সেক্টর কমান্ডার কর্নেল কাজী নূর-উজ্জামান

Comments

একাত্তরের মার্চে কাজী নূর-উজ্জামান ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। ২৫ মার্চ পাকিস্তানী বর্বর হানাদার বাহিনী যখন বাঙালী হত্যা শুরু করে বিশেষত ইপিআর-এর সদস্য ও তাদের পরিবার-পরিজনের ওপর নির্বিচারে আক্রমণ চালায় তখন ইপিআর সদস্যদের পরিবার-পরিজনের আর্তনাদ তাঁকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। সেই নৃশংস দৃশ্য দেখে মেজর (অব.) কাজী নূর-উজ্জামান তাঁর পরিবারের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন হানাদারের বিরুদ্ধে আবার অস্ত্র তুলে নেওয়ার। তিনি তাঁর পরিবার-পরিজনকে ময়মনসিংহ জেলার গান্ধিনা গ্রামে পাঠিয়ে ২৮ মার্চ তৎকালীন কর্নেল শফিউল্লাহর ব্যাটালিয়নে যোগ দেন।

দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়ায় যান। সেখানে ৪ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া বিদ্রোহী বাহিনীগুলোর কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিদ্রোহী বাহিনীগুলোকে একটি কমান্ড চ্যানেলে এনে সমন্বিতভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এই সিদ্ধান্তের আলোকে তিনি দায়িত্ব পান মুক্তিবাহিনীর কেন্দ্রীয় দপ্তরে। মুক্তিবাহিনীর পুনর্গঠন-প্রক্রিয়ায় কাজী নূর-উজ্জামান নানা ভূমিকা পালন করেন।

২৬ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে অর্থাৎ ২৭ সেপ্টেম্বর প্রথম প্রহরে ৭ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হক মুক্তিবাহিনীর উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠক শেষে সেক্টর হেডকোয়ার্টারে ফেরার পথে ভারতের শিলিগুড়ি এলাকায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা নিহত হলে কাজী নূর-উজ্জামানকে ৭ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। এই সেক্টরের আওতায় ছিল গোটা রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলা এবং দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার অংশবিশেষ। উত্তরবঙ্গের অর্ধেকের বেশি এলাকা নিয়ে ছিল এই সেক্টর। এর অধীনে সাবসেক্টর ছিল নয়টি।

কাজী নূর-উজ্জামান ৭ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব পাওয়ার পর শাহপুর গড়সহ আরও কয়েকটি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। নভেম্বর মাসের শেষ দিকে শাহপুর গড়ের যুদ্ধে রণাঙ্গনে উপস্থিত থেকে তিনি নিজেই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি মুক্তিবাহিনীর একটি দল নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ অভিমুখে অগ্রসর হন।

১০ ডিসেম্বর নূর-উজ্জামানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা মহানন্দানদীর উত্তর-পশ্চীম তীর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর দখলের জন্য অগ্রসর হয়। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেক্টর কমান্ডার কাজী নূর-উজ্জামানের নির্দেশে প্রায় পঞ্চাশজন যোদ্ধার একটি দলকে নেতৃত্ব দিয়ে মহানন্দা তীরের বারঘরিয়া গ্রামে আসেন এবং ১৩ ডিসেম্বর গভীর রাতে মহানন্দা পেরিয়ে শহরের উপকণ্ঠে এসে উপস্থিত হন। রেহাইচরে শত্রুসেনাদের সঙ্গে লড়াইয়ে বীরদর্পে যুদ্ধ করে শহীদ হন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। এ যুদ্ধের পরেই নূরুজ্জামানের নেতৃত্বে ৭ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনী ১৪ ডিসেম্বর তারিখে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরকে শত্রুমুক্ত করতে সক্ষম হয়।

অসীম সাহসী স্বাধীনচেতা নূর-উজ্জামানের জন্মগ্রহণ করেন ২৪ মার্চ ১৯২৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার চাটদহ গ্রামে। পিতার নাম খান সাহেব কাজী সদরুলওলা, মাতার নাম রতুবুন্নেসা। কলকাতা সেন্ট-জেভিয়ার্স কলেজের কেমিস্ট্রির ছাত্র থাকা অবস্থায় অনার্স পরীক্ষা শেষ না করেই বাবার অমতে তিনি ১৯৪৩ সালে নেভিতে ভর্তি হন। নেভিতে চাকরিরত অবস্থায় ব্রিটিশ অফিসারদের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতবিরোধ ঘটায় দু-দুবার কোর্ট মার্শাল হয়; অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার কারণে সেই কোর্ট মার্শাল থেকে তিনি রেহাই পান। ১৯৪৬ সালে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর আহ্বানে নেভি থেকে সেনাবাহিনীতে ট্রান্সফার নেন।

১৯৪৯ সালে ইংল্যান্ডের রয়েল আর্টিলারি স্কুল থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ শেষে কাশ্মির যুদ্ধে জেলাম সেক্টরে যোগদান করেন। ১৯৫০ সালে ক্যাডেট ট্রেনিং স্কুলে শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। ১৯৫৬ সালে মেজর হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।

পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান যখন সামরিক ফরমান জারি করে যে সেনাকর্মকর্তাদের পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা একটি নথিতে স্বাক্ষর করতে হবে তখন কোয়েটার স্টাফ কলেজে যে দু’জন সামরিক কর্মকর্তা সেই দলিলে স্বাক্ষরে অস্বীকৃতি জানান তাদের অন্যতম ছিলেন মেজর কাজী নূর-উজ্জামান। অপরজন তাঁরই দীর্ঘদিনের বন্ধু ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সালাউদ্দীন আমিন। ঘটনাচক্রে দু’জনই বাঙালী।

১৯৫৮ সালে স্টাফ কলেজে অত্যন্ত মনোযোগের সাথে অধ্যয়ন শেষে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে যুদ্ধ কোনো সমস্যার সমাধান করেনি এবং ভবিষ্যতেও যুদ্ধ দিয়ে কোনো রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ১৯৬২ সালে ইপিআইডিসিতে বদলি হয়ে আসেন। এখানেও পশ্চিম পাকিস্তানি আমলাদের সাথে তাঁর মতবিরোধ দেখা দেয়। আমলাদের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি ১৯৬৯ সালে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন এবং ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন।

কর্নেল কাজী নূর-উজ্জামান আর্মিতে চাকরিকালীন সময় থেকেই বিশেষ করে ১৯৬২ সাল থেকে এদেশের প্রগতিশীল শিক্ষক চিন্তাবিদ লেখক বুদ্ধিজীবীদের সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ড. আহমদ শরীফ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টস ফ্যাকাল্টির ডিন তখন থেকেই কাজী নূর-উজ্জামান ড. আহমদ শরীফের স্বাতন্ত্র্য-বৈশিষ্ট্যের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তাঁর সান্নিধ্যে আসেন। ড. আহমদ শরীফের সমাজচিন্তা, স্পষ্টবাদিতা এবং চারিত্রিক দৃঢ়তার জন্য তিনি তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। ড. শরীফ প্রতিষ্ঠিত স্বদেশ চিন্তা সঙ্ঘের সাথেও তিনি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত হয়ে ড. আহমদ শরীফের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজ করেছেন। কর্নেল কাজী নূর-উজ্জামান বীরউত্তম সাম্রাজ্যবাদ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে একসময় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখেছেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ লেখক শিবির-এর অন্যতম সদস্য, ছিলেন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ফ্রন্টের অগ্রভাগে।

কর্নেল (অব.) কাজী নূর-উজ্জামান একজন প্রতিবাদী মানুষ ছিলেন। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক লড়াই-সংগ্রামে তিনি ছিলেন অন্যতম সংগঠক। দেশী-বিদেশী সকল প্রতিক্রিয়াশীল বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ আন্দোলনকামী জনতাকে উদ্বুদ্ধ করেছে।

কর্নেল (অব.) কাজী নূর-উজ্জামানকে আহ্বায়ক করে প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠনগুলো গড়ে তুলেছিল ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক কমিটি। ১৯৮৫ সালে গঠিত মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কর্নেল (অব.) কাজী নূর-উজ্জামান। ১৯৮৬ খৃস্টাব্দে প্রকাশিত এদেশীয় রাজাকার, আলবদরদের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কর্মকান্ড ও গণহত্যার তথ্য স্মবলিত প্রথম গ্রন্থ ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ -এর অন্যতম সম্পাদক কর্নেল (অব.) কাজী নূর-উজ্জামান।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে সোচ্চার কাজী নূর-উজ্জামান ১৯৯২ খৃস্টাব্দের জানুয়ারী মাসে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় কমিটি’ গঠন করেন। ‘গণ আদালত’ এর প্রধান উদ্যোক্তা কাজী নূর-উজ্জামান শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গণআদালতের অন্যতম বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন।

কাজী নূর-উজ্জামানের সাথে ১৯৫০ সালে বিয়ে হয় চট্টগ্রামের মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলামের কন্যা সুলতানা সারওয়াত আরা জামানের। এমিরেটাস সুলতানা সারওয়াত আরা জামান, যিনি বাংলাদেশে একাধারে একজন শিক্ষাবিদ, মুক্তমনা, সমাজ সংস্কারক ও মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের দুই কন্যা নায়লা খান পেশায় শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, লুবনা মারিয়াম প্রতিষ্ঠিত নৃত্যশিল্পি ও কোরিওগ্রাফার এবং পুত্র নাদিম ওমর (প্রয়াত)। এই দম্পতির তিন সন্তানই

তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ – ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ: একজন সেক্টর কমান্ডারের স্মৃতিকথা’, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনীতি’, ‘বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি’ এবং ‘স্বদেশ চিন্তা’ সুধীজন কর্তৃক সমাদৃত। সংহতি প্রকাশনী, ২০১৭ খৃস্টাব্দে কর্নেল কাজী নুর-উজ্জামানের রচনাসমগ্র প্রকাশ করে। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে সাপ্তাহিক নয়া পদধ্বনি।

মুক্তিযুদ্ধে অসম সাহসী নেতৃত্বের স্বীকৃতি হিসেবে সেক্টর কমান্ডার কাজী নূর-উজ্জামানকে “বীর উত্তম” উপাধি দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান কৃতিত্ব গণমানুষের, এই বিশ্বাসে অটল কাজী নুর-উজ্জামান বীর উত্তম উপাধি গ্রহণ করেননি এবং কখনও কোথাও এই উপাধি তিনি ব্যবহারও করেননি।

সাহসী যোদ্ধা, সংগঠক, মুক্তচিন্তক কাজী নূর-উজ্জামান ২০১১ সালের ৬ মে বার্ধক্যজনিত কারণে ৮৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।

বাঙালীয়ানা/এসএল

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট