সোমেন চন্দের জীবন নিয়ে আলোচনার আগে, আমাদের চন্দ বংশ, পরিবার ও আত্মীয়স্বজন সম্পর্কে কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য পেশ করা প্রয়োজন।
আমাদের গ্রামের নাম বালিয়া, আমরা বলতাম, বাইল্যা। পূর্বে ছিল নারায়ণগঞ্জ সাবডিভিশনের বালীগঞ্জ থানার অধীন। বর্তমানে নরসিংদি জেলার পলাশ উপজেলার অন্তর্ভুক্ত। ঘোড়াশাল ফ্ল্যাগ ষ্টেশন থেকে ছয় মাইল। পলাশ থেকে তিন মাইল আর চরসিন্দুর এক মাইল। গ্রাম থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটাপথে শীতলক্ষ্যা নদী। স্বচ্ছ, টলটল জলের এই নদী। এমন স্বচ্ছ জলের নদী এই উপমহাদেশে আমি আর দেখিনি। নারায়ণঞ্জে শীতলক্ষ্যার জলে প্র্রস্তুত “রায়বণের মোজ” সেই যুগে সমস্ত পূর্ব বাংলায় যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল।
বালিয়া গ্রামে আমাদের ছয়-সাত পুরুষের বাস। দুই একটি আশ্রিত (আত্মীয়) পরিবার ও কয়েক ঘর প্রজা ছাড়া গ্রামটিতে আমাদের চন্দদেরই বাস। ছোট জোতদার পরিবার। পিতামহ রামকুমার চন্দ পর্যন্ত আমাদের পরিবার বেশ সচ্ছলই ছিল। ঢাকা বাংলা একাডেমি প্রকাশিত, সোমেন চন্দের প্রথম জীবনী লেখক হায়াৎ মামুদ অনুসন্ধানের প্রয়োজনে আমাদের গ্রামে গিয়েছিলেন। তিনি আমাদের বংশের যারা রয়েছে, তাদের বেশ সচ্ছলই দেখেছেন।
জ্যাঠামশায় রাজেন্দ্র কুমার লিখিত বংশ-লতিকা অনুযায়ী আমাদের ধরে সাত-পুরুষ। এখানে আমরা কোথা থেকে এলাম? এর আগে আমাদের বাস কোথায় ছিলো সব রয়েছে সেখানে।
এ বিষয়ে জ্যাঠামশায় তাঁর ডাইরিতে লিখেছেন, “আমাদের পূর্বপুরুষেরা বোধ হয় চন্দ দ্বীপের বাসিন্দা ছিলেন। ঐ দ্বীপ বিলুপ্তির কারণে এখানে এসে বসতি স্থাপন করা হয়।”
কিন্তু আমাদের বংশে, আমাদের ভাইদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বড়, যাঁকে আমরা চিনিদাদা বলতাম, সেই জীতেন্দ্রনাথ চন্দ (যিনি পদস্থ সরকারী কর্মী ছিলেন) অনেক অনুসন্ধানের পর এই সিদ্ধান্তে আসেন, “বালিয়া গ্রামে আসার পূর্বে আমরা ছিলাম বিক্রমপুরের সোনারগাঁও গ্রামে।” তিনি তাঁর ডাইরিতে লিখেছেন, “রাজবল্লভ ও রামকানাই দুই ভাই সোনারগাঁও ছেড়ে আমাদের গ্রামের পাশের দক্ষিণ পাড়াতে বসবাস আরম্ভ করেন। রাজবল্লভের শ্বশুরবাড়ীও এ গ্রামে। অন্য ভাই রামকানাই চরসিন্দুরের নিকট মঠবাড়ীর চন্দ্রকিশোর সেনের (বৈদ্য) কন্যাকে বিয়ে করেন। চিনিদা বৈদ্য কথাটা বোধ হয় এইজন্য লিখেছেন, সেই যুগে কায়েতের ছেলের বৈদ্য মেয়ে বিয়ে করা উল্লেখ করার মত ঘটনা। তিনি আরো লিখেছেন, “রামকানাই ঘরজামাই হন।” ঠাকুরদা রামকুমার, ঠাকুরমা কাদম্বিনী দেবী এবং তাদের তিন সন্তান, বড় ছেলে রাজেন্দ্র পরের ছেলে রাজেন্দ্র থেকে দশ বছরের ছোট নরেন্দ্র ও একমাত্র কন্যা ধীরণ। এই নিয়ে ছোট্ট সংসার।
কাদম্বিনী দেবী, ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পারের গ্রাম শুভাঢ্যার রায় বংশের মেয়ে। বৃহৎ গ্রাম; উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম পাড়া। মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত একটি খাল। শিক্ষায় উন্নত এই গ্রামের লোকদের মধ্যে গভীর স্বদেশপ্রেমও ছিলো। ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পলায়মান সিপাহীদের আশ্রয় দিয়ে, নিরাপদ পলায়নে সহায়তা করে সেই যুগে তারা তাদের স্বদেশপ্রেমের স্বাক্ষর রেখেছিলেন।
ঐ গ্রামের অনেক পরিবারের মত রায় পরিবারেও ছিলো শিক্ষার পরিবেশ। অপরদিকে আমাদের গ্রামে শিক্ষালাভের কোনো সুযোগ ছিলো না। পাশের গ্রাম ‘মাইলতায়’ একটিমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়। ঐ স্কুলের হেড-পণ্ডিত ছিলেন, বাবাদের একমাত্র পিসেমশায়, যিনি আমাদের বাড়ীতে থেকে প্রায় চল্লিশ বছর শিক্ষকতা করেছেন।
ঠাকুরমা সন্তানদের শিক্ষালাভের বিষয়টির যথেষ্ট গুরুত্ব দিতেন। তাই নিজেদের নিঃসঙ্গতা বেদনাদায়ক হলেও একে একে দুই ছেলেকেই পিত্রালয়ে প্রেরণ করেন।
প্রথমে বড় ছেলে রাজেন্দ্র শুভাঢ্যায় থেকে পড়াশোনা করতে থাকেন। মাঝে এক বছর ছোট মামা তারক রায়ের কাছে ছিলেন। তারক রায় ব্রতচারীখ্যাত গুরুসদয় দত্তদের বীরশ্রী গ্রামের স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং গুরুসদয়ের গৃহশিক্ষক ছিলেন। দত্তদের বাড়ীতে থাকতেন। রাজেন্দ্রও ঐ বাড়ীতে ছিলেন।
রাজেন্দ্র ১৮৯৯ সালে এন্ট্রাস পাশ করেন। আমাদের গ্রামের আশে-পাশে তিনিই প্রথম এন্ট্রাস পাশ করেন। পরে এফ্ এ প্লাকড্ হয়ে তার চাকুরী জীবনে প্রবেশ। ঢাকা পুলিশ অফিসে কেরানী। শেষ দিকে ঐ দপ্তরের (জিলা কেন্দ্র) এ্যাকাউনটেন্ট। হায়াৎ মামুদ বা বিশ্বজিৎ ঘোষ যেমন লিখেছেন, তিনি জিমখানা ক্লাবে চাকুরী করতেন তা সঠিক নয়। তবে, পুলিশ অফিসের কাজের বাইরে জিমখানায় পার্টটাইম কাজ করতেন। রিটেয়ার করার পর জিমখানার কাজটা নিয়মিত করতেন।
যথাসময়ে ছোট ছেলে নরেন্দ্রও মামাবাড়ী প্রেরিত হন। শুভাঢ্যায় মামাবাড়ী থেকে বুড়িগঙ্গা নদী পেরিয়ে ঢাকায় এসে পড়া। ঐ সময় পুলিন দাসের আখড়ায় ব্যায়াম শিক্ষাও করতেন। এমনকি ১৯০৪-৫ সালে ঢাকায় ন্যাশনাল স্কুল প্রতিষ্ঠা হলে তিনি তার ছাত্র হিসাবে যোগ দেন। সেই যুগে ব্যায়ামাগারগুলি শরীর চর্চার সাথে সাথে বিপ্লবী দলের কর্মী সংগ্রহের কেন্দ্র ছিলো। বাবাও বিপ্লবী দলে যুক্ত হয়ে পড়েন।
১৯০৫ সালে অনুশীলন সমিতির নেতা প্রমথ মিত্র সেই যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাগ্মী ও জাতীয় নেতা বিপিনচন্দ্র পালকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় আসেন। বাবা বিপিন পালের অনুরক্ত হয়ে পড়েন।
কিছুকাল বিপ্লবীদের সঙ্গে যুক্ত থাকার পর, এদের হত্যা ও ডাকাতির রাজনীতি বাবার মনোজগতে নানা দ্ব›দ্ব ও জিজ্ঞাসার সৃষ্টি করে। তিনি ক্রমে ক্রমে এদের কাছে থেকে সরে আসেন। ঐ সময় বিপিন পালও বিপ্লবীদের সঙ্গ এড়িয়ে নিজের অনুবর্তীদের সংগঠিত করতে প্রয়াসী হন। এই সময়কার একটি তথ্য থেকে বাবার রাজনৈতিক সক্রিয়তার আন্দাজ করা যাবে। ১৯১০-১১ সালে বাবা ও তার বন্ধু অক্ষয় কুমার রায় কলকাতায় আসেন। সাত বা দশদিন বিপিনচন্দ্র পালের বাড়ীতে অবস্থান করেন। ঢাকার সংগঠন বিষয়ে আলোচনা এবং বিপিনবাবুর নির্দেশ নিয়ে ঢাকা যান।
চাকুরী পাওয়ার অল্পকাল পরে জ্যাঠামশায় উর্দু জয়নাগ রোডে বাসা ভাড়া করেন। এদিকে বাবা, বেশ কয়েক বছর রাজনৈতিক কর্মীরূপে কাজ করার পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হতাশাবোধ করতে থাকেন।
এই সময় বাবার উপর যাঁর প্রভাব খুবই তীব্র সেই দাদা রাজেন্দ্র তার প্রিয়তম ছোট ভাইয়ের উদ্দেশ্যহীন (তার মতে) গতিবিধির লাগাম ধরে টান লাগাতে আরম্ভ করেন। অবশেষে বাবাকে চাকুরী নিতে রাজী করান।
জেলা পুলিশ দপ্তরের জনপ্রিয় কেরানী (পরে এ্যাকাউনটেন্ট ছিলেন) ভাইয়ের জন্য একটার পর একটা চাকুরী জোগাড় করেন। প্রথম চাকুরী চমকে যাওয়ার মত। যে পুলিশের খাতায় গোয়েন্দাদের নজরে বাবা তখন তালিকাভুক্ত সেই পুলিশেই কিনা চাকুরী? জেঠা নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে সেইসব মুছে ফেলার ব্যবস্থা করলেন। বাবা পুলিশের চাকুরীতে ঘোরতর আপত্তি সত্ত্বেও দাদার পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে যোগ দিলেন। বাবার সঙ্গে একই দিনে ঢোকা মতি দে (পরবর্তীকালে চিনিদার শ্বশুর) গোয়েন্দা দপ্তরের ডি-এস-পি হয়ে অবসর নিয়েছিলেন। এই কাজে তিন বছরের ‘বন্ড’ ছিলো। বাবার পক্ষে এই চাকুরী করা অসম্ভব হয়ে দেখা দেয়। তিনি এই কাজে তার আপত্তির কথা দাদাকে প্রতিনিয়ত বলতে থাকেন। এমনকি তার আপত্তি এমন পর্যায়ে যায় যে দাদা বাধ্য হয়ে, আবার নানা কৌশল-চাতুরী খাটিয়ে, বাবার শারীরিক অক্ষমতা প্রমাণ করে, ‘বন্ড’ সত্ত্বেও তাঁকে মুক্ত করে আনলেন।
পরের চাকুরী পাটের অফিসের কেরানীর। এখানেও পুলিশের মত দুর্নীতি। অশিক্ষিত চাষীদের হিসাব ও ওজনে ঠকিয়ে অর্থ উপায়। এমনকি কোম্পানিকেও ছেড়ে দিলেন।
এবার ষ্টীমার ষ্টেশন মাষ্টারের কাজ। মাঝরাতে ষ্টীমার আসে, সময়েরও স্থিরতা নেই। রাতে ঘুমানো প্রায় অসম্ভব। এ’ছাড়া পরিবার থেকে দূরে একলা থাকা, নানা অসুবিধা। এ কাজও ছেড়ে দিলেন। এর পরের কাজ, ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে রিসিভিং ক্লার্ক। হাসপাতালে যে সব খাদ্যদ্রব্য (কাঁচামাল) আসে তা রিসিভ করা। সেদিনে এটাও ঘুষের চাকুরী। বাবা বোধ হয় চাকুরী ছাড়তে ছাড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, তাই আর ছাড়লেন না। পরের জীবনের তেত্রিশ বছর এই চাকুরীই করেছেন। যে কর্মী ঘুষ নেন না সাপ্লায়াররাও তাঁর সম্পর্কে সচেতন থাকে। বাবার একমাত্র লক্ষ্য খাদ্যদ্রব্য যেন গুণমানের দিক থেকে গ্রহণযোগ্য হয়। কিছুকাল পরে তিনি হাসপাতালের ষ্টোরকিপার হন।
উর্দুতে বাসা, দু‘ভাইয়ের উপার্জনে সচ্ছল পরিবার। দাদা-বৌদি, মেয়ে সংযুক্তা এবং বাবাকে নিয়ে পরিবার। বোধহয় ১৯১৮ সালের প্রথম দিকে বাবা কয়েকজন বন্ধু নিয়ে নিজের পাত্রী দেখতে যান। বাবা লিখেছেন, “গায়ের রং খুব ফর্সা নয়, তবে ফর্সা বলা চলে। কিঞ্চিৎ লালাভ মুখশ্রী এবং শরীরের গঠন সুন্দরই ছিল। আধুনিক যুগের ষ্টাইল দিয়ে রূপবতী বলা চলে, অনুপম রূপবতী বলা চলে না। কিন্তু তাঁর নিখুঁত অবাধ স্বাস্থ্যের দিকে দৃষ্টি দিলে বোঝা যায় যে, অনুপম রূপবতী”। বাবা এই রূপবতী কন্যা, সোমন চন্দের গর্ভধারিণী হিরণবালাকে বিয়ে করলেন। তাঁর পিতা আদিত্য বসু, পারজোয়ার পরগণার টেঘরিয়ায় বাড়ী। হায়াৎ মামুদ বা বিশ্বজিৎ ঘোষ লিখিত ধিতপুর নয়। তিনি টঙ্গী থেকে চারমাইল দূরে আশুলিয়া গ্রামে রায় বাড়ীতে বিয়ে করেন, ঘরজামাই হন। অবশ্য টেঘরিয়া আশুলিয়া দু’দিক বজায় রেখে। তাঁর দুই কন্যা হিরণবালা ও কিরণবালা এবং একমাত্র পুত্র অরুণ বসু। যিনি বড় হয়ে নারায়ণগঞ্জ মিউনিসিপ্যালিটিতে চাকুরী করতেন। অল্প বয়সেই টিবি রোগে মারা যান।
সোমেনের জন্ম মাতুলালয় আশুলিয়ায়, ১০ই জৈষ্ঠ্য ১৩২৭ সন। কয়েক মাস পর মা ও ছেলেকে ঢাকা নিয়ে আসা হয়। জেঠিমার ইতিমধ্যে দ্বিতীয় কনা (নিরাশা) হয়েছে। পরিবারে সোমেন প্রথম পুত্র সন্তান, সকলের আদরের ধন। জেঠিমা সুখদা চন্দ সোমেনকে নিজের মেয়েদের থেকেও বেশি ভালবাসতেন। গৃহকত্রীর ভয়ে কেউ দাদাকে বিরক্ত করতে সাহসী হতো না। কোন কারণে দাদাকে কাঁদতে দেখলে তিনি বাড়িতে হুলুস্থুলু বাধিয়ে দিতেন।
ইতিপূর্বে আমাদের পিতামহ রামকুমার উর্দু বাসায় ইনফ্লুয়েনজায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান, ১০ই জুলাই ১৯১৯।
মৃত্যুর আগে তিনি ছেলেদের তার সম্পত্তি বুঝে নিতে বলেন। জমির আয় ছাড়া তিনি তেজারতি কারবারও করতেন। এ বিষয়ে “আগুনের অক্ষর” বইয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুল তথ্য পরিবেশনার জন্য মার্জনা চাইছি। একজন আত্মীয়ের দেওয়া তথ্য বিচার-বিবেচনা না করে লিখেছিলাম, তেজারতির টাকা বিশ পঁচিশ হাজার হতে পারে। সেইদিনে এটা সম্ভব ছিলো না, তবে তিনি তেজারতিতে টাকা খাটাতেন।
দাদু বাবাকে সব বুঝে নিতে বলেন। বাবা বলেন, দাদাকে বুঝিয়ে দিতে। বড় ছেলে বেহিসাবী বিবেচনায় দাদু তাকে বুঝিয়ে দিতে সম্মত ছিলেন না। অবশেষে ছেলেরা বলেন, আমরা দু’ভাই তো শহরে চাকুরী করি, আমাদের চলে যাবে। কিন্তু কাকাদের পরিবার তো জমির উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। ছেলে-পুলে নিয়ে তাদের সংসারও বড় হয়েছে। আপনার কেনা জমি চার-ভাইয়ের (দাদুরা চার ভাই ছিলেন) মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দিন। চন্দ বংশের সম্পত্তির চারআনা অংশের মালিক ছিলেন দাদুরা। ঐ সম্পত্তিও দাদুর অর্জিত জমি-জমা সমান চারভাগে ভাগ করে দেওয়া হল।
দাদুর মৃত্যুর পর তাঁর মহাজনী কারবারের অর্থ আদায়ের কোনো চেষ্টা বাবারা করেননি। বাবাতো মহাজনী কারবারকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখতেন। দু’একজন শহরে এলে, ঋণশোধ করতে এসে বাবাকে না দিতে পেরে বড় ভাইকে দিয়েছেন। এইভাবেই ঋণগ্রস্তরা ঋণমুক্ত হলেন।
পরবর্তী সময়ে অনেককাল কেউ নিজেদের জমির প্রাপ্য অংশ গ্রহণের জন্য দেশের বাড়ীতে যাননি। জ্যাঠামশায় দু’একবার দেশে গেছেন। কিন্তু প্রত্যেকবার তার কোন না কোন সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। ফলে আমাদের পরিবারে এই বিশ্বাস দৃঢ়মূল হয়েছে, দেশে গেলে অমঙ্গল ঘটবে। পরে বড়দি সংযুক্তার বিয়ের সময় ঐ সম্পত্তি বাধা রেখে ঋণ নেওয়া হয়। এর অনেকদিন বাদে, ফজলুল হক সাহেবের প্রধানমন্ত্রীত্বের আমলে আইনের ফলে অন্যান্যদের সাথে আমাদের সম্পত্তিও ঋণমুক্ত হয়ে যায়।
অত্যধিক আদরের মধ্যে দাদার শিশুকাল কেটেছে। জ্যেঠিমা (দাদা যাঁকে বড়মা বলতেন)। তার কথা আগেই লিখেছি। বড়দি সংযুক্তা (দাদা থেকে নয়-দশ বছরের বড়) দাদাকে অত্যধিক আদর করতেন। বাবা এদের কথা বারবার বলেছেন। দাদার যখন মাত্র তিনি বছর বয়স তখন মা হিরণবালা কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বয়সের দরুন এই মৃত্যু দাদার অনুভব বা উপলব্ধির বাইরে ছিল।
হিরণবালার মৃত্যুর বছরখানেকের মধ্যে বাবা আবার বিয়ে করেন সরযূকে, অনেকে আদর করে ডাকতেন সরোজহাসিনী। আমার বাবা থেকে মা বয়সে অনেক ছোট ছিলেন। সেদিনে এমনটা হয়ে থাকত। বাবা সৎচরিত্রের ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়ায় এবং উভয়েরই মামাবাড়ী একই গ্রাম শুভাঢ্যায় হওয়ায়, দুই পক্ষের আত্মীয়দের উদ্যোগের ফলে এই বিয়ে হয়েছিলো। অন্যদিকে মার পিত্রালয় নিয়ে কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন। যা থেকে এই বিয়ের কারণ অনেকটা বোঝা যাবে।
মায়েরা চারবোন, দুই ভাই। বড়বোনের আগেই বিয়ে হয়েছিল। ধামগড় নিবাসী, মুরাপাড়ার নায়েব জিতেন্দ্রনাথ ঘোষের সঙ্গে (তাঁর বড় ছেলে অরবিন্দ ঢাকা ও কলকাতায় সুনামের সঙ্গে ফুটবল খেলেছেন)। মার বাবা শরৎ বিশ্বাস জনপ্রিয় ডাক্তার ছিলেন। তিনি টঙ্গীতে ডিসপেনসারি করেন। গাছার জমিদার বাড়ীর গৃহ চিকিৎসকরূপে তিনশত টাকা পেতেন। নিজ গ্রাম ধউর, টঙ্গী ও গাছায় ঘোড়ায় চড়ে চিকিৎসা করতেন। যথেষ্ট পসার। মাত্র ৪১/৪২ বছর বয়সে তিনি মারা যান। তাঁর বড়ভাই উমেশ বিশ্বাস গাছার জমিদার বাড়ীর নায়েব ছিলেন। হাতির পিঠে চড়ে, তুরাগ নদী পারাপার করে তিনি নায়েবগিরি করতেন। দুই ভাইয়ের প্রচুর আয়ের ফলে সংসারে প্রাচুর্য। মনের মত করে পাকা বাড়ী হয়েছে। অনেক জায়গা নিয়ে, চারদিকে সাত আট ফুট উঁচু প্রাচীর ঘেরা বাড়ী। পেছনের দিকে অনেক ধরনের ফল-ফলাদির গাছ, সামনের দিকে ফুলের বাগান। বাড়ীর বাইরে বৃহৎ কাছারী ঘর। ডাক্তার ভাইয়ের মৃত্যুর ফলে পরিবারের আয় অনেক কমে যায়। কিন্তু বড়লোকী অব্যাহত থাকে। অল্পকাল পরে তিনি গাছার জমিদারের তহবিল তছরূপের দায়ে অভিযুক্ত হন। সমস্ত সম্পত্তি নিলামে ওঠার অবস্থা। এই অবস্থায় উমেশ বিশ্বাসের মৃত্যুও হয়। সমস্ত পরিবারে অন্ধকার নেমে আসে। আমার বড়মামা সুধীর বিশ্বাস প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করে তখন ঢাকা কলেজে পড়ছিলেন। দিদিমা তাঁকে পড়া ছাড়িয়ে গ্রামে নিয়ে এলেন। ঢাকা শহরের কায়েতটুলির বাড়ী বিক্রি ও অন্যান্য উপায়ে অর্থসংগ্রহ করে দেনার দায় মিটিয়ে সম্পত্তি রক্ষা করা হয়। এই সময় দিদিমা তাঁর মেয়েদের বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মার বিয়ের পর, পরের মেয়ে ননীবালাকেও মহেশ্বরদি পরগণার জোতদার পরিবারের একমাত্র পুত্র প্রফুল্ল নাগের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেন।
আমার ছোট সময়ের দু’একটি কথা বলা প্রয়োজন। ছোটমামা শিশিরের পিঠাপিঠি মার জন্ম। দিদিমার পক্ষে এই দুই সন্তানের দেখাশুনায় অসুবিধা দেখা দেয়। দিদিমার সই ছিলেন ঐ গ্রামের সমৃদ্ধ জেলে পরিবারের বড় বউ। নামটা আজ আর মনে আসছে না। ঐ বাড়ীতে আবার মেয়ে নেই। সইয়ের অসুবিধা দেখে ও মার প্রতি মমতাবশত জেলে দিদিমা মাকে লালন-পালনের দায়িত্ব নেন। সকালে জেলেমার কাছে যাওয়া, সারাদিন ও বাড়ীতে কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফেরা। এইভাবে দুই বাড়ীর দুইমার আদর-যতেœর মধ্যে মার বেড়ে ওঠা।
গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে কায়স্থ ও জেলে পরিবারের ঘনিষ্ঠতা থেকে বিশ্বাস করা কঠিন স্বাধীনতার এতকাল পরেও দেশে জাত-পাত, উঁচু-নীচুর তীব্র সংঘাত।
আমার মা তাঁর জেলেমার প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। ঐ মার জন্য শাড়ী নিয়ে যেতেন। ঐ বাড়ীতে নাতি হিসাবে আমাদেরও যথেষ্ট অধিকার ও আদর ছিল। ঐ বাড়ীর ঘাটে (তুরাগ নদীর তীরে বাড়ী) কয়েকটি নৌকা থাকত। আমরা তা ব্যবহারও করতাম। আমরা মামাবাড়ী থাকলে জেলে-দিদিমা নাতি-নাতনীদের জন্য বিনাপয়সায় মাছও দিয়ে যেতেন। এইভাবে মা ও আমরা শিশুকাল থেকে সামাজিক ও জাত-পাত বৈষম্যের কুপ্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে গড়ে উঠেছি। দাদার ক্ষেত্রে বোধ হয় এর যথেষ্ট প্রভাব পড়েছে।
বাবার এই বিয়েতে সবচেয়ে আশংকার বিষয় ছিলো, ছেলে তার নতুন মাকে কিভাবে নেবে বা নতুন বৌ ছেলেকে কি নজরে দেখবে। বাবা লিখেছেন, “এক বছর যাওয়ার পর আমি সরোজহাসিনীকে বিয়ে করলাম। টঙ্গী ষ্টেশন থেকে আগের শ্বশুরবাড়ী আশুলিয়ায় যাওয়ার অর্দ্ধপথে ধউর গ্রাম। এই বিবাহ অনুষ্ঠানের সর্বক্ষণ আমার মন শম্ভুর (দাদার ডাকনাম) জন্য ব্যাকুল। একদিকে বিবাহের আতিশয্য আর একদিকে শম্ভুর ব্যাকুলতায় আমার মন অস্থির হয়ে উঠল। আমি কোনমতে তিনদিন পর শম্ভুর মাকে নিয়ে ঢাকার বাসায় ফিরলাম। আর একবার শ্বশুরবাড়ী যাওয়ার নিয়ম। শম্ভুকে নিয়ে যাওয়া যাবে। মনটা খুব ঠাণ্ডা হল।
“সরোজহাসিনী ঢাকা বাসায় এসে ছেলে পেয়ে খুব খুশী হল। শম্ভুও মাকে পেয়ে কোলে গিয়ে চেপে বসল। সে দিনের সে দৃশ্য আমি কিছুতেই বর্ণনা করতে পারব না”। বাবা লিখেছেন, “পরের বার শম্ভুকে নিয়ে ধউর গেলাম।…দুপুরের ভাত খাওয়ার সময় শম্ভু একটা ভীষণ কাÐ করে ফেলল। আমাদের সঙ্গে কয়েকজন আত্মীয়ও খেতে বসেছেন। পরিবেশনে প্রথমে প্রত্যেকের পাতে দুটি করে চিংড়ি মাছের বড় মাথাভাজা দেওয়া হয়েছে। আমার পাতে, আমি নতুন জামাই বলে, বেছে খুব বড় দেখে দেওয়া হয়েছে। যেমনই দেওয়া, এমনই আমার পাতের দিকে চেয়ে, আমার দিকে একটু তাকিয়ে, ঘুরে ওর নিজের পাত পেছন করে, ঠিক উল্টোদিক করে বসে রইল। আমাকে কিছুই বলল না। সকলে অবাক! বাড়ীশুদ্ধ হইচই পড়ে গেল। …আমার শাশুড়ী-ঠাকরুণ এসে, “দাদুরে খাওরে” বলে অনেক কিছু বললেন। কিছুতেই কিছু শুনল না। চুপ করে মাথা নীচু করে বসে রইল। তখন আমার পাতের দু’টি ভাজা ওকে হঠাৎ দিয়ে দিলাম। …বললাম, শম্ভু, আমারটা তোমাকে দিয়েছি। দেখ, কি বড় বড়, খাও। শম্ভ মাথা নীচু করে পিছনে তাকিয়ে দেখল। ঠিকইত! তখনই আবার ফিরে বসে খেতে আরম্ভ করল। নিজের পাতের ছোট দু’টি পাতেই পড়ে রইল।
এর পরের উল্লেখ করার মত ঘটনা, রবিবাবু যখন ঢাকায় যান, ১৯২৫ সালে। বাবা রোজ বুড়িগঙ্গায় স্নান করতে যেতেন। কখনও দাদাকে নিয়ে যেতেন। তখন রবীন্দ্রনাথ গঙ্গায় পিনিসে (বড় সুসজ্জিত বজরা) অবস্থান করছিলেন। বাবা লিখেছেন, আমি কোলে করে শঙ্কুকে দেখালাম। ঐ দেখ বাবা, ঐ যে সাদা বড় চুল, সাদা লম্বা দাড়ি একজন বড় মানুষ বসে আছেন, তিনি বাংলাদেশের একজন খুব বড় লোক। শম্ভু জিজ্ঞাসা করে, “বড়লোক কি বাবা”? আমি বললাম, আরে খুব বিদ্বান আর খুব বড় কবি। আবার জিজ্ঞাসা করে, “কবি কি বাবা”? আমি বললাম, যারা খুব লিখতে পারে, যাদের লেখা পড়ে সকলে খুব সুখ পায়। আর পড়ে খুব জ্ঞান হয়। কোলে উঠে চেয়ে দেখল। দেখে বলল, “উঃ দেখতেই পারি না, কত মানুষ”। একুট বিরক্ত হয়ে বলল, “চল বাবা স্নান করি”। এই উদ্ধৃতি, দাদার মৃত্যুর পর দু’টি খাতায় বাবা কিন্তু লিখে রেখেছিলেন। তাকে সংকলিত করে সাহিত্য-চিন্তা বৈশাখ ১৩৯৯ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। তা’ থেকে নেওয়া।
জীবনীগ্রন্থে কিরণশঙ্কর লিখেছেন, “এই ঘটনার কথা সোমেনের মনে থাকবার কথা নয়, কিন্তু পরবর্তীকালে এই ঘটনার কথা পুত্রকে নানা প্রসঙ্গে নরেন্দ্রকুমার প্রায়ই মনে করিয়ে দিতেন। ১৯৪১-এ রবীন্দ্রনাথের তিরোধানের সময় সোমেনের বয়স কুড়ি বছর উত্তীর্ণ হয়েছিল। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রিয় প্রসঙ্গ হয়ে উঠেছিল। কখনও কখনও রবীন্দ্রনাথের গান নিচু গলায় গুণগুণ করে গাইতেন। জীবনীগ্রন্থ, পৃ: ১৫।
দাদার প্রথম শিক্ষিকা মা। তাঁর কাছে তিনি অ আ ক খ-র প্রথম পাঠ শেখেন। সেই সময় বড়দি সংযুক্তার গৃহশিক্ষক ছিলেন, অক্ষয়কুমার দত্ত। বড়দিকে পড়াবার সময় দাদা প্রায়ই পাশে গিয়ে বসে থাকতেন। বড়দির নেওটা হওয়ায় এবং পড়া বিষয়ে কৌতুহল, দুই কারণে। এই দেখে মাষ্টারমশায়কে বাবা দাদাকেও পড়াতে অনুরোধ করেন এবং বইপত্র কেনার টাকা দিয়ে দেন। দাদা সেই পাঁচ বছর বয়সেই খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, টিপটপ ছিলেন। তাঁর আবদার, বইপত্র হবে একদম নতুন, নতুন না হলে তিনি কিন্তু পড়বেন না।
অক্ষয়বাবুর কাছে কিছুকাল শিক্ষালাভের পর জ্যেঠামশায় তাঁকে পগোজ স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করে দিলেন। ডাকনাম শম্ভু থেকে নাম দেওয়া হলো সোমেন্দ্র। সোমেন্দ্র নাম জ্যেঠামশায়েরই দেওয়া।
শিশুকালে দাদার পড়া ছাড়া খেলার দিকে বিশেষ আগ্রহ দেখা যায় না, একমাত্র ঘুড়ি ওড়ানো ছাড়া। এই ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে এক দুর্ঘটনা ঘটলো। তখন আমাদের বাসা নবরায় লেনে, সুতারনগরের মোড়ের মিত্রদের বাড়ীর একদম পিছনে এই বাসাটি ছিলো। তখনকার দিনে ঢাকার একতলা বাড়ীগুলিতেও ছাদে কোনো রেলিং থাকত না। ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে দাদা পাশের মেথরের গলিতে ছাদ থেকে পড়ে যান। সম্ভাবনা থাকলেও আঘাত তেমন গুরুতর হয়নি। এই ঘটনায় অবশ্য দাদার ঘুড়ি ওড়ানোর নেশার অবসান হলো না। তবে বাড়ীর সকলের সতর্ক নজরের ফলে তীব্রতা কমে এলো।
এরপর আমরা বিবাহ লেনের বাসা ছেড়ে বাসাবাড়ী লেনের একটু বড় বাসায় চলে আসি। বাড়ীর মালিক খুব সম্ভবত রজনী বসাক। তিনটি পর পর দোতলা বাড়ী ছিলো। তার একটিতে।
এখানেই সোমেনের কিছু বন্ধু দেখা যায়। সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ছিলেন খ্যাতনামা উকিল মনোরঞ্জন ঘোষের ছেলে ফটিক। দাদার মৃত্যুর সময় তিনি টি-বি রোগে শয্যাশায়ী। প্রিয় বন্ধুর হত্যায় বিচলিত ফটিকদা বোনদের দিয়ে মালা বানিয়ে প্রেরণ করেন। তার কয়েকদিন পরে তাঁরও মৃত্যু হয়।
অন্য বন্ধুদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ছিলেন হরিপদ দাস। ফটিক দাসের জ্ঞাতিভাই হরিপদদা পড়ার জন্য তাদের বাসায় ছিলেন। তাঁকে নিয়ে দাদা “মরূদ্যান” গল্পটি লেখেন। ফটিক দাসের স্ত্রী আমাদের সকলের প্রিয় মামীমা, তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে তীব্র ব্যঙ্গাত্মক গল্পটি হওয়া সত্তে¡ও এই গল্পের সত্যতা নিয়ে সপ্রশংস আলোচনা করতেন। হরিপদদা পুলিশে চাকুরী করেছেন। কোনো থানায় কখনও পোষ্টিং না নিয়ে ডি-এস-পি হয়েছিলেন। অল্পকাল আগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া ছিলেন ননী দাস, ফটিক দাসের ছোট ভাই। উয়ারী ক্লাবের ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। নীতু বোস, শম্ভু মজুমদার এবং কিরণশংকর।
ছাত্র জীবনে বন্ধুদের মধ্যে উল্লেখ করা যায় কলকাতা পুলিশের রণজিৎ গুপ্ত, ইন্ডিয়া এয়ার লাইনের কিরণ রায় প্রভৃতিরা।
দশ এগার বছর বয়সে ঘুড়ি ওড়ানোর নেশা থেকে দাদা মুক্ত হলেও আর এক নেশা দেখা দিল। বড়দের সাইকেল নিয়ে হাফ প্যাডেলে সাইকেল চড়া। বাবা লিখেছেন, “সর্বদাই বলে, বাবা আমাকে একটা সাইকেল কিনে দেবে না? সাইকেল না দিলে, নতুন বই না দিলে আমি আর পড়ব না। …এইভাবে আমাকে ভয় দেখিয়ে আবদার করতে লাগল। আমি নিরুপায় হয়ে চৌধুরীদের নবাবপুরের দোকান থেকে একটা সাইকেল ইনষ্টলমেন্টে কিনে দিলাম”।
দোকানের মালিক বললেন, “তুমি খোকা এতবড় সাইকেল দিয়ে কি করবে, কিছুদিন অপেক্ষা কর ছোট সাইকেল কলকাতা থেকে আনাব। অর্ডার দিয়েছি।” কিছুতেই মানল না। বড় সাইকেল দিয়েই একপাশের প্যাডেলে দাঁড়িয়ে চালাতে আরম্ভ করল। নবাবপুরের রাস্তাটাই ঢাকার মধ্যে বড় এবং উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। শম্ভু সাইকেল নিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। বহু পূর্বেই পাড়ার বড় ছেলেদের সাইকেল নিয়ে শম্ভু একপাশে দাঁড়িয়ে সাইকেল চালাতে অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছিল।
দোকানের মালিকের ইচ্ছা সব টাকা যখন নগদ দেবে না, তখন ছোট সাইকেল হলে কম টাকা লাগবে। বাকী দেবার রিস্ক কম। তিনি শম্ভুকে তখনও বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। শম্ভু কিছুতেই ছাড়বে না। আমরা আলোচনা করছি, খোকা পাদানিতে এক পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করে বলল, “বাবা টাকা দিয়ে দাও, আমি চললাম”। …আমি টাকা দিচ্ছি দেখে সাইকেল নিয়ে চম্পট! আমি বাসার দিকে রওনা হয়েছি। আর চিন্তা করছি না জানি কোথায় পড়ে যায় অথবা গাড়ী বা মটরের তলায় পড়ে। কিন্তু খানিকটা গিয়ে দেখি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে হাসল। আর বলল, “চল বাসায় যাই।” – সাহিত্য চিন্তা, বৈশাখ, ১৩৯৯।
দাদা এই সাইকেলটি চেপে, পরবর্তী জীবনে সারা শহরে ঘুরে, লেখক সমিতি, রেল ইউনিয়ন এবং শহরের অসংখ্য লোকের সঙ্গে দৈনন্দিন যোগাযোগ রেখেছেন। মৃত্যুর দিন, শোভাযাত্রা নিয়ে যেতে রেল ইউনিয়ন অফিসে যাওয়ার আগে তাঁর প্রিয়সঙ্গী সাইকেলটি ঠাটারী বাজার বাসায় রেখে যান।
মার মৃত্যু দাদার মনে থাকার কথা নয়। ইতিপূর্বে দাদা নিকটজনের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেননি। ৩রা আগষ্ট ১৯২৯ সাল আমাদের জ্যেঠিমা সুখদার অকাল মৃত্যু হয়। দাদাকে আদর যতেœ যিনি প্রায় আগলিয়ে রাখতেন, সেই অতিপ্রিয় বড়মার মৃত্যু দাদার পক্ষে গভীর বেদনার কারণ হয়।
তাঁর মৃত্যুর পর যৌথ পরিবারে গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হয়। জ্যেঠিমার একমাত্র পুত্র সন্তান পরাণ তখন দশমাসের মাত্র। আমার মার কোলে, তার স্তন্যপান করে সে বড় হতে থাকে। কিছুকাল বাদে জ্যেঠামশায়, বন্ধুদের পরামর্শ ও যোগাযোগে এক মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলাকে নিয়ে এলেন তাঁর ছেলেমেয়েদের দেখাশুনার জন্য। মহিলা স্বামী পরিত্যক্তা। সম্ভ্রান্তবংশীয়া। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করেন, সেলাই, রান্নায় দক্ষ। প্রভৃতি নানা গুণের অধিকারী ছিলেন। কিন্তু বদরাগী ও ক্ষমতাপ্রিয় ছিলেন। তখনকার পরিবারের কর্তা আমার মাকে পাত্তাই দিতে চাইতেন না। এ নিয়ে প্রতিদিন নানা ঝামেলা। বাবা বাইরের কোনো মহিলার এই ধরণের আচরণ বন্ধ করতে সচেষ্ট হলেন, দাদাকে বললেন। জ্যেঠামশায় কোনো প্রতিকার না করায় পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেল।
দুভাইয়ের মধ্যে বাবার আয় কম। আমরা তিন ভাইবোন। জ্যেঠামশায়কে কেউ কেউ পরামর্শ দিলো, রোজ ঝামেলা হওয়া থেকে ভিন্ন হয়ে যাওয়াই ভালো। বাবা ঐ মহিলা সম্পর্কে প্রতিকার না হওয়ায় এবং দাদার এই ইচ্ছার কথা জেনে ভিন্ন হওয়া মেনে নিলেন। আত্মীয়রা দুই ভাইকে বলতেন, রাম-লক্ষণ। ভাইয়ে ভাইয়ে এমন মিল সেদিনেও সচরাচর দেখা যেত না। সেই সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটলো। বাবা ভিন্ন বাসা নিলেন, কয়েকটা বাড়ীর পর। বলা হতো বিভাবতীর (বাড়ীওয়ালী) বাড়ী। আমরা যখন নতুন বাসায় চলে আসি তখন এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটলো। জ্যেঠতুতো সেজ বোন নিরাশা, যে দাদা থেকে বয়সে সামান্য বড় তাকে ঐ বাড়ীতে কিছুতেই রেখে আসা গেল না! নিরাশা (আমরা ছোড়দি ডাকতাম) কাকা-কাকীমার সঙ্গে থাকবেন, ও বাড়ীতে কিছুতেই নয়। কয়েকদিন পরে অবশ্য মা ও বড়দি সংযুক্তা অনেক বুঝিয়ে তাকে পাঠাতে সক্ষম হন।
বিভাবতীর বাসায় তিনটে ঘর। বাড়ীর পেছন দিকটায় (নয়া বাজারের দিকে) বিস্তৃত অঞ্চল জলা-জঙ্গল, সাপও বিচরণ করে। আমরা ছাড়াও আমাদের অন্ধ ঠাকুরমা, ছোট বৌ ভিন্ন কারো সঙ্গে থাকবেন না এই মনোভাবের দরুন আমাদের সঙ্গে চলে এসেছেন। এই বৃহৎ পরিবার ছাড়াও মার পেটে তখন আমাদের ছোটবোন গীতা। অবস্থা সামলাতে ও মাকে সহায়তার জন্য মার ছোটোবোন বীণাকে দিদিমা পাঠিয়ে দিলেন।
সেই সময় দাদা বেশ ভীতু প্রকৃতির ছিলেন। ইদুর গল্পে তিনি তার কথা এইভাবে বলেছেন, “এদের মধ্যে একজন ছিল ভীম, সে একদিন খোলা মাঠের নতুন জল থেকে একটি প্রকাÐ জোঁক তুলে সেটা হাতে করে আমার দিকে চেয়ে হাসতে হাসতে বললে, “সুকু তোমার গায়ে ছুঁড়ে মারব”।
আমি ওর সাহস দেখে অবাক হয়ে গেলাম, ভয়ে আমার গা শিউরে উঠল, আস্তে আস্তে বুদ্ধিমানের মতো দূরে সরে গিয়ে বললাম, দ্যাখ্ ভীম, ভালো হবে না বলছি, ভালো হবে না। ইয়ার্কি না? “ভীম হি হি করে বোকার মতো হাসতে হাসতে বললে, এই দিলাম, দিলাম”…..
“সেদিনের কথা আজও মনে পড়ে, ভীমের সাহসের কথা ভাবতে আজও অবাক লাগে। অনেকের এমন স্বভাব থাকে¾অনেকে কেঁচো দেখলেও ভয় পায়। আমি কেঁচো দেখলে ভয় পাই না বটে, কিন্তু জোঁক দেখলে ভয়ে শিউরে উঠি। এইসব ছোটোখাটো ভয়ের মূলে বুর্জোয়া রীতিনীতির কোনো প্রভাব আছে কিনা বলতে পারিনে”।
জলার পাশে শেষ ঘরে ঠাকুরমা। ও ঘরে বাবা সাপ প্রতিরোধের জন্য কার্বলিক এ্যাসিড এনে রেখেছিলেন। একবার হাতে ফেলে আমি আহত হয়েছিলাম। মাঝের ঘরে দাদার অবস্থান। তাতেও নয়, দু’ঘরের দরোজা সর্বদা খোলা রাখতে হবে।
গীতা জন্মের পরেও, ধউর গ্রামে, পড়ার সুবিধা না থাকায় বীণা মাসীমা থেকে গেলেন, স্কুলে ভর্তি হলেন। তিনি আমাদের পরিবারের একজন হয়ে গেলেন। আমাদের মাতৃসমা। বাবা আদর করে ডাকতেন বীণাপাণি। দাদা থেকে সামান্য বড়, প্রায় সমবয়সী। পরবর্তীকালে দাদার রাজনৈতিক কাজের সহযোগীও। দাদার বন্ধু কবি কিরণশংকরের সহধর্মিণী।
শিশুকাল অতিক্রম করে কৈশোরে দাদার মধ্যে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। সেই অল্পতে রেগে যাওয়া, তীব্র অভিমানবোধ এবং কোনো কিছু চাইলে তা না পাওয়া পর্যন্ত জিদ করে থাকা এসব আর রইল না। কিশোর বয়সে বাবা জনপ্রিয় গায়ক ছিলেন। তাঁর এক সমবয়সী জ্ঞাতি ভাই শশী চন্দকে নিয়ে গান গাইতেন। গ্রামে গেলেই তাদের গান গাইতে ডাক পড়তো। শেষ বয়সেও সুমিষ্ট কণ্ঠের অধিকারী ছিলেন। জ্যেঠামশায় ভালো তবলা বাজাতেন। অনেক গানও তিনি লিখেছিলেন। সুরও দিয়েছিলেন। ফলে, পরিবারে একটা গানের পরিবেশ ছিলো। ছেলেবেলায় দাদারও গানের প্রতি ঝোঁক ছিলো। গলাও মিষ্টি ছিলো। কিন্তু সেদিকে তিনি এগোননি।
ম্যাট্রিক পরীক্ষার সামান্য আগে বা পরে দাদা সিনেমা নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেন। সেই সময়ের বোম্বের নায়ক অশোককুমার তার প্রিয় অভিনেতা ছিলেন। বোধ হয় তার কোনো ছবি দেখে দাদা অশোককুমারকে পত্র দিয়েছিলন। হয়ত তার ছবিও চেয়েছিলেন। অশোককুমারের স্বাক্ষরিত ১০² ´ ১২² ইঞ্চি সাইজের একটি ছবি তিনি দাদাকে পাঠিয়েছিলেন। অনেকদিন সেই ছবিটি আমাদের বাসায় ছিলো।
স্কুলে পড়ার সময় দাদার কোনো গৃহশিক্ষক ছিলেন না। ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে, অংকে কাঁচা থাকায় একজন মাষ্টারমশায় নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৯৩৬-এ তিনি দ্বিতীয় ডিভিশনে পাশ করেন। প্রথম বিভাগ থেকে ১১ নম্বর কম পান। খুব সম্ভবত দাদার পরীক্ষার পরেই, আমরা বাসা বাড়ীর বাসা ছেড়ে দক্ষিণ মৈশুÐির ৪৭নং লালমোহন সাহা স্ট্রীটে চলে আসি।
শিশুকালে দাদার উপর সবচেয়ে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন জ্যেঠিমা, জ্যেঠামশায় এবং বাবা। বাবারা দু’ভাই গান-বাজনায় পারদর্শী ছিলেন। জ্যেঠামশায়ও খুব ফুর্তিবাজ, রসিক ব্যক্তি ছিলেন। সরস গল্প বলায় তার জুড়ি মেলা ভার। তিনি রহস্য করে, আকর্ষণীয় কায়দায় এমন হাস্যরসের সঞ্চার করতে পারতেন যে, পরিচিত-পরিজনরা তার কথা শোনার জন্যে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন।
আর বাবা অবসর সময়ে বাড়ীর সকলকে নিয়ে বসে গল্প করা পছন্দ করতেন। সরকারী চাকুরী করা সত্তে¡ও তাঁর গভীর স্বদেশপ্রেম ছিল। তিনি বিপিন চন্দ্র পাল, বালগঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রায়, মহাত্মা গান্ধী, চিত্তরঞ্জন দাশ প্রভৃতিদের নিয়ে নানা কথা বলতেন। বিপ্লবীদের, বিশেষত ক্ষুদিরাম, বাঘাযতীন, বিনয় বোস, চট্টগ্রাম বিপ্লবীদের সাহস ও ত্যাগের কাহিনী শোনাতেন। বিনয় বোসরা হাড্সন-লোম্যানকে গুলি করেন। স্থানটা ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালের প্রধান গেটের কাছে, অফিস ঘরের কোনায়। গুলির শব্দ পেয়ে বাবা জানালা দিয়ে সাহেবদের গুলি খেয়ে পড়ে যাওয়া এবং বিনয় বোসদের চলে যাওয়া দেখেছিলেন। পুলিশ থেকে বাবাকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য যথেষ্ট চাপ দেয়া হয়েছিলো। বাবা দেখেননি বলে, সাক্ষ্য দিতে সম্মত হননি। কিন্তু বাড়ীতে এই ঘটনার প্রত্যক্ষ বর্ণনা দিয়ে বিনয়বোসের সাহস ও স্বদেশপ্রেমের প্রশংসা করতেন। এইভাবে বাবার কাছ থেকে প্রতিনিয়ত শুনে দাদার স্বদেশপ্রেম ও চেতনা সৃষ্টি হয়েছে। তাই বাবাই দাদার প্রথম রাজনীতি শিক্ষাদাতা। কিশোর বয়স থেকেই নানা বই পড়ার প্রবণতা দেখে বাবা দাদাকে ‘পণ্ডিত’ বলে ডাকতেন।
কিশোর সোমেনের উপর সবচেয়ে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন মা সরোজহাসিনী। তিনি যেমন দাদাকে অ আ ক খ শিখিয়ে প্রথম শিক্ষিকার ভূমিকায়, তেমনি বই পড়ার প্রবণতা মার কাছ থেকেই। মা অতি দ্রæত, দক্ষতার সঙ্গে সংসারের সব কাজ করতেন। যখনই একটু ফুসরত পেতেন মেঝেতে শাড়ীর আচল পেতে, কাস্তের মত বেঁকে শুয়ে, কোনো বই নিয়ে পড়তেন। বাসাবাড়ী লেনে এমন আরও কয়েকজন আগ্রহী পাঠিকা ছিলেন। তারা বই জোগাড় করে লেনদেন করে পড়তেন। মা বঙ্কিম শরৎ থেকে নিরুপমা-অনুরূপাদের সব বই সেই সময় পড়েছেন। মার এই পড়ার আগ্রহ ও প্রবণতা দাদার উপর গভীর প্রভাব ফেলে একথা বলা বাহুল্য। পরবর্তীকালেও মার পড়ার এই প্রবণতা অব্যাহত ছিলো। দাদার টেবিলে যে সব গল্প-উপন্যাস থাকতে মা ও বড়বোন রুবি সব সময় তা পড়তেন। দাদার গল্পে সেই চিত্র পাওয়া যাবে।
“একটি রাত” গল্পে দাদা মার বাস্তব চিত্র এইভাবে প্রকাশ করেছেন।
– “এর কয়েকদিন পরেই সন্ধ্যায় লক্ষ্মীর প্রদীপ জ্বালিয়ে অনেকদিন পরে মা একখানা বই খুলে বসলো। বইটা পড়ে তার এত ভাল লেগে গেল যে, এদিকে যে ন’টা বেজে গেছে, সেদিকে তার একটুও খেয়াল নেই। একসময় কুকুরটার কলরবে বই-এর প্রতি তার মনোযোগ কিছুক্ষণের জন ভেঙেছিলো বটে, কিন্তু একটু পরেই সে আবার পড়তে আরম্ভ করে দিয়েছিলো। ভাবলে ছেলের আসতে এখনো অনেক দেরী, রাত এগারোটার আগে সে কখনো আসে না! কিন্তু সেদিন সুকুমার হঠাৎ এসে পড়লো। দরজা খোলা পেয়ে এত চুপি চুপি সে আসতে পেরেছিলো যে, ভোলা একবার আনন্দে ঘেউ ঘেউ করে উঠলেও বইটি তাড়াতাড়ি লুকানোর অবসর মা পায়নি।
তার হাতে বই দেখে সুকুমার বিস্মিত। মা ভ্রু কুঁচকে দাঁতে দাঁত চেপে – কিন্তু বোকার মত একবার হেসে মা বললে, “কেন তোরা পড়িস আমরা পড়তে পারিনে? আমাদের পড়ায় দোষ আছে নাকি?
বই-এর মলাট দেখেই সুকুমার চিনতে পেরেছে। ভয়ানক খুশি হয়ে সে বললে, তুমিও এই বই পড়ছো মা? দোষ হয়েছে কে বললে? কিছু দোষ নেই। তুমি সত্যি সত্যি পাভেলের মা হতে পারবে। আমি অবশ্য পাভেলের মতো হতে এখনো পারিনি। তবে হবো -”
বাবার যৌবনে রাজনৈতিক সংযোগ ও পরবর্তীকালে চর্চা দাদার স্বদেশপ্রেম, রাজনৈতিক মন তৈরিতে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে তেমনি মার আত্মীয় পরিমণ্ডলেও ছিলো স্বদেশপ্রেম। মার ছোড়দা আমাদের ছোটমামা শিশির বিশ্বাস নারায়ণগঞ্জে কলেজে পড়ার সময় বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন, ফলে অনেকদিন নজরবন্দী থাকেন। মার মাসতুত বোন হেলেনা বল (পরে বিপ্লবী সুকুমার দত্তের স্ত্রী) রাজনৈতিক কারণে অনেক বছর জেলে ছিলেন। মা কোনো কোনো সময় এই বোনের গোপন কাগজপত্র ও বে-আইনী বই রাখতেন। মার আর এক মামা, প্রফুল্ল কুমার দত্ত, বিনয় বোসদের দলে ছিলেন, তিনি অনেক বছর কারাভোগ করেন। তাঁর বড়ভাই ঢাকার খ্যাতনামা চিকিৎসক সত্যেন্দ্রকুমার দত্ত কংগ্রেস রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছেন।
আমাদের বড় সংসার। বাবা সাধারণ কেরানী, স্বল্প আয়। বাবা শুধুমাত্র মাসিক মুদির দোকানের সওদা কিনে বাকী অর্থ মার হাতে দিয়ে খালাস। তখন অবশ্য সাস্তার বাজার। চালের মন তিন/ সাড়ে তিন টাকা। খাটি দুধ গ্রামে একসের তিন পয়সা, ঢাকায় ঐ এক চুঙ্গ চার/ পাঁচ পয়সা। এক আনা ছয় পয়সার মাছ কিনলে অনেক। বাড়ীর মালিক বাবার ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় বাড়ীভাড়া বার কি সাড়ে বার টাকা (অবশ্য সেদিনে ঢাকায় বাড়ীভাড়া খুব কমই ছিলো) পাঁচ ঘরের আলিশান একতলা বাসা। একটি ঘরতো, হল ঘরের মতো। পেছন দিকে বয়ে চলেছে খাল। (এখন সেই খাল নেই)। নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা হতো। পাশে একই ধরনের আর একটি ফ্ল্যাট মুরারি বোসরা থাকতেন, যাদের সঙ্গে ছিলো আমাদের গভীর হৃদ্যতা।
আমার দিদিমা ও ঠাকুরমার পিত্রালয় একই গ্রামে। তাই মা ও বাবার মামাবাড়ীও ঐ একই গ্রামে, শুভাঢ্যায়। আমার দিদিমা অনেক গুণের অধিকারিণী ছিলেন। তাঁর হাতের লেখা ছিলো অতি সুন্দর। তিনি ভালো রাঁধুনী ছিলেন, অনেক ধরনের রান্না জানতেন। সেইদিনে সম্পন্ন ভোজরসিক পরিবারে কতো রকমের রান্নাই না হতো। বিভিন্ন খাবার-দাবার ও বহুবিধ পিঠা-পায়েস তার হাতে খুব উপাদেয় হতো। তিনি, তাঁর মেয়েরা যাতে তাঁর এই গুণগুলি পায়, তার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। আমার মা, দিদিমার কাছে শিখে, তার কিছু গুণ আয়ত্ত করেছিলেন। রাধতেন খুবই ভালো। আজ আর তেমন সুস্বাদু রান্না আমরা খাই না। আমাদের অভাবের সংসারের হাল মা-ই ধরে ছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে, আমরা কিন্তু বিশেষ অভাববোধ করিনি। তখন অবশ্য আজকের মতো সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের উপকরণ, সর্বব্যাপক প্রচারের মোহ সৃষ্টি হওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতিও ছিল না। অল্পেতে সন্তুষ্ট হওয়ার মানসিকতা ছিল। খাওয়া-দাওয়া ও সাধারণ জীবন যাপনের ন্যূনতম ব্যবস্থা পরিবারে ছিল। মা নিজ হাতে (একটি সিঙ্গার মেসিন বাড়ীতে ছিল) আমাদের জামা প্যান্ট, সায়া-ব্লাউজ তৈরি করতেন। বাবার জামাও। অবশ্য বড় হয়ে গেলে দাদারটা নয়।
বাবা একটু দার্শনিক প্রকৃতির ছিলেন। সমস্যাসংকুল সংসারের কি হাল তা নিয়ে বিশেষ ভাবতেন না। মার উপর নির্ভরতা।
জীবনীকার হায়াৎ মামুদ ও কেউ কেউ লিখেছেন, “শ্বশুর কুলের বিত্ত আমাদের সংসারে প্রবাহিত হয়নি।” এটা একেবারেই সত্য নয়। মামাবাড়ী বেশ সচ্ছল। প্রচুর জমি-জায়গা, ফলফলাদি। ধউর গ্রামের জমিদার বড়মামা সুধীর বিশ্বাস মামলা ও অন্যান্য প্রয়োজনে মাসে একবার দুইবার ঢাকায় আসতেন। আসার আগের দিন দিদিমাকে বলতেন, মাদার (এই সম্বোধন করতেন) কাল ঢাকায় যাব। প্লাসের (মা সকলের জন্যে ব্যাকুল হয়ে ঝাপিয়ে পড়তেন, সাধ্যাতিত কর্তব্য পালন করতেন, তাই সকলের পক্ষেই তিনি প্লাস, এই বিবেচনায় মামা এই সম্বোধন করতেন।) ওখানে কি দেবেন ঠিক করে রাখবেন।
এইভাবে প্রচুর খাদ্যদ্রব্য, ফলফলাদি এমন কি প্রচুর মাছও ঢাকার বাসায় নিয়মিত আসত। মামা ছাড়াও ধউর থেকে গোয়ালারা রোজ ঢাকায় দুধ নিয়ে আসতো। দিদিমা তাদের মারফৎ নানা সংবাদ ও দ্রব্য পাঠাতেন। এর একটা কারণ অবশ্যই ও বাড়ীর ছোটো মেয়ে বীণার আমাদের পরিবারে বাস করা। এছাড়া, গ্রীষ্মের ছুটিতে, আম-কাঁঠালের সময় আমরা অনেকদিনের জন্য মামাবাড়ী থাকতাম, বলা বাহুল্য, প্রচুর প্রাচুর্যের মধ্যে। অবশ্য বাবা বিশেষ যেতেন না এবং দাদা আমাদের থেকে কম সময় থাকতেন। আমাদের জ্যাঠতুতো ভাই পরাণও আমাদের সঙ্গে যেতো। সে এই বাড়ীকেই নিজের মামাবাড়ী বলে গণ্য করতো।
এই প্রসঙ্গে একটা মজার বিষয় জানাই। ঢাকায় একবার নাকি বোয়াল মাছের পেটে শিশুর হাত পাওয়া যায়। এই ঘটনায় বাবা বাড়ীতে জানিয়ে দেন বোয়াল যেন বাড়ীতে কখনও না আসে। বাবাকে অমান্য করে আর বোয়াল কেনা হয়নি বটে, তবে মা-মাসীদের বোয়াল খাওয়া তাতে আরও বেড়েছিলো। ওরা ঐ মাছ খুবই ভালোবাসতেন। ফলে, দিদিমা যখনই সুযোগ পেতেন বড় বোয়াল পাঠাতেন। আমাদের ছোটদের কাছে তখন ব্যাপারটা অজ্ঞাত ছিল। আমাদের খেতে দেওয়া হতো না, যদি বাবাকে বলে দিই। ১৯৩৬-৪১ সময়কালে মামাবাড়ীর সহায়তা আমাদের পরিবারের অভাব দূর করতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে।
শিশুকাল অতিক্রান্ত হওয়ার পরও দাদা মার বেশ নেওটা ছিলেন। মা যেখানে, সেখানে দাদাও। মামাবাড়ী ধউরই হোক বা অন্যত্র। ধউর গ্রামের জেলেপাড়া যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে থেকে দেড় মাইল দূরে, আমাদের আগের মা, (দাদার গর্ভধারিণী) হিরণবালার পৈতৃক বাড়ী আশুলিয়া। এখনও অল্প অল্প মনে পড়ে আমরা সকলে নৌকা করে আশুলিয়ায় দাদুর কাছে গেছি। মার ন্যাওটা দাদাও। যখন জল থাকত না তখন এক জায়গায় নদী পেরিয়ে হেঁটেও আশুলিয়া গেছি। তাই যারা লিখেছেন, হিরণবালার মৃত্যুর পর আমাদের সঙ্গে ঐ পরিবারের কোনো সম্পর্ক ছিলো না, তারা সঠিক কথা লেখেননি।
দাদার গল্প উপন্যাসে গ্রামের যে বর্ণনা তা প্রধানত ধউরের অভিজ্ঞতায়। বর্ষায় যখন আমরা মামাবাড়ী যেতাম তখন ঐ বাড়ীরই সামনে থেকে বিস্তৃত মাইলের পর মাইল বিলকে সমুদ্রের মতোই মনে হতো।
সেই স্মৃতি থেকে দাদা ‘বনস্পতি’তে লেখেন, “বর্ষাকালে এই বিলগুলি আর নদীতে মিলিয়ে যে অবস্থা হয়, সেকথা মনে করিতে হইলে, কেবল কোনো সমুদ্রের সঙ্গেই তুলনা করা চলে। পারকে মনে হয় কোন রহস্যময় কুয়াশাচ্ছন্ন পৃথিবী, বিপুল রহস্যের ফেনা সারা গায়ে মাখিয়া ওপারের পৃথিবীর সন্তানদের চোখে ধাঁধা লাগাইতেছে ইত্যাদি।
বাবার রাজনীতি চর্চা, মার পড়ার অভ্যাস বার-তের বছর বয়সেই দাদার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। বাসাবাড়ী লেনে, জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী নেতা, কর্মীরা ছিলেন। কিন্তু দাদা তাদের প্রতি কোনো আগ্রহ বা আকর্ষণবোধ করেন নি (কিরণশংকর ঐ বয়সে যুক্ত হয়েছিলেন। পরে সরে আসেন)। দক্ষিণ মৈশুন্ডিতে এসে পেলেন তাঁর মনের মত একটি সংগঠন, ‘প্রগতি পাঠাগার’। বে-আইনী কমিউনিষ্টদের একটি প্রকাশ্য সংগঠন। পরিচালনা করতেন দাদার থেকে প্রায় দশ বছরের বড় কমিউনিষ্ট কমী তিনকড়ি চক্রবর্তী। দাদা প্রগতি পাঠাগারে যোগ দিলেন। এখানে নানা পত্র-পত্রিকা, বই ছিলো। এখানে যোগ দিয়ে তার পড়া-শুনার আগ্রহ আরো তীব্র ও গভীরতা লাভ করলো। নানা জনের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটল। সাহিত্য ও রাজনীতির বই পড়ার সঙ্গে এদের গোপন ক্লাশে যোগ দিলেন। বিশেষত সাহিত্যে তার আগ্রহ এমন বৃদ্ধি পেল যে তিনি নিজেকে একজন লেখকরূপে প্র্রস্তুত করে তুললেন। লেখালেখি আরম্ভ করলেন। ১৯৩৭ সালেই দেশে প্রকাশিত হলো তার প্রথম গল্প ‘শিশু তপন”। ৩৭-৩৮ এ তিনি অনেকগুলি গল্প প্রকাশ করেন। উপন্যাস ‘বন্যা’ও এই সময়ের রচনা। এই সময়টা তাঁর কেটেছে গভীর অধ্যায়ন, রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ আর নিজের লেখালেখি নিয়ে দিন যাপন।
১৯৩৬ এ দাদার ম্যাট্রিক পাশের পর একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। বাবা কেরানী থেকে প্রমোশন পেয়ে এ্যাকাউনটেন্ট হবেন। অর্থাৎ দীর্ঘদিন বাদে চাকুরীতে উন্নতি। কলকাতা থেকে অর্ডারও এসে গেছে। সেই সময় ঘটলো অঘটন। মার জ্যোঠতুত ভাই যার সঙ্গে আমাদের মামাদের সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, তিনি মামাদের জব্দ করার জন্য জেলা পুলিশ সুপার ও জেলা মেডিক্যাল অফিসার (যিনি ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতাল ও স্কুলের প্রধান) এই দুই জায়গায়, এই অভিযোগ লিখিতভাবে করলেন যে, নরেন্দ্র চন্দ দুর্নীতিগ্রস্ত, হাসপাতাল থেকে চুরি করে প্রচুর সম্পত্তির মালিক হয়েছে। সেই সময় নতুন সুপার মিঃ ফিমার বা মিলটন সবে বিলেত থেকে এসে কাজে যোগ দিয়েছেন। তিনি কোনো কিছু তদন্তের আগেই বাবা দুর্নীতিগ্রস্ত তাই তার প্রমোশন বাতিল করা হউক এই নোট দিয়ে প্রমোশনের ফাইল কলকাতায় ফেরৎ পাঠালেন এবং তা যথারীতি গৃহীত হোল।
এদিকে পুলিশ কিছু অনুসন্ধানের পর, আমাদের বাসা, মামাদের বাড়ী খানাতল্লাশ করলো। অবশ্য বাবার মত একজন কর্মীর কোনো অতিরিক্ত সম্পদ বা কোনো সরকারী দ্রব্যের সন্ধান পাওয়া গেল না। বিষয়টি জানাজানি হতে সেই সময়কার কয়েকজন সরকারী কনট্যাকট্র বা বিশিষ্ট সাপ্লায়ার, বিশেষ করে এদের মধ্যে সত্যেন সেন (যিনি সেই সময়ে সাহেব মহলেও জনপ্রিয় ছিলেন) গিয়ে নতুন আসা সুপারকে বললেন, নরেনবাবুর মত সৎ লোকের বিরুদ্ধ এ তুমি কি করলে ? কারো কাছ থেকে আর্থিক বা বৈষয়িক কোন সুবিধা তিনি কখনও গ্রহণ করেন নি।
তদন্তে কিছু না পাওয়া ও বিশিষ্টজনের প্রতিবাদের ফলে নতুন আসা সাহেবের অনুশোচনা হলো। তিনি বাবাকে ডেকে দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং বাবার কোনো উপকার করা যায় কিনা তার জন্য সচেষ্ট হলেন। তিনি আমাদের পরিবার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিলেন। দাদা তখন সবে ম্যাট্রিক পাশ করেছে। তাঁকে ডাক্তারীতে ভর্তি করে দিতে বললেন। প্রথম বিভাগে পাশ না। হলে ডাক্তারীতে ভর্তি হওয়া যায় না। তিনি তার বিশেষ ক্ষমতাবলে তা করে দেবেন। আরো জানালেন, আমি ঢাকায় থাকতে থাকতেই (তখন চার বছরের কোর্স) ও পাশ করে বেরুবে, আমি ওকে ভালভাবে চাকুরীও দিয়ে যেতে পারব।
বাবার তো আকাশ থেকে পড়ার অবস্থা। বললেন, আমার মত গরীব লোক ডাক্তারী পড়াবো কি করে? সাহেব বললেন, “আমি ওর পড়া ফ্রি করে দেব বাবা রাজী হচ্ছেন না দেখে বললেন, “তুমি বাড়ী গিয়ে আলোচনা কোরে দ্যাখো, আমাকে জানিও”।
কেউ কেউ লিখেছেন, বাবা হাসপাতালের অধস্তন কর্মী হওয়ায় দাদার ডাক্তারী পড়ার সুযোগ হয়েছিল। কিন্তু, এটা আংশিকভাবে সত্য হোলেও প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ সত্য নয়। সাহেব বাবার ক্ষতি করার অনুশোচনা থেকে বাবাকে সাহায্য করতে চাইলেন।
রাতে বাবা বাড়ী ফিরে, চা-মুড়ি খেতে খেতে কৌতুক করে, গল্পচ্ছলে মাকে বললেন। বাবা যা অসম্ভব বিবেচনায় কৌতুকরসে আচ্ছাদিত করে, গল্প বলার মত বললেন, মার কাছে তাই এক সম্ভাবনা বলে মনে হলো। দাদু ডাক্তার ছিলেন। মা এই সূযোগ ব্যবহার করে ছেলেকে ডাক্তার করতে আগ্রহী হয়ে উঠলেন।
বাবাতো অবাক! এ কি করে সম্ভব? টাকা আসবে কোথা থেকে? অনেক খরচ-খরচা লাগবে।” মা দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, “সে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি শম্ভুর ভর্তির ব্যবস্থা করো।”
দাদাকে বলতে তিনি ডাক্তারী পড়তে রাজী হলেন না। মাও নাছোড়বান্দা। দাদাকে রাজী করাতে নিজে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করা ছাড়াও একে একে আত্মীয়স্বজনকে দিয়ে দাদার উপর চাপ দিতে থাকলেন। এমন কি বৃদ্ধ দাদু আদিত্য বসুকেও মা নিয়ে আসলেন, তাকে দিয়ে নাতিকে বলালেন।
কেউ কেউ লিখেছেন, হিরণবালার মৃত্যুর পর বাবার আগের শ্বশুরবাড়ীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিলো না। তা সত্য নয়। দাদুর যতকাল শারীরিক সক্ষমতা ছিলো বছরে দু’এক বার ঢাকায় আসতেন, ফলমূল খাদ্যদ্রব্য নিয়ে। কয়েকদিন আমদের মধ্যে থেকে যেতেন। মাকে খুবই স্নেহ করতেন। এমনকি তার মৃত মেয়ের নামে আমার মাকেও হিরণ বলে ডাকতেন। এ ছাড়া, আশুলিয়ায় আমাদের দাদুর কাছে যাওয়ার কথা আগেই লিখেছি।
অবশেষে, অনিচ্ছা সত্তে¡ও দাদা ডাক্তারীতে ভর্তি হতে রাজী হলেন। প্রথম বিভাগে পাশ না করলে ডাক্তারী পড়া যেত না। সুপারের বা মেডিক্যাল স্কুলের অধ্যক্ষের বিশেষ ক্ষমতাবলে দাদা ভর্তি হতে পারলেন। মার সোনার গহনা বিক্রি করে সম্পূর্ণ নরকঙ্কাল, বইপত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনে দেওয়া হলো। নিজ বাসায় থেকে সাইকেলে যাতায়াত। পড়া ফ্রি। দৈনন্দিন বিশেষ অর্থের প্রয়োজন ছিলো না।
প্রথম থেকেই দাদার মধ্যে ডাক্তারী পড়ায় কোনো উৎসাহ লক্ষ্য করা যায়নি। আমার মনে হয় দুইটি কারণ। প্রথম, প্রগতি পাঠাগারে যোগদানের পর দাদা নিজেকে লেখক হিসাবে গড়ে তোলার জন্যে সচেষ্ট ছিলেন। দুই, ডাক্তারীতে যারা পড়তেন, তারা সমাজের ধনবান বা এলিট সম্প্রদায়ভুক্ত। তাদের মধ্যে পড়ার পরিবেশ দাদার পছন্দ না হওয়ার কথা। প্রথম বছরে সব পরীক্ষা দিলেন না। ফেল করলেন। মাঝে অবশ্য অল্পদিন সামান্য অসুস্থ হয়েছিলেন। কিন্তু কেউ কেউ যেমন লিখেছেন, দারিদ্র ও অসুস্থতার কারণে তাঁর ডাক্তারী পড়া হয়নি। তা সত্য নয়। দাদা গুরুতর অসুস্থ হয়েছিলেন, পড়া ছাড়ার অনেক পরে, ১৯৩৯ সালে।
সুপার বাবাকে ডেকে পাঠালেন। কারণ জানতে চাইলেন। বাবা বাধ্য হয়ে দাদার অসুস্থতার কথা জানালেন। সুপারের, দাদাকে সপ্রতিভ ও বুদ্ধিমান বলে মনে হয়েছে। তিনি নজিরবিহীন হলেও দাদাকে দ্বিতীয় বর্ষে তুলে দিতে এবং ফ্রি রাখতে রাজী হলেন। কিন্তু দাদাকে আর ডাক্তারী পড়তে রাজী করানো গেল না। তার জীবনের লক্ষ্য অন্যদিকে ধাবিত হয়েছে।
১৯৩৮ সাল, দাদার কর্মতৎপরতা আর গুরুতর অসুস্থতারও বছর। ১৯৩৭-৩৮ সালের মধ্যে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর এগারোটি গল্প, আনন্দবাজার, রবিবাসরীয়, অগ্রগতি, সবুজ বংলার কথা, শান্তি প্রভৃতিতে প্রকাশিত হয়। ’৩৮-এ শারদীয় ‘নবশক্তি’তে তাঁর প্রথম উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। সেটি উদ্ধার করা যায়নি।
বিপ্লবী সতীশ পাকড়াশী জেল থেকে ছাড়া পেয়ে জোড়পুল কমিউনে থাকতেন। তিনি প্রগতি পাঠাগারের সভ্য ও অন্যান্যদের রাজনৈতিক ক্লাশ নিতে আরম্ভ করেন। পরে আমাদের বাসায়ও ক্লাশ হতো। সতীশদা আসতেন। এই সময় তিনি দাদা, এমনকি আমাদের পরিবারের বড়দের ঘনিষ্ঠ হয়ে যান। বীণা মাসী ও রুবি তার ভক্ত হয়ে যায়।
দাদার পড়াশুনার ব্যাপক বিস্তৃত ক্ষেত্র নিয়ে কিরণশংকর ও অন্যান্যরা লিখেছেন। সেই সময় তিনি দেশ-বিদেশের সাহিত্য বা রাজনীতির উল্লেখযোগ্য সব বই অধ্যয়নে গভীরভাবে ব্যস্ত। ঢাকার কমিউনিষ্ট নেতা জ্ঞান চক্রবর্তী লিখেছেন, (একতা ১০/৩/১৯৯৭)… ‘তিনি গভীর মনোযোগের সাথে মার্কসবাদী সমাজ বিজ্ঞান এবং বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখকদের লেখাগুলো আয়ত্ত করতে আরম্ভ করেন। সেই সময় প্রায়ই দেখা যেত সারারাত জেগে তিনি গভীর অধ্যয়নে মগ্ন আর ভোর হতেই ফোলা ফোলা লাল চোখ নিয়ে পাড়ার কাজে ব্যস্ত”।
’৩৭-এর শেষভাগ ১৯৩৮-এ তিনি কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় কর্মী। ’৩৮-এ তিনি প্রগতি পাঠাগারের সম্পাদক হন। পাড়ায় তার উদ্যোগে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কার্যকলাপের ফলে অল্পকালের মধ্যেই দক্ষিণ মৈশুন্ডি কমিউনিস্টদের ঘাঁটিতে পরিণত হয়। আমাদের বাসা ভেতরের দিকে হওয়ায় এবং বাসায় যথেষ্ট জায়গা থাকায়, পাটির ক্লাশ, পোষ্টার লেখা (দাদা সুন্দর পোষ্টার লিখতে পারতেন) প্রভৃতি নানা কাজের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। দাদার ব্যবহারে এমন একটি কমনীয়তা ও মাধুর্য ছিলো যে, দাদা যা করতেন বাড়ীর কেউ কখনও বাধা দিত না। অন্যদিকে পার্টির গোপন কাজে বীণামাসী (যিনি ক্লাশে অংশ নিয়েছেন) ও রুবিকে, মেয়েরা অনেক নিরাপদ বিবেচনার ব্যবহার করেছেন। আমি ছোট এসব কার্যকলাপের কিছুই বুঝতাম না, তবু শেষের দিকে সাইকেল দিলে দাদার কাগজপত্র দিয়ে এসেছি।
বাজারটা দাদার করার কথা। কখনও ব্যস্ত থাকলে আমাকে পাঠাতেন। অবশ্যই আমাকে সাইকেল দিতে হবে। মা বলতেন, “শম্ভু ওকে সাইকেল দিয়ে পাঠাবি না, দুর্ঘটনা ঘটাবে”। দাদা বলতেন, “না কিছু হবে না। যা ভাই।” মনে আছে দুই আনার বাজার। মাছ আর বেগুন (এক ভাগা, ২৪টা মাছ এক ভাগা) নলা মাছ (এখনকার চারাপোনা) সাইজ প্রায় ২০০ গ্রামের কম নয়, মূল্য ছয় পয়সা। আর দুই পয়সার বেগুনে ব্যাগ ভর্তি করে, হাফ প্যাডেলে সাইকেল চালিয়ে, গর্বিতভাবে এনে দিয়েছি, মনে আছে। তখন সাতশ আটশ গ্রামের ইলিশ মাছ এক আনায় পাওয়া যেত। জ্ঞানবাবু লিখেছেন, “খাওয়া খরচ তখন জনপ্রতি তিন টাকার বেশি ছিল না”।
দাদা আমাদের বাসাটাকে পার্টি কেন্দ্র বানিয়ে ফেলেছে। বাবা কিন্তু এ বিষয়ে কিছুই জানতেন না। বাবা ছুটির পর, হাসপাতালের প্রধান গেটের সামনে, ঢাকার অন্যতম প্রধান ঔষধের দোকান, কে. পি. সাহার দোকানে কাগজ পড়তে ও আড্ডা দিতে যেতেন। অনেক রাত পর্যন্ত কাগজের আদ্যপ্রান্ত পড়ে, উপস্থিত অন্যদের সঙ্গে গল্পগুজব করে অনেক রাত করে ফিরতেন। সেদিনে কিন্তু আমাদের বাসায় বে-আইনী কমিউনিস্ট পার্টির কাজকর্ম কোনোভাবে পুলিশের হাতে ধরা পড়লে নির্ঘাত বাবার চাকুরী যেত।
দাদার জীবনের সঙ্গে প্রগতি লেখক সংঘ অচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে রয়েছে। সতীশ পাকড়াশী লিখেছেন, (অগ্নিদিনের কথা) …“নতুন গণসাহিত্য সৃষ্টির কাজে রণেশ দাশগুপ্তের উৎসাহ, রচনা ক্ষমতা, জ্ঞানবুদ্ধি যথেষ্ট প্রখর। এই মেধাবী লেখকের জোরেই আমরা প্রগতি লেখক সংঘ গঠনের কাজে উদ্যোগী হলাম”।
…..“মিটিং-এর ব্যবস্থা করা, সকলকে খবর দেওয়া, নতুন সভ্য সংগ্রহ করার কাজে সোমেনের উৎসাহ থাকায় তারই উপর এ সকল কাজের ভার পড়ল”।
জ্ঞান চক্রবর্তী লিখেছেন (একতা ১০/৩/৭৩), “কিন্তু তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম, সাংগঠনিক গুণ, মানুষকে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা, অমায়িক ব্যবহার ও উদার দৃষ্টিভঙ্গী এই সংগঠন প্রতিষ্ঠার কাজে বোধ হয় সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে”।
রণেশ দাশগুপ্ত মৃত্যুর অল্পকাল আগে, বোধ হয় তাঁর শেষ সাক্ষাৎকার দেন বাংলাদেশের সৌমিত্র শেখরকে। তাঁর রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি
“সৌ শে, সোমেন চন্দ তো এ সময় আপনাদের সঙ্গে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় কিভাবে?
র দা : সোমেন চন্দই আমাকে লেখক সংঘে নিয়ে আসেন। বয়সে আমার ছোট। জেল থেকে বেরিয়ে সতীশ পাকড়াশী ১৯৩৭-৩৮ সালের দিকে সাহিত্য শিল্পীদের একটি প্রগতিশীল প্ল্যাটফর্ম করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন সোমেন চন্দকে সঙ্গে নিয়ে। ওরা একই পাড়াতে থাকতেন। সোমেন চন্দ আমাদের সংগঠিত করেন। কিরণশংকর সেনগুপ্ত আর আমি একই সঙ্গে এসেছি। আমরা মূলত তাত্তি¡ক আলোচনা করতাম, সোমেন চন্দই ছিল আমাদের মধ্যে ক্রিয়েটিভ লেখক। বয়সে সবার ছোট কিন্তু সৃজনশীলতায় সবাইকে ছাড়িয়ে।”
কিরণশংকর সেনগুপ্ত ও নানা প্রবন্ধে সোমেন, প্রগতি লেখক সংঘে’ তাঁকে নিয়ে এসেছেন বলে লিখেছেন।
সংঘের প্রথম দিকের একজন অমৃত কুমার দত্ত। কলকাতায় নানা পত্র-পত্রিকায় তখন তার গণকবিতা, গল্প ইত্যাদি প্রকাশিত হচ্ছে। ফান্টামারার অনুবাদও করতে থাকেন। তাঁর সঙ্গে দাদার পরিচয় সম্পর্কে লিখেছেন, “১৯৩৭ সালে অগ্রগতি কাগজে, সোমেনের অন্ধ শ্রীবিলাসের অনেকদিনের একদিন’ পড়ে নির্মলবাবু অভিভূত হন। তিনি সোমেনের লেখায়, সাহিত্য ক্ষেত্রে বিপুল সম্ভাবনা লক্ষ্য করেন। তাঁর সঙ্গে পরিচিত হতে ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হয়ে, আমাকে পত্র দিয়ে সোমেন সম্পর্কে জানতে চান। আমি তখনও সোমেনের সঙ্গে পরিচিত নই।
কবি কিরণশংকর সেনগুপ্তের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। …কিরণশংকরের সঙ্গে সোমেনের আগেই ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাঁকে সোমেনের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে অনুরোধ করতে তিনি ব্যবস্থা করে রণেশ দাশগুপ্তর বাসায় আসতে বলেন।
প্রথম সাক্ষাতেই পরিচয় ও আলাপে সোমেনকে এমন ভালো লেগেছিল যে, সেদিনই আমি ওকে বললাম, তোমার সঙ্গে প্রতিদিন দেখা হওয়া প্রয়োজন। এইভাবেই সোমেন আমার সুখ দুঃখের সাথী হয়ে গেল।
এরা ছাড়া শুরুতেই ছিলেন, জ্যোতির্ময় সেনগুপ্ত, দাদা থেকে ন’দশ বছরের বড়। ‘৩৮-এ ছয় বছর জেল খেটে ক্ষয়রোগ নিয়ে মুক্ত হন। তিনিই বাংলা ভাষায় প্রথম জার্মান কবি নাট্যকার ব্রেখট নিয়ে অনেকগুলি প্রবন্ধ লেখেন। সে সময় সুধী প্রধানের মতো নাট্য ব্যক্তিত্বরাও ব্রেখটের সম্পর্ক কিছুই জানতেন না (প্রধানের একটি রচনায় এ তথ্য রয়েছে)। তিনি অনেক গানকবিতাও লিখেছিলেন কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল বিপ্লবী নাট্যকার হওয়া। বাংলা ভাষায় প্রথম গণনাট্য “ভাঙ্গাচাকা’র (রচনা ২৭/৫/৩৬) তিনিই রচয়িতা।
ইষ্টবেঙ্গল রেলওয়ে ওয়াকার্স ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে ইউনিয়ন দপ্তর বসে যেটুকু সম্ভব কাজ করতেন। অসুস্থতার কারণে কলকাতায় চলে আসেন, অল্পকাল পরে মারা যান। সফল বিপ্লবী নাট্যকার হওয়ার স্বপ্ন তাঁর সফল হলো না।
সংঘ প্রস্তুতিকালের অল্পদিন পরে যুক্ত হন অচ্যুৎ গোস্বামী, রণেশ দাশগুপ্তের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে। রণেশদার মতে তাঁর, ‘বাংলা উপন্যাসের ধারা’ মার্কসবাদী দৃষ্টিতে বাংলাভাষায় প্রথম আলোচনা গ্রন্থ। প্রাবন্ধিক হিসেবে যথেষ্ট সাফল্যের তিনি পরিচয় দেন। এছাড়া কয়েকটি বৃহৎ উপন্যাস “কানাগলির কাহিনী”, “মৎস্যগন্ধা” প্রভৃতি তিনি লিখেছেন। বিজয়গড় কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের প্রধান হিসাবে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। অল্পকাল পরে দূর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়।
আর একজন, সরলানন্দ স্বামী। সংঘের প্রভাবে সন্ন্যাসী থেকে গৃহী হন, সরলানন্দ সেন। বাংলা ভাষায় মাও সে তুং চ্যু তে ও পেং তু ইয়ের প্রথম জীবনীকার। এছাড়া, ছোটদের রামমোহন, চিত্তরঞ্জন, বালগঙ্গাধর তিলকের জীবনী লেখক। পেশায় সাংবাদিক। কিছুকাল ‘আজাদ’ ও পরে দৈনিক সংবাদের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। যুগান্তরের ঢাকার সংবাদদাতা। তাঁর এই পত্রসমূহ ঐ সময়কার ঢাকার ইতিহাস জানার একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
পরে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। দৈনিক যুগান্তরের সহকারী এডিটর ছিলেন। এছাড়া আরো অনেকে ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন তরুণ লেখক এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র। ছিলেন সোমেন হোড়, গৌরপ্রিয় দাশগুপ্ত, অসিত সেন প্রমুখেরা।
৪০-এ ক্রান্তি প্রকাশের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলীম ছাত্রদের মধ্যেও সংঘের প্রভাব পড়ে। অনেকের সঙ্গে লেখক সংঘের যোগাযোগ হয়। দাদার হত্যার পর এরা প্রকাশ্যে প্রগতি লেখক সংঘের কার্যকলাপে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে ছিলেন মুনীর চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, সানাউল হক প্রভৃতিরা। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতি আন্দোলনে এঁরা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। লেখক হিসাবেও যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন।
সত্যেন সেন। যিনি পরবর্তীকালে বাংলাদেশের প্রখ্যাত লেখক এবং বিশিষ্ট সংগীত সংগঠন উদীচী’র প্রতিষ্ঠাতা। আমাদের ঠাটারীবাজার বাসায় তিনি দাদার কাছে কয়েকবার এসেছেন, দেখেছি। সেই সময় তিনি কৃষকদের সংগঠিত করার কাজে যুক্ত ছিলেন। তখনই নিজে গান লিখে, সুর দিয়ে, দরাজ গলায় গেয়ে, কৃষকদের উদ্দীপ্ত করতেন। দাদার হত্যার পর তাঁকে লেখক ফ্রন্টেরও দায়িত্ব নিতে হয়।
মনোরমা গুহঠাকুরতা শিশু সাহিত্যিক। দাদার থেকে বয়সে অনেক বড়। আমাদের বাসায় অনেকদিন এসেছেন। দাদা ছাড়াও মার সঙ্গে জমিয়ে গল্প করতেন। উদ্দেশ্য, মার কাছ থেকে গ্রামে প্রচলিত রূপকথা, ডাইনী, ভূত-প্রেত নিয়ে প্রস্তাব (গল্প) শোনা। মা যা যা জানতেন তাকে শোনাতেন। পরে শিশু সাহিত্যে তিনি যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। ‘শিশুসাথী’’ পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন। ‘সোনার বাংলায়’ও লিখতেন। দাদার হত্যার প্রতিক্রিয়ায় তিনি প্রগতি লেখক সংঘে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। পরে, কলকাতায় মাসিক ও বার্ষিক শিশুসাথী’র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করেন।
সোমেন চন্দ নিহত হওয়ার অল্পকাল পূর্বে আর একজন প্রতিভাবান শিল্পী সংঘে যুক্ত হন। তিনি সাধন দাশগুপ্ত। গীতিকার, সুরকার ও গণশিল্পী। উদাত্ত কণ্ঠে গান গাইতেন। জনপ্রিয় গায়ক ছাড়াও তিনি নাটকে ভালো অভিনয় করতেন। পূর্ব বাংলার গণনাট্য আন্দোলনে অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব।
দাদাকে হত্যার প্রতিক্রিয়ায় তিনি একটি সাড়া জাগানো গান লেখেন। সুরও তাঁরই। তাঁর প্রথম লাইন-‘তোমার বুকের খুনে পথ কে ভাসায় বন্ধু, একবার বলো না।’ এই গানটিতে তখন সব সভায় গাওয়া হতো। তিনি নিজে উদাত্ত কণ্ঠে যখন এইগানটি গাইতেন, তখন সভায় উপস্থিত সকলের মধ্যে আবেগ, শিহরণ ও উত্তেজনার সৃষ্টি হতো। নিয়মিত সাহিত্য সভায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা পর্যালোচনার ফলে ঢাকায় একঝাঁক প্রতিভার জন্ম সম্ভব হয়েছিলো। কলকাতার বাইরে (কলকাতা ভিত্তিক লেখকরা উপলব্ধিও করতে পারতেন না) এমনটা ভাবা যায় না।
সোমেন চন্দের জীবনের নানা তথ্যের ক্ষেত্রে কিছু বিভ্রান্তি এমনকি পরস্পরবিরোধী তথ্য রয়েছে। সে সম্পর্কে পূর্বে দু’একটি কথা লিখেছি। ‘আগুনের অক্ষরে’ আমার প্রকাশিত লেখায় একটি তথ্য সংশোধন করতে চাই। আমি লিখেছিলাম, দাদার চিকিৎসা করেছিলেন দাদু। ঢাকার চিকিৎসক সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। মনে পড়ে, দাদার অসুখের সময় দাদু কয়েকবার দাদাকে দেখে গিয়েছেন। কিন্তু দাদার অন্তরঙ্গ বন্ধু অমৃতকুমার দত্ত যিনি দাদার সেবাযতœ নিজহাতে সবচেয়ে বেশি করেছেন, তিনি লিখেছেন, (সাহিত্য চিন্তা বৈশাখ ১৪০৪) “পরিচয়ের কিছুদিন বাদে, ওদের দক্ষিণ মৈশুÐির বাসায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডবল নিমুনিয়া হয়। উয়ারীর ডাক্তার রায়ের সঙ্গে আমারই পরিচয় ছিল, চিকিৎসা করতে এসে সোমেনের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। অসুস্থতা চলাকালীন তিনি সোমেনকে দু’বেলাতেই দেখে যেতেন। মনে আছে ঔষধের মধ্যে ছিল এম-বি ৩৯৬ এবং পুলটিস, অ্যান্টি প্রজেক্ট টিং দিয়ে চিকিৎসা করা হয়েছিল। তখন আজকের মত নানা ঔষধ ছিল না। তখন সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হত সেবাযতেœর উপর।”
অমৃতদা লিখেছেন, ডবল নিমোনিয়া কিন্তু আমাকে বলেছেন দাদা প্লুরিসি হয়েছিল। হায়াৎ মামুদের গ্রন্থে, আমার কাকীমা বলেছেন স্বপ্নদত্ত ঔষধের কথা। তা ব্যবহার করে নাকি দাদা ভালো হলেন। এটা সত্য নয়। তিনি হয়তো পাঠিয়েছেন। দাদা ঐ সময় প্রায় তিন মাস অসুস্থ ছিলেন।
দাদা যখন রোগশয্যায় তখন মা দাদাকে জিজ্ঞেস করেছেন, “হারে শম্ভু, এই যে তুই এত ভুগছিস তোর কি এখনও ভগবানের কথা মনে হয় না”। দাদা স্মিত হেসে বলেছেন, “কেন? যে ভগবানের কোনো অস্তিত্বই নাই, তার কথা মনে হবে কেন”? দাদা যখন রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে গভীরভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন তখন মা তাকে প্রায়ই সাবধান করতেন, রাজনীতি করতে গিয়ে কত নির্যাতন সহ্য করতে হয়। তুই কি পারবি”? দাদা তাঁর সহজ সরল হাসি মিশিয়ে দু’এক কথায় মাকে আশ্বস্ত করতেন।
‘সোমেন চন্দ ও তাঁর রচনা সংগ্রহের’ সম্পাদক দিলীপ মজুমদার, দাদা ও সেই সময়কার পরিস্থিতি পাঠকের কাছে তুলে ধরার জন্যে, অনেক পরিশ্রম করে অনেক তথ্য ও বহুজনের রচনা যুক্ত করেছেন। তিনি লিখেছেন, (প্রথম খÐের ভূমিকা) …“আমি নিজে সোমেনের জীবনী রচনা করতে বসিনি; সেইজন্য বিভিন্ন আলোচনার তথ্যগত ত্রæটি কিংবা স্ববিরোধিতা মোটামুটি যেগুলি চোখে পড়েছে, সে সম্বন্ধে কোন মন্তব্য না করেই পুরো রচনাটি উদ্ধৃত করেছি”।
দাদার সাহিত্য সৃষ্টি ও বিকাশে ’৩৮-’৩৯ সালে নির্মল ঘোষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁর রচনা থেকে কয়েকটি বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। দাদা ও আমাদের পরিবার সম্পর্কে কতকগুলি তথ্য সঠিক নয়। অন্যত্র আমি তা নিয়ে আলোচনা করেছি।
কিন্তু রচনাবলীর দ্বিতীয় খÐে, নির্মল ঘোষের প্রবন্ধের আগে যে ভূমিকা তাতে লেখা হয়েছে। (পৃ: ১৭০) “তিরিশের দশকের শেষদিকে – ১৯৩৬-৩৭ সালে নির্মলচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে সোমেনের পরিচয় হয়। শ্রীঘোষ ঐ সময়ে ঢাকায় গিয়েছিলেন। তাঁর অনুরোধে সোমেন ‘বন্যা’ উপন্যাস, অন্ধ শ্রীবিলাসের অনেক দিনের একদিন’ -‘এক্স সোলজার’ প্রভৃতি গল্প লেখেন এবং সেগুলি শ্রী ঘোষ সম্পাদিত বালীগঞ্জ, অগ্রগতি প্রমুখ মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।”
এই বিষয়ে অমৃত দত্ত যা লিখেছেন তা পূর্বেই উদ্ধৃতি দিয়েছে। এছাড়া, ১৯৩৮-এর ডিসেম্বরে দাদার প্রথম কলকাতা আসার পূর্বে নির্মলবাবুর সঙ্গে কোনো প্রত্যক্ষ পরিচয়ই ছিলো। দাদা লিখেছেন (পত্র ১৪/১২/৩৮), …“সেই অনুযায়ী ষ্টেশনে লোক রাখতে হবে (আপনাকে আমি চিনবো, না হলে অমৃতকে পাঠালেও হয়..)” কোনো চেনা লোককে বলা যায় না “আপনাকে আমি চিনবো”। দাদার এই পত্র থেকে পরিষ্কার নির্মলবাবুর সঙ্গে দাদার ইতিপূর্বে সাক্ষাত হয়নি। আর একটি কথা, নির্মলবাবু ষ্টেশনে এসেছিলেন দাদাকে না পেয়ে ভেবেছিলেন, হয়তো আসেন নি। কিন্তু দাদা ষ্টেশনে কাউকে দেখতে না পেয়ে নির্মলবাবুর বাড়ী চলে যান। নির্মলবাবু অনেক পরে বাড়ী ফিরে দাদাকে দেখে অবাক হয়ে যান। আরো আশ্চর্য হন, তাঁর দৃষ্টিতে একজন দক্ষ লেখক এত অল্প বয়সের! ভেবেছিলেন, বেশ বয়স্কই হবেন। বোধ হয় নির্মলবাবুর সঙ্গে আলোচনায় দিলীপবাবুর এই বিভ্রান্তি ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে ‘অন্ধ শ্রীবিলাসের অনেক দিনের একদিন’ দাদার সতেরো বছর বয়সের রচনা, যা প্রকাশিত হলে নির্মলবাবু লেখকের সঙ্গে ব্যক্তিগত সংযোগ সৃষ্টির জন্যে সচেষ্ট হন।
দাদার মৃত্যুর পর, নূতন লেখায়’ (বৈশাখে ১৩৪৯) নির্মলবাবুর একটি লেখা প্রকাশিত হয়। তাতে দাদার লেখা চিঠিপত্রের কিছু উদ্ধৃতিও তিনি দেন। ঐ লেখায় তিনি লিখেছেন (পৃ: ৩৭), ‘অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক ‘অগ্রগতি’ পত্রিকার প্রকাশের উদ্দেশ্যে সে ‘অন্ধ শ্রীবিলাসের অনেক দিনের একদিন’ একটি গল্প পাঠায়। সেই প্রথম লেখা পাঠ করেই আমার মন ওঠে চমক দিয়ে,¾পাকা ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। তারপর হোলো পত্রযোগে আলাপ। ক্রমে তার আরো অনেক গল্পই ঐ পত্রিকায় প্রকাশিত হলো।
‘অগ্রগতি’ পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ হয়ে যাবার পর আমি ‘সবুজ বাংলার কথা’ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেছিলাম। সোমেন্দ্র তাতেও তার লেখা দিয়েছিল। এই পত্রিকাটিও কয়েক সংখ্যা প্রকাশিত হবার পর উঠে যায়।
… ‘বালীগঞ্জ’ নামে একটি মাসিক পত্রিকার সম্পাদনা করি এক বৎসর। এবং বলা বাহুল্য প্রথম সংখ্যা থেকেই সোমেন গল্প ও উপন্যাস (‘বন্যা’- লেখক) লিখে এবং ঢাকা শহরে বন্ধুবান্ধবের সহযোগে পত্রিকাটি বিক্রি করার সহায়তা করে। নতুন লেখার পরের সংখ্যায় লীলাময় রায় (অন্নদাশংকর রায়) লেখেন, সেদিন পরিচয়ে তার একটি ছোট গল্প পড়ে বিস্মিত হয়েছিলুম ও স¤প্রতি ‘নতুন লেখায়’ পড়লুম তাঁর বন্ধু নির্মল ঘোষের প্রবন্ধ। পড়ে মুগ্ধ হলুম। সোমেন্দ্রকে আমি চিনতুম না, কিন্তু তাঁর একটি উক্তি থেকে চিনতে পারি তিনি ছিলেন সত্যিকারের সাহিত্যিক। এই যেমন- “এখানকার দিনগুলি কী ভালো লাগে। তার প্রধান কারণ উপন্যাস লেখার উত্তেজনা, কবে শেষ হবে সেই চিন্তাই করি”। …. “হাতে চাঁদ কপালে সূয্যি নিয়ে যাঁরা জন্মান তাঁদের আয়ু মাত্র পঁচিশ বছর হলে ক্ষতি নেই, যদি চন্দ্র সূর্য অম্লান থাকে”। ”এখন সোমেন চন্দের অপ্রকাশিত লেখাগুলি প্রকাশ করার ব্যবস্থা হোক। সেই হবে তাঁর যথার্থ স্মৃতিরক্ষা এবং বাংলা সাহিত্যের একটি সকরুণ সম্পদ”।
নির্মলবাবু দাদার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে যেমন অবাক হয়েছিলেন কল্পিত সোমেন থেকে অনেক তরুণ এক সোমেনকে দেখে, তাতেও আঠারো বছরের সোমেনকে একুশ ভেবেছিলেন। নতুন সাহিত্যে তিনি দাদার মৃত্যুকালীন বয়স পঁচিশ লিখেছেন। তাঁর লেখা থেকে অন্নদাশংকর রায় পুনরুক্তি করেছেন। আমাদের পৈত্রিক বাড়ী, আর্থিক অবস্থা দাদার ডাক্তারী পড়তে না পারার কারণ ইত্যাদিতে নির্মলবাবু যা লিখেছেন, তাতে কিছু ভূল ও অজ্ঞানতাজনিত বিভ্রান্তি ঘটেছে।
১৯৩৯ সালে, রোগভোগের সময়টা বাদ দিয়ে দাদা প্রগতি পাঠাগার পরিচালনা, প্রগতি লেখক সংঘ সংগঠন, পার্টির কাজে অংশগ্রহণের সঙ্গে গভীর অধ্যয়নে নিজেকে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। হারিকেনের আলোয় রাতে লেখা-পড়া। সেইদিনে কলম বলতে কাঠের হাতলের সঙ্গে নীব্ যুক্ত হওয়া। ট্যাবলেট গুলে দোয়াত ভর্তি করা কালী। সেই কালীকলম, কাগজ বইপত্র নিয়ে একটা টেবিল। কাছেই লাল রঙের আলমারি। তাতে লেখা ও প্রয়োজনীয় বইপত্র তালাবন্দী থাকতো। অনেক প্রকাশিত লেখার কথা বা নতুন লেখার কথা বাড়ীতে কেউ জানতে পারতেন না। স্বভাব লাজুক দাদা বন্ধুদেরও বলতেন না। কোনো কাগজ থেকে একটা ‘রাজা’ কলম উপহার পেয়েছিলেন, পরে তা দিয়েও লিখেছেন।
নির্মল ঘোষকে লেখা পত্রের দুটো তথ্য উল্লেখ করি। দাদা ‘৩৮-এ বোধ হয় দু‘এক জায়গায় লিখে অর্থ পেতেন। লিখেছেন, “আপনি নবশক্তি’তে গল্পটা প্রকাশের কথা লিখেছেন¾ভালো কথা ওরা আমাকে পারিশ্রমিক দেয়নি”। “আমার দিনগুলো এখন মনোরম¾ আর অনেক, আপনাকে বলতে বাধা নেই, অনেক মানসিক (সাংসারিক) বিপর্যয়ের বাধা-বিপত্তি এড়িয়েও এখনকার দিনগুলো কী ভালো লাগে। তার প্রধান কারণ উপন্যাস লেখার উত্তেজনা”। “এখনকার রাতগুলো আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকলো (আর আপনি তার প্রথম শ্রোতা) উপন্যাস লেখা ব্যর্থই থেকে আর অব্যর্থই হোক¾মাঝে মাঝে এক একটি রাত কখন যে শেষ হয়ে যায়, টেরও পাইনে”। ‘৩৮ সালেই দাদা তার একটি গল্পের বই প্রকাশের ইচ্ছা ঐ পত্রে ব্যক্ত করেছিলেন। লিখেছেন, প্রকাশনের মধ্যে মাত্র চারটি গল্প বইয়ের জন্য নির্বাচিত হতে পারবে, অন্ধ শ্রীবিলাস, অমিল, মুখোস, দুই পরিচ্ছদ (পরিবর্তিত হয়ে)। আর কয়েকটি আমার হাতে।
বিশ্বজিৎ ঘোষ সম্পাদিত রচনাবলীতে সাতটি পত্র প্রকাশিত হয়েছে। পত্রগুচ্ছ অংশের এই পত্রগুলি “সোমেন মানস অনুধাবনের জন্য অপরিহার্য উপাদান বলে তিনি মন্তব্য করেছেন, যথার্থভাবে।
১৯৩৮ সালেই দাদার রাজনৈতিক চেতনা কত গভীরতা লাভ করেছিল পত্রে তার স্বাক্ষর বহন করেছে। তৃতীয় পত্রে, তিনি নির্মলবাবুকে লিখেছেন, … “ভারতেরও তাই হবে, শেষ পর্যন্ত সেই বহু নিন্দিত ডেমোক্রেসিÑরায় বা ভারতের অগণ্য দরিদ্র অধিবাসীর আশা সফল হবে না, কাল নয় বৃটিশের হাত থেকে ছাড়া পেলো। পরশু গিয়ে পড়বে ধনীদের হাতে”।
শুধু রাজনীতি নয়, সাহিত্য বিষয়ে গভীর অধ্যয়নে, মতামত প্রকাশে তার দৃঢ় প্রত্যয় সৃষ্টি হয়েছিল। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে এ বিষয়ে তার মন্তব্য উল্লেখ করা যায়। নির্মলবাবুর কাছে দ্বিতীয় পত্রে। “শ্রেষ্ঠ গল্প লেখকের যা গুণ তার সবই আছে তার মধ্যে বিশিষ্ট রচনাভঙ্গি, অভিনব চরিত্র সৃষ্টি, অপূর্ব অভিজ্ঞতার উপলব্ধি সবই আছে, পড়াশোনা কম বলে মনে হয়। কল্পনা করা যায় এই প্রতিভার সঙ্গে বিস্তর পড়াশোনার যোগ থাকলে আরও কতো বড়ো সাহিত্যই না আমরা পেতাম”।
আর ১৯৪০-এ অমৃত দত্তকে লিখিত পত্রে তিনি লেখেন, … “মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বড় লেখক হতে পারেন, তাঁর লেখায় প্রগতি চিন্তার ছাপ আছে। ‘অমৃতস্য: পুত্রাঃ’ পড়ে মনে হলো তিনি ভালো লিখবেন। তবে রাজনীতির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ মনে হয় ক্ষীণ, আর পড়া-লেখাও, কম। কলকাতায় গেলে মানিকবাবুর সঙ্গে দেখা করবো।
‘৪০-এ ঢাকার লেখকদের প্রকাশিত সাহিত্য সংকলন (তিনি তার প্রকাশক ছিলেন) ‘ক্রান্তি’ নিয়ে তিনি কলকাতায় এসেছিলেন। ‘ক্রান্তি’ দিতে এবং মানিকবাবু সম্পর্কে তাঁর মতামত আলোচনার জন্যে মানিকবাবুর টালীগঞ্জের বাসায় গিয়েছিলেন। কিন্তু মানিকবাবু অন্যত্র থাকায় তার সঙ্গে দাদার সাক্ষাৎ হয়নি।
ঐ পত্রে তিনি আরো লিখেছেন, ‘গত কয়েকদিন রেল শ্রমিকদের নিয়ে বেশ ঝামেলায় ছিলাম। লেখার জন্য একটুও সময় পাই না। তবু লিখতে হবে মেহনতী মানুষের জন্য, সর্বহারা মানুষের জন্য আমাদের লিখতে হবে। র্যালফ ফক্সের বই পড়ে আমি অন্তরে অনুপ্রেরণা পাচ্ছি। কডওয়েলের বইটিও আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। এই না হলে কি মহৎ সাহিত্যিক হওয়া যায়? স্পেনের পপুলার ফ্রন্ট সরকারের সমর্থনে তাঁদের আত্মবিসর্জন ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে”।
১৯৪০-এ দাদা ইষ্টবেঙ্গল রেলওয়ে ওয়ার্কস ইউনিয়নের কাজে সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করেন। এর আগেও দাদা শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করতে চেয়েছেন, সাহিত্য ফ্রন্টের ও অন্যান্য কাজের প্রয়োজনে পার্টি আনুমতি দেয়নি।
বড় মাসীর বাড়ী ছিল ধামগড়। নানা সামাজিক কারণে আমরা ধামগড় যেতাম, দাদাও। ধামগড়ে ছিল ঢাকেশ্বরী কটন মিল। মনে পড়ে, আমরা ঐ কারখানা ঘুরে দেখেছি। দাদার দেখা প্রথম সংগঠিত শিল্প। কর্মীরা, কোয়ার্টার বা আশে-পাশে থাকতেন। অনুমান করা যায়, দাদা তাদের সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ ব্যবহার করেছেন।
সেদিনের ঢাকা শহরে (বর্তমান মহানগরী তো নয়) আড়াই-তিন লাখ লোকের বাস। ধাঙ্গর, মিউনিসিপ্যাল কর্মী, প্রেস কর্মী, ব্যাঙ্ক ইনসোরেন্স কর্মচারী, হোসিয়ারী, সাবান, বিস্কুট তৈরির ঘরোয়া সব উৎপাদন কেন্দ্র ছাড়া ছিল হরদেও গ্লাস ওয়ার্কস ও কয়েকটি বরফ কল। ঢাকা শহরে বৃহৎ শিল্প বলতে রেলওয়ে, তার ওয়ার্কশপ। দাদার ঢাকেশ্বরী মিল ও অন্যত্র শ্রমিকদের নিয়ে সীমিত অভিজ্ঞতা ছিলো, তাই নিয়ে, রেলওয়ে ইউনিয়ন সংগঠনে যোগ দিলেন। এখানে উল্লেখ করা যায়, শ্রমিক আন্দোলনের পটভূমিকায় তাঁর বিখ্যাত গল্প “সংকেত” ১৯৩৮-এ রবিবাসরীয় আনন্দবাজারে প্রকাশিত হয়।
১৯৪০-এ দাদার লেখক পরিচিতি হয়েছে। ঢাকা রেডিও স্টেশন থেকে ‘কথিকা’ পাঠের ডাক পেয়েছেন। দু’তিনটি কথিকা তিনি বেতারে পড়েছেন। তার মধ্যে একটি Rip Van Winkle নামে ২০ মিনিটের। ২০শে মে ১৯৪০-এ। সেইদিনে রেডিও দু’একজন ভাগ্যবানের বাড়ীতে প্রবেশাধিকার পেয়েছে। আমরা সপরিবারে করোনেশন পার্কে রেডিওতে দাদার কথিকা শুনতে গিয়েছিলাম। সেই যুগে একজন তরুণের পক্ষে রেডিওতে কথিকা পাঠ যথেষ্ট মর্যাদা ও গর্বের ছিল। একটি ঘটনায় সব ওলট-পালট হয়ে গেলো ‘দাদা ঐ সময় রেডিওতে চাকুরীর জন্য ইন্টারভিউ দেন। চাকুরী হলোই না, পুলিশ রিপোর্টে তার কথিকা পড়াও বন্ধ করে দেওয়া হল।
১৯৪০-এ দাদার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা ‘বনস্পতি’, ‘ক্রান্তি’তে প্রকাশিত। প্রকাশক সোমেন প্রায় একশো কপি ক্রান্তি নিয়ে কলকাতায় আসেন। অনেকের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তখন রেল ইউনিয়নের কাজে যোগ দিয়েছেন। তাই কলকাতায় এসে ইউনিয়নের কাজের বিষয়ে যোগাযোগ করেন। স্নেহাংশু আচার্য লিখেছেন, (সংশপ্তক পত্রিকা জুন, ১৯৭৭)..” ৪৬ নং ধর্মতলা স্ট্রীটে ক্রমে ক্রমে প্রগতি “লেখক ও শিল্পী সংঘ” (পরবর্তীকালে “ফ্যাসি বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ”) “ভারতীয় গণনাট্য সংঘ” ও তখন বে-আইনি কমিউনিস্ট পার্টির কাজকর্ম সব হতো। সোমেন চন্দের মৃত্যুর আগে ওইখানেই আমাদের সঙ্গে দেখা। লেখা নিয়ে কথাবার্তা ছাড়া সোমেন চন্দ এসেছিল জ্যোতি বসুর সঙ্গে রেল শ্রমিক সংগঠনের সম্বন্ধে কথাবার্তা বলতে। তখন জ্যোতি বসু রেল শ্রমিক সংগঠনে লিপ্ত”।
এই লেখা থেকে বোঝা যায় দাদা ৪৬নং ধর্মতলা স্ট্রীট অফিসে, ‘লেখা নিয়ে কথাবার্তা’ এবং শ্রমিক সংগঠন নিয়ে “জ্যোতি বসুর সঙ্গে আলোচনা” করেছেন।
৩৮-এ প্রথম কলিকাতা আসার সময় তিনি সুরেন গোস্বামী, বিনয় ঘোষ প্রভৃতি কারো কারো সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। স্নেহাংশু আচার্যের লেখা থেকে মনে হয় ঐ সময় আরো অনেকের সঙ্গে পরিচয় ও আলাপ-আলোচনা দাদার হয়ে থাকবে। কিন্তু এ বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
১০.৯.৪০ এ, পত্রে অমৃত দত্তকে লিখেছেন, “ক্রান্তির কাজ প্রায় শেষের পথে। তুমি এসে তরতাজা গ্রন্থ দেখতে পাবে। প্রগতি লেখক সংঘের কাজ ভালোভাবে চলছে। কিছুদিনের মধ্যে একটা সভা করতে চাই। সতীশবাবুর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়েছে। অনুষ্ঠানে কাজী আবদুল ওদুদ কিংবা বুদ্ধদেব বসু অথবা সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে আনার চেষ্টা করবো। তুমি প্রাথমিক আলোচনা শেষ করে আসতে পারো কি? ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে আমি কলকাতা যাবা তখন তাঁদের সঙ্গে দেখা করবো”। এ পত্র থেকে অনুমান করা যাক এদের সঙ্গে দাদা কলকাতায় যোগাযোগ করেছেন।
কিরণশংকর ‘সময়-অসময়’-এ লিখেছেন, “৪০-এ জগন্নাথ অ্যাসেম্বলী হলে বুদ্ধদেব বসুর সভাপতিত্বে সংঘের বার্ষিক প্রীতি সম্মেলনী হয়। উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করেন সুকুমার রায়, যিনি পরবর্তীকালে সঙ্গীতের উপর বই লিখে রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছেন।” বোধ হয় অমৃত দত্তকে লেখা পত্রে দাদা যে সভার কথা উল্লেখ করেছেন এই সভা সেটাই।
প্রগতি লেখক সংঘ সভার প্রথম দিকে ঢাকার শিক্ষিত সমাজের রক্ষণশীল অংশের বিরোধিতা ছিল স্বাভাবিক। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন মোহিতলাল মজুমদার। তিনি তো খুবই বিরক্তি প্রকাশ করতেন। কিন্তু ঢাকার উদীয়মান তরুণ লেখকদের আন্তরিক, দৃঢ় প্রচেষ্টার দরুণ এই বিরোধিতা বিশেষ বাধা হয়ে দেখায় দেয় নি। ‘ক্রান্তি’ প্রকাশের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ঝাঁক মুসলিম তরুণ সংঘের অনেক কাছে চলে আসেন। এদের মধ্যে অনেকে সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। কেউ কেউ ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
কিরণশংকর লিখেছেন (সময়-অসময়), “অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু, অধ্যাপক মহম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক অমিয় কুমার দাশগুপ্ত, অধ্যাপক পৃথ্বীশ চক্রবর্তী প্রভৃতিরা কোনো কোনো সভায় উপস্থিত থেকে আমাদের উৎসাহিত করেছিলেন।” অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন প্রথম সম্মেলনের উদ্বোধন করেছেন একথা পূর্বেই লিখেছি। এইসব তথ্য থেকে বোঝা যায় শিক্ষিত রক্ষণশীলদের বাধা সত্তে¡ও সংঘ ঢাকার সংস্কৃতি জীবনে ’৪০-৪১ সালে দৃঢ়ভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে।
কিরণশংকরের জীবনীগ্রন্থে তথ্যগত কিছু ভুল রয়েছে। তিনি লিখেছেন (পৃ : ২৫), “কলকাতা থেকে ফিরে এসে আর দ্বিতীয়বার কলকাতায় যাওয়ার সুযোগ সোমেনের হয়ে ওঠেনি”।… “সেই সময়ে কলকাতায় অবস্থানকারী বন্ধু গৌরপ্রিয় দাশগুপ্তের সঙ্গে একটি ফটো তুলেছিলেন”।
প্রসঙ্গত দ্বিতীয়বার দাদা ‘৪০-এ কলকাতায় এসেছিলেন। আশ্চর্যের কথা কিরণশংকরের সঙ্গেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, হীরেন মুখোপাধ্যায়-এর বাড়ী গিয়েছিলেন। অবশ্য কারোর সঙ্গেই দেখা হয়নি। তিনি একথা অনেকবার আমাকে বলেছেন। তাছাড়া, হীরেনবাবুর লেখায়ও এ কথার উল্লেখ রয়েছে। আর ফটোটাও ‘৪০-এ তোলা। আগুনের অক্ষরেও ভুল তথ্য রয়েছে।
গৌরপ্রিয় দাশগুপ্তের সঙ্গে তোলা ঐ একটিমাত্র ছবি দাদার রয়েছে। ছবিতে দাদার চেহারার যথার্থ রূপ প্রকাশ পায়নি। প্রথমত কলকাতায় ঘুরে ঘুরে তার মধ্যে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট এবং ছবি তোলায় অনভ্যস্ত হওয়ায় মুখের ঘামও মোছেন নি। দাদা বেশ ফর্সা, লম্বায় ৫ ফুট ৩১/২ ইঞ্চি থেকে ৪ ইঞ্চির মত। বলিষ্ঠ গড়ন, বড় মাথা; স্বপ্নালু চোখ, সদা স্মিত হাস্যময়, সারল্যে পরিপূর্ণ মুখাবয়ব তার। বন্ধুদের দৃষ্টিতে?
সরলানন্দ সেন (প্রতিরোধ ১৫ই জৈষ্ঠ্য ১৩৪৯), দাদাকে “বলিষ্ঠ তরুণ”, “প্রশস্ত ললাট”, “কমলালেবুর রং-এর মত গাল” বলে বর্ণনা করেছেন।
কিরণশংকর লিখেছেন (জীবনী গ্রন্থ পৃ : ১০).. দেহ ছিল সুগঠিত, দেখতে সুশ্রী, রং ফর্সা। অচ্যুৎ গোস্বামী লিখেছেন (আগুনের অক্ষর পৃ: ৩৮২), ‘মাথাটা দেহের তুলনায় আয়তনে একুট বড়, মুখখানা চ্যাপ্টা, দাড়ি-গোঁফ ভাল করে ওঠেনি, দু‘পাশের চোয়াল একটু উঁচু, একটু নীলচে চোখদুটি বেশ বড় আর স্বপ্নালু, একটু বেটে হলেও মানানসই চেহারা। তরুণ মুখখানিতে কোমল মাধুর্য।
সোমেনের এত অল্প বয়সে ঢাকার লেখক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র ও শ্রমিকদের মধ্যে জনপ্রিয়তার রহস্যের সন্ধান তার বন্ধুদের মন্তব্য থেকে বোঝা যায়।
অমৃত দত্ত লিখেছেন (সাহিত্য চিন্তা বৈশাখ ১৪০৪), “প্রথম সাক্ষাতেই পরিচয় ও আলাপে সোমেনকে এমন ভালো লেগেছিল যে সেদিনই আমি ওকে বললাম, তোমার সঙ্গে আমার প্রতিদিন দেখা হওয়া প্রয়োজন। এইভাবেই সোমেন আমার সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে গেল”।
সরলানন্দ সেন (প্রতিরোধ ১৩৫০, স্মৃতিসংখ্যা), “পরিচিত হওয়ার অল্প কয়েকদিনের ভিতরই সোমেন পরকে খুব সহজে আপন করে নিতে পারত। আমার মনে হয় এটা ছিল তাঁর চরিত্রের চুম্বকশক্তি এবং এটাই বোধ হয় তাঁর চরিত্রের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য।
জ্ঞান চক্রবর্তী লিখেছেন (একতা ১০/৩/৭০), … “তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম, সাংগঠনিক গুণ, মানুষকে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা, অমায়িক ব্যবহার ও উদার দৃষ্টিভঙ্গী এই সংগঠন প্রতিষ্ঠার কাজে বোধ হয় সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে”।
ঢাকা বাংলা একাডেমি প্রকাশিত সোমেন চন্দ রচনাবলীর সম্পাদক বিশ্বজিৎ ঘোষ লিখেছেন (পৃ : ৩২৪), তবে ৪১ সালের মাঝামাঝি সময় সোমেন চন্দ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। জ্ঞান চক্রবর্তীর ঢাকা জিলার কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসে লিখেছেন “৪৩শে পার্টি সভ্য ছিলেন দুইশতের উপর” পৃ: ৫৭।
বে-আইনী পার্টির সঠিক কোন তথ্য সেই সময়কার পাওয়া যায় না। পার্টি সভ্যপদ অর্জন আজকের মতন ছিলো না, বেশ কঠিন ছিলো। তা সত্তে¡ও বলা যায়, দাদার সভ্যপদ প্রাপ্তির সময়টা আরো আগে হওয়া সম্ভব। কারণ ‘৩৭-এ দাদা পার্টির কাজে যোগ দেন। ৩৮-এ প্রগতি পাঠাগারের সম্পাদক। ঐ সময় থেকে প্রগতি লেখক সংঘের সংগঠক, এবং সর্বোপরি ৪০-এ দাদা রেল শ্রমিকদের সংগঠনে যোগ দেন। কোনো পার্টি সভ্য না হলে ‘৪১-এ গুরুত্বপূর্ণ রেলওয়ে ইউনিয়নের সম্পাদক হওয়া সম্ভব ছিল না।
অমৃত দত্তকে দাদা লিখেছিলেন, (১৫.৯.৪৫) রেল-শ্রমিকদের নিয়ে বেশ ঝামেলায় ছিলাম। লেখার জন্য একটু সময় পাই না”। ধরা যেতে পারে ঐ সময় থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দাদা লেখার বিশেষ সময় করে উঠতে পারেন নি। এই সময়কালে তিনি তিনটে গল্প মাত্র লিখেছেন, ‘একটি রাত’, ‘দাঙ্গা’ ও ‘ইঁদুর’। ইঁদুর তাঁর শেষ রচনা। কিরণশংকর ’৪১-এর শেষভাগে কলকাতা আসেন, দাদা তাকে ঐ লেখাটি পরিচয়ে দেওয়ার জন্য দেন। দাদার মৃত্যুর পর ‘পরিচয়ে’, ‘ইঁদুর’ প্রকাশিত হয়। ‘দাঙ্গা’ লেখক সমিতির নির্দেশে লেখা। এ বিষয়ে অচ্যুৎ গোস্বামী লিখেছেন, (‘এষা’ ৪র্থ বর্ষ, ১ম সংখ্যা ১৩৭৫) “হঠাৎ একদিন সোমেন সংঘের বৈঠকে একটি গল্প পড়ে শোনাল।….গল্পটির নাম ‘দাঙ্গা’। আমরা হাসি হাসি মুখ নিয়ে গল্পটি শুনতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু ছোট্ট গল্পটি পড়া শেষ হয়ে গেলে আমরা সকলে থ’ হয়ে গেলাম। আমাদের সমালোচক চূড়ামণি রণেশবাবু পর্যন্ত চুপ করে থেকে মন্তব্য করতে বাধ্য হলেন- একেবারে সর্বাঙ্গসুন্দর গল্প, কোন খুঁত বের করার উপায় নেই। আজও আমার ধারণা সমগ্র বাংলা সাহিত্যের মধ্যে দাঙ্গার উপর এইটিই একমাত্র সার্থক গল্প”।
‘একটি রাতে মা ও দাদা যেমনটি ছিলেন তার কিছু টুকরো চিত্র চিহ্নিত। ‘দাঙ্গা’ ও ‘ইঁদুর’ গল্পে প্রধান চারত্রগুলি আমাদের পরিবারের। দাদা, বাবা ও আমরা। অধিকাংশ সত্য ঘটনা, গল্পের প্রয়োজনে সামান্য সংযোজন ও পরিবর্তন সহ। দাদার অধিকাংশ গল্প তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ফসল। ইতিপূর্বে আমি ‘মরূদ্যান’ গল্পের উল্লেখ করেছি। ‘এক্স সোলজার’ এর প্রধান চরিত্রের ব্যক্তি আমাদের বাসা বাড়ী লেনে বাস করতেন।
দক্ষিণ মৈশুন্ডিতে পাড়ার মাঝামাঝি বৈষ্ণবদের একটি আখড়া ছিল। আর আমাদের বাসার পাশেই ছিল ‘জিউ মন্দির’। এই বৈষ্ণবদের তিনি কাছ থেকে দেখেছেন। এই অভিজ্ঞতার তিনি একটি মাত্র গল্প ‘রাত্রিশেষ’ লিখেছেন। আর লেখেননি। কারণ তিনি নির্মল ঘোষকে লিখেছেন (দুই : ৯/১১/৩৮), “বৈষ্ণবদের সেই আখড়ার সাথেও ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত আমি, কিন্তু এতদিন যেসব সম্বন্ধে কিছু লিখিনি এই ভেবে যে, ওসব পুরনো হয়ে গেছে, যখন নতুন দৃষ্টিভঙ্গির দরকার”। ৪১-এর এপ্রিলে ঢাকা শহরে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়। আমাদের দক্ষিণ মৈশুন্ডির বাসার পর একটি জিউ মন্দির তারপরই মুসলীম এলাকা। তখন শহরে চলেছে পরস্পরকে আক্রমণ, লুট ও অগ্নিসংযোগ। বাধ্য হয়ে আমাদের বাসা পাল্টাতে হয় আমরা চলে আসি ঠাটারীবাজারে। একদিক থেকে দাদার পক্ষে লাভেরই হলো। অল্প দূরে ঢাকা ফুলবাড়িয়া রেল ষ্টেশন, ইয়ার্ড ও কোয়ার্টার এবং ইউনিয়ন শ্রমিকদের পক্ষেও নেতার বাসা কাছে হওয়ায় বিশেষ সুবিধা হল। প্রয়োজনে অনেকেই বাসায় চলে আসতেন। শ্রমিকদের সঙ্গে দাদার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের সুযোগ আগের থেকে বৃদ্ধি পেল। স্বভাবতই সংগঠনের কাজে গতিশীলতা বাড়লো।
ঐ দাঙ্গার সময় ঢাকার ট্রেড ইউনিয়নগুলির দৈনন্দিন কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেল। জ্ঞান চক্রবর্তীর ভাষায় “একমাত্র রেল ও সূতাকল ইউনিয়ন বাদে”। দাঙ্গার মধ্যেও রেল ইউনিয়ন দপ্তর চালু থেকেছে। হিন্দু-মুসলীম শ্রমিকরা যোগাযোগ রেখেছেন। আর, দাদাতো এই ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রচারে অংশগ্রহণ ছাড়াও বিপদের ঝুঁকি নিয়ে শহরের নানা এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। বন্ধু ও কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। মুসলীম বন্ধুদেরও। যেমন : মহম্মদ শহীদুল্লার ছেলে সফিউল্লা (যতদূর মনে পড়ে এই নামই হবে) দাদার বন্ধু ছিলেন। দাদা ওঁদের রমনার বাড়ীতে গিয়ে প্রায়ই খোঁজ খবর নিতেন। এক কথায়, দাঙ্গার দিনগুলিতে দাদার সঙ্গে তাঁর লেখক বন্ধুদের, পার্টি কর্মীদের ও রেল শ্রমিকদের যোগাযোগ খানিকটা ব্যাহত হলেও অব্যাহত ছিল। যেটা দাঙ্গার দিনগুলিতে; শহরের পরিস্থিতিতে অনেকের কাছে আশ্চর্যের মনে হয়েছে।
সোমেন ‘৪০-এর প্রারম্ভে রেল ইউনিয়নের কাজে যোগ দেন। ‘৪১-এ সম্পাদক হন। ঐ সময়ের কথা বলতে গিয়ে জ্ঞান চক্রবর্তী লিখেছেন (একতা, ২০/৩/৭৩)। “ ’৪১ সালেই শক্তিশালী রেলওয়ে ইউনিয়নের তিনি সম্পাদক নির্বাচিত হন সর্বসম্মতিক্রমে। ২০ বছরের যুবকের পক্ষে এটা ছিল অত্যন্ত গৌরবের ব্যাপার। কারণ রেল কর্তৃপক্ষের জাঁদরেল লোকদের সাথে সমপর্যায়ে বসে শ্রমিকদের সমস্যাগুলি নিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে নিয়ে যেতে হত। তাঁদের ক্ষুরধার কুটবুদ্ধি সোমেনের দৃঢ়তা ও সরলভাবে সমস্যাগুলি উপস্থিত করার ক্ষমতার কাছে সম্পূর্ণভাবে হার মেনে যেত। তাঁকে কর্তৃপক্ষ ভয়ের চোখে দেখতেন দু’টি কারণে, একটি দৃঢ়তা-সারল্যের জন্য অপরটি তাঁর বয়সের জন্যে। তাদের চোখে একটি বালকের কাছে হার মেনে নেওয়া ছিল খুবই লজ্জার বিষয়”।
ঐ প্রবন্ধে তিনি অন্যত্র লিখেছেন, “তার সারল্য, কোনরকম গর্ব বা গরিমার অভাব এবং মানুষের যে কোন সমস্যাকে অত্যন্ত দরদ দিয়ে দেখার ফলে তার উপস্থিতি এবং দু’একটি কথাই অনেক সমস্যা সমাধানের পথ সুগম করে দিত”।
দাদার মৃত্যুর পরেও এই ইউনিয়ন শ্রমিক সংগ্রামে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই সংগ্রাম থেকে ধরণী রায়, সুকুমার চক্রবর্তীর মত সংগঠক বেরিয়ে এসেছেন। সাধারণ শ্রমিকদের মধ্য থেকে নেতৃত্বে পর্যায়ে উন্নীত হওয়া আজ আর বিশেষ লক্ষ্য করা যায় না। কিন্তু সেই দিনে রেল ইউনিয়নের আবদুল বারী প্রাদেশিক নেতৃত্বে উন্নীত হয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে একটি বিষয় উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ‘৪৬-এ সাধারণ নির্বাচনে এই ইউনিয়ন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেই নির্বাচনে শ্রমিক আসনে তখনকার দিনের প্রখ্যাত সব নেতারা, বঙ্কিম মুখােপাধ্যায় প্রভৃতিরা পরাজিত হন।
রেল শ্রমিক আসনে কংগ্রেস প্রার্থী ছিলেন, সেই সময়কার বিশিষ্ট নেতা হুমায়ুন কবীর। তাঁকে তরুণ ট্রেড ইউনিয়ন নেতা জ্যোতি বসু পরাজিত করে বঙ্গীয় বিধানসভায় নির্বাচিত হন। ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পার্লামেন্টারিয়ানকে তার যাত্রার সূচনার পথটি যাঁরা করে দিয়েছিলেন, বলা বাহুল্য, সোমেন চন্দের ইষ্টবেঙ্গল রেলওয়ে ওয়ার্কস ইউনিয়নের ভূমিকা তাদের মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
আর একটি তথ্য দিয়ে এই অংশ শেষ করি। “প্রতিরোধ” ‘সোমেন স্মৃতি সংখ্যা’ ১৩৫০-এ সরলানন্দ সেন লিখেছেন, শেষে বোধহয় কোথাও কাজে ঢুকেও ছিল। বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্পগুজব করে সময় কাটাতে পারত না সে। এ বিষয়ে তথ্য হচ্ছে, দাদা আর্থিক প্রয়োজনে ‘৪২-এর প্রথম দিকে টিউশনী নিয়েছিলেন। কিন্তু এক বা একাধিক কিনা বা কোথায় তা আমাদের জানা নেই।
সোমেন চন্দের দু’টি জীবনীগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। প্রথমটির লেখক হায়াৎ মামুদ, প্রকাশক বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ। অপরটির লেখক কিরণশংকর সেনগুপ্ত, প্রকাশক পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ। অপরটি লেখক কিরণশংকর সেনগুপ্ত, প্রকাশক পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, মে ১৯৯৭। হায়াৎ মামুদের গ্রন্থ কিরশংকরের বইয়ের প্রায় দশ বছর আগে লেখা। ফলে তথ্যের দিক থেকে হায়াৎ মামুদের গ্রন্থের অনেক অপূর্ণতা ও কিছু কিছু ভুল সংশোধিত হতে পেরেছে।
কিন্তু দুই বাংলার দুই প্রখ্যাত লেখক সোমেন চন্দকে কেন হত্যা করা হল, হত্যাকারীই বা কারা এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোন অনুসন্ধান বা প্রায় আলোচনা না করে পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন। কেবল হায়াৎ মামুদ এক জায়গায় রণেশ দাশগুপ্তর মন্তব্য লিখেছেন (পৃ : ৬৪) – “রেভুলেশনারী সোসালিষ্ট পার্টির লোকেরা মিছিলের উপর আক্রমণ করে এবং নৃশংসভাবে হত্যা করে।
কিরণশংকরের জীবনীগ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সুমিতা চক্রবর্তী মন্তব্য করেছেন, “কে বা করা তাকে মেরেছিল? কে বা কারা ছিল তাদের পিছনে? এ প্রশ্নের উত্তর হায়াৎ মামুদ দেননি, কিরণশংকরও দেননি। কিন্তু জরুরী এ প্রশ্নের উত্তর সন্ধান।”- সাহিত্যচিন্তা, আশ্বিন ১৪০৪।
১৯৪১-এ ২২শে জুন হিটলারে সোভিয়েট ইউনিয়ন আক্রমণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এক নব অধ্যায়, নতুন চরিত্র ধারণ করে।
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, প্রমথ চৌধুরী, যামিনী রায় প্রভৃতিরা এক আবেদনে, সোভিয়েট ইউনিয়নকে সর্বপ্রকার সাহায্যে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানান।
২১শে জুলাই ১৯৪১ কলকাতায় গঠিত হয় “সোভিয়েট সুহৃদ সমিতি”। ঢাকাতেও ঐ বছরের শেষের দিকে উক্ত সমিতির শাখা গড়ে ওঠে। যুগ্ম সম্পাদক হন কবি কিরণশংকর সেনগুপ্ত ও ছাত্রনেতা দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। কিরণশংকর, প্রগতি লেখক সংঘের উদ্যোগে গঠিত এই সংগঠন সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, “এই নবগঠিত সংগঠন সোমেন চন্দেরই অবিস্মরণীয় সাংগঠনিক কীর্তি। জীবনী পৃ: ২৯।
ঢাকার সমিতি দেশের অন্য অংশের তুলনায় অনেক দ্রুততার সঙ্গে কাজে অগ্রসর হয়। এ থেকে ঢাকা সমিতির রাজনৈতিক সাংগঠনিক বিচক্ষণতা ও উদ্যোগী নেতৃত্ব লক্ষ্য করার মত।
কিন্তু কমিউনিষ্ট পার্টির সঙ্গে আর এস পি, ফরোয়ার্ড ব্লক প্রভৃতি জাতীয়তাবাদী দলগুলির মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ তীব্ররূপ ধারণ করে। কমিউনিষ্টরা মনে করেন, বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিষ্ট শক্তির পরাজয়ের ফলে, বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহ জোরদার হবে। ফলে, পরাধীন দেশগুলির মুক্তির সংগ্রাম শক্তিশালী হবে এবং তাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম দ্রুত সাফল্য লাভ করবে।
অন্যদিকে, জাতীয়তাবাদী দল-গ্রুপগুলি এই নীতির তীব্র বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়। তারা মনে করে কমিউনিষ্টদের নীতি ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদকে সাহায্য করছে। ফলে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সেই সময় কমিউনিষ্টদের পক্ষে পরিস্থিতি বেশ কঠিন, জটিল। ঢাকায় নেতৃস্থানীয়রা হয় জেলে বা আত্মগোপনে, ইংরেজ সরকারের কমিউনিষ্টদের উপর দমন-পীড়নের নীতি অব্যাহত। অন্যদিকে, জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক শক্তির ‘ওরা বৃটিশের দালাল’ গণ্য করে তীব্র বিরোধিতা।
১৯৪১-৪২ সালের সেই দিনগুলিতে এই দলগুলি, তাদের নেতা ও কর্মীরা কমিউনিষ্ট পার্টি থেকে অনেক বেশি প্রকাশ্য রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালাতে পেরেছেন। স্মরণ করা যেতে পারে বেআইনী কমিউনিষ্ট পার্টির উপর নিষেধাজ্ঞা ১৯৪২-এর জুলাই পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
‘সোভিয়েট সুহৃদ সমিতির’ প্রথম উদ্যোগ, সোভিয়েট রাশিয়ার নতুন সমাজ ও সভ্যতার বহুমুখী অগ্রগতি জনসাধারণের সামনে উপস্থিত করার জন্য এক প্রদর্শনীর আয়োজন। এই প্রদর্শনীকে সফল করার জন্য সাধারণের কাছে এক আবেদন প্রচার করা হয়। তাতে স্বাক্ষর করেন; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপকগণ প্রফেসর সত্যেন বোস, ডক্টর পৃথ্বীশ চক্রবর্তী, কবি জসিমুদ্দিন, মিস ম্যাকাই প্রভৃতিরা।
ব্যাপটিষ্ট মিশন হলে সপ্তাহব্যাপী এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন ড: মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। নাম দেন সোভিয়েট মেলা’! গোপাল হালদার উদ্বোধনী ভাষণ দেন। ঢাকার শিল্পীদের আঁকা চিত্র, সোভিয়েট জীবনের ফটোচিত্র (সে যুগে অনেক কষ্টে সংগৃহীত), ঐ দেশের সম্পর্কে নানা চার্ট ইত্যাদির সমন্বয়কে এই প্রদর্শনী ছিল ঢাকায় একদম নতুন। ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। স্কুল ছুটি দিয়ে শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীরা প্রদর্শনী দেখতে আসতেন। প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার লোক প্রদর্শনী দেখতেন। সমাজের সর্বস্তরের জনসাধারণের কাছে, ছবি, চার্ট ও ফটো ব্যাখ্যা করার কর্মী তেমন ছিল না। সোমেন চন্দ রোজ হাজির। চিত্র সম্পর্কে প্রধান বক্তা। কিরণশংকর লিখেছেন, “সোমন চন্দ ছিলেন চিত্রব্যাখ্যাতাদের পুরোভাগে। দেখা গেল যেখানেই সোমেন ছবি সম্পর্কে কিছু বলছেন, সেখানেই দর্শকরা এসে জড়ো হচ্ছেন, ভীড় বাড়ছে। জীবনী পৃ: ২৯।
জানুয়ারি ১৯৪২-এর প্রদর্শনীর ফলে, ধীরে ধীরে সোভিয়েটের সপক্ষে, ফ্যাসিষ্টদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠতে থাকে। পরে এই প্রদর্শনী ঢাকা জেলার অন্যত্রও করা হয়। প্রদর্শনীর এই বিপুল সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে সোভিয়েট সুহৃদ সমিতি ৮ই মার্চ ১৯৪২ “ঢাকা জিলা ফ্যাসিষ্ট বিরোধী সম্মেলন” আহ্বান করেন। উল্লেখ করা যায় সারা ভারতে ঢাকাতেই এই উদ্যোগ প্রথম নেওয়া হয়।
উগ্র জাতীয়তাবাদীরা, ইংরেজ বিরোধিতার নামে, যারা ফ্যাসিষ্ট শক্তির জয়ের জন্য কাজ করছিলেন, সেই আর এস পি, ফরোয়ার্ড ব্লক ও অন্যান্য কমিউনিষ্ট বিরোধী গ্রুপগুলির কাছে সোভিয়েটের পক্ষে, ফ্যাসিষ্টদের বিরুদ্ধে উপরিউক্ত কার্যকলাপ চক্ষুশূল হয়ে দেখা দেয়।
ঢাকার কমিউনিস্ট নেতা জ্ঞান চক্রবর্তী লিখেছেন, (একতা, মার্চ ১৯৭৩) “তার এবং একদল শিল্পী যুবকের প্রচেষ্টায় এ ব্যাপারে বহু প্রবন্ধ, কবিতা, গান প্রভৃতি রচনা করা হয় এবং একটি সুসজ্জিত পোস্টার প্রদর্শনীর মাধ্যমে জেলার বিভিন্ন জায়গায় প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়। এইসব কাজের মধ্য দিয়ে সোমেন চন্দ ঢাকার প্রগতিশীল সমস্ত আন্দোলনে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। …তাঁর জনপ্রিয়তা শ্রমিকদের কাছে হু হু করে বেড়ে যায়। …বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর জনপ্রিয়তা, কর্মপটুতা ও আকর্ষণীয় ক্ষমতার জন্য তিনি প্রতিপক্ষ আর এস পি, ফরোয়ার্ড ব্লক প্রভৃতি গ্রুপগুলির চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়ান।
সোমেন চন্দ হত্যা প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আর একটি বিষয়ের আলোচনা প্রয়োজন। ২৮শে অক্টোবর, ১৯৮৬ পশ্চিমবঙ্গ সরকার “মুক্তির সংগ্রামে ভারত” বইটি প্রকাশ করেন। তাতে সোমেনকে উপস্থিত করা হয় এইভাবে। “একদিকে যেমন ইংরেজ সরকার স্বভাবতই কমিউনিষ্টদের বিশ্বাস করেনি, নানাভাবে তার বিপক্ষতাই করেছে, অন্যদিকে তেমনি কমিউনিষ্ট বিরোধী প্রতিক্রিয়াপন্থীরা ঐ সময় তাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছিল। যেমন, ঢাকায় তরুণ কমিউনিষ্ট ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ও সুলেখক সোমেন চন্দকে ১৯৪২ সালের ৮ই মার্চ তারা ঐ সময়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এর প্রতিবাদে ২৮শে মার্চ কলকাতায় রামনন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে লেখদের যে সম্মেলন হয় তার থেকে উদ্ভূত হয় ফাসিষ্ট বিরোধী লেখক ও শিল্পী সমিতি”। পৃ: ১৭৪।
আর এস পি-র একটা অংশে এর প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করার মত। ১১ই ফেব্রুয়ারি ১৯৮১ গণবার্তায় এমনভাবে লেখা হয় যে সোমেন চন্দকে উল্লেখ করলে পুলিশের গুলিতে নিহত অখিল দাসকে উল্লেখ করা প্রয়োজন। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ছাত্র সমাজ বইটির সমালোচনার নামে ঐ দিনের ঘটনার বিকৃত, মিথ্যা নানা কাহিনী লেখা হয়। লিখেছেন, “এরপর অখিল দাসের মৃতদেহ নিয়ে বিরাট জনতার মৌন মিছিল তার বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করে। ঠিক সেই সময়ে একটা ছোট মিছিল সোমেন চন্দের নেতৃত্বে এগিয়ে আসছিল ফ্যাসী বিরোধী সম্মেলনে যোগ দিতে। ঐ মিছিলকারীরা ক্রমাগত জাপানী দালাল, পঞ্চম বাহিনীরা ধ্বংস হউক, ধ্বংস হউক – শ্লোগান দিয়ে যাচ্ছিল শব বহনকারী জনতাকে লক্ষ্য করে। এর ফলে জনতার মধ্যে প্রচণ্ড উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সেই সংঘর্ষে সোমেন চন্দ নিহত হন…।” তথাকথিত প্রত্যক্ষদর্শী এই লেখক সোমেন হত্যার দীর্ঘ সাতচল্লিশ বছর পর কল্পিত কাহিনী প্রচারে ব্যস্ত। এই লেখার প্রতিক্রিয়ায় তৎকালীন ঢাকার বিশিষ্ট কমিউনিষ্ট কর্মী গোকুল চক্রবর্তী, “সংবর্তন” বিশেষ সংখ্যায় লিখেছেন, “দাঙ্গা হাঙ্গামা হতে পারে বলে অনুমান করে সাদা পোষাকের পুলিশ বাহিনীর লোকেরাও প্যান্ডেলের বাইরে ঘোরাফেরা করছিল। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের অনুচরেরাও এই সম্মেলনকে স্বাভাবিকভাবেই ভালো চোখে দেখেনি। সাদা পোষাক পরা এক পুলিশের লোককে কমিউনিষ্ট কর্মী ভেবে অখিল দাস তার বুকে ধারালো তলোয়ার চালাতে যান, সাথে সাথে গুলি। পুলিশের গুলিতে নিহত অখিল দাসের দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।” তিনি প্রশ্ন করেছেন, “পুলিশের গুলিতে নিহত অখিল দাসের দেহ ত পুলিশের হেফাজতে! তাকে নিয়ে শোভাযাত্রা হল কিভাবে?”
১৯৮৯-এর আর. এস. পি-র প্রাদেশিক সম্মেলনে বিষয়টি আলোচিত হয় এবং সংবাদপত্রে তাদের বক্তব্য প্রকাশিত হয়। এ সম্পর্কে ১৮ই এপ্রিল ১৯৮৯ গণশক্তি পত্রিকায় সোমেন চন্দের রচনাবলীর সম্পাদক ও সোমেন গবেষক দিলীপ মজুমদার লেখেন, “… নানা তথ্যের ভিত্তিতে সোমেনের হত্যাকারীকে সনাক্ত করতে পেরেছিলাম। …..বীরেনদাকে (বীরেন চট্টোপাধ্যায়) আমি সেকথা বলি। বীরেনদা আমাকে বলেন, সোমেনের হত্যা সম্পর্কে তথ্য না উল্লেখ করাই ভালো। আমি প্রত্যুত্তরে বলি, ইতিহাস রচয়িতাকে নিরপেক্ষ হতেই হবে, অকপট হতে হবে। বীরেনদা তখন তার মধুর হাসি দিয়ে আমাকে নিরস্ত্র করে বলেছিলেন, বৃহৎ সত্যের জন্য ক্ষুদ্র সত্যকে বলি দিতে হয়। বৃহৎ সত্যটা তখনকার যুক্তফ্রন্ট কংগ্রেস বিরোধী শক্তি সমাবেশ, কমিউনিষ্ট দলের সঙ্গে আর. এস. পি. যার অংশীদার ছিল। বীরেনদার মত ধীর মানুষরা বৃহত্তর সত্য ও স্বার্থের জন্য অবলীলায় ক্ষুদ্র সত্য ও স্বার্থকে বলি দিতে জানতেন। সোমেন চন্দকে মনে রেখে একটি আশ্চর্য সুন্দর কবিতাও (যারা চলে যায়, তারা ভাল থাকে) লিখেছিলেন। যুক্তফ্রন্টের স্বার্থে বীরেনদা সেই যুক্তফ্রন্টের এক শরিকের কীর্তি প্রকাশ করতে নিষেধ করেছিলেন।”
দিলীপবাবুর এই বক্তব্যের সঙ্গে আমি যোগ করতে চাই, বীরেনবাবু আরও একটি কবিতা লিখেছিলেন, “সোমেন চন্দ, একটি স্বপ্ন”। প্রথমটির রচনা মে, ১৯৭৩। দ্বিতীয়টি ফেব্রুয়ারি ১৯৮১। আগুনের অক্ষর। পৃ: ২৪৬।
সোমেন গবেষক ও রচনাবলীর সম্পাদকের বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কার তিনি সিদ্ধান্তে এসেছিলেন সোমেন চন্দের হত্যাকারী আর. এস. পি। কিন্তু বীরেনবাবুর অনুরোধে তা নিয়ে আর এগোননি।
আমার বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা শহরের কিছু আর. এস. পি. কর্মী ও সমর্থকের সাথে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। এমনকি দুই-একজন নেতৃস্থানীয় আমাকে যথেষ্ঠ স্নেহ করতেন। এদের ব্যবহারের দরুণ আমার মনে হতো, এরা দাদাকে হত্যার জন্য মর্মাহত, অনুতপ্ত। কিন্তু দীর্ঘ সাতচল্লিশ বছর পর নিজেদের রক্তাক্ত ঘৃণিত হাত ধুয়ে-মুছে ফেলে “মুক্তি সংগ্রামে ভারত” বইয়ে সোমনকে শহীদের মর্যাদা দেওয়ায় ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তুলে, অখিল দাসকেও শহীদের সম্মান দাবী করে প্রাদেশিক সম্মেলনে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। তাদের মুখপত্রে বিকৃত ইতিহাস ও কল্পিত কাহিনী প্রচার করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
আর, এস. পি. নেতৃত্ব দাদাকে হত্যার সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছিল। কিন্তু একলা পেয়ে মেরে ফেলা নয়, তার যেন রাজনৈতিক চরিত্র থাকে। দাদা সারা শহরে সাইকেলে নানা কাজে ঘুরতেন। আর, এস. পি-র ঘাঁটি একরামপুরের কুলুটোলায় তাঁর প্রিয় বন্ধু অমৃতর বাড়ি প্রায় রোজই যেতেন। হত্যার দিনও গিয়েছিলেন। প্রদর্শনী সফল হতেই ওরা একবার চেষ্টা করে। কোর্ট হাউস স্ট্রীটে সেই সময় বে-আইনী কমিউনিষ্ট পার্টির এক প্রকাশ্য কেন্দ্র ছিল। রোজ অফিস খোলা হতো। দাদার সপ্তাহে একদিন ঐ অফিসে বসার কথা। ওরা নজর রেখেছে কি বার সোমেনের ডিউটি। সেই নির্দিষ্ট দিনে ওরা সশস্ত্রভাবে আক্রমণ করতেও আসে। দাদার সেইদিন অন্যত্র জরুরি কাজ থাকায় কালী সূত্রধরকে ভার দিয়ে আসেন। সুতারনগরের কালীদা ঢাকার কমিউনিষ্ট কর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিধর ও দেহ সৌষ্ঠবের অধিকারী ছিলেন। শান্তিনিকেতনে রামকিংকর বেজের যে আদিবাসী যুবকের বলিষ্ঠ মূর্তিটি রয়েছে, তার থেকেও বলিষ্ঠ, কালো কুচকচে কালীদা ঐ যুবকদের আক্রমণে উদ্যত হতে দেখে তীব্র হুংকারে, সামনের টেবিলটি ধাক্কা দিয়ে ওদের উপর ঠেলে দেন এবং প্রতি আক্রমণে উদ্যত হন। নিরিহ গোবেচারা একজনকে আঘাত করতে এসে এক দানবের (?) দাপটে ওরা তখন পালিয়ে বাঁচে। দাদা রাতে বাড়ী এসে বলেন, কালী না হয়ে আমি থাকলে আজ যে কি হতো? এরপর ঐ অফিসে সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।
মা বেশ কিছুদিন থেকে দেশের বাড়ীতে যাওয়ার জন্য বাবাকে রাজী করাতে সচেষ্ট ছিলেন। উদ্দেশ্য, জমির ফসলের আয় সংগ্রহ। ঐ আয় যুক্ত হলে সংসারের অভাব দূর হয়ে যাবে। অবশেষে বাবা, চারমাসের ছুটি নিয়ে, গ্রামে গেলেন। মা-বাবা, আমি ও ছোটবোন গীতা এই চারজন। ঢাকার বাসায় রইলেন দাদা, রুবি ও বীণামাসীমা। অন্ধ বৃদ্ধা ঠাকুরমাকে ততদিনের জন্য জ্যেঠামশায়ের সূতারনগরের বাসায় রাখা হল।
৮ই মার্চ বড়মাসীমার বড় মেয়ে লিলির বিয়ে। নারায়ণগঞ্জ সংলগ্ন ওদের ধামগড়ের বাড়ীতে সম্মেলন, তাই দাদা যেতে পারবে না। রুবি বীণামাসীমা যাবেন। দাদাকে ওঁরা বলেছেন, “একটু তাড়াতাড়ি এসো, তোমাকে খাইয়ে আমরা রওনা হবো”। দশটা-এগারোটা নাগাদ দাদা অমৃতদার বাড়ী যান। অমৃতদা বাসায় ছিলেন না। সম্মেলন মঞ্চ ব্যবস্থাপনায় তার দায়িত্ব ছিল। মাসীমা (অমৃতদার মা) জিজ্ঞেস করেন, “সোমেন এখন তুমি কোথায় যাবে”। জবাব শুনে বলেন, “তাহলে তুমি খেয়ে যাও, রান্না হয়ে গেছে। মাসীমা জোর করে খাইয়ে দেন।
অমৃত দত্ত লিখেছেন (সাহিত্য চিন্তা বৈশাখ, ১৪০৪), “মা ওকে খাইয়ে দেন। সম্মেলনে রেলওয়ে শ্রমিকদের শোভাযাত্রা নিয়ে আসতে হবে বলে আমার জন্য অপেক্ষা না করে রেলওয়ে কোয়ার্টারের উদ্দেশ্যে চলে যায়। এই কথোপকথনের সময় পাশের বারান্দায় হত্যাকারীদের একজন নায়ক বসে ছিল। সব শুনেছে ও।
বীণামাসীমা বলেছেন, “সোমেন দেড়টা নাগাদ ফিরেলো। মাছ ছিল না, তবু ঘি-তরকারী দিয়ে ভালোই খেলো”। নীতীশ বিশ্বাসের রচনা থেকে এই উদ্ধৃতি, ‘উবুদশ শহীদ সোমেন চন্দ বিশেষ সংখ্যা।’ ঐ রচনায় নীতীশবাবুর কাছে স্মৃতি চারণায় বীণামাসীমা বলেছেন, “ঠাকুরমাও আমাদের বাসায় ছিলেন। রাতে অনেকগুলো দরমা এনে সোমেন ঘরে ঢোকায়, উদ্দেশ্য- পরের দিন মিছিলে প্ল্যাকার্ড করা হবে। ঠাকুরমা বলে, এগুলো দিয়ে কী করবি – শম্ভু উত্তর দ্যায়- তোমাকে নিয়ে আলাদা ঘর বাঁধবো।” বীণামাসীমার এই তথ্যে কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। দীর্ঘদিন বাদে এটা হতে পারে। দাদার সঙ্গে এই রসালাপ অন্য কোন সময় হয়ে থাকবে। আর, আগেই বলেছি ঠাকুরমাকে জ্যেঠামশায়ের ওখানে রেখে আমরা গ্রামে যাই। কারণ, রুবি-বীণামাসী যাবেন স্কুলে। দাদা তার নিজের কাজ নিয়ে। অন্ধ এই বৃদ্ধাকে তখন দেখবে কে? তাছাড়া, দাদার হত্যার সংবাদ পেয়ে বাবা মঙ্গলবার ঢাকায় আসেন। তিনি লিখেছেন, … “আমি আমার বৃদ্ধা অন্ধ শয্যাশায়িনী মাকে দেখিবার জন্য আমার দাদার বাসার দিকে রওনা হইলাম”। রেলওয়ে কোয়ার্টার হয়ে তিনি চলে যান বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে সম্পর্কে তৎকালীন ছাত্র, পরবর্তী জীবনে অধ্যাপক বিভূতি দাশগুপ্ত লিখেছেন, “সোমেন চন্দের সঙ্গে আমার পরিচয় অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে ঘটে এবং তার পরবর্তী ঘটনা, সেই মুহূর্তটা আমার জীবনে একটি স্মরণীয় ঘটনা। আমার সঙ্গে থাকত (ঢাকা হোষ্টেলে – লেখক) সুশীল দাস, ইংরেজিতে এম, এ পড়ত। লেবরেটারি থেকে ঘরে ফিরে দেখি সুশীলের কাছে বসে আছে উজ্জ্বল প্রতিভাদীপ্ত চেহারার ছেলে। সেই চেহারা আমার চোখে চিরন্তন হয়ে আছে। আমি অবাক দৃষ্টিতে দেখছিলাম। সুশীল বলল, এই ছেলেটিই সোমেন চন্দ, রেল ইউনিয়নের নেতা। সুশীলও রেল ইউনিয়ন করত জানতাম। বললাম, ওর লেখক পরিচিত আমার জানা।”
দাদার আর এক বন্ধু, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকর্মী সোমেন হোড় লিখেছেন, (প্রতিরোধ, সোমেন স্মৃতি সংখ্যা ১৩৫০)….“সাইকেল ষ্টেশনের দিকে যাচ্ছি, সোমেন অল্প কয়েকজন শ্রমিক নিয়ে ইউনিয়ন অফিসে বসে আছে। শুনলাম, মিছিল চলে গেছে (কলকাতার নেতাদের নিয়ে সম্মেলনের উদ্দেশ্যে -লেখক), আমি বললাম, মিছিল চলে গেছে -তুমি এখানে বসে কেন? চলো যাই। সোমেন বলল আরো একটু অপেক্ষা করবো সবাই এসে পৌঁছাননি। সেই সোমেনের সঙ্গে শেষ দেখা-মনে হয় আমিই সবার শেষে দেখেছিলাম”।
সোমেন হত্যার আগে পর্যন্ত এইটুকু তথ্য পাওয়া যায়। এবার সম্মেলন স্থলের পরিস্থিতি ও হত্যা নিয়ে কিছু তথ্য ও নানা জনের বক্তব্য অবতারণা করা যাক।
প্রতিরোধ কাগজে (১৫ই জৈষ্ঠ ১৩৯৪) সরলানন্দ সেন (যিনি দাদার বন্ধু পরবর্তীকালে ঢাকার বিখ্যাত সাংবাদিক ও শেষে যুগান্তরের সাব-এডিটর হয়েছিলেন) লিখেছেন, … “একজনের কাছে বত্রিশখানি শ্রমিক টিকিট বিক্রয় করিলাম। এবং পরক্ষণেই সেই লোকই আরো বত্রিশখানি টিকিট লইল। বোধকরি সেই টিকিটগুলিরই সাহায্য লইয়া এক নাতিক্ষুদ্র দল প্যান্ডেলের ভিতর প্রবেশ করে। তাহাদের হাবভাব দেখিয়া এবং বিশেষ করিয়া তাহাদের মুখে ফ্যাসীবাদী ধ্বনি শুনিয়া স্বেচ্ছাসেবকরা গোলমালের সম্ভাবনা দেখিয়া তাহাদের রাজপথে বাহির করিয়া দেন। ইহা সূত্রপাত মাত্র। অনতিবিলম্বেই দেখা গেল, একদল ভদ্রবেশী বিক্ষোভকারী প্যান্ডেলের দিকে অগ্রসর হইতেছে। দৃষ্টি তাহাদের হিংস্র তাহাদের সঙ্গে হকিষ্টিক, লোহার ডান্ডা এবং ছোরা। তাহাদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে কোন সন্দেহেরই যখন আর কোন অবকাশ রহিল না, তখন শান্তিপ্রিয় ফ্যাসী-বিরোধী সভাকে বিশৃঙ্খলার হাত হইতে রক্ষা করিবার সংকল্প লইয়া সম্মেলনের অপ্র্রস্তুত স্বেচ্ছাসেবকরা লৌহাস্ত্রের বিরুদ্ধে নগণ্য ইট এবং লাকড়ী লইয়া বিক্ষোভকারীদের প্রতিরোধ করিতে অগ্রসর হইলেন। একটা সংঘর্ষ বাধিয়া গেল। ইতিমধ্যে কয়েকজন পুলিশ কর্মচারী আসিয়া পড়ায় স্বেচ্ছাসেবকরা শান্তিরক্ষার ব্যাপারে তাহাদের আর কোন দায়িত্ব নাই বুঝিয়া ফিরিয়া আসেন। টিকিট বিক্রি বন্ধ করিয়া আমিও সভামণ্ডপে ঢুকলাম। কিন্তু সেখান হইতেই চাঞ্চল্যকর সংবাদ পাইলাম যে আততায়ী পুলিশের বাধা অগ্রাহ্য করিয়াই প্যান্ডেলের দিকে অগ্রসর হইতেছিল। পুলিশের আমলাতান্ত্রিক রক্ত ঐ ঔদ্ধত্য সহ্য করিতে পারে না, রিভলভার টিপিয়া তাহার যে বুলেট নিক্ষেপ করিয়াছে তাহাতে একজন আততায়ীর জীবনান্ত ঘটিয়াছে এবং তাহার সঙ্গীরা শবদেহ লইয়া দূরে সরিয়া গিয়াছে”।
সোভিয়েট সুহৃদ সমিতির অন্যতম সম্পাদক ছাত্রনেতা দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন (সাহিত্যচিন্তা, বৈশাখে ১৪০৪)।
“হঠাৎ দেখা গেল মাঠের গেটের দিকে রাস্তায় ছোটাছুটি, গোলমাল ধ্বস্তাধ্বস্তি। শোনা গেল দলবদ্ধভাবে কিছু দুষ্ট লোক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সভায় ঢুকতে চায়। তাদের দুরভিসন্ধি টের পেয়ে বিনয় বোসের নেতৃত্বে ভলান্টিয়ারগণ ছুটে যায় গেটে তাদের বাধা দিতে। তারপর মারপিট লেগে যায়। খানিকক্ষণের মধ্যে কমরেড বিনয় বোস ভিতরে ঢোকেন, তাঁর মাথায় দারুণ রক্তাক্ত আঘাত।
মাইকে তখন ছাত্র নেতা অজিত রায় দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করলেন, বন্ধুগণ, শত্রুপক্ষ আমাদের আক্রমণ করে সভা পণ্ড করতে উদ্যত। আমরা নিজ শক্তিতে তাদের প্রতিরোধ করতে দৃঢ়সঙ্কল্প, কিন্তু কোন অবস্থাতেই পুলিশের কোন সাহায্য আমরা চাই না। তাদের হস্তক্ষেপে বাধা দেব। গেটের বাইরে রাস্তায় মারামারি, প্যান্ডেলে ছোটাছুটি দীর্ঘসময় ধরে চলতে লাগল।
৮ই মার্চের ঘটনাবলী নিয়ে এর আগে গোকুল চক্রবর্তীর রচনা থেকে উল্লেখ করেছি। এখন সরলানন্দ সেন ও দেবপ্রসাদের রচনা থেকে উপস্থিত করলাম। তথ্যের দিক থেকে কিছু পরস্পর বিরোধী বক্তব্য দেখা যাচ্ছে। কিন্তু একটা সত্য পরিষ্কার। সম্মেলন বানচাল করার জন্য সশস্ত্রভাবে আক্রমণ করা হয়েছে এবং সেখানে ব্যর্থ হয়ে, সরে যেতে বাধ্য হয়ে এরা গিয়ে সোমেন চন্দকে হত্যা করেছে।
এ ছাড়া গোকুল চক্রবর্তীর লেখা সম্পর্কে কিরণশংকর লিখেছেন, (“সংবর্তন” প্রাক্ কথন) কীভাবে ১৯৪২-এর ৮ই মার্চ সোমেনের মৃত্যু ঘটেছিল সে বিষয়ে অনেকেই জিজ্ঞাসা করে থাকেন। গোকুল চক্রবর্তী রাজনৈতিক জীবনে সোমেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হওয়ায় ৮ই মার্চ ও পরবর্তী কয়েকদিনের ঘটনার খুঁটিনাটি বিবরণ তাঁর জানা থাকায় রচনাটি পাঠ করে সোমেনের মৃত্যু সম্পর্কে নানা ভুলভ্রান্তির অবসান ঘটবে”।
সোমেনকে হত্যা করতে দেখেছেন এমন একজনের মাত্র মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে। তিনি নিহত অখিল দাসের দাদা শিক্ষক পূর্ণচন্দ্র দাস। তিনি ঘটনার মাসখানেক বাদে একদা তার ছাত্র দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে বলেন, “অখিল দাস আমার ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে তার মৃত্যুতে আমি মর্মাহত। কিন্তু সোমেন চন্দকে সেদিন যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তা আমার সহ্যাতীত। আমার বাড়ির জানালা দিয়ে কি বর্বরের মত তাকে হত্যা করা হয় তা আমি নিজের চক্ষে দেখেছি। শাবল দিয়ে দু‘চোখ কিভাবে ওরা তুলে নেয়, মাথায় লোহার ডান্ডা মারে, পেটে ছুরি চালায় সে দৃশ্য ভোলবার নয়। আমি জানালা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকি। এমন মর্মান্তিক হত্যা সহ্যের অতীত। এক ফোঁটা জল তার মৃত্যুর সময় দিতে কেউ এগিয়ে যায়নি”। এই উদ্ধৃতি সাহিত্য চিন্তা, বৈশাখ ১৪০৪ দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের থেকে দিলাম।
স্নেহাংশু আচার্য লিখেছেন, (সংশপ্তক, ২৫শে জুন ১৯৭৭) গোয়ালন্দ থেকে জাহাজে করে যখন নারায়ণগঞ্জে পৌঁছিলাম তখন দেখি সোমেন চন্দের নেতৃত্বে সমস্ত ট্রেনটা লাল পতাকায় সুসজ্জিত হয়ে যেন আমাদের ঢাকায় নিয়ে যাবার জন্যই নারায়ণগঞ্জে অপেক্ষা করছে।…সাধন গুপ্তের বাড়িতে একটু বিশ্রাম নিয়ে সম্মেলনের দিকে রওনা হলাম।
জ্যোতি, সুরেনবাবু ও আমি যখন প্রায় সভাস্থলের কাছে এসেছি তখন একদল ফ্যাসিস্ট দুর্বৃত্ত লাঠি, লোহার রড, ছুরি, বল্লম ইত্যাদি মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেই সময় সোমেন চন্দও রেল শ্রমিক মিছিলের পুরোভাগে আমাদের পিছনে এসে গেছে। এই দুবৃত্তরা বহিরাগত আমাদের তিনজনের কাউকেই চিনতে পারেনি। তাই আমার মাথায় রডের একটা বাড়ি মেরে (সেটা আমি রুখে দিয়েছিলাম এবং আঘাত খুব সামান্য হয়েছিল) দৌড়ে গিয়ে সোমেন চন্দকে ছুরি মারে। এই ঘটনা এতই অতর্কিত এবং এতই অপ্রত্যাশিত ছিল যে এর প্রতিবিধানের কোন ব্যবস্থাই ছিল না”।
কবি বুদ্ধদেব বসু ঢাকার লোক। প্রতি বছর দুই একবার ঢাকায় যেতেন এবং গেলেই প্রগতি লেখক সংঘের সভায় গিয়ে তরুণদের উৎসাহিত করতেন। ঢাকা শহরের সাংস্কৃতিক জগতের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে জানতেন। তিনি লিখেছেন, (কবিতা আষাঢ় ১৩৪৯)।
“ঢাকার তরুণ সাহিত্যিক সোমেন চন্দের হত্যার সংবাদে বাংলার মনীষী মহলে যে উত্তেজনা প্রকাশ পেয়েছে তা একান্তই সঙ্গত। সংবাদপত্রের থেকে বোঝা যায় যে এ হত্যাকান্ডের পিছনে পুর্ব সংকল্প ছিল এবং এর নিছক নৃশংসতাও অকথ্য”।
অশোক মিত্র ঢাকায় বড় হয়েছেন। শহরের রাজনৈতিক পরিবেশ, গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় সবটা জানেন। তিনি লিখেছেন, (আগুনের অক্ষর : সোমেন স্মারকগ্রন্থ পৃ: ৩৭০)
“সোমেন চন্দকে হত্যা করেছিল, ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা মাফিকই করেছিল”। অধ্যাপক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, (স্মারকগ্রন্থ পৃ: ২৭) “অল্প বয়সে তাঁর লেখক খ্যাতি গোচর যখন হতে থাকছে তখনই হঠাৎ (অবশ্য একেবারে অকস্মাৎ হয়তো নয়, শত্রুর সুপরিকল্পিত চক্রান্তের ফলেই) ১৯৪২ সালের ৮ই মার্চ ঢাকার রাজপথে বীভৎস আক্রমণে নিভিয়ে দেওয়া হল এক নিষ্কলুষ তরুণ প্রতিভার জীবনদ্বীপ”।
সোমেনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন অমৃত কুমার দত্ত। কুলুটোলর দত্ত পরিবার ঐ তল্লাটে সুপরিচিত। বাবা প্রখ্যাত শিক্ষক, পিসিমাও। কাকা ঢাকার খ্যাতনামা ব্যায়ামবীর হরিদাস (সুধীর ) দত্ত। সোমেন হত্যাকারী বালক সমিতির প্রায় সকলে তার কাছে ব্যায়ামচর্চা করত। তিনি আগের দিনই জানতেন, দাদাকে টার্গেট করা হয়েছে। সম্মেলনেও গন্ডগোল হবে।
এ সম্পর্কে অমৃত দত্ত লিখেছেন, (সাহিত্য চিন্তা, বৈশাখ ১৪০৪) “আমার সবচেয়ে আফশোষ, আজও তা আমাকে পীড়িত করে, সেটা হচ্ছে ঘটনার আগের দিন আমার কাকা বিখ্যাত ব্যায়ামবীর সুধীর দত্ত বলে দিয়েছিলেন কাল গোলমাল হবে। সাবধানে থাকতে। সোমেন যেন একরামপুর দিয়ে কোন শোভাযাত্রা নিয়ে না আসে। প্রথমত আমি এ সংবাদে বিশেষ গুরুত্ব দেই নি। তাছাড়া সোমেন তো রোজই এ রাস্তায় যাতায়াত করে, অনেকের চেনা। দেখা হলেও হয়ত বলতাম। কিন্তু এরপর আর দেখাও হয়নি, তাই সতর্কও করা হয়নি। “আক্রমণকারীদের অনেকে তাঁর চেনা মুখ। আমাদের কুলুটোলার বাসায় তার নিয়মিত যাতায়াতের দরুণ এটা খুবই স্বাভাবিক ছিল। তাই দ্রুত তাঁর হত্যা সুনিশ্চিত করতে অনেকে একসঙ্গে তাকে আঘাত করেছে”।
অনেকের কথা লিখলাম। এর মধ্যে সুধীর দত্তর সতর্কবার্তাই প্রমাণ করে আর. এস. পি.-র সমর্থক বালক সমিতি, ফ্যাসীবিরোধী সম্মেলন বানচাল করার জন্য সশস্ত্র আক্রমণ সংগঠিত করেছে এবং “টার্গেট নম্বর ওয়ান” সোমেন একরামপুর দিয়ে শোভাযাত্রা করে এলে হত্যার নির্দেশ কার্যকরী করা হবে।
আদু গোসাই ও মাখন মিশ্র পরিচালিত বালক সমিতির সভ্যরা ১৯৪১ এপ্রিলে ঢাকায় হিন্দুমুসলমান দাঙ্গায় কুলুটোলা-গেন্ডারিয়ার খালপাড়ের (পরে এই খাল বুজিয়ে ফেলা হয়েছে) দরিদ্র মুসলমানদের ঘর পুড়িয়ে, লুট করে এবং কাউকে কাউকে হত্যা করে হাত পাকিয়েছে। এলাকায় বীরের মতন তাদের চলন-বলন, সরব অবস্থিতি। অভিজ্ঞ মাত্রেই জানেন, একবার গুন্ডামীতে হাত পাকালে তাদের আরো এ্যাকশনের জন্য হাত নিস-পিস করে। এদের দলে ধরে রাখতে হলেও ঐ জাতীয় কাজ দিতে হয়। আর. এস. পি. যদি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না হবে তবে সোমেন চন্দের হত্যাকে নিন্দা না করে হত্যাকারীদের পক্ষে নানা অজুহাত, কারণ উপস্থিত করার হাস্যকর প্রয়াস কেন? যে হত্যায় অখিল দাসের দাদাও গভীরভাবে মর্মাহত।
ইতিহাস বড় নির্মম! কে বৃটিশ দালালকে হত্যা করে তারা পুলকিত, সেই ইংরেজ সরকার কিন্তু সেই সময় কমিউনিষ্ট পার্টিকে বে-আইনী করে রেখে, নেতাদের জেলে রেখে বা আত্মগোপনে বাধ্য করে দমননীতি চালিয়ে যাচ্ছিল। আর. এস. পি.-র নেতা-কর্মীদের সেদিন কিন্তু বিদেশী সরকারের দমনের তেমন মোকাবিলা করতে হয়নি। এই প্রসঙ্গে এটা উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না কে, সোমেন চন্দের হত্যাকারী কারা সেদিন ঢাকা শহরের সকলেরই জানা। কিন্তু ইংরেজ সরকার বা তার পুলিশ এই হত্যা নিয়ে কোন কেস ফাইল করেনি বা কাউকে স্পর্শ করা হয়নি। সোমেন চন্দ হত্যার পর তাঁর সহকর্মীরা ভীত না হয়ে আরো দৃঢ়তার সঙ্গে সক্রিয় হলেন, প্রতিরোধে অগ্রসর হলেন। প্রকাশ করলেন পাক্ষিক পত্র প্রতিরোধ। আর এস পি শঙ্কিত হয়ে আবার আঘাত হানলো। রাজনৈতিক প্রচার সংগঠন নয়। ভয় দেখিয়ে, হত্যা করেন প্রতিপক্ষকে প্রতিরোধের সহজ পথ তখন তাদের একমাত্র অবলম্বন।
সোমেনকে হত্যার সময় কষ্টকর হলেও ঘটনা পরম্পরায় নানা তৈরি কাহিনীর আশ্রয় নেয়া খানিকটা সম্ভব হয়েছিলো। এবার সেই জাতীয় কৈফিয়তেরও আর সুযোগ পাওয়া গেল না।
রণেশ দাশগুপ্ত, দাদা থেকে নয় বছরের বড়। লেখক সংঘের সবচেয়ে পরিণত ব্যক্তিত্ব। যাঁর তাত্তি¡ক ও সাংগঠনিক নেতৃত্ব সংঘে প্রতিষ্ঠিত। পরবর্তীকালে বাংলাদেশে সর্বজন স্বীকৃত অন্যতম শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী, মার্কসীয় নন্দনতত্ত্বের শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা। ঐ সময় ঢাকা ব্যাঙ্ক ইনসোরেন্স কর্মীদের এ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক।
সোমেন হত্যার পর এবার টার্গেট রণেশ দাশগুপ্ত। তিনিও ব্যক্তিজীবনে দাদার মত নির্বিরোধী, শত্রুহীন বলে বিবেচিত হতেন। ২৪শে জুলাই ১৯৪৩, তাঁতিবাজারে তার বাসার কাছে, ভোজালী দিয়ে তাকে মাথায় কোপ মারা হল। উদ্দেশ্য মাথা দু’ভাগ করে হত্যা সুনিশ্চিত করা। রণেশদা বেশ লম্বা, আর আক্রমণকারী বেঁটে। অন্ধকারে (তখন যুদ্ধের জন্য ব্ল্যাকআউট) তাদের মনে হয়েছে, অপারেশন সাকসেসফুল। কিন্তু আক্রমণকারী বেঁটে হওয়ায়, লাফ দিয়ে মাথার মাঝখানে আঘাত করতে ব্যর্থ হয়, পাশে লাগে। তা সত্তে¡ও আঘাত ছিল গুরুতর। দীর্ঘদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে রণেশ দাশগুপ্ত বেঁচে যান। উয়ারীর যুবককর্মী, কচি নাগকে হত্যা ও অন্যান্য কয়েকজন কমিউনিষ্ট কর্মীকে আক্রমণের পর দাদাকে হত্যা। কিন্তু কমিউনিষ্ট পার্টির নির্দেশ : প্রতিরোধ করো, প্রতি আক্রমণ নয়। কিন্তু রণেশ দাশগুপ্তকে আক্রমণের পর কর্মীদের আর নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হল না। রণেশদার আক্রমণকারীদের একজনকে পাল্টা আঘাত করা হলো। এতে ফল হলো। এরপর অনেককাল আর. এস. পি. থেকে কমিউনিষ্টদের হত্যার উদ্দেশ্যে আর কোনো আক্রমণ ঘটেনি।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। আর. এস. পি. আজ দেশের অন্যতম বামপন্থী শক্তি, বামফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত। মার্কসবাদ তাদের আদর্শ, মার্কসবাদ সমালোচনা আত্মসমালোচনাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, প্রয়োজনীয় বিষয় বলে গণ্য করে থাকে। তাই সোমেন চন্দকে হত্যা নিয়ে তারা কল্পিত, অলীক, অযৌক্তিক কাহিনীর জাবরকাটা ছেড়ে প্রকৃত সত্যকে স্বীকার করে চলুন। উগ্র জাতীয়তাবাদ সর্বত্র, সবদেশে স্বদেশপ্রেমের নামে ভ্রান্তপথে পদচারণা করে। জনগণকে বিপর্যয়ের পথে নিয়ে যায়। ফলে, প্রকৃতপক্ষে তারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের মিত্র স্বদেশীয় একচেটিয়া শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের সেবাদাসে পরিণত হয়।
বর্তমান বিশ্ব আজ গভীর সংকটের সম্মুখীন। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ একচেটিয়া ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে। তাই তাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদীদের লালসা আজ বল্গাহীন। তারা তাদের লুণ্ঠনের প্রয়োজনে সব ধরনের উপায় অবলম্বন করেছে। কোথাও প্রত্যক্ষ শক্তি প্রয়োগ, অন্যত্র অর্থনৈতিক দাসত্বের নাগপাশে বাঁধার কার্যক্রম।
সম্প্রতি ইরাক ও যুগোস্লাভাকিয়ায় সাম্রাজ্যবাদীদের সামরিক অভিযান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্যাসিষ্ট শক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ইরাককে সামরিক শক্তি দিয়ে পদানত করতে না পেরে তারা অর্থনৈতিক অবরোধ করেছে। ঐ দেশের শিশুরা, মানুষজন খাদ্য ও ঔষধের অভাবে মারা যাচ্ছেন।
কিউবায় মার্কিনী অবরোধ বহু বছর চলছে। এমনকি মার্কিন গোয়েন্দা দপ্তর ঐ দেশের নায়ক ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যার জন্য বহুবার চেষ্টা করেছে। আমাদের দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি ও প্রচার মাধ্যমের কাছে এই ঘৃণ্য মানব শত্রুরাই নাকি গণতান্ত্রিক! নির্ভরযোগ্য মিত্র!
ভারতকে লুটের জন্যই ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীরা এদেশে তাদের শাসন কায়েম করেছিল। এবং এই শাসন বজায় রাখতে এমন কোনো অপকর্ম নেই যে তারা করেনি। দেশ স্বাধীন করার জন্য হাজার হাজার লোক তাদের জীবনদান করেছেন। লক্ষ লোক নির্যাতন ভোগ করেছেন। দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু বিশ্বায়ন ও অবাধ বাণিজ্যের নামে ভারত আজ সাম্রাজ্যবাদীদের লুণ্ঠনের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। আর এই লুণ্ঠনের অংশীদার হয়েছে এদেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিশ্রেণী। একদিকে, বিশ্বায়ন ও অবাধ বাণিজ্যের নামে দেশের অর্থনীতিতে লঙ্কাকাণ্ড ঘটে চলেছে। তখন শাসকশ্রেণীর একটি প্রধান অংশ হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠার নামে মুসলীম ও খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে দেশের ঐক্য ও সংহতি বিপন্ন করে তুলছে। এইসব অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে সোমেন চন্দের জীবন, আত্মত্যাগ ও সাহিত্য প্রগতিশীল শক্তিকে প্রেরণা দিতে পারে।
ফাল্গুন মাস এলে আমাদের পরিবারের সকলের মন বেদনার্ত হয়ে যায়। এটাতো স্বাভাবিক। বসন্তে পাতা ঝরে যায়, আবার নতুন পাতা এসে তার জায়গা নেয়। পার্কসার্কাস ময়দানে রোজ সকালে হাঁটতে গিয়ে দেখি, গাছ থেকে ঝরে গভীর লাল পলাশ ফুল নীচে ছড়িয়ে রয়েছে। তখন একরামপুরের কদমগাছ তলায় দাদার রক্তঝরার দৃশ্য, ইত্যার কথা মনে পড়ে। মন বেদনার্ত হয়ে যায়। এও তো জানি, ঐ পলাশ গাছটি আগামী বসন্তে আরো এক বছরের বড় হবে, আরো বেশি আচ্ছাদিত হয়ে গভীর লালের শোভা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করবে।
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিহত লেখক র্যালফ ফক্স ও কডওয়েল সোমেন চন্দের সাহিত্য ও সংগ্রামী জীবনের আদর্শ ছিলেন। ভারতে ফ্যাসিষ্ট শক্তির বিরুদ্ধে, আন্তর্জাতিক জনযুদ্ধের জন্যে লড়তে গিয়ে সোমেন নিজের প্রাণ দিলেন। ঐ বীর শহীদদের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দিলেন ভারতের প্রথম লেখক শহীদ। এ আত্মত্যাগের জন্য তিনি যেন প্র্রস্তুতই ছিলেন। তাই, ‘শুভদিনের সংবাদ শোন’ কবিতায় তিনি লিখেছিলেন?
এই বীর শহীদেরা স্পেনকে রাঙিয়ে দিলো,
সবুজ জলপাই বন হলো লাল,
মা-র বুক হলো খালি-
তবু বলি, সামনে আসছে শুভদিন।
চলো, ওদের রক্তের পরশ নিতে,
ঐ রক্ত দিয়ে লিখে যাই
শুভদিনের সঙ্গীত।
লেখক: কল্যাণ চন্দ, শহীদের ছোট ভাই
পোর্টেট শিল্পী: মাশুক হেলাল, প্রথম আলোর সৌজন্যে
কৃতজ্ঞ: সোমেন চন্দ চর্চা কেন্দ্র