ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সেলিম আকবর মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল ২০২০ সন্ধ্যায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। প্রশাসন তার মৃত্যুর পর বুধবার, ১৫ এপ্রিল ২০২০ তার ১১/১ টয়েনবি সার্কুলার রোডের বাড়ীর সামনে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় শেষ সম্মান Gun Salute প্রদান করে। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এ ব্যাপারে ঢাকার ডিসির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে, প্রতিবেদনটি প্রকাশের সময় পর্যন্ত জেলা প্রশাসকের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সেলিম আকবরকে রাষ্ট্রীয় শেষ সম্মান Gun Salute প্রদান করা হচ্ছে।
সেলিম আকবরের মৃত্যুতে তাকে ‘বীর প্রতীক’ আখ্যায়িত করে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর বিষয়টি নিয়ে বাঙালীয়ানাকে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আলোচনাকালে জানান যে সেলিম আকবর মেলাঘর ট্রেনিং ক্যাম্পে ১০/১২ দিন অবস্থান করেন। পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের সাথে দেশে প্রবেশ করেন। তবে ঢাকায় বা দেশের কোথাও তিনি মুক্তিযুদ্ধে বা কোন অপারেশনে অংশগ্রহণ করেছেন কিনা তা তার সতীর্থরা নিশ্চিত করতে পারেননি।

শহীদ সেলিমের ‘বীর প্রতীক’ পদক
সেলিম আকবর বিভিন্ন সময়ে সাক্ষাৎকার ও প্রকাশনায় দাবী করেন যে তিনি ক্র্যাক প্লাটুনের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন এবং ঢাকার ধানমন্ডি অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। এ বিষয়ে ঢাকায় গেরিলাযুদ্ধরত দুটি গ্রুপের দুজন নেতা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ এবং মো. হাবিবুল আলম বীর প্রতীকের সাথে বাঙালীয়ানা প্রতিবেদক যোগাযোগ করলে তারা সেলিম আকবর নামে কেউ তাদের দলে ছিলেন না বলে জানান। ধানমন্ডি অপারেশনের দল নায়ক মো. হাবিবুল আলম বীর প্রতীক বলেন, ‘এ নামে আমার দলেই কেউ ছিল না ধানমন্ডি অপারেশনে থাকা তো দূরের কথা।’

সেলিম আকবরকে দুদক এই পত্রে ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম ব্যবহার করে সকল সুবিধা ভোগ’ করার অভিযোগ তদন্তে তলব করে।
তিনি কোন যুদ্ধে বীরত্বের জন্যে ‘বীর প্রতীক’ বীরত্বসূচক খেতাব লাভ করেন সে বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে এক অভিনব জালিয়াতি প্রকাশ পায়। প্রসঙ্গটি নিয়ে একাধিক মুক্তিযোদ্ধার সাথে কথা বলার পর বাঙালীয়ানা প্রতিবেদকের কাছে বেশ কিছু তথ্য আসে। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম স্বাক্ষরিত ২০১৬ সালে ২৬ এপ্রিলের একটি চিঠিতে দেখা যায় যে কথিত ‘বীর প্রতীক’ সেলিম আকবরকে দুদক তলব করছে তার বিরুদ্ধে ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম ব্যবহার করে সকল সুবিধা ভোগ’ করার অভিযোগে।
এই চিঠির সূত্রে বাঙালীয়ানা যোগাযোগ করে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ফাউন্ডেশনের জেনারেল সেক্রেটারী মেজর (অব.) ওয়াকার হাসানের সাথে। তিনি বলেন, ‘কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের সন্তান মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সেলিম প্যারাভাঙ্গা যুদ্ধে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হন। সে কারণে শহীদ সেলিমকে ‘বীর প্রতীক’ খেতাব দেয়া হয়। পরবর্তীকালে ১১/১ টয়েনবি সার্কুলার রোডের বাসিন্দা জনৈক সেলিম আকবর জালিয়াতির মাধ্যমে এই খেতাব ও পদকটি মিথ্যা গেজেটের মাধ্যমে নিজের নামে বাগিয়ে নেন। কাকতালীয়ভাবে দুজনেরই পিতার নাম ছিল আকবর আলী।’

২০১৩ সালে ২৯ মেতে প্রকাশিত পরিশুদ্ধ গেজেট।
এ বিষয়ে প্রকৃত খেতাবপ্রাপ্ত শহীদ সেলিমের বোন বর্তমানে ঢাকার বিশেষ জজ (জেলা জজ) হোসনে আরার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘২০১১ সালে দৈনিক প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনের সূত্র ধরে আমরা এই (জালিয়াত) সেলিম আকবরের কাছ থেকে আমার ভাইয়ের নামের পদক ও বিভিন্ন সময়ে নেয়া টাকা উদ্ধার করি এবং গেজেট পরিবর্তন করার ব্যবস্থা করি। সেইমত ২০১৩ সালে ২৯ মে নতুন পরিশুদ্ধ গেজেট প্রকাশ হয়। সেলিম আকবর প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে বাধ্য হয়ে পদক ও অর্থ ফেরত দেন।’

সেলিম আকবরের প্রকাশিত বই
সূত্র আরও জানায় যে সেলিম আকবর From School Boys to Guerillas নামে যে বই প্রকাশ করেন এবং সেখানে যে যুদ্ধের স্মৃতি প্রকাশ করেন সেটিও তার নিজের অভিজ্ঞতালব্ধ যুদ্ধস্মৃতি নয়। তিনি তার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুদের যুদ্ধস্মৃতি সংগ্রহ করে নিজের স্মৃতি হিসেবে লিখে ফেলেন।
প্রকৃত খেতাবপ্রাপ্ত শহীদ সেলিমের বোন বিশেষ জজ হোসনে আরা বলেন, ‘সেলিম আকবর কোন অবস্থাতেই ‘বীর প্রতীক’ নন এবং সেলিম আকবর জালিয়াতি করে পার পাননি তবে তার মৃত্যুর পরে যারা তাকে বীর প্রতীক হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন তা অন্যায়, এটি তারা আইনত করতে পারেন না।’
সেলিম আকবর আদতেও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তেমন কোন গেজেট বা সার্টিফিকেট তার পরিবার বাঙালীয়ানা প্রতিবেদককে দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
বাঙালীয়ানা/এসএল
অগ্নিঝরা এপ্রিলের দিনগুলো, পড়ুন –
এপ্রিল ১৯৭১
উত্তাল মার্চের দিনগুলো, পড়ুন –
মার্চ ১৯৭১