“স্তালিন” ও কামালউদ্দিন নীলু: একটি পর্যালোচনা

Comments

।। সাগর লোহানী ।।

৮০ দশকের শেষ দিকে কিম্বা ৯০ এর দশকের শুরুতে টিএসসির সামনে গোল চত্ত্বরে (রাজু ভাস্কর্য যেখানে আজ) দেখেছিলাম অসাধারণ এক থিয়েটার “বিপ্লব গাথা”। সেখান থেকেই অসামান্য এই নাটকের পরিচালক কামালউদ্দিন নীলুর শিল্প ভাবনা, আদর্শিক চেতনা আর আবেগী মনের সাথে পরিচয় হয়েছিল। যদিও ব্যক্তিগত জীবনেও তার সাথে পরিচয় ছিল তার আগে থেকেই। তার সরল রৈখিক জীবনের ব্যত্যয় মন খারাপ করে দিলেও বিপ্লব গাথা-পরিচালকের আসন টলেনি। আজও মনে করি “বিপ্লব গাথা” বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠতম থিয়েটারগুলোর একটি।

সেদিন আমার টেলিফোনে যখন একটি অপরিচিত নম্বর থেকে কল এল পরক্ষণেই ট্রু-কলার দেখাল কামালউদ্দিন নীলুর নাম, সানন্দে ফোনটি ধরলাম। আপ্লুত হলাম যখন নাটকের পরিচালক স্বয়ং ফোনে দীর্ঘদিন পরে তার নির্দেশিত নাটক দেখতে আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন।

“স্তালিন” দেখলাম। নাটকটি বাংলাদেশের প্রথম এবং একমাত্র পেশাদারী থিয়েটার সংগঠন হিসেবে দাবীদার সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার প্রযোজিত। বিশাল ক্যানভাসে নাটকের মঞ্চ ব্যাপৃত। কখনও জাতীয় নাট্যশালার লবি সংলগ্ন সিঁড়িতে, কখনও মিলনায়তনের ব্যালকনিতে, কখনও দর্শকসারিতে, কখনও পর্দায় চলচ্চিত্রের ব্যবহারে নাটক এগিয়েছে। সাবলীল আলোকসম্পাত আর শব্দ মাত্রা দিয়েছে নাটকে। মঞ্চসজ্জায় ছিল গভীরতা। অভিনয়ে ভালভাবেই উৎরে গেছেন শিল্পীরা।

প্রত্যাশা ছিল আরো অনেক। দর্শকের বোধ ও মেধায় আঘাত করবার সামগ্রিক আয়োজন থাকলেও দর্শক কি পেয়েছে এ নাটকে? বর্তমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় “স্তালিন”এর কাছ থেকে, “কামালউদ্দিন নীলু”র কাছ থেকে অনেক কিছু পাওয়ার আকাংখা থাকাটাই তো স্বাভাবিক। দেশে দেশে যখন ধর্মান্ধতার কালো ধোঁয়ায় জনগণের শ্বাসরুদ্ধ, বাক স্বাধীনতা যেখানে স্থবির, গণমাধ্যমের কন্ঠ রোধ করে স্তাবকে পরিণত করা হচ্ছে তখন কামালউদ্দিন নীলুদের মত একদা আদর্শবোধে সোচ্চার, দেশপ্রেমিক, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কাছে বিনম্র সৈনিকদের কাছ থেকে শেষ চিৎকারটা আশা করা কি অন্যায়?

স্ট্যালিনের রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞের শিকার আমার পরিবারও। আমার অন্যতম পিতামহ গোলাম আম্বিয়া খান লোহানী ভ. ই. লেনিনের অন্যতম সহযোগী এবং পরবর্তি সময়ে ছিলেন স্ট্যালিনের কট্টর সমালোচক। ফল হিসেবে স্ট্যালিন তাকে ১৯৩৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর গুলি করে হত্যা করেন। কিন্তু সে কারণে নয় ব্যক্তিগতভাবে আমি স্ট্যালিনের রাজনৈতিক দর্শনের ঘোরতর সমালোচক। কিন্তু এটা খুব স্বাভাবিক বিষয় যে বিশ্বব্যাপী এখনও লাখো মানুষের রয়েছে স্ট্যালিন-দর্শনের প্রতি আনুগত্য। যখন সভেতলানা বলছে, ‘সে মরে গেছে, কিন্তু তার ছায়া এখনও আমাদেরকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ছায়াটা আমাদেরকে একের পর এক নির্দেশ দিয়ে যায়’। তখন সে সত্যেরই প্রকাশ ঘটাচ্ছেন পরিচালক।

১৯২২ সাল থেকে যে ব্যক্তি ৩১ বছর সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি হিসেবে নিজেকে বহাল রেখে সোভিয়েত ইউনিয়নের মত বিশ্বের বৃহত্তম ভৌগলিক রাষ্ট্র সীমানাকে সুসংঘবদ্ধ রেখেছিলেন, শিল্প সমৃদ্ধ একটি দেশে পরিণত করেছিলেন, একক প্রচেষ্টায় হিটলারের নাৎসি বাহিনীকে প্রতিহত করেছিলেন, সেই যোসেফ স্ট্যালিন কি একজন রাজনৈতিক ভাঁড় হিসেবেই তা করে গেছেন কেবলই “ভয়”কে হাতিয়ার করে?

নাটকের সংলাপ যেন তৈরী করাই হয়েছে স্ট্যালিনকে বিশ্বের একজন নিকৃষ্ট রাজনৈতিক ভিলেন হিসেবে উপস্থাপনের আকাংখায়। অযাচিত, অপ্রয়োজনীয় অশ্লীল সংলাপ নিয়ে আলোচনায় না গিয়েই বলতে পারি অত্যন্ত দূর্বল সংলাপের মাঝে পরিচালকের কোন মুন্সিয়ানা খুঁজে পাবার কথা নয়। অহেতুক ভাঁড়ামি আর লম্ফঝম্প দিয়ে হিটলারকে যেমন কমেডি চরিত্রের আদলে উপস্থাপনের প্রয়াস পায় পশ্চিমী দুনিয়া এক্ষেত্রেও পরিচালক স্ট্যালিনকে সে আঙ্গিকেই উপস্থাপনের চেষ্টা করলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর নাট্যশালা মঞ্চে।

কী দিতে চাইলেন পরিচালক দর্শকদের? কোন পথের দিশা পেল দর্শক? দর্শকের মেধা ও মননে কোন বাণী প্রবিষ্ট করাবার চেষ্টা করলেন পরিচালক? একি পরিচালকের অন্তরের কথা নাকি তার হাতে অন্য কারো বাঁশি বাজল?

“বিপ্লব গাথা”র কামালউদ্দিন নীলুকে “স্তালিন”এ খুঁজতে গিয়ে বার বার হোঁচট খেলাম। সর্বপরি স্তম্ভিত হলাম যখন শেষ দৃশ্যে কামালউদ্দিন নীলু স্ট্যালিনকে যাজক করবার মায়ের ইচ্ছার প্রকাশে স্ট্যালিনের মুখে গুঁজে দিলেন সংলাপ, আমি যাজক হলেই ভাল হত, তাহলে কোনো শ্রেণীবৈষম্য থাকত না!

লেখক:

সাগর লোহানী
সম্পাদক, বাঙালীয়ানা

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.