মার্কস কেন সাহিত্য পাঠে এতটা আগ্রহী ছিলেন? সে নিয়ে আলোকপাত করা হয়ে গেছে। তিনি প্রধানত লিখছেন রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে, কিন্তু সাহিত্য পাঠে বরাবরই দেখা গেছে তাঁর ঝোঁক। বিভিন্ন নাটক বা সাহিত্য পাঠ করার পর মার্কস খুব উৎসাহ নিয়ে সে সম্পর্কে চিঠিপত্র লিখতেন এঙ্গেলসকে, এঙ্গেলস আবার নিজের মতামত দিতেন। দুপক্ষ থেকেই তেমনটা ঘটতো সাহিত্য পাঠ নিয়ে। মার্কস সম্পর্কে জানা যায়, তিনি নতুন কিছু লিখবার আগে খুব নাটক পড়তেন। সাহিত্য পাঠে সকল প্রধান প্রধান মার্কসবাদী নেতাদের সর্বান্তকরণে আগ্রহের কারণ আছে। মহাভারত বা প্রাচীন গ্রিক নাটকগুলি রাজনীতির বহু কারণগুলিকে ব্যাখ্যা করে। বর্তমান বিশ্বের এমন কোনো ঘটনা নেই যা মহাভারত, রামায়ণ, প্রাচীন গ্রিক নাটক, শেক্সপিয়রের নাটক, ব্রেশটের রচিত নাটক, মঙ্গল কাব্য; ইত্যাদি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। মার্কস সেজন্যই বলেছিলেন, মহৎ সাহিত্য থেকে সেই সময়কার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার চেহারা যেমন জানতে পারা যায়, ইতিহাস ও অর্থনীতির বই থেকেও তেমনটা পারা না।
মার্কসবাদের সঙ্গে আমরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে মহাভারতের মিল খুঁজে পাবো। মার্কস সবকিছুকে বিশ্লেষণ করেছেন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের চোখ দিয়ে। মহাভারতে এই দ্বান্দ্বিক দিকটি কমবেশি পাওয়া যায়, বিশেষ করে চরিত্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে। সন্দেহ নেই, মহাভারতের প্রধান লক্ষ্য ছিল ব্রাহ্মণদের মহিমা প্রচার করা। কিন্তু মহাভারত রচিত হয়েছে বহু মানুষের দ্বারা যুগ যুগ ধরে। ফলে ব্রাহ্মণদের মহিমা প্রচারের বাইরে আরো নানা সমাজসত্য সেখানে উদ্ভাসিত। ভারতের প্রাচীন যুগের ইতিহাস লিখবার জন্য মহাভারত একটি বড় উপাদান। মহাভারতে কী আছে ইতিহাসের উপাদান? রয়েছে ভারত বা আর্যাবর্তের নানা স্থান বা নানা দেশের নাম, রয়েছে নানান সমসাময়িক ইতিহাসের চরিত্র; তা প্রাচীন যুগের ইতিহাস লিখতে সাহায্য করেছে। মহাভারতে নারী-পুরুষ চরিত্র অঙ্কনে এমন সব দুসাহস দেখিয়েছে, যা মনুর বিধানের বিপরীত। মনু নারীকে করে রেখেছেন গৃহবন্দী, পুরুষের দাস। মহাভারতের ছত্রে ছত্রে রয়েছে নারীর মনোবাসনার নানা কথা। যদি আজকের বিচারে দেখতে হয়, তাহলে মহাভারতের প্রধান চরিত্রদের জন্ম অবৈধ বলে বিবেচিত হবে। পাণ্ডব, ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর, কর্ণ; কারো জন্মই আজকের বিচারে বৈধ নয়। কিন্তু তৎকালের রচয়িতারা অনেক সাহস দেখিয়েছেন সেক্ষেত্রে। ঠিক যেভাবে গ্রিক নাট্যকার লিখেছিলেন, ইডিপাস আর মিডিয়া। বর্তমান সময়ে সেসব আখ্যান রচনা করে নাটক লিখলে নির্ঘাত আদালতের রায় কারাবাস বা পাথর ছুঁড়ে মৃত্যু।
মহাভারতের সকল দোষগুণ বাদ দিয়ে সবচেয়ে বড় যে দিকটি ছাপিয়ে উঠেছে, তা হলো মানুষের অন্তরের জগৎ। নানাভাবে মানুষের মনোবাসনা, মনের দ্বন্দ্ব, কাম, চাওয়া-পাওয়া নির্ধিদ্বায় সেখানে বারবার স্থান পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে তাই অনেক সময় মনের কথা বলতে মহাভারতের কাছে ফিরে যেতে হয়েছে। ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’ আর ‘গান্ধারীর শেষ আবেদন’ রবীন্দ্রনাথের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুটি কাব্য মহাভারতের উপর ভিত্তি করে রচিত। রামায়ণকে ঘিরে মধুসূদন সাম্রাজ্যশক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন মেঘনাদবধকাব্যে, বাংলা তথা ভারতের সাহিত্য চিন্তায় এ এক, নতুন সংযোজন। মধুসূদনকে পরে আরো নানাজন এ পথে অনুসরণ করেছেন। বিশ্বের মহাকাব্যগুলির গল্প নিয়ে নয় কিন্তু তার রচনা কাঠামোকে অনুসরণ করে নাটক লিখেছেন পৃথিবীর অন্যতম সেরা নাট্যকার ব্রেখট। নিজের নাট্যধারার নাম দিয়েছিলেন, ‘মহাকাব্যিক’। কড়া মার্কসবাদী নাট্যকার ব্রেখট কী পেয়েছিলেন প্রাচীন মহাকাব্যগুলির মধ্যে যার কারণে নিজের নাট্যচিন্তাকে মহাকাব্যিক বলে বসলেন।
মহাকাব্যে আছে বিরাট ব্যাপ্তী। ঘটনাকে সেখানে নানাদিক থেকে বিশ্লেষণ করা হয়। মহাভারত নানাদিক থেকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে তার চরিত্রগুলিকে। সেখানে কোনো চরিত্রই সম্পূর্ণ ভালো বা সম্পূর্ণ মন্দ নয়। সকল চরিত্র উচ্চতরভাবে প্রশংসিত আবার ভয়াবহভাবে সমালোচিত। রবীন্দ্রনাথ গান্ধারীর আবেদনে মহাভারতের চরিত্র অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে যেন ঠিক সেভাবেই এঁকেছেন। পুত্র দুর্যোধনকে বকা দিচ্ছে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র। গালমন্দ করছে একবার তাদের ষঢ়যন্ত্র করে ক্ষমতা দখলের জন্য আর একবার জ্ঞাতীভ্রাতা পাণ্ডবভ্রাতাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার জন্য। কিন্তু গান্ধারী যখন স্বামী ধৃতরাষ্ট্রকে পুত্রদের বিরুদ্ধে পাণ্ডবদের পক্ষে ন্যায়বিচার করার পরামর্শ দেয়, ধৃতরাষ্ট্র তা করতে রাজি হয় না। ধৃতরাষ্ট্র নিজের দুর্বলতাকে আর ব্যর্থতাকে মেনে নিয়ে বলে, ‘অন্ধ আমি ভিতরে বাহিরে’। কারণ সে শুধু দৃষ্টি-অন্ধ নয়, পুত্র-স্নেহেও অন্ধ। স্বভাবতই ন্যায়বিচার করা সম্ভব নয় তার পক্ষে। রাষ্ট্রকে, ক্ষমতাকে, রাজনীতিতে পিতার উত্তরাধিকারকে এর চেয়ে চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করা কি সম্ভব? সাহিত্য কয়েকটি পংক্তিতে যা বলেছে, দর্শন রাজনীতি বহু পংক্তি ব্যবহার করে তা স্পষ্ট করতে পারে না কখনো কখনো।
আগের পর্ব
সাহিত্য নিয়ে কিছু কথা: প্রথম পর্ব
সাহিত্য নিয়ে কিছু কথা: দ্বিতীয় পর্ব
ধৃতরাষ্ট্র ন্যায়বিচার না করতে পেরে নিজে নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বলছে, এত স্নেহ! মানে এত পুত্র-স্নেহ। সাহিত্যে ধৃতরাষ্ট্র্র যা অল্প কথায় শেষ করেছে, গ্রিক দার্শনিক প্লাটো সেটাই ব্যাখ্যা করেছেন তার দর্শন বা রাষ্ট্রচিন্তার বই রিপাবলিক বা গণরাজ্যে। তিনি স্পষ্ট সমালোচনা করছেন ‘পুত্র-স্নেহ বা সন্তান-স্নেহ নিয়ে’। খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, শাসকরা হবেন জ্ঞানী আর শাসকদের কোনো সন্তান থাকবে না। শাসকরা বিলাস দ্রব্য ব্যবহার করতে পারবে না। তিনি শাসকদের সন্তান না থাকার কথা বলে, শাসকদের ‘পুত্র-স্নেহ’কে রাষ্ট্র থেকে বাতিল করতে চেয়েছেন। কারণ সন্তানদের জন্যই শাসকরা দুর্নীতি করে, সঞ্চয় করে সম্পদের পাহাড় বানায়। শাসক ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ ছিলেন পুত্র-স্নেহে, ফলে প্লাটোর স্পষ্ট কথা, শাসকদের ‘পুত্র-স্নেহ’ থাকা যাবে না। পুত্রস্নেহ থাকা যাবে না মানে সন্তানই থাকা যাবে না। শাসকদের যৌনজীবনকে প্লাটো অস্বীকার করেননি। তিনি বলেছেন, শাসকরা অবাধে নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক তৈরি করতে পারবে, কিন্তু শাসকরা জানবে না, কে তার সন্তান। কারণ সেই নারীর কাছে আরো পুরুষ যাবে, নারী শাসকদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি হবে না। ফলে জানার উপায় নেই সন্তানটি কার। সন্তান জন্ম নিলে তার সকল দায়িত্ব নেবে রাষ্ট্র। শাসক জানবে রাষ্ট্রের সকল সন্তানরাই তার সন্তান, না হলে কেউ নয়।
মার্কস দেখিয়েছেন, মানুষ দোষ আর গুণের আধার। মহাভারত একই কথা বলেছে, ‘পৃথিবীতে সম্পূর্ণ ভালো আর সম্পূর্ণ খারাপ বলে কোনো মানুষ নেই’। কথাটা কিন্তু স্পষ্ট করে বলতে পারেননি মহাজ্ঞানী দার্শনিক প্লটো বা য়্যারিস্টটল। দর্শনের বইয়ে নানা বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলেছেন, ন্যায় কী বোঝাতে গিয়ে কতোরকম ঘুর পথে বির্তক আমদানী করেছেন। কিন্তু মহাভারতের পরতে পরতে পাওয়া যাবে ন্যায় প্রতিষ্ঠার সঙ্কট কোথায়। মহাভারত প্রতিটি চরিত্রকে উপস্থিত করে দেখিয়েছেন মানুষ মাত্রই দোষ আর ত্রুটিতে মিশ্রিত। প্রাচীন গ্রিক নাটকে পাওয়া যাবে না বর্তমান সস্তা সাহিত্যের মতো ‘নায়ক বা খলনায়ক’। চরিত্রদের সকলের গতিপ্রকৃতি সেখানে ঘটনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। গ্রিক নাট্যকাররা কেউ কেউ কখনো তাকে নিয়তি হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। নিয়তি তাঁদের কাছে আসলে ঘটনার উত্থান পতন বা ঘটনার স্রোত। পরবর্তীতে উইলিয়াম শেক্সপিয়র তাঁর নাটকে সম্পূর্ণ ভালো বা মন্দ চরিত্র তৈরি করেননি, নাটকের প্রধান প্রধান চরিত্ররা সকলেই দোষগুণের সমাহার।
নাট্যকার শেক্সপিয়র জন্মেছেন পুঁজিবাদী সমাজের প্রথম লগ্নে। পুঁজিবাদী সমাজ সেই ক্ষণে সবচেয়ে প্রগতিশীল সমাজ, দাসসমাজ আর সামন্ত সমাজের চেয়ে। কিন্তু শেক্সপিয়রের নাটকে দেখা যাবে, পুঁজিবাদী সমাজকে তিনি না গ্রহণ করতে পারছেন, না সম্পূর্ণ বাদ দিতে পারছেন। পুঁজিবাদী সমাজের প্রশংসা আছে, পাশাপাশি আছে তাদের টাকার প্রতি লোভের নিন্দা। সমাজের দ্বান্দ্বিক চরিত্র এত চমৎকার ফুটে ওঠে তাঁর নাটকে, সেজন্যই শেক্সপিয়রের সে এতটা প্রিয়। কথাটা হলো, শেক্সপিয়র দর্শকদের নীতিকথা শোনাতে যাননি। সমাজ কী ঘটে সেটাই ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন, বিচার করার দায় দর্শকের। ঠিক একই কথা বলেছেন ব্রেখট, নাটক নীতিকথা শেখানোর আখড়া নয়। তিনি বলছেন নাটকের কাজ সমাজসত্যকে সামনে আনা। কারো পক্ষ নিয়ে নীতিকথা শোনানোর বিদ্যালয়গুলি চলতে পারে না, সাহিত্য তা করতে পারে না। সাহিত্যের কাজ প্রতিনিয়ত সমাজকে আর ব্যক্তিকে ব্যবচ্ছেদ করা। মানুষকে ব্যবচ্ছেদ করলে যেমন মানুষের ভিতরটাকে জানা যায়, ঠিক একইভাবে সমাজকে ব্যবচ্ছেদ করে তার শিরা-উপশিরাগুলিকে যতোটা সম্ভব স্পষ্ট করা দরকার।
সকল মহৎ রচনায় তাই পাওয়া যাবে। সমাজকে তাঁরা নানাভাবে বিশ্লেষণ করে চলেছেন। মার্লো, গ্যাটে, শিলার, ইবসেন, বালজাক, টলস্টয়, চেকভ, দস্তয়ভস্কি, গলসওয়ার্দি, বার্ণার্ড শ, রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর; এরকম বহু নাম উচ্চারণ করা যাবে। বহু সময় পাঠক তাঁর সঙ্গে একমত হবেন না, কিন্তু জানবেন নতুন কথা। জীবনের নতুন নতুন দৃষ্টি ভঙ্গি। মহৎ স্রষ্টারাও তাঁর যুগের শাসকের দৃষ্টিভঙ্গি এড়াতে পারেন না। মহাভারত পারেনি যেমন বন্ধ রাখতে ব্রাহ্মণ ভজনা। কিন্তু সেটাই একমাত্র সত্য নয়। ব্রাহ্মণ ভজনা ছাপিয়ে ফুটে ওঠেছে আরো নানা সত্য, ক্ষমতার জন্য রক্তপাত; সম্পদের ভাগ-বাটোয়ারার কারণে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায়, মহান সব নীতিবানরা নিয়েছেন শক্তিমান কৌরবদের পক্ষ। ঠিক পাশাপাশি উচ্চারিত হচ্ছে গীতার বাণী। ভিন্ন দিকে কর্ণ যুধিষ্ঠিরের চেয়েও নির্লোভ। সিংহাসন নিয়ে যেখানে লড়াই, কর্ণ সেখানে অবলীলায় নায়ধর্ম রক্ষার জন্য সিংহাসন ত্যাগ করছে। নানারকম মানুষের মিলনকেন্দ্র মহাভারত। মনে হবে, বিশ্বের মানুষের যতোরকম চরিত্র হতে পারে, তারই যেন প্রতিনিধিত্ব করছে মহাভারতের চরিত্ররা।
শাসকদের ভজনা এড়ানো যায়নি মহাভারতে, ভয়াবহ সে ভজনা। ব্রাহ্মণদের প্রতিনিধিত্ব করে নতুনরূপে কালো মানুষ কৃষ্ণ। ফলে কৃষ্ণ ভজনা মহাভারতের একটি দিক। কিন্তু কৃষ্ণ ভজনার সঙ্গে সেখাানে কৃষ্ণের শঠতা, কৃষ্ণের চাতুর্য আর ছলনা একই সঙ্গে উচ্চারিত। কৃষ্ণের চরিত্র সেখানে বর্তমান শাসকদের ন্যায় ফুলের মতো পবিত্র নয়। মহৎ সাহিত্যের বড় গুণ হচ্ছে শাসকদের মানসিকতা গ্রহণের পাশাপাশি তার বিপরীত মানসিকতাকেও স্থান দিতে পারা। গ্যাটে, শিলার সকলেই নানাভাবে বুর্জোয়া মতাদর্শের বিরোধিতা করে দেখা যাবে আবার বুর্জোয়া মতাদর্শকে ধারণ করছে। বিপরীত দিক থেকে বলা যায়, বুর্জোয়া মতাদর্শ গ্রহণ করেও তা পুরোপুরি মেনে নিতে পারছেন না। সবচেয়ে বড় যে সত্যটি তাহলো, সমাজকে একচোখ দিয়ে দেখছেন না। মার্কস বলেছিলেন, ‘শিল্প-সাহিত্য হচ্ছে সমাজ চৈতন্যের প্রকাশ।’ মহৎ সাহিত্যের ক্ষেত্রেই সেটা ঘটে। নিজ সমাজের বহু কিছু বিরুদ্ধেই সেখানে স্রষ্টা প্রতিবাদমুখর। ফরাসী বিপ্লব যেমন ছিল মূলত বুর্জোয়া বিপ্লব। কিন্তু তার ভিতরেই আরো নতুন বিপ্লবের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। মহৎ সাহিত্য ঠিক তাই। বর্তমানের ভিতরে দাঁড়িয়ে নতুন যুগের সম্ভাবনা তৈরি করে তা।
নাটক উপন্যাসের পাশাপাশি বহু চলচ্চিত্রের কথা বলা যাবে একইভাবে। দর্শনের গ্রন্থের চেয়ে যা মানুষের চেতনাকে অনেক দ্রুত ধারালো করতে পারে। ঠিক যেমন চ্যাপলিনের, ‘মডার্ণ টাইমস’ ‘গ্রেট ডিক্টেটর’, ‘মশিয়ে ভার্দু’ বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল মানুষের চেতনাকে নাড়া দেবার জন্য। কারণ নানারকম উত্তেজনাকর আর নাটকীয় ঘটনার ভিতর দিয়ে তাতে দর্শকের সামনে নতুন সব বার্তা উপস্থাপন করা হয়েছিল। টনব্রিজের এক পাদ্রী একবার রেগে গিয়ে বলেছিলেন, চার্চে হাজারবার ঘণ্টাধ্বনি করে তাদের পাওয়া যায় না; কিন্তু নাটক দেখার ক্ষেত্রে জনতার অভাব হয় না। চলচ্চিত্র, নাটক সারাজীবনই মানুষকে উত্তেজনার খোরাক যুগিয়েছে; মহৎ নাট্যকাররা সেখানে শুধু উত্তেজনাই নয়, নানারকম চিন্তারও খোরাক যুগিয়েছে। নাটক দেখতে দেখতে মানুষের মনের নানা কুসংস্কার ভেঙে পড়েছে। যারা লেখাপড়া জানে না, যাদের সামান্য অক্ষরজ্ঞান ছিল না; নাটকই বছরের পর বছর তাদের মধ্যে নতুন বার্তা পৌঁছে দিয়েছে। নাটক মানেই সবচেয়ে প্রাচীন সাহিত্যের একটি। সাক্ষরহীন মানুষকে বহুকাল ধরে সচেতন করে এসেছে শিল্প-সাহিত্য। সাহিত্য মানে শ্রুতি-সাহিত্য। মহাভারত শ্রুতি সাহিত্য হিসেবেই শতকের পর শতক পার করেছে।
দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান পাঠকে কিন্তু না করা, বা নিষিদ্ধ করার কথা বলা হচ্ছে না। সমাজ-অর্থনীতি না বুঝলে আবার সাহিত্যকে বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যা করা যায় না। বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য পড়ানোর সঙ্কট হচ্ছে, শিক্ষকরা মনে করেন সাহিত্য পড়ানোর জন্য রাজানীতি-অর্থনীতি বা সমাজবিজ্ঞান জানার দরকার নেই। মনে করেন, শুধু সাহিত্যের বই পড়লেই চলে। মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্র আর প্লাটোকে পাশাপাশি রাখলেই আসলে শিক্ষাটা খুব কাজের হয়। বাংলার ইংরেজ শাসনের চরিত্র আর সেই সময়ের ইতিহাস আর সমাজবিজ্ঞান বা ভদ্রলোকদের মানসিকতা না জানলে, প্রমথনাথ বিশীর ‘লালকেল্লা’ বা ’কেরী সাহেবের মুন্সি’ বা বঙ্গভঙ্গের রাজনীতি না বুঝলে রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’ পড়ানোর মানেই দাঁড়াবে না। রাশিয়ার বিপ্লবপূর্ব শ্রমিক সমাজের ইতিহাস আর মনস্তত্ত্ব জানলেই ম্যাক্সিম গোর্কীর ‘মা’ সফল উপন্যাস কেন বোঝা যায়। বাংলার সতেরো, আঠারো, উনিশ শতকের সমাজ সম্পর্কে জানলেই বা তখনকার হিন্দু নারীর অবস্থা বিবেচনা করতে পারলেই, সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালীর ইন্দির ঠাকরুনকে পুরোপুরি চেনা যাবে।
কথাটা সহজ। রাজনীতি বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে আর সমাজবিজ্ঞান বিভাগে যেমন সাহিত্য পাঠ দরকার; সাহিত্য বিভাগে তেমন রাজনীতি আর সমাজবিজ্ঞান বোঝা দরকার। রাজনীতি আর সমাজ বুঝতে সাহিত্য সাহায্য করে বলেই, মার্কসের মতো ব্যক্তিত্ব বারবার সাহিত্যের আশ্রয় নেন। ইস্কাইলাস আর শেক্সপিয়র যেমন মার্কসের নিতসঙ্গী ছিল, ঠিক একইভাবে হাইনে আর গ্যাটের কাব্য ছিল তাঁর কণ্ঠস্থ। তিনি ছিলেন উপন্যাসের পোকা, বিশেষ করে আঠারো শতকের ইউরোপের উপন্যাসের। সাহিত্য পাঠের আকাঙক্ষা লেনিনেরও ছিল ঠিক অনুরূপ। সাইবেরিয়াতে নির্বাসিত জীবনে তিনি বারবার পড়তেন পুশকিন, লেরমন্তভ ও নেকরাসোভের রচনা। পরবর্তীতে ক্রেমলিনে যে তার কার্যালয়ের ঘরটি ছিল, সেটা ঠাসা ছিল রুশ সাহিত্যিকদের বইপত্রে। টলস্টয়, লেরমন্তভ, গোগোল, তুর্গেনিভ, উসপেনস্কি, নেস্তর, সলটিকভ, চেকভ ও গোর্কী সহ বিভিন্ন প্রবন্ধকারের রচনা সেখানে স্থান পেয়েছিল।
সাহিত্য পাঠের ভিতর দিয়েই তাঁদের প্রথম মানস গড়ে ওঠে। শিল্প-সাহিত্যের জন্মের ইতিহাস থেকেই বোঝা যায় সাহিত্য ও শিল্পকলার প্রাণভোমরা লুকিয়ে আছে মানবিকতার মধ্যে; সেটা সৃষ্টি হয় মানুষের দ্বারা মানুষের জন্য। সৎ সাহিত্য মানুষকে জানায় তার অন্তহীন সম্ভাবনারকথা, তার কাছে বার্তা পৌঁছে দেয় বৃহৎ জীবনের। সেকারণেই মহাভারত, রামায়ণ, ইলিয়ড অডিসি, গিলগামেশ, শাহনামা ইত্যাদি মহাকাব্য পাঠ রাজনীতি ও সমাজ এবং মানুষকে বুঝতে সাহায্য করবে। মানুষের মুখের দিকে সারাক্ষণ তাকিয়ে থেকে মানুষকে বোঝা যাবে না। রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে আর বস্তিতে বস্তিতে ঘুরে সমাজ অর্থনীতি আর প্রকৃত রাজনীতি বোঝা যাবে না। তার জন্য যেমন দর্শন, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজবিজ্ঞান পড়তে হবে; ঠিক পাশাপাশি প্রচুর সাহিত্য পাঠ করতে হবে। বিশেষ করে ধ্রুপদী সাহিত্য, আধুনিক সাহিত্য সবকিছুর সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে হবে। মহৎ সাহিত্য পাঠ করার মাধ্যমে মানসিক তৃপ্তিও লাভ করা যায়। নিজের মন মানসিকতাও ধারালো হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে প্রথম বছরে আসলে মহৎ সাহিত্য পড়ার দিকে নজর দেয়া দরকার। মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম থেকেই সাহিত্য পাঠে জোর দেয়াটা খুবই জরুরি। না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে হঠাৎ সব সাহিত্য পড়া সম্ভব নয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে সেগুলি ‘মানবিক আর সামাজিকবিজ্ঞান’ অনুষদের সকল-ধরনের বিষয় পড়াশুনার সঙ্গে আলোচিত হওয়া দরকার। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, চার বছর ধরে ‘মহাভারত’ পড়িয়ে একজন শিক্ষক চাইলে তাঁর শিক্ষার্থীদের জগতের বহু কিছু সম্পর্কে ধারণা দিতে পারেন। যদি তার সঙ্গে যুক্ত হয় হোমারের রচনা, প্রাচীন গ্রীসের নাটক, শেক্সপিয়র, ইবসেন, ব্রেখট, রবীন্দ্রনাথ এবং বিশ্বের কিছু আলোচিত উপন্যাস আর চলচ্চিত্র; রাজনীতি সমাজনীতি এবং মানুষের মনস্তত্ত্ব বুঝতে তার আর সমস্যাই হবে না। যিনি পাঠ দান করবেন অবশ্যই তাঁর নিজের দখল থাকতে হবে দর্শন, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞানের আর নন্দনতত্বের উপর।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি চার বছর শিক্ষার্থীদের উল্লেখিত রচনাগুলি সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করে পড়াতে পারে, তাহলে বহু রাজনীতিবিদের লেখা রাজনৈতিক গ্রন্থের চেয়ে শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি রাজনীতি সচেতন হবে। মহাভারতের করুক্ষেত্রের যুদ্ধ আর তার পূর্বাপর ব্যাখ্যা করেই বর্তমান বিশ্বের অনেক কিছু স্পষ্ট করে তোলা যাবে। ঠিক মতো ব্যাখ্যা করে যদি মহাভারত পড়ানো যায়, একজন শিক্ষার্থী তা থেকে অনেক বেশি শিখবেন। কারণ বহু শিক্ষার্থী প্রথম দর্শন, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞানের বইগুলি পড়তে উৎসাহ পায় না। সাহিত্য পাঠ দিয়ে আরম্ভ করলে অবশ্যই তা তাদেরকে আকর্ষণ করবে। যারা পূর্ব থেকে সাহিত্য পাঠ করে আসেনি, তাদের ক্ষেত্রে মহাভারত দিয়ে শুরু করলে হবে না। ভিন্ন সাহিত্য দিয়ে তাদের পাঠদান আরম্ভ হবে। মহৎ সাহিত্য মানুষের উপলব্ধির জগতকে নাড়া দেয়। মানুষের বিবেকের কাছে প্রশ্ন রাখে। মানুষের আবেগকেও তা ভয়াবহ ঝাঁকুনি দেয়। মার্কস তাই সকলকে, গ্যাটে, শিলার, বালজাক আর অতি অবশ্যই শেক্সপিয়রের নাটকগুলি পড়ার নিদান দেন।
গ্রীসের মানুষকে সচেতন করার দায় নিয়েছিল নাটক। মিডিয়ার মতো নাটক সেইকালেই নারী মুক্তির কথা ঘোষণা করে, যা রাজনীতিবিদদের উপলব্ধি করতে আরো হাজার বছরের বেশি চলে যায়। ইডিপাস আসলে ছদ্মবেশে নারীর বন্দীত্বের কথাই ঘোষণা করে, বিবাহ সম্পর্কে নতুন প্রশ্নকেই সামনে আনে। রাজনীতিতে নারীর সক্রিয় প্রবেশ আন্তিগোণে। বিদ্রোহ শেখায় আন্তিগোণে। দুহাজার বছরের নাট্যচর্চার ইতিহাসে আন্তিগোণের মতো চরিত্র খুবই কম সৃষ্টি হয়েছে। ফলে তা এখনো মানুষকে মুগ্ধ করে। ঠিক একইভাবে রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর ‘নন্দিনী’। বিশ্বে গত দু হাজার বছরে লক্ষ লক্ষ নাটক রচিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়, কিন্তু গ্রিক নাটকের মতো শক্তি ধারণ করতে পেরেছে পরবর্তীকালের খুব কম নাটক। কয়েকজন নাট্যকার ছাড়া বাকিদের হাতে যা সৃষ্টি হয়েছে, তার বেশিরভাগ আবর্জনা। ফলে গ্রিক নাটক এখনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। চারশো বছর আগের শেক্সপিয়র এখনো শীর্ষে।
যদি ভাস্কর্যের উদাহরণ খুঁজতে চাই, এখনো ফিরতে হয় প্রাচীন গ্রীস আর রোমের দিকে। দু হাজার বছর আগের মহাভারত আর ইলিয়ডের আখ্যানকে ঘিরেই রচিত হয়েছে কতো শত নাটক। যারা এখন মহাসমারোহে লিখছে আর পুরস্কার পাচ্ছে, যদি তাদের প্রায় সকলকে মহাভারত, ইলিয়ড, টলস্টয়, দস্তয়ভস্কির সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়; কী ঘটবে? যদি লেখালেখিতে দু হাজার বছর বা দুশো বছর আগের লেখাকেই ছাড়িয়ে না যাওয়া যায়; তাহলে আর আস্ফালন করার কী আছে? প্রাচীনের কাছে মাথা নত করে কি বিনয়ী হবার কথা নয়? লক্ষ লক্ষ আবর্জনার ভিতর থেকে কি একটা তালিকা তৈরি করা দরকার নয়: কী পাঠ করা হবে? বাকিগুলির কি আদৌ নাম উচ্চারণের দরকার আছে? মানুষকে ঠিক করতে হবে, সত্তর বছরের আয়ুষ্কালে কী পড়বে আর কী নয়।
নিশ্চয় সিদ্ধান্ত নেবার আছে, বস্তাপচা রচনা পাঠ করে কি ভাঁড় সাজবে, নাকি মহৎ সাহিত্য পাঠ করে গভীর জীবনবোধের মুখোমুখী হবে। সকলেই আমরা এখন সবকিছু প্রচার করতে চাই, এমন কি একান্ত সম্পর্কগুলিকে। জীবনে কিছুই যেন আর একান্ত নয়। প্রচারই যেন আসল। কার প্রতি আমার একান্ত ভালোবাসা সেটাও যেন চীৎকারে করে বলে হাজার মানুষের ভোট চাইতে হয়। সেরকম একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে সমাজবিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব, অর্থনীতি, বাজার-সংস্কৃতিকে বুঝতেই হবে। পাশাপাশি সাহিত্যপাঠ আবশ্যক হবে। শিক্ষা জীবনে সেটাই হবে প্রথম পর্বের প্রধান পাঠ্য বিষয়।
।। সমাপ্ত ।।
লেখক পরিচিতি:
রাহমান চৌধুরী, লেখক, শিল্প সমালোচক
আগের পর্ব
সাহিত্য নিয়ে কিছু কথা: প্রথম পর্ব
সাহিত্য নিয়ে কিছু কথা: দ্বিতীয় পর্ব