বুধবার, ১২ জুন, ২০১৯, প্রদর্শনীর শেষ দিনে সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার প্রযোজিত নাটক “স্তালিন” এর বিষয়বস্তুতে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ তুলে দ্বিতীয়দিনের মত বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে নাট্য ও সাংস্কৃতিককর্মী, বামপন্থি রাজনৈতিক ও ছাত্রকর্মীরা।
বুধবার নাটক প্রদর্শনের তৃতীয়দিনে বিকেল ৫টার দিকে নাট্যশালার টিকিট কাউন্টারের সামনে বিক্ষোভকারীদের অবস্থান গ্রহণ করতে দেখা যায়। এক পর্যায়ে এ সমাবেশে নেতৃস্থানীয় কয়েকজন বক্তব্য দেন। তারা পরিচালক কামালউদ্দিন নিলুকে ইতিহাস বিকৃতির, সমাজতন্ত্র ও স্ট্যালিন বিরোধী অপপ্রচারের দায়ে অভিযুক্ত করেন। প্রদর্শনীর দ্বিতীয়দিনে হল লবিতে দর্শকদের প্রতিবাদকালে কামাল উদ্দিন নিলুর অশোভন আচরণেরও প্রতিবাদ জানান।

“স্তালিন” নাটকের ব্যানার
সমাবেশে বক্তারা বলেন, ‘নাটকটিতে ব্যাপক তথ্যগত ইতিহাস বিকৃতির পাশাপাশি স্ট্যালিন এবং তৎকালীন কমিউনিষ্ট পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্যদের মদ্যপ, ভাঁড় ও যৌন বিকৃত মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে যা সত্যের চূড়ান্ত অপলাপ’।
‘নাটকের যে পোস্টার ছাপা হয়েছে সেখানে মার্কস, লেনিন, স্ট্যালিন, মাও সে তুং এর মাথায় জন্মদিনের টুপি পড়িয়ে বিকৃতি ঘটানো হয়েছে; বলে অভিযোগ করেন বক্তারা। তারা বলেন, ‘নাটকে শুধু স্ট্যালিন নয় মার্কস এবং লেনিনকেও হেয় করা হয়েছে’।
নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘যে স্ট্যালিন গোটা মানবজাতিকে হিটলারের ফ্যাসিষ্ট নাৎসী বর্বরতার হাত থেকে রক্ষা করেছেন, যে সোভিয়েট ইউনিয়ন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অকুণ্ঠ সমর্থনই শুধু দেয়নি, অস্ত্র-অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছে, এমনকি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যখন ৭ম নৌবহর পাঠিয়ে আমাদের স্বাধীনতা লড়াইকে মাঝপথে থামিয়ে দিতে চেয়েছিল তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সময়োচিত পদক্ষেপে মার্কিন নৌবহর ফিরে গেছিল মাঝ পথ থেকে, সেই স্বাধীন দেশে সোভিয়েত ইউনিয়ন, সমাজতন্ত্র এবং স্ট্যালিনসহ সোভিয়েত নেতাদের অসম্মানিত করে নাটক প্রদর্শিত হচ্ছে কাদের প্ররোচনায় তা ভেবে দেখতে হবে।’
সমাবেশে উল্লেখযোগ্যদের মাঝে বক্তব্য রাখেন বজলুর রশীদ ফিরোজ, ফয়জুল হাকিম লালা, রাজেকুজ্জামান রতন, মানস নন্দী, হামিদুল হক, জহিরুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম, সৈয়দ আবুল কালাম, মফিজুর রহমান লাল্টু, জাফর হোসেন, আকবর আলী, শফি রহমান, সীমা দত্ত, শম্পা বসু, প্রমুখ।

বিক্ষোভ সমাবেশের একাংশ
কামালউদ্দিন নীলু পরিচালিত বিতর্কিত “স্তালিন” নাটক সম্পর্কে বাঙালীয়ানার প্রতিবেদক প্রশ্ন করেছিলেন প্রথম প্রদর্শনীর দর্শক নাট্যজন রামেন্দু মজুমদারকে, তিনি বলেন, ‘এটা ক্যাপিটালিষ্টদের অর্থায়নে কমিউনিস্টদের হেয় প্রতিপন্ন করবার জন্যে উদ্দেশ্য প্রণোদিত প্রোডাকশন তা বোঝাই যায়।’ তিনি বলেন, ‘নীলুর প্রোডাকশনের মান সব সময়ই খুব ভাল, কিন্তু ও কেন এই বিষয়কে বেছে নিয়ে এখন এই নাটক করলো সেটাই প্রশ্ন’।
দ্বিতীয়দিনে দর্শক হিসেবে নাটক দেখতে এসেছিলেন নাট্যজন মামুনুর রশিদ। বিরতির সময় তিনি হল ত্যাগ করেন। পরে টেলিফোনে প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি বিরতির সময় ক্ষিপ্ত হয়ে বের হয়ে চলে এসেছি।’ তিনি বলেন, ‘পলিটিক্যালি এত রং (wrong) নাটক আমি ইউরোপ আমেরিকাতেও দেখিনি।’
দ্বিতীয়দিনে আরেক দর্শক নাট্যকার মান্নান হিরা যিনি বিক্ষোভের সময় হল এবং লবিতে উপস্থিত ছিলেন, হঠাৎ এই সময়ে স্ট্যালিনকে নিয়ে এই নাটক উপস্থাপনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, ‘প্রতিটি মানুষের ভাল আর মন্দ দিক থাকে, কিন্তু স্ট্যালিনের কি কিছুই ভাল ছিল না? এই লোকটি কি সারা জীবন মদ আর মানুষ হত্যাতেই নিয়োজিত ছিল? স্ট্যালিন ছাড়া কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পৃথিবী রক্ষা পেত? সে কথাটি একটি বার আসলো না কোথাও! সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কেও কিছুই বলেননি তিনি, কেন?’ নাটকের শেষ দৃশ্য নিয়ে মান্নান হিরা বলেন, কামালউদ্দিন নীলু না ধর্ম বুঝলেন না শ্রেণীসংগ্রাম বুঝলেন।’
প্রদর্শনীর দ্বিতীয়দিনে ক্ষুব্ধ দর্শকদের প্রতিক্রিয়া:
“স্তালিন” নাটকের পরিচালকের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে এবং টেক্সট পাঠিয়েও কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় নাট্যশালা মঞ্চে সোমবার, ১০ জুন, ২০১৯ থেকে তিনদিনব্যাপী সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা যোসেফ স্ট্যালিনের জীবনভিত্তিক নাটক “স্তালিন” মঞ্চস্থ হয়। প্রথম দিন মূলত আমন্ত্রিত অতিথিদের সামনে নাটকের প্রদর্শনীর পরে উপস্থিত দর্শকদের মাঝে সরব প্রতিবাদ না হলেও কয়েকজন নাট্য ও সংস্কৃতিজনের বিরূপ সমালোচনার মুখে পড়তে দেখা যায় নাটকের পরিচালক কামালউদ্দিন নীলুকে।
প্রদর্শনীর দ্বিতীয়দিনে দর্শক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। হলের মধ্যে এক তরুণ দর্শকসারী থেকে ‘ইতিহাস বিকৃতির কারণ’ জানতে চাইলে নাটকের পরিচালক তার দিকে ‘তেড়ে’ আসেন বলে অভিযোগ ওঠে। পরে ক’জন নাট্যজন পরিচালক ও ক্ষুব্ধ দর্শককে লবিতে যেয়ে কথা বলতে অনুরোধ করলে তারা লবিতে কথা বলার সময় উত্তেজিত পরিচালক ‘আমার চেয়ে বড় কমিউনিস্ট কে আছে এখানে’ বলে একজন দর্শককে ধাক্কা দিয়ে ঐ স্থান ত্যাগ করেন বলে উপস্থিত দর্শকরা বাঙালীয়ানা প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। এরপরে কিছুক্ষণ সেখানে উপস্থিত ক্ষুব্ধ দর্শক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ও ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে এবং নাটক প্রদর্শন বন্ধের দাবীসহ শ্লোগান দিয়ে তৃতীয়দিনেও বিক্ষোভ অব্যাহত রাখবার কর্মসূচি দিয়ে নাট্যশালা ত্যাগ করেন।
বাঙালীয়ানা/জেএইচ