পরানের গহীন ভিতরে সৈয়দ হক

Comments

।। অজুফা আখতার ।।

‘যখন স্মৃতির দুধ জ্যোৎস্নার সাথে ঝরে পড়ে,
তখন কে থাকে ঘুমে? কে থাকে ভেতরে?
কে একা নিঃসঙ্গ বসে অশ্রুপাত করে?’

‘আমার জীবন আমি দীর্ঘ মনে করি না। আমাদের সামনে লালন ১১৬ বছর বেঁচে ছিলেন। সেখানে পৌঁছুতে এখনো আমার ৩৬ বছর বাকি। আমি মনে করি যে, শিল্প-সৃজনের ক্ষেত্রে যাঁরা আছেন, তাঁদের একটা ট্র্যাজেডি হচ্ছে, যখন কাজ করতে করতে হাতটা এসে যায়, আরও ভালো করার একটি দক্ষতা পেয়ে যান লেখক, ঠিক সেই সময়টিতেই তাঁর চলে যাওয়ার সময় হয়।’

কথাগুলো সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের। তাঁর আশিতম জন্মদিনের আগে এক সাক্ষাৎকারে নিজের দীর্ঘ জীবন প্রসঙ্গে বলেছিলেন। তাঁকে এবং তাঁর পাঠকদেরও এই ট্র্যাজেডিতে পড়তে হয়েছে। আমরা তাঁকে হারিয়ে বুঝতে পেরেছি, শিল্প-সৃজনের ক্ষেত্রে যাঁরা আছেন, তাঁদের ট্র্যাজেডি আর পাঠক জীবনের ট্র্যাজেডি সমান্তরাল। তিনি প্রয়াত হলেন আর আমরা বঞ্চিত হলাম নতুন কিছু পাঠের সুযোগ থেকে। আসলেই তাঁর জীবন দীর্ঘ ছিল না। কিন্তু তিনি যা লিখে গেছেন তা একজন লেখককে তাঁর কর্মে অমর করবার জন্য যথেষ্ট। তবু তিনি নিজের কাজে অতৃপ্ত ছিলেন, যা একজন প্রকৃত লেখকের সহজাত গুণ।

সৈয়দ শামসুল হক

সৈয়দ শামসুল হক

‘এই জীবনে যা কিছু করেছি, আমার নিজের কাছে কখনোই সেগুলো খুব তৃপ্তি বা স্বস্তি আনেনি। মনে হয়েছে আরও ভালো করে, আরও মর্মস্পর্শীভাবে আমার কথাগুলো হয়তো বলা যেত। বিভিন্ন মাধ্যমে কথা বলার চেষ্টা করেছি আমি—কখনো কবিতায়, গল্পে, কখনোবা উপন্যাসে, নাটকে, প্রবন্ধে; এবং যা কিছুই করি না কেন, ভাষার ভেতরেই আমি থাকতে চেয়েছি। আমার কাছে এই মাধ্যমগুলো মোটেই আলাদা নয়। সবগুলোর মূলে আমার হাতে একটিই অস্ত্র—ভাষা। আমার মনে হয়, কেউই তার শ্রেষ্ঠ লেখাটি লিখে যেতে পারে না। শেক্সপিয়ার পারেননি, কালিদাস, তলস্তয়, রবীন্দ্রনাথও না। তার কারণ হচ্ছে, হাত যতই দক্ষ হোক, আমরা যা কল্পনা করি, শেষ পর্যন্ত তার একটা ছায়াতেই মাত্র সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কিংবা পাঠকের সামনে ওই ছায়াটুকুই তুলে ধরতে হয়!’

আমি জন্মেছি বাংলায় আমি বাংলায় কথা বলি।
আমি এই বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি।
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরো শত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে?

১৯৩৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের জন্ম। ছোটগল্প, কবিতা, উপন্যাস, কাব্যনাট্য, শিশুসাহিত্য, নাটক, প্রবন্ধ সাহিত্যের সব শাখায় সমানভাবে অবদান রাখার জন্য তিনি বাংলাদেশের সব্যসাচী লেখক হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি নিজেকে প্রথমত কবি বলতেন, কবি পরিচয়টাই তাঁর কাছে বড় ছিল। কবি লেখালেখি শুরু করেন ১২ বছর বয়স থেকেই। সাংবাদিক হিসেবে পেশাজীবন শুরু করলেও পরবর্তী সময়ে লেখালেখিকেই মূল উপজীব্য হিসেবে নিয়েছিলেন। তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা দুই শতাধিক।

কবির নিজের লেখা থেকে, তাঁরই ভাষ্যে তাঁর লেখক জীবন থেকে ঘুরে আসা যাক,

“জন্মের দেশকাল ব্যাপারটা দৈবের। জন্ম নেবার ইচ্ছেটাও আমাদের বিন্দুবিসর্গের একেবারে বাইরে। জন্ম নেবার পর, অনেকগুলো বছর পেরিয়ে এসে একদিন আমি দেখে উঠি, সৌভাগ্য আমার—আমি এমন একটা দেশকালে জন্ম পেয়েছিলাম। আমি জন্মেছিলাম ঘোর ব্রিটিশকালে, হিন্দুপ্রধান এলাকায়, মুসলিম পরিবারে। এই তিনের পরিসরে এই যে আমি বেড়ে উঠি, আমাকে দেয় ইংরেজি ভাষা সাহিত্য তথা পাশ্চাত্যে অধিগম্যতা, আমি নিঃশ্বাস লয়ে লয়ে বড় হই ভারতবর্ষীয় সংস্কৃতি ও পুরাণের আবহে, আর একই সঙ্গে মুসলিম ঐতিহ্যের ভেতরেও আমার বর্ধন ঘটতে থাকে। এদিক থেকে আমার বালকবেলার হিন্দু বন্ধুদের তুলনায় কি এখনকারই তাদের প্রায় সবারই তুলনায় অনেক বড় একটা মানব-মানচিত্রে নিজেকে আমি দেখতে পাই। এই অনুভবটি আমার অক্ষরপাতের প্রতিটি মসি-শোণিতে আছে বলেই আমি মনে করি। বাঙালিকে যে আমি বাঙালি বলে জানি, বাংলা ভাষাকে যে আমি জীবন-অপরূপতারই ভাষা জেনে পৃষ্ঠার পটে এরই তুলিকায় মানুষের ভেতর-বাহিরের ছবি এঁকে চলি, তা ওই অনুভব আর জন্মসূত্রের ওই দৈবনির্ণীত দেশকাল থেকেই।

নিষিদ্ধ লোবান

নিষিদ্ধ লোবান

আমার জন্ম হয় ছোট্ট একটি শহরে, প্রায় গ্রামই বলা যায় তাকে—সেই যে গ্রামটিকে পেয়েছিলাম দেখেছিলাম জেনেছিলাম, সেই গ্রামখানি সেই গ্রামজীবন তার হাজার বছর বয়সী শেকড় নিয়ে আজও আমার ভেতরে মাটিরস টানে। এই মাটি তো কেবল মাটি নয়, কোরআনের সেই কথা—মাটি থেকেই মানুষের নির্মাণ, অতিরেকে মাটি আসলে মানুষই বটে। মানুষের সেই বয়ান যে আমি অক্ষরে অক্ষরে ধরতে চাই, ধরবার চেষ্টা এই এতটা কাল করে আসছি, সেটি ওই আমার গ্রামে জন্ম নেবার কারণে বলেই এখন শনাক্ত করি। শহরে-নগরে জন্ম নিলে কী হতো? রবীন্দ্রনাথ এক মহানগরে জন্ম নিয়েছিলেন, ওখানেই যদি তিনি বৃত্তাবদ্ধ হয়ে থাকতেন তাহলে জোড়াসাঁকোর রবিঠাকুরই হয়ে থাকতেন, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ হতেন না—হয়েছেন, শিলাইদহে এসেছিলেন বলে, তাঁর অন্তর-শেকড়টিকে তিনি গ্রামের মাটিতে মানুষের বিতানে রোপণ করতে পেরেছিলেন বলে।

সেই বালকবেলা থেকেই ঝোঁকটা ছিল লেখার দিকে। আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বালককালে প্রথম যেদিন জানলাম এটি এক মানুষেরই রচনা, বিস্মিত হয়ে গেলাম। আমি মনে করতাম, গাছ যেমন আপনা থেকেই, ঘাস যেমন, হাওয়া যেমন, আকাশের সূর্য বা রাতের নক্ষত্র যেমন, ওই কবিতাটিও আপনা থেকে হওয়া। এর পেছনে কারও কোনো চাষবাস নেই। এক বাইশে শ্রাবণের পর তেইশে, মফস্বলে খবর কাগজ আসে একদিন দেরিতে, সেদিন সময়ের আগেই ডিসপেনসারি বন্ধ করে বাবা এলেন বাড়িতে, মাকে বললেন, রবীন্দ্রনাথ কাল মারা গেছেন। চমকে উঠে জানতে চেয়েছিলাম, কে তিনি? বাবা বললেন সেই যে তোমার—আমাদের ছোট নদী!—ওইটে যিনি লিখেছেন তিনি। বিস্ময় আমাকে জাগিয়ে তোলে। মানুষই তবে লেখে!

আমার বাবাকে লিখতে দেখেছি। চিকিৎসক তিনি, লিখতেন হোমিও চিকিৎসাপদ্ধতির ওপর বই। রাত জেগে লিখতেন। বাবার পাশেই আমি ঘুমোতাম। ঘুমোবার চৌকির পাশেই তাঁর লেখার টেবিল। সকাল থেকে তাঁর রোগী দেখার ভিড়, সারা দিন ওই, ছুটি পেতেন অধিক রাতে, বই লেখার অবসরই তাঁর ছিল শেষ রাতে। হঠাৎ একেকটা রাতে জেগে উঠে ঘুম জড়ানো চোখে দেখতে পেতাম, লণ্ঠনের আলোয় বাবার মুখখানা অন্ধকারে পদ্মফুলের মতো ফুটে আছে, ঝুঁকে পড়ে তিনি লিখে চলেছেন, রাতের নির্জন স্তব্ধতার ভেতরে শব্দ উঠছে খস্ খস্ খস্ খস্, কাগজের ওপরে তাঁর কলম চলছে, দোয়াতে কলম ডুবিয়ে কালি নিচ্ছেন, ভাবছেন, আবার লিখছেন। এই ছবিটা আজও এতটাই স্পষ্ট, যেন এখনই দেখছি। কেউ যখন এখন আমাকে জিজ্ঞেস করেন, লেখার ব্যাপারটা আমার মনে এল কী করে? এখন আমি মনে করি, বাবার ওই নিশুতি রাতের ছবিটা, ওই ছবিটাই!

তখনই আমি ভাবি, আমাকেও লিখতে হবে। বাবা যে কাজটি রাতের ঘুম থেকে উঠে করেন, যে কাজটি করবার সময় তাঁর মুখখানি যে পদ্ম হয়ে ওঠে, ওই কাজটিই আসল কাজ। মনের ভেতরে ঝোঁক আর সামাল দিতে পারি না। প্রতিজ্ঞাটিই শুধু—লেখক হব! কিন্তু তা বললে হয়? বাবা চান আমি আর কিছু নয়, ডাক্তার হই। খুব জোর করতে লাগলেন, বিজ্ঞান ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দিলেন কলেজে, কিন্তু ঝোঁক বলে কথা! বাড়ি পালালাম। বাড়ি পালিয়ে দেড় বছর পরে যখন ফিরে এলাম, বাবা হার মানলেন। বললেন, ‘বেশ! যা ইচ্ছে হ! লেখক হতে চাস তো জেনে রাখ তোর যক্ষ্মা হবে, পাজামা ছেঁড়া থাকবে, ময়লা শার্ট গায়ে উঠবে, পায়ের স্যান্ডেল ক্ষয়া, পকেটে ফুটো পয়সা নেই, মদ খেয়ে মাতাল হয়ে নর্দমায় গড়াবি। এর পরও তুই লেখক হতে চাস?’

কী যে ভূতে পেয়েছিল আমাকে! জেদ করে তৎক্ষণাৎ বলে উঠি, হ্যাঁ, হতে চাই।

মার্জিনে মন্তব্য

মার্জিনে মন্তব্য

আজ বুঝি, ঝোঁকটা যে ছিল, ঝুঁকি আমি সেই সেদিনই নিয়ে ফেলি। লেখক, শুধু লেখক, এ ছাড়া আর কিছুই আমি হব না। ঝুঁকিটা এই ছিল যে আমাদের সেকালে শুধু লিখে সংসার দূরে থাক, নিজেকেও প্রতিপালন করা যেত না। আমি ঝুঁকি নিলাম লেখাকেই পেশা করে নেব। সারাক্ষণের চাকরি এই লেখা, আর কিছু নয়, নিজেকেই নিজে দেওয়া এই চাকরিটাই আমি করে যাব। এ এমন এক চাকরি, এ থেকে অবসর নেওয়া নেই, এর প্রভিডেন্ট ফান্ড-টান্ড কিচ্ছু নেই, তবু করব—করেও আসছি এই এতটা কাল। উনিশ শ একান্ন সালের মে মাসে আমার লেখা প্রথম ছাপা হয়েছিল, সে হিসেবে আজ তেষট্টি বছর! শুধু লিখেই চলেছি। ঝোঁকটা দিনে দিনে বেড়েছে, এখনো প্রতিদিন লেখার টেবিলে যখন বসি, প্রথম দিনের সেই ঝোঁকটারই নবায়ন পাই আমার ভেতরে, তবে ঝুঁকিটা আর বোধ করি না তেমন তীব্র করে, কারণ এখন ওটি সয়ে গেছে! সময় বদলেছে, বাবা যে-সময়ের পরিসরে লেখক-জীবনের পতন ও বিপন্নতার কথা বলেছেন, সেটাও আর সর্বাংশে এখন সত্য নয়। তবে, ভুলে যেন না যাই যে একটি সফল মানুষের পেছনেই কিন্তু নিরানব্বইটি লাশও পড়ে থাকে—তারা পারেনি, হয় তাদের ঝোঁকটা মরে গেছে কিংবা ঝুঁকিটাতে ভয় পেয়ে তারা একসময় বইঠাই ছেড়ে দিয়েছে।

আমি ছাড়িনি! বাবার আরও একটি কথা মনে রেখেই আমি লেখার টেবিলে এখনো বসি। কলকাতায় বাবা বছর দুয়েক মেডিকেল কলেজে পড়ে আর্থিক অনটনের কারণে সে পড়া ছেড়ে হোমিওপ্যাথিতে যান। সেই মেডিকেল কলেজে প্রথম দিনের ক্লাসে ইংরেজ অধ্যাপক যে কথাটি বলেছিলেন, কত দিন গল্প করেছেন তিনি বালক আমার কাছে, যে একজন চিকিৎসকের থাকা চাই এই তিন—ইগলস আই, লায়নস হার্ট, লেডিস ফিঙ্গার—বাজপাখির মতো সন্ধানী চোখ, সিংহের মতো নির্ভীক হৃদয় আর নারীর কোমল হাত। লেখার শুরু থেকেই আমি চিকিৎসকের ওই তিনকে একজন লেখকের জন্যও অনন্য প্রয়োজন বলে দেখে উঠেছি।”

কিছু একটা হবার জন্য কলম ধরেননি, এ কথা কবি বহু সাক্ষাৎকারে বলেছেন। বলেছেন তিনি কিছু হয়ে উঠতে পারেননি। অথচ, তার লেখাই আমাদের জানায় কি হতে পেরেছিলেন তিনি। আমরা জানি, মৃত্যুশয্যায় তিনি যখন নিজে আর লিখতে পারছিলেন না, তখন মুখে বলে গেছেন আর তাঁর স্ত্রী প্রখ্যাত সাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, কখনো বা পুত্র দ্বিতীয় সৈয়দ হক তা লিপিবদ্ধ করেছেন। যিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লিখে গেছেন, মৃত্যু আসন্ন জেনে, জীবনের সময় ফুরিয়ে আসছে জেনেও চার চারটি নাটক লেখার কাজে হাত দিয়েছিলেন, আর মৃত্যুশয্যায় প্রায় দু’শ কবিতা লিখে ফেলেছিলেন তিনি নিজে না বললেও পাঠকের হৃদয়ে তিনি শক্তিমান লেখক, তারও আগে অবশ্যই শক্তিমান কবি। কবিতার এক অন্য ভাষা, কেমন যেন একটা আপন ভাষায় লিখতেন কবি। তাঁর কবিতা সরাসরি আমাদের মনের কথাই বলে। পড়ার আগে হয়ত আমরা জানি না, এসব আমাদেরই মনের কথা। অথচ তাঁর কবিতা পড়ার পর মনে হয়, আমিই তো এই কথা বলতে চেয়েছিলাম! আর কবি তা লিখেও ফেলেছেন?

মানুষ এমন ভাবে বদলায়া যায়, ক্যান যায়?
পুন্নিমার চান হয় অমাবস্যা কিভাবে আবার?
সাধের পিনিস ক্যান রঙচটা রদ্দুরে শুকায়?
সিন্দুরমতির মেলা হয় ক্যান বিরান পাথার?
মানুষ এমন তয়,একবার পাইবার পর
নিতান্ত মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর।

কাব্যনাট্য রচনায় ঈর্ষণীয় সফলতা পাওয়া সৈয়দ হক নূরলদীনের সারাজীবন, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, গণনায়ক, ঈর্ষা ইত্যাদি নাটকে রেখেছেন মুন্সীয়ানার স্বাক্ষর। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ ও ‘নুরলদীনের সারাজীবন’ বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে আছে। আমাদের প্রতিবাদের ইতিহাসের এক নিদর্শন হয়ে উঠেছে ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ নাটকটি। নাটকের ‘সবিনয় নিবেদন’ অংশে তিনি লিখেছেন,

নূরলদীনের সারাজীবন

নূরলদীনের সারাজীবন

‘ইতিহাস থেকে আমি পেয়েছি নূরলদীন, দয়াশীল ও গুডল্যাডকে; কল্পনায় আমি নির্মাণ করে নিয়েছি আব্বাস, আম্বিয়া, লিসবেথ, টমসন ও মরিসকে। নূরলদীনের আত্মা ও প্রেরণা আমি ইতিহাসের ভেতর থেকে সংগ্রহ করেছি। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও মানসিক সংকট আমি সম্ভবপরতার ক্ষেত্র থেকে আবিষ্কার করে নিয়েছি।’

পুন্নিমার চান বড় হয় রে ধবল।
জননীর দুগ্ধের মতন তার দ্যাখো রোশনাই।

সব্যসাচী লেখকের এ অমর সৃষ্টি ভেতরে ভেতরে আমাদের তাড়িত করে। দেশের অস্থির সময়ে আমরা ভরসা পাই, আমরা যেন কথা বলার সাহস খুঁজে পাই আবার!

 

হামার মরণ হয়, জীবনের মরণ যে নাই।
এক এ নূরলদীন যদি চলি যায়,
হাজার নূরলদীন আসিবে বাংলায়।
এক এ নূরলদীন যদি মিশি যায়,
অযুত নূরলদীন য্যান আসি যায়,
নিযুত নূরলদীন য্যান বাঁচি রয়।

কবি সৈয়দ শামসুল হক গীতিকার হিসেবেও অনুপম ছিলেন। বাংলা চলচ্চিত্রে তিনি রেখে গেছেন স্বর্ণখনিতুল্য অনেক গান। কবি এক সাক্ষাৎকারে বলেন,

‘আমি কখনো গান লিখতে চাইনি। প্রথম গান লিখতে হয়েছিল প্রডাকশনের খরচ বাঁচাতে এবং সুরকার সত্য সাহাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। সত্যিকার অর্থে একজন লিখছেন, একজন সুর করছেন। এটা আমার পছন্দ নয়। এতে সুর ও কথার বিচ্যুতি ঘটে। একজনই এই দুটো কাজ করলে অসাধারণ কিছু সৃষ্টি হয় বলেই আমার বিশ্বাস। এ কারণে আমি গানটা লিখেছি বটে, কিন্তু মন কখনো সায় দেয়নি।’

মন সায় না দিলেও অতুলনীয় যে সব গান আমরা কবির কলম থেকে পেয়েছি, সে সব বাংলা চলচ্চিত্রের সম্পদ। তাঁর লেখা প্রথম গান ছিল সুতরাং ছবির ‘তুমি আসবে বলে, কাছে ডাকবে বলে, ভালোবাসবে বলে শুধু মোরে’। এই ছবির চিত্রনাট্য, সংলাপ এবং সবগুলো গানই সৈয়দ শামসুল হকের লেখা। প্রথম গানটি লিখেছিলেন ফরাশগঞ্জে একটি বাড়ির চিলেকোঠায় বসে ১৯৬১ সালে। সেখানে একটি মেসে থাকতেন সত্য সাহা। গানটি তাঁরা একসঙ্গে বসেই করেছিলেন। কবি এক লাইন লিখেছেন, আর সত্য সেটা সুর করেছেন। এভাবেই তৈরি হয় গানটি।

সৈয়দ শামসুল হক

সৈয়দ শামসুল হক

শুনে পরিচালক সুভাষ দত্ত বলেছিলেন, ‘আঞ্জুমান আরা বেগম গানটি ভালো গাইবেন।’ গানটির রেকর্ড হয়েছিল এফডিসিতে। লিটল অর্কেস্ট্রা বাজিয়েছিল। তখন সরাসরি রেকর্ডিং হতো। যন্ত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী একসঙ্গে। একবার ভুল হলে আবার প্রথম থেকে শুরু। কবির স্মৃতিচারণে জানতে পারি, রাত ১০টায় শুরু হয়ে, রাত তিনটায় শেষ হয়েছিল রেকর্ডিং। এই গানটির শেষ মুখরাটুকু গেয়েছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। এই ছবিতেই ‘নদী বাঁকা জানি, চাঁদ বাঁকা জানি, তাহার চেয়ে আরও বাঁকা তোমার ছলনা’—এই গানটিতে মুস্তাফা জামান আব্বাসী ও ফেরদৌসী রহমান দুই ভাই বোন প্রথম একসঙ্গে প্লেব্যাক করেন। এ ছাড়া আব্দুল আলীম আর কাজী আনোয়ার হোসেন গেয়েছিলেন ‘এই যে আকাশ, এই যে বাতাস, বউ কথা কও সুরে যেন ভেসে যায়, বেলা বয়ে যায়, মধুমতি গাঁয় ওরে মন ছুটে চল চেনা ঠিকানায়’।

আরেকটি গান ‘এমন মজা হয় না, গায়ে সোনার গয়না, বুবুমণির বিয়ে হবে বাজবে কত বাজনা’ গেয়েছিল শিশুশিল্পী আলেয়া শরাফী। ছবির সবগুলো গানই শ্রোতাপ্রিয় হয়েছিল।

সুভাষ দত্তের আরেকটি ছবি আয়না ও অবশিষ্টতে তাঁর লেখা ‘যার ছায়া পড়েছে মনেরও আয়নাতে, সে কি তুমি নও ওগো তুমি নও’—ফেরদৌসী রহমানের গাওয়া এই গানটি ওই সময় ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল। সুর করেছিলেন সত্য সাহা।

সত্য সাহা ছাড়া আরও কয়েজন সুরকারের সঙ্গে কাজ করেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন, আবদুল আহাদ, সমর দাস, আলম খান, বশীর আহমেদ। কাজী জহিরের ময়নামতি ছবিতে বশীর আহমেদের সুর ও কণ্ঠে কবির লেখা একটি গান বেশ আলোচিত হয়। গানটি ছিল ‘অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায়, মিছে তারে শিকল দিলাম রাঙা দুটি পায়’। গানটি কাজী জহিরের গ্রিনরোডের বাসায় বসে লিখেছিলেন কবি। কবি এক সাক্ষাৎকারে বলেন,

কাজী জহিরের একটা কায়দা ছিল, সুরকারদের তাঁর বাসায় গিয়ে তাঁর সামনে বসে সুর করতে হতো। সুর পছন্দ হলে তিনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়তেন। আর পছন্দ না হলে দাঁড়িয়ে যেতেন।’

‘বড় ভালো লোক ছিল’ ছবিরসবগুলো গানই সৈয়দ শামসুল হক লিখেছিলেন। এই ছবির চিত্রনাট্য আর সংলাপও কবির লেখা। কবি একবার স্মৃতিচারণ করেছিলেন,

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ হক

‘আমি পীর বংশের ছেলে। ভেতরে একটা আধ্যাত্মিকতা কাজ করে। ‘বড় ভালো লোক ছিল’ ছবির চিত্রনাট্য, সংলাপ লেখার সময় আমি অনেকটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। ঘোরের মধ্যেই ছবির গানগুলো লেখা। বিশেষ করে ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস’ গানটির কথা বলব। মনে আছে, এই ছবির গল্প নিয়ে মণিপুরি পাড়ায় আমার ভাড়াবাড়িতে যেদিন বসি, সেদিন আলম খানকে গানটির অস্থায়ীটুকু দিই। প্রায় তিন মাস পর এক সকালে বাসায় এসে অস্থায়ীর সুর শোনান আলম। প্রথম শুনেই ভালো লেগেছিল। ওই দিন তাঁকে আমি দুটো অন্তরা দিই। গানটি রেকর্ড হয়েছিল শ্রুতি রেকর্ডিং স্টুডিওতে। ছবির এই গানটিসহ আরও দুটো গান এন্ড্রু কিশোর গেয়েছিলেন। গান দুটো হলো ‘তোরা দেখ দেখ দেখরে চাইয়া, রাস্তা দিয়া হাইটা চলে রাস্তা হারাইয়া’ এবং ‘আমি চক্ষু দিয়া দেখতাছিলাম জগৎ রঙ্গিলা’। ছবির আরও দুটো গান বেশ জনপ্রিয় হয়। দুটো গানই রুনা লায়লা গেয়েছিলেন। একটি অবশ্য দ্বৈত গান। রুনার সঙ্গে ছিলেন বিপুল ভট্টাচার্য। এই গানটি হলো ‘চাম্বেলিরও তেল দিয়া কেশ বান্ধিয়া’, অন্যটি ‘পাগল পাগল মানুষগুলো পাগল সারা দুনিয়া, কেহ পাগল রূপ দেখিয়া, কেহ পাগল শুনিয়া’। আলমের সঙ্গে আমার আরও দুটো গান করা হয়েছিল। এই দুটো গানও ভীষণ জনপ্রিয় হয়। একটি মান সম্মান ছবির ‘কারে বলে ভালোবাসা কারে বলে প্রেম, মিলনে বিরহে আমি জানলেম’-এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া।

অন্যটি আশীর্বাদ ছবির ‘চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা’। গেয়েছিলেন রুনা লায়লা ও এন্ড্রু কিশোর। চলচ্চিত্রের জন্য এটাই ছিল আমার লেখা শেষ গান। এরপর আমি আর কোনো গান লিখিনি।

সৈয়দ শামসুল হকের বিখ্যাত সাহিত্যকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—উপন্যাস: ‘নিষিদ্ধ লোবান’, ‘খেলা রাম খেলে যা’, ‘সীমানা ছাড়িয়ে’, ‘নীল দংশন’ ও ‘মৃগয়ার কালক্ষেপ’। নাটক: ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘নুরলদীনের সারাজীবন’, ‘গণনায়ক’। কবিতা সংকলন: ‘পরানের গহীন ভেতর’, ‘বেজান শহরের জন্য কোরাস’, ‘এক আশ্চর্য সংগ্রামের স্মৃতি’, ‘প্রেমের কবিতা’। শিশুসাহিত্য: ‘সীমান্তের সিংহাসন’। ‘নিষিদ্ধ লোবান’ উপন্যাস অবলম্বনে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ‘গেরিলা’ সিনেমাটি তৈরি করা হয়েছিল।

লন্ডনের রয়্যাল মার্সডেন হাসপাতালে চার মাস ক্যানসার চিকিৎসার পর বাংলাদেশে ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়, ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর তারিখে অন্যলোকে পাড়ি দেন বিখ্যাত এই বাংলা সাহিত্যিক।

‘তয় কি অচিন বৃক্ষ তুমি সেই ভুবনে আমার,
আমারে দিয়াছো ব্যাধি, নিরাময় অসম্ভব যার?’

লন্ডনে কবির বন্ধু সাংবাদিক গাফ্ফার চৌধুরীকে বলেছিলেন,

‘শোনো গাফ্ফার, চলে যাওয়ার কথা এত বলতে নেই। ঠিক আছে, যেতে তো হবেই, ‘জন্মিলে মরিতে হবে/ অমর কে কোথা কবে?/ চিরস্থির কবে নীর/ হায় রে জীবন-নদে’—মাইকেল মধুসূদনের কথা। এই কবিতারই শুরুতে বলেছেন, ‘রেখো মা, দাসেরে মনে/ এ মিনতি করি পদে।’ তাঁর মতো করেই বলতে চাই, দাস হিসেবেই বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের মানুষের জন্য, যত সামান্য কিছুই করেছি, শেষ পর্যন্ত বলব, ‘রেখো মা দাসেরে মনে।’ তবে সেটা আমাকে মনে রাখা নয়, আমার কাজটাকে মনে রাখা। আমি মনে করি, আমাদের চেয়ে বড় হচ্ছে আমাদের কাজ। যদি কাজ করে থাকি, সেটাকেই যেন মানুষ মনে রাখে।’

আমরা কবিকে এবং তাঁর কাজকে মনে রেখেছি। পরানের গহীন ভিতরে যিনি রুমাল নাড়তে জানেন, তাকে বাংলার মানুষ চিরদিন মনে রাখবে।

‘মৃত্যুর পরে একজন বাঙালি হিসেবে বাঙালির মনে বেঁচে থাকতে চাই।’

পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের—
কখনোই ভয় করি নাকো আমি উদ্যত কোনো ‌খড়্‌গের।
শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস;
অস্ত্রেও শাণ দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;
একই হাসিমুখে বাজিয়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস;
আপস করিনি কখনোই আমি—এই হলো ইতিহাস।

সৈয়দ শামসুল হক

সৈয়দ শামসুল হক

সূত্র: পত্রিকায় প্রকাশিত সৈয়দ শামসুল হকের বিভিন্ন লেখা ও সাক্ষাৎকার
গ্রাফিক্স: সৈয়দ মাহদী ইসলাম অয়ন

বাঙালীয়ানা/এজে

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.