
জাহানারা ইমাম
৭১ এর ঘাতক দালাল যুদ্ধাপরাধী বিচার আন্দোলনের প্রধান নেতৃ, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক, শহীদ রুমীর মা, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ১৯২৯ সালের ৩ মে অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামের এক রক্ষণশীল পরিবারে পিতা সৈয়দ আব্দুল আলী ও মাতা হামিদা আলীর গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শৈশবকালে মুসলিম পরিবারের মেয়েদের আধুনিক শিক্ষালাভের দ্বার উন্মুক্ত ছিল না। তবে তিনি তাঁর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পিতার তত্ত্বাবধানে রক্ষণশীলতার বাইরে এসে আধুনিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন। বিবাহিত জীবনে লেখাপড়ায় তিনি পুরকৌশলী স্বামী শরীফুল আলম ইমাম আহমদের দিক থেকেও উৎসাহ ও আনুকূল্য পেয়েছিলেন।
পিতার চাকরিসূত্রে জাহানারা ইমাম বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন। ১৯৪৫ সালে কলকাতার লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ থেকে তিনি বিএ পাস করেন। বিএড পাস করার পর ১৯৬৫ সালে তিনি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ করেন। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় স্কুলে শিক্ষকতার মাধ্যমে। ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (১৯৫২-১৯৬০), বুলবুল একাডেমি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক (১৯৬২-১৯৬৬) এবং ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রভাষক (১৯৬৬-১৯৬৮) হিসাবে তার কর্মজীবন অতিবাহিত হয়। তিনি কিছুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটেও খন্ডকালীন শিক্ষক হিসাবে কাজ করেন। ফুলব্রাইট স্কলার জাহানারা ইমাম আমেরিকা থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। ১৯৬৮-র দিকে চাকরি ছেড়ে তিনি নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। ব্যক্তিত্বময়ী জাহানারা ইমাম ষাটের দশকে ঢাকার সংস্কৃতি মহলে সুপরিচিত ছিলেন।
ষাট ও সত্তর দশকে সাহিত্যজগতে জাহানারা ইমাম অল্প-বিস্তর পরিচিত ছিলেন শিশুকিশোর উপযোগী রচনার জন্য। কিন্তু তাঁর সর্বাধিক খ্যাতির কারণ দিনপঞ্জিরূপে লেখা তাঁর অনবদ্য গ্রন্থ “একাত্তরের দিনগুলি”। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি পুত্র রুমী ও স্বামীকে হারান। পুত্র রুমীর দুঃসাহসিক অভিযান ও জীবনদান, স্বামী শরিফ ইমামের অকালপ্রয়াণ জাহানারা ইমামের সাজানো সংসার তছনছ করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস কেটেছে তাঁর একদিকে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও ত্রাসের মধ্য দিয়ে। অন্যদিকে মনের মধ্যে ছিল দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার স্বপ্ন। ইতিহাসের ঘটনাধারায় পর্যুদস্ত না হয়ে তিনি ধীরে ধীরে শোক আত্মস্থ করে আবার জীবন গড়ার সাধনায় ব্রতী হলেন, রুমীকে খুঁজে পেতে চাইলেন সব মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে, নিজ বেদনার রূপ দেখলেন হাজারো পরিবারের আত্মদান ও ত্যাগে। সেই দুঃসহ দিনগুলোতে প্রাত্যহিক ঘটনা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার বৃত্তান্ত লিখেছিলেন তিনি নানা চিরকুটে, ছিন্ন পাতায়, গোপন ভঙ্গি ও সংকেতে। স্বাধীনতার পরে আপন শোক সংহত করে লিখতে শুরু করলেন “একাত্তরের দিনগুলি”, সচিত্র সন্ধানী সাময়িকীতে এর ধারাবাহিক প্রকাশ তৈরি করল অভাবিত আলোড়ন, গ্রন্থাকারে প্রকাশের পর মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালে জন্ম নেওয়া তরুণ প্রজন্মকে আবার ফিরিয়ে আনলেন মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোয়। ১৯৮৬ সালে গ্রন্থরূপ “একাত্তরের দিনগুলি” প্রকাশ পাওয়ার পর তা জনমনে বিপুল সাড়া জাগায়। বস্তুত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি শিহরণমূলক ও মর্মস্পর্শী ঘটনাবৃত্তান্ত হলো “একাত্তরের দিনগুলি”।

জাহানারা ইমাম
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জাহানারা ইমাম লেখালেখিতে ব্যস্ত সময় কাটান এবং তাঁর প্রধান গ্রন্থগুলি এ সময়ে প্রকাশ পায়। গল্প, উপন্যাস ও দিনপঞ্জি জাতীয় রচনা মিলিয়ে তাঁর আরও কয়েকটি গ্রন্থ রয়েছে। সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: অন্য জীবন (১৯৮৫), বীরশ্রেষ্ঠ (১৯৮৫), জীবন মৃত্যু (১৯৮৮), চিরায়ত সাহিত্য (১৯৮৯), বুকের ভিতরে আগুন (১৯৯০), নাটকের অবসান (১৯৯০), দুই মেরু (১৯৯০), নিঃসঙ্গ পাইন (১৯৯০), নয় এ মধুর খেলা (১৯৯০), ক্যানসারের সাথে বসবাস (১৯৯১) ও প্রবাসের দিনলিপি (১৯৯২)।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে জাহানারা ইমামের নাম ছড়িয়ে পরে তাঁর সামাজিক-রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য। অতীতে তিনি রাজনীতিসচেতন হলেও রাজনীতিবিদ ছিলেন না, এবার ভবিতব্যই তাঁকে রাজনীতির অঙ্গনে নিয়ে আসে। একাত্তরে তাঁর প্রথম পুত্র রুমী ছাত্রত্ব ত্যাগ করে দেশের মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন এবং কয়েকটি সফল গেরিলা অপারেশনের পর পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে নিহত হন। পাকিস্তানী নরঘাতকদের পৈশাচিকতায় হারালেন স্বামীকেও।বিজয় লাভের পর রুমীর বন্ধুরা রুমীর মা জাহানারা ইমামকে সকল মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে বরণ করে নেন। তখন থেকেই তিনি ‘শহীদ জননী’র মর্যাদায় ভূষিত।
মুক্তিযুদ্ধের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য জাহানারা ইমাম নিজেও সর্বদা সক্রিয় ছিলেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় জীবনে স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধ ঘাতক-দালালদের পর্যায়ক্রমিক পুনর্বাসনে অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বিভিন্ন সভা-সমিতিতে বক্তৃতা করে এবং লিখে জনসচেতনতা গড়ে তোলেন। তিনি বুদ্ধিজীবীদের পরিচালিত ‘সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদবিরোধী নাগরিক কমিটি’, ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি’ ইত্যাদি উদ্যোগের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। কিন্তু অচিরেই তিনি উপলব্ধি করেন যে, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষের মানুষদের একত্র করতে না পারলে বিরোধী দুষ্ট চক্রকে প্রতিরোধ করা যাবে না। এ সময় তিনি অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। তিনি ছিলেন মূলত সংস্কৃতি অঙ্গনের লোক, কিন্তু এ সময় থেকে তিনি রাজনীতির অঙ্গনেও সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। তিনি ১৯৯২ সালে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল (অব) নুরুজ্জামান প্রতিষ্ঠিত ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’ -র প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং দ্রুত দেশের প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রায় সব রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনকে যুক্ত করে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় কমিটি” গঠন করেন এবং নেতৃত্ব দান করেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিক দল ও কর্মি এবং দেশপ্রেমিক তরুণ সমাজকে সংগঠিত করে তিনি স্বাধীনতাবিরোধী চক্র, ৭১এর যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে গণ-আদালত গড়ে তোলেন।

জাহানারা ইমাম
গণ-আদালত ছিল স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের অপকর্মের বিরুদ্ধে একটি প্রতীকী প্রতিবাদ। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ তৎকালীন বিএনপি সরকার ও পুলিশ ও বিডিআর এর সমস্ত বাধা উপেক্ষা করে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী ময়দানে বসল “গণ-আদালত”। ১২ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত গণ-আদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী জামায়েতে ইসলামীর নেতা গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করলেন। কিন্তু তৎকালীন সরকার এই প্রতীকী বিচার মেনে নিতে পারল না। সরকার জাহানারা ইমামসহ গণ-আদালতের সঙ্গে যুক্ত ২৪জন বরেণ্য বুদ্ধিজীবীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে মামলা দায়ের করল। জাহানারা ইমাম মৃত্যুকালেও এ অভিযোগ থেকে মুক্তি পাননি।
১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে গণ-আদালত বার্ষিকীতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণতদন্ত কমিটি ঘোষিত হয় এবং আব্বাস আলী খান, মতিউর রহমান নিজামী, মো. কামরুজ্জামান, আবদুল আলীম, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মওলানা আবদুল মান্নান, আনোয়ার জাহিদ ও আবদুল কাদের মোল্লাকে যুদ্ধাপরাধী ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৩ সালের ২৮ মার্চ নির্মূল কমিটির সমাবেশে পুলিশ বাহিনী হামলা চালায়। পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন জাহানারা ইমাম এবং তাঁকে পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
১৯৮১-র দিকে জাহানারা ইমাম ক্যান্সারে আক্রান্ত হন; রোগ উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে, কথা বলাও দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু কর্কট রোগ তাঁর কর্মস্পৃহা ও আদর্শকে বিন্দুমাত্র স্তিমিত করতে পারেনি। সকল ব্যথা-বেদনা উপেক্ষা করে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির কর্মকান্ড সমান উৎসাহে চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন আমেরিকার মিশিগান স্টেটের ডেট্রয়েটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর জীবনাবসান ঘটে। ঢাকায় তাঁকে সমাহিত করা হয়।
লেখক:
সাগর লোহানী
সম্পাদক, বাঙালীয়ানা