেটে দেন পথিকৃৎ মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট জহুর

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.