শ্রমিকশ্রেণীকে অবশ্যই দরকার এ সমাজের। শ্রমিকশ্রেণীই এ সমাজে সবচেয়ে বড় সত্য। শ্রমিক যদি ভোগী হয়, মালিকের জন্য কাজ করবে কখন? ফলে শ্রমিককে ভোগ করার সুযোগ দেয়ার উপায় নেই মালিকের কিন্তু ভোগের আকাঙক্ষা তার মানসিকতার মধ্যে নানান রকম প্রচার যন্ত্রের মাধ্যমে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। কারণ ভোগের আকাঙক্ষা থেকে শ্রমিক আরো বেশি শ্রম দেবে। শ্রম দিতে দিতে সে হয়ে উঠবে শ্রমক্লান্ত এক মানুষ। কাজের একঘেঁয়েমির ভিতর দিয়ে সে পঞ্চইন্দ্রিয়ের অনুভূতি হারিয়ে ফেলবে। বিপ্লবের জন্য দরকার সুস্থ্য চিন্তা করবার ক্ষমতা, সেই সুস্থ্য চিন্তা করবার ক্ষমতা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলবে শ্রমিক। স্বাভাবিকভাবেই শ্রমিকদের চিন্তাকে পুঁজির বা কারখানার মালিকরা কাজের চাপে এমনভাবে ভোঁতা করে রাখে, সে সৃষ্টিশীল হতে পারে না। সৃষ্টিশীল চিন্তাকে ধারণ করতেও পারে না। নিজের বিপরীতেই সে তখন অচেতনভাবে কাজ করে চলে।
সৃষ্টিশীল হতে পারে না মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্তরাও। কারণ নিজের অজান্তে তারা মালিকদের পক্ষে প্রচার চালায়। মালিকদের পক্ষে প্রচার চালাতে চালাতে সে আয়েসী হয়ে দাঁড়ায়। যখন জানতে পারে সে মালিকের গোলামী করছে, কিছুতেই সে গোলামীটা ছাড়তে চায় না। কারণ ততদিনে মালিকের টাকায় সে সমাজের সম্ভ্রান্ত সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষ। মালিকের পক্ষে এবার সে সচেতনভাবে আরো জোর গলায় প্রচার চালায়, কারণ মালিক না থাকলে তার সম্ভ্রান্ত হিসেবে অস্তিত্বই থাকছে না। ধরা যাক বিভিন্ন বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কথা। বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের মালিকানার পত্রিকার সাংবাদিকরা কি কখনো তার মালিকের বিরুদ্ধে খবর ছাপাবে? ধরা যাক সমাজের এক মহান শিল্পী, যিনি বড় কোনো ব্যবসায়ীর টাকায় চলচ্চিত্র বানাচ্ছেন, তিনি কি সেই ব্যবসায়ীর অপরাধ দেখে প্রশ্ন তুলতে চাইবেন? প্রতিবাদ করা দূরের কথা। ফলে তিনি লুণ্ঠনকারী একজন ব্যবসায়ীর অধীনে থেকে কী রকম শিল্প-সাহিত্য বানাবেন ধারণা করা যায়।
কাউকে দোষারোপ করার আগে সত্যটা অনুধাবন করতে হবে। সমাজ আটকে পড়েছে পুঁজিবাদের চক্রে। আর আমাদের দেশ পুঁজিবাদ আর সাম্রাজ্যবাদের বন্ধনে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা। কিছু প্রগতিশীল মানুষ বলবে, এ সমাজ ভাঙবে শ্রমিক শ্রেণী। কথাটা ঠিক আছে, কারণ শ্রমিকরা সবচয়ে বড় সত্য এ সমাজে পুঁজিব বিপরীতে। কিন্তু পুঁজির নিগড়ে সেও তো বাঁধা। না হলে তো তার মুক্তি কবেই ঘটে যেতো। শ্রমিক বাঁধা কেন? নানা কারণে। দিন আনা দিন খাওয়া মজুরের জন্য সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া সবসময় সহজ নয়। দ্বিতীয়ত তার চেতনা সমাজের নানাকুসংস্কারের বন্ধনে আটকা পড়ে আছে। মার্কস বলেছেন, এ শ্রমিক কখনো বিপ্লবী শ্রমিক নয়। কারণ পুঁজির দাপটে সে নিজের কাছ থেকেই বিয়োজিত হয়ে পড়েছে। মার্কসের বিখ্যাত ‘বিয়ুক্তি’ বা ‘এলিয়েনেশন’ তত্ত্ব দেখায় শ্রমিক যত মালিকের জন্য পণ্য উৎপাদন করে, নিজের থেকে ততই বিয়োজিত হয়ে পড়ে। শ্রমের পরিণাম থেকে সে বিযুক্ত হয়ে পড়ে, কারণ তার শ্রমের ফলের অধিকারী মালিক পক্ষ।
মার্কস মনে করেন, শ্রমিক নিত্যদিনের কাজের চাপে, প্রতিদিনের অসম্মানে, ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে পূর্ণাঙ্গ মানুষ থাকে না। বাস্তবিকভাবেই সে হয়ে দাঁড়ায় অর্ধমানুষ। মার্কস মনে করে সেই মানুষ বিপ্লব করার জন্য প্রস্তুত নয়। মার্কস বলেন, সেই মানুষকে বিপ্লবের চেতনা পৌঁছে দেবার আগে তাকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠবার সুযোগ করে দিতে হবে। তিনি চান না, আগেই তাকে বিপ্লবের দুর্বোধ্য দর্শন পৌঁছে দেয়া হোক। কারণ পূর্ণ মানুষ না হয়ে উঠবার আগে সে বিপ্লবের তত্ত্ব ধারণ করতেই পারবে না। মার্কস চান, সবার আগে তার কাছে সৃষ্টিশীল কিছুর সন্ধান দেয়া হোক। যার ভিতর দিয়ে শ্রমিক নিজের পূর্ণাঙ্গ অবয়বটা বুঝতে পারবে। মার্কস মনে করেন, মানবিক শিল্প সাহিত্য শ্রমিকদের উজ্জীবিত করতে পারে। কিন্তু বর্তমানের বাম ঘরানার মানুষরা কিন্তু সেখানে মনে করেন শ্রমিকদের আগে দর্শনের বড় বড় তত্ত্ব শেখাতে হবে। সবার সঙ্গে আলোচনায় আগে তারা মার্কসবাদের তত্ত্ব নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করেন। নিজেরা মার্কসবাদ কতোটা বোঝেন, সে বিতর্ক বাদই রাখলাম। সাহিত্য বা বিশ্বসাহিত্য নিয়ে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করতে গেলে খুব হতাশ হতে হবে।
মার্কস নিজে ধ্রুপদী সাহিত্বের বিরাট পাঠক ছিলেন। নাটকের ছিলেন বড় একজন ভক্ত। নাটক আর কবি হবার সখ ছিল তাঁর। কবিতা তো লিখেছেনই, নাটকও লিখেছিলেন। পরে যখন বুঝলেন নাটক লেখা তাঁর কাজ নয়, কারণ নাটক লিখে তিনি সেরকম উচ্চাঙ্গে পৌঁছাতে পারবেন না; নাটক লেখা ছেড়ে দিলেন। নাটক, কবিতা ইত্যাদি লেখা ছেড়ে পুরো মাত্রায় দর্শন আর রাজনীতিতে মন দিলেন। কিন্তু সাহিত্য পড়া বাদ দেননি কখনো। নাটক ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। বহু লেখাতে তিনি নাটক থেকে উদাহরণ দিয়েছেন। বিভিন্ন রচনায় নানা পৌরাণিক ঘটনাকে টেনে এনেছেন। “ধর্ম প্রসঙ্গে” গ্রন্থে দেখা যাবে তিনি লিখেছেন, “কাজেই সর্বপ্রথমে আমরা পেশ করছি লুশেন-এর ‘দেবগণের কথোপকথন’ থেকে একটা দৃশ্য”। তিনি তারপর হার্মেজ আর মেইয়ার কথপোকথন অনেকটা উদ্ধৃত করেন। গ্রিক হার্মেজ ছিল বাগ্মিতা আর যুক্তিশাস্ত্রের দেবতা।
বিশ্বের যে কজন মার্কসবাদী নেতা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিরাট ভূমিকা রেখেছেন, প্রত্যেকের প্রচুর সাহিত্য পড়া ছিল। বিশেষ করে ধ্রুপদী সাহিত্য। মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্টালিন, মাও সে তুং; কার নয়? সকলেই ছিলেন তাঁরা শিল্প-সাহিত্যের বিরাট বোদ্ধা। মাও সেতুংয়ের ‘ইয়েনানের ভাষণ’, শিল্প-সাহিত্য সম্বন্ধে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রচনাগুলির একটা। জর্জ টমসন, যিনি মার্কসবাদ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। ভারতেও ছিলেন অনেকদিন মার্কসবাদের ধারণা প্রদান করার জন্য। তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর ইংরেজ আইরিশ ধ্রুপদী সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিশেষজ্ঞ। গ্রিক নাটকের মার্কসবাদী ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। টমসনের ‘এ্যাস্কাইলাস এ্যান্ড এথেন্স’ এবং ‘মার্ক্সিজম এ্যান্ড পোয়েট্রি’ নামে দুটা বই আছে। মার্কসবাদীদের সাহিত্য চর্চার বড় একটা উদাহরণ এটা।
বাংলাদেশের বাম আন্দোলনকারীদের সাহিত্য পাঠের প্রয়োজন হয় না। মার্কস আর লেনিনের দু-চারটা বই কোনোরকম পড়ে নিলেই হয়, সুবিধা মতো উদ্ধৃতি দেবার জন্য। কারো কারো তাও দরকার হয় না। শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করার চেয়ে, সাংবাদিকদের আর পত্রিকার প্রচার তাদের বেশি কাম্য। অথচ সত্যিকারের মার্কসবাদী হওয়া মানেই শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করা। শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করা মানেই, প্রথম তাদের বিক্ষিপ্ত মানসিকতা নতুনভাবে উজ্জীবিত করা। মার্কসবাদীরা মনে করেন, শিল্প-সাহিত্যের ভূমিকা এক্ষেত্রে ব্যাপক। কিন্তু বাংলাদেশের যেসব মার্কসবাদীরা নিজেরাই সৃষ্টিশীল সাহিত্য পাঠ করেন না, শ্রমিকদেরকে তারা কেমন করে উজ্জীবিত করবেন? একবার এক মার্কসবাদীকে মহাভারত পাঠ করার কথা বলার পর, এমনভাব করলেন যেন আমি মহা-অন্যায় করে ফেলেছি। তিনি মহাভারত কখনো ছুঁয়েও দেখেননি, কিন্তু তার ধারণা হচ্ছে, মহাভারত একটা প্রতিক্রিয়াশীল গ্রন্থ। ফলে এটা পাঠ করা অন্যায়। মার্কসের সময়ে মহাভারতের তেমন অনুবাদ ছিল না, ফলে মার্কস মহাভারত পড়েছেন বলে জানা যায় না। মার্কস যা পড়েননি, সেটা প্রতিক্রিয়াশীল তো বটেই!
মানলাম, মার্কস মহাভারত পড়েননি, সেজন্য সেটা পড়া যাবে না। তিনি তো হোমার পড়েছেন, প্রাচীন গ্রীসের নাটকগুলি পড়েছেন। গ্রিক নাটকের স্বাদ খুব ভালোভাবে পাবার জন্য গ্রিকভাষা পর্যন্ত শিখেছিলেন। শেক্সপিয়রের অনেক নাটকের সংলাপ পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ছিল মার্কসের মুখস্থ। শুধু মার্কসের নয়, তাঁর কন্যাদেরও। কথাগুলি এঙ্গেলসের ক্ষেত্রেও সত্য। আমাদের বামপন্থীরা কি ভারতীয় ধ্রুপদী নাটক, বা সারা বিশ্বের ধ্রুপদী সাহিত্য পাঠ করার ব্যাপারে সামান্য আগ্রহ দেখিয়েছেন? দু-একটা ব্যতিক্রম এখানে আলোচ্য নয়। মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্টালিন. মাও, কাস্ট্রো প্রমুখের সাহিত্য পড়ার যে আগ্রহ ছিল; বাংলাদেশের মার্কসবাদীদের যাঁদের কমবেশি আমি চিনি, তাঁদের কারো মধ্যেই তার সামান্য লক্ষণ চোখে পড়েনি। সাহিত্যের কথা বাদ রাখা গেল। ‘ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন’ বিষয়ে কারোর যে তেমন ধারণা আছে তাও মনে হয়নি, হাতে গোনা দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া। পড়াশুনা না করেই ওনারা বিপ্লব করবেন। মাও সে তুং ইয়েনানের ভাষণে বিপ্লব করার জন্য বারবার অধ্যয়নের উপরই জোর দিয়েছেন। সাহিত্য পাঠের কথা বলেছেন।
বিভিন্ন বামদলগুলি যে রাজনৈতিক কাগজ বের করে সেটা দেখলেই তাদের সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস পাঠের নমূনা পাওয়া যাবে। যতোটা সময় অন্য ডান বাম দলের সমালোচনায় ব্যস্ত থাকেন, কিছুটা সময় তার থেকে ধার নিয়ে সাহিত্য পাঠ করলে যে জ্ঞান বাড়ে এটা মানতে বোধহয় রাজি নন তাঁরা। বরং সাহিত্য পাঠকে বিচ্যুতি ভেবে বসতে পারেন। বরং সেই তুলনায় অনেক বুর্জোয়াদের সাহিত্য পাঠের আগ্রহ এবং জানাশোনা অনেক বেশি। আসলে ইলিয়ড পড়া তাদের কাছে সময় ক্ষেপন? কিন্তু মার্কসবাদের বই পড়েন কি? পড়লে নিশ্চয় দেখতে পারতেন রাজনীতিতে শিল্প-সাহিত্যের ভূমিকাটা কতো বড়। মুখস্থ বুলির মতো প্রায়ই বলেন, শিল্প-সাহিত্যের গুরুত্বের কথা। কিন্তু সাহিত্য পড়েন না। শিল্প সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখেন না। কিন্তু মুখ বড় বড় বুলি লেগেই আছে। নিশ্চয় তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষাকে আমি সামান্য খাটো করে দেখছি না। যথেষ্ট ত্যাগ-তিতিক্ষা আছে তাঁদের। শুধু ত্যাগ-আর তিতিক্ষা দিয়ে বিপ্লব হয় না।
অন্য পর্ব
সাহিত্য নিয়ে কিছু কথা: প্রথম পর্ব
সাহিত্য নিয়ে কিছু কথা: তৃতীয় পর্ব
প্রশ্ন হলো, আসল লড়াইটা কিসের জন্য। জয় এক লক্ষ্য তার। জয়টা দরকার বাজার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে। বিশ্বের সকল মার্কসবাদীদের তাহলে চিন্তা-চেতনায়, শিল্প-সাহিত্য রচনায় সকলের চেয়ে এগিয়ে থাকার কথা। বাজার সংস্কৃতির বহু কিছু উল্টে যাবার কথা, তাদের সৃষ্টির দ্বারা। ব্যাপারটা ঘটছে কি? মার্কসবাদীদের লেখা কটা সাহিত্য আছে, কটা ভালো গান আছে, কটা রচিত নাটক আছে; যা দিয়ে সে শ্রমিকশ্রেণীর ঘুম ভাঙ্গাবে। ম্যাক্সিম গোর্কি সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে বিরাট সমর্থন পেয়েছিলেন রাশিয়ায় মার্কসবাদীদের। কিন্তু আমাদের মার্কসবাদীদের ম্যাক্সিম গোর্কিকে দরকার নেই, দরকার কেবল মুখস্থ শ্লোগান দেবার লোক। মার্কসবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য বিপ্লব করেছেন লেনিন, স্টালিন, মাও, কাস্ট্রো; সেই মানের নেতা কারা বা কোন্ জন যিনি আমাদের বিপ্লবকে নেতৃত্ব দেবেন? যাঁর পেছনে মানুষ আস্থা নিয়ে দাঁড়াতে পারে?
মনে করেন নিজের মত প্রচার আর তর্ক করাটাই কাজ, পড়াশুনা নয়। মার্কসবাদের পক্ষে সমাজে যারা লিখছেন, কখনো কখনো তাঁদের লেখা চেয়ে নিয়ে সেগুলো নিজেদের পত্রিকায় ছাপালেও; নিজেরা কিন্তু পড়েন না। কারণ তাঁরা না পড়েই সবজান্তা। সাহিত্য কতোটা বোঝেন আর কতোটা পড়েন সে নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, একধরনের সাহিত্যের তারা খুব ভক্ত। জ্বালাও পোড়াও বা শ্লোগানধর্মী সাহিত্য পেলে খুব উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ঘটনাচক্রে তাদের মধ্যে কেউ কেউ লেখেনও এমন সব দু-চারটা সাহিত্য, যারা আয়ুষ্কাল বড়ই সংক্ষিপ্ত। সমাজতান্ত্রিক বা শ্রেণীসংগ্রামের সাহিত্য বা নাটক নাম দিয়ে, কিছু কিছু রচনা করেছেন তাঁরা। কিন্তু সেগুলি সাহিত্য বা নাটক হতে পেরেছে কি না সে প্রশ্ন থেকেই যায়। সত্যি বলতে সেগুলি না হয় সাহিত্য, না ঘটায় বিপ্লব। পুঁজিবাদী সমাজে সাহিত্য সৃষ্টি হয় না ব্যাপারটা একেবারেই তা নয়। পুঁজিবাদী সমাজেই ম্যাক্সিম গোর্কী, ব্রেখটের মতো নাট্যকারের জন্ম। পুঁজিবাদী সমাজের উত্থান পর্বে জন্ম শেক্সপিয়র, শিলার, বালজাক প্রমুখের। পুঁজিবাদী সমাজে সাহিত্য জন্মাবে, মালিকদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই। সাহিত্য জন্মাতেই হবে বিপ্লবের স্বার্থে, সমাজ কখনো পুরো অন্ধকারে হারিয়ে যায় না। কিন্তু সেই সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমাদের বামদের ভূমিকাটা কী?
মার্কস উনিশ শতকের যেসব ইংরেজ ঔপনাাসিকদের বাস্তবপন্থী বলে মান্য করেছিলেন তাঁরা হচ্ছেন ডিকেন্স থ্যাকারে ব্রণ্টিভাগ্নীরা এবং গাসকেল। তিনি বললেন, এই ঔপন্যাসিকরা এমন রাজনৈতিক ও সামাজিক সত্য বাণীবদ্ধ করেছেন যার চেয়ে বেশি সত্য রাজনীতিবিদ ও নীতিবিদরা সকলে একত্রেও বলতে পারতেন না। বালজাক, ফ্লোবার, শার্লোট ব্রণ্টি বা ডিকেন্স-এর মতো ঔপন্যাসিকরা কায়েমী স্বার্থবাদীদের অনাচার, পুঁজির ব্যাপক প্রসার ও শ্রমিকের দুঃখকাতরতা লক্ষ্য করেছিলেন। ঠিক একইভাবে সত্য যে, অভিজাত পরিবারের সন্তান পুশকিন, গোগোল, তুর্গেনেভ এবং তলস্তয় সাহিত্যে তাঁদের ব্যক্তিগত শ্রেণীস্বার্থ বজায় রাখতে চাননি, বরং শ্রেণীর ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলি নির্মমভাবে সমালোচনা করেছেন। যদিও তাঁরা সঙ্কটের সমাধানের পথ দেখিয়ে যেতে পারেননি।
সমাধান দেখানো সবসময় সাহিত্যের কাজ নয়। দরকার সমাজসত্য ফুটিয়ে তোলা। কিন্তু তথাকথিত বামরা মনে করেন, সমাজসত্য ফুটিয়ে তোলার চেয়ে সমাধানের পথ দেখানোটাই জরুরি। সাহিত্য রচনার সহজ অঙ্ক তাদের কাছে শ্রমিক-কৃষককে থাকতে হবে সেসব সাহিত্যে বিপ্লব করার জন্য। শ্রমিকের ভাগ্য পাল্টানো আর শ্রমিকদের নিয়ে বিপ্লব করার জন্য তাঁরা যেন মরীয়া। নিশ্চয় শ্রমিকদের নিয়েই বিপ্লব ঘটাতে হবে, কিন্তু বিপ্লবের জন্য যারা প্রস্তুত হয়নি সেই শ্রমিক নয়। শ্রমিকরাই বিপ্লবের মূল শক্তি তা নিয়ে বিতর্ক নেই কিন্তু সে কোন শ্রমিক? শ্রমিকরা যেমন অর্ধমৃত থাকে, ঠিক একইভাবে শ্রমিকদের মধ্যে থাকে পাতিবুর্জোয়ার মানসিকতা আবার নানারকম দোদুল্যমানতা। যতক্ষণ শ্রমিকরা সেসব থেকে বের হয়ে এসে সত্যিকারের শ্রমিকশ্রেণী হয়ে উঠতে না পারছে, বিপ্লবের কাজে লাগবে না।
গণনাট্যের বহু নাটকে, বাংলার আরো বহু তথাকথিত অতিবাম নাট্যকর্মে বা সাহিত্যে দেখা গেছে বিপ্লব খুব সহজ। শ্রমিকদের একজোট করাটাই তারজন্য বড় কথা, আর সেটা যেন রাতারাতি সম্ভব। বাম ঘরানার সেসব নাটকে বা সাহিত্যে দেখা যায় সংঘবদ্ধ কিছু মানুষকে, যারা নানাভাবে শোষিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ করে। যাঁরা এসব রচনা করেন বা মঞ্চায়ন করেন, নিজেদের মনে করেন খুব বিপ্লবী নাট্যকার বা সাহিত্যিক। গথবাঁধা কিছু চরিত্র থাকে সেসব রচনায়। শ্রমিকরা সকলেই সেখানে যেমন শোষিত, তেমনি ত্যাগী ভালো মানুষ। ভিন্ন দিকে তার চেয়ে ত্যাগী হচ্ছে একজন বিপ্লবী নেতা; যার চরিত্রে সামান্য দোষ থাকে না। সকল দোষ শোষক চরিত্রটির, তার আবার বিন্দু পরিমাণ ভালো গুণ নেই; হতে পারে সে মিল মালিক বা জমিদার। বিপ্লবী এসে শ্রমিকদের সচেতন করে, দু-একটা ঘটনার পরই তারপর বিপ্লব ঘটে যায়। নাটক-সাহিত্য রচনা এসব অতিবিপ্লবীদের কাছে খুব সহজ কাজ। নাটক বা সাহিত্য সেখানে সকল রকম সাহিত্য গুণ হারিয়ে মোটাদাগের সূত্রবদ্ধ গল্পে পরিণত হয়।
মাও সে তুং বলেছিলেন, মানব ইতিহাসের স্রষ্টা শ্রমিক শ্রেণীর আমরা জয়গান করবো না কেন? কিন্তু শ্রমিক শ্রেণীর জীবনের অন্ধকার দিকগুলিকেও তুলে ধরতে হবে এবং তাদের একজন বন্ধু হিসেবেই। নাট্যকার-নির্দেশক উৎপল দত্ত লিখেছেন, অতিবিপ্লবীরা কাল্পনিক বস্তির কাল্পনিক বিপ্লবী শ্রমিক তৈরি করে তাদের দিয়ে বিপ্লব ঘটান। বাস্তবের শ্রমিকদের জীবনের সঙ্গে, তাদের সত্যিকারের লড়াইয়ের সঙ্গে যার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি গণনাট্য সংঘের সূত্রবদ্ধ রাজনৈতিক নাটককে ব্যঙ্গ করে লিখেছিলেন, প্রথমে এক সাহেব বা এক জমিদার চাবুক দিয়ে বেধড়ক পেটায় একদল চাষীকে। কিছুক্ষণ পরে আসে এক কমিউনিস্ট, সকল গুণের আধার; যার না আছে কোনো দ্বিধা, না আছে কোনো দুর্বলতা, না আছে কোনো দ্বন্দ্ব। নিষ্পাপ সেই কমিউনিস্ট সন্ন্যাসী এসে চাষীদের বোঝায়। ব্যস চাষীরা বুঝে গিয়ে জমিদারকে পেটায়। বিপ্লব সম্পন্ন। যবনিকা-ইতি গণনাট্য সংঘস্য নবনাটকম। বঙ্গ করার পর পরই উৎপল দত্ত বলেন, এসব পোস্টারধর্মী নাটক বিপ্লবের ক্ষতি করে। তিনি জানিয়ে দেন , শ্রমিক মানেই মহান নয়। শ্রমিক ঢের বেশি সংগ্রামী কিন্তু তার চরিত্রেও থাকে নানা সংকীর্ণতা।
রঁম্যা রলাঁ বলেছিলেন, জনগণের উপর সাজানো সূত্রবদ্ধ সাহিত্য চাপিয়ে দেয়ার মতো দুর্ভাগ্য আর কিছু নেই। নাট্যকার ব্রেখট বলেছিলেন, নাটকে, শিল্প-সাহিত্যে দৈনন্দিন বাস্তবের হুবহু বর্ণনা দরকার নেই, দরকার প্রতিদিনের বাস্তবের নির্যাস; বাস্তবের সঙ্গে কল্পনা মিশে নতুন বাস্তবোত্তর সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সেই সত্য যা রচিবে তুমি। য়্যারিস্টটল বলেছিলেন, যা আছে তা নয় শুধু, যা হওয়া উচিৎ তাও সাহিত্যে স্থান পাবে। শিল্প-সাহিত্যে কেউ দৈনন্দিনের হুবহু বর্ণনা চান না, ভিন্ন দিকে প্রকৃত বাস্তব থেকে সম্পূর্ণ সরে গিয়ে মনগড়া কল্পনা দাঁড় করালে চলবে না। সঠিক তথ্যটাই দিতে হবে কল্পনার রঙে রাঙিয়ে। জীবনের কোনো এক খণ্ডাংশের বর্ণনা মানেই তা সাহিত্য নয়, যদি তা মানব সভ্যতার দ্বন্দ্বগুলিকে ব্যাখ্যা করতে না পরে। জ্ঞান বাদ দিয়ে, পূর্বে আহরিত তথ্য অভিজ্ঞতা বাদ দিয়ে, কল্পনা বাদ দিয়ে শুধু চোখে দেখা ঘটনার উপর নির্ভর করে সত্যকে প্রকাশ করা যায় না। ঘটনার আগেও ঘটনা থাকে। মানুষ যদি তার জ্ঞান বাদ দিয়ে চোখের দেখার উপর নির্ভর করে সূর্যের দিকে তাকায়, তাহলে মনে হবে পৃথিবীটা স্থির আর সূর্যটা তার চারদিকে ঘুরছে; যা আসলে সত্য নয়। মহৎ সাহিত্যে তাই জীবনের খণ্ডিত রূপ নয়, ধরা পড়ে তার গভীরতম এক দ্বান্দ্বিক চরিত্র।
বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মানুষরা যে মহাভারত বা ধ্রুপদীগুলি পাঠে আগ্রহী হন না, তার কারণ তাঁরা জীবনের গভীর দিকগুলিকে জানতে বুঝতে উৎসাহী নন। মুখস্থ বুলির মতো শ্রমিক শ্রেণীর রাজনীতি নিয়ে কথা বলতেই তাঁরা আগ্রহী। মার্কস-এঙ্গেলস, লেনিন, স্টালিন, মাও, কাস্ট্রো প্রমুখকে পূজা করাই তাদের কাছে মার্কসবাদ। মার্কসবাদী নেতারা সকলেই তাঁদের কাছে পয়গম্বরদের মতো শ্রদ্ধাভাজন বিনা প্রশ্নে। বাইরের কেউ তাঁদের নিয়ে প্রশ্ন তুললে বা সমালোচনা করলে তাঁরা রেগে যান ধর্মান্ধদের মতো। কিন্তু যুক্তি দিয়ে লড়তে চান না। সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতা বা তাঁদের নেতাদের নিয়ে প্রশ্ন তুললে ধর্মান্ধ বা কট্টরদের মতো তাঁরা বিরোধী পক্ষের গায়ে তকমা লাগিয়ে দেন। যখন আক্রমণ আসে, তখন ভুলে যান মার্কসবাদ কোনো অন্ধত্ব নয়, এটা একটা বিজ্ঞান। মার্কসবাদ স্থির কিছু নয়, দরিদ্র মানুষের ভাগ্য পাল্টাবার জন্য চলমান এক প্রক্রিয়া। ভুল ভ্রান্তি সেখানে থাকতেই পারে, মার্কসবাদীরা ভুল থেকেই নতুন করে শিখবে। ধর্মগ্রন্থের মতো পুরানকে আক্রে থাকবে না। বিজ্ঞানমনস্কতার দ্বারা উত্তর খোঁজা তাঁর কাজ।
মহাভারত তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ তাঁরা মনে করেন পুঁজিবাদী সমাজ থেকে মুক্তিলাভের পথ বা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা সেখানে নেই। সাহিত্যের ক্ষমতা না বুঝলে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। রামায়ণের মতো সাহিত্যকে কী করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো যায়, তার উদাহরণ মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধকাব্য’। সাহিত্যের এরকম শক্তিটাকেই মার্কস-এঙ্গেলস খুব গুরুত্ব দিয়ে বিচার করেছেন। বলে গেছেন তাঁরা, শিল্প-সাহিত্য শুধু ভাবমূলক নয়, জ্ঞানমূলকও। মার্কসের কেন বালজাকের ‘লা কোমেদি হুমেন’ বা এ্যাস্কাইলাসের নাটক, বা শেক্সপিয়র প্রিয় ছিল? মার্কস নিজেই জানাচ্ছেন, তাঁদের লেখা থেকে সেই সময়কার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার চেহারা যেমন জানতে পারেন তিনি, ইতিহাস ও অর্থনীতির বই থেকেও তেমনটা পারেন না।
কথা হলো, বাজার সংস্কৃতির কাছে মহৎ সাহিত্যের মূল্য নেই কিন্তু সেগুলির কি খুব মূল্য আছে তথাকথিত মার্কসবাদী বা বামদের কাছে? পুনরায় যা বলতে চাই, ব্যতিক্রমটা উদাহরণ নয়। বাজার সংস্কৃতির সমালোচনা করার পাশাপাশি এ প্রশ্নটা তোলাই যায়, তথাকথিত বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্তদের কাছে সৃষ্টিশীল শিল্প-সাহিত্যের মূল্যই বা কতটুকু? বাংলাদেশের গত চল্লিশ বছরেরা কথাই ধরা যাক, কতোটা তাঁরা তার পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন? চর্চাই বা করেছেন কতোটা!
চলবে…
লেখক পরিচিতি:
রাহমান চৌধুরী, লেখক, শিল্প সমালোচক
অন্য পর্ব
সাহিত্য নিয়ে কিছু কথা: প্রথম পর্ব
সাহিত্য নিয়ে কিছু কথা: তৃতীয় পর্ব