।। স্বাতী চক্রবর্তী ।।
রাজনারায়ণ বসু এমন এক বাঙালি মনীষী এবং সাহিত্যিক যাঁকে আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি। এই মাস তাঁর জন্ম ও মৃত্যুচিহ্নিত, জন্ম ৭ সেপ্টেম্বর ১৮২৬, মৃত্যু ১৮ সেপ্টেম্বর ১৮৯৯। গোটা উনিশ শতক জুড়ে তাঁর কর্মজীবন। রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতিতে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন বালকের মত সরল স্বভাব এই ‘বৃদ্ধের’ কথা যিনি অনায়াসে নিজের পান্ডিত্যকে সরিয়ে রেখে অবলীলায় মিশতে পারতেন তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে, তাদের উদ্বুদ্ধ করতে পারতেন স্বদেশি ভাবনায়, তাদের নিয়ে মেতে উঠতে পারতেন নানা কর্মকান্ডে।
জন্ম দক্ষিণ ২৪ পরগণার বোড়াল গ্রামে, আদিগঙ্গার পাড় ঘেঁষা বর্ধিষ্ণু গ্রাম। লেখাপড়া কলকাতার হেয়ার স্কুল এবং হিন্দু কলেজে। আজ বোড়াল কলকাতার মধ্যে ঢুকে পড়েছে, ভাবতে অবাক লাগে সেই যুগে ১৮৪০-৪৫ এ পায়ে হেঁটে নিত্য কলেজ যাতায়াত করতেন রাজনারায়ণ। প্রিয় ছাত্র ছিলেন বিখ্যাত শিক্ষক রিচারডসনের। ১৮৪৯ সালে সংস্কৃত কলেজে যোগ দেন ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে। সমাজসংস্কারক হিসেবে জড়িয়ে পড়েছিলেন বিদ্যাসাগরের সঙ্গে, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্রাহ্ম সমাজ এবং জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল নিবিড়। ১৮৫০-এর দশকে বিধবাবিবাহ নিয়ে উৎসাহী যুবকদের মধ্যে তিনিও ছিলেন একজন। তারপর ১৮৫১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি মেদিনীপুর জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। মেদিনীপুর জেলায় তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৮৬০ সালে মদ্যপানের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরির জন্য তিনি মদ্যপান নিবারণী সভা’ নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন।
কিন্তু স্বাদেশিকতা ছিল তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র। বিভিন্ন রচনায় বারে বারেই বিদ্ধ করেছেন বাঙালির অনুকরণপ্রিয়তাকে, জোর দিয়েছেন দেশীয় সম্পদের, প্রযুক্তি ভাবনার, সংস্কৃতির বিকাশে। এই প্রসঙ্গে, বিশেষত যখন আমরা দেশীয় পোশাক পরা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি, এমনকি ‘বাংলাটা ঠিক আসে না’ বলে নাক কুঁচকোতে পারলে বেশ স্ট্যাটাস বাড়ল মনে করি, হ্য়ত দেখে নিলে মন্দ হয় না, “একাল আর সেকাল” বইতে কি বলছেন রাজনারায়ণ। উদ্ধৃতি একটু লম্বা হলেও লোভ সামলাতে পারলাম না।
“আমরা সকল বিষয়েই সাহেবদের অনুকরণ করিতে ভালবাসি, কিন্তু বিবেচনা করি না যে, সে অনুকরণ আমাদের দেশের উপযোগী কি না, আর তদদ্বারা আমাদের দেশের প্রকৃত উপকার সাধিত হইবে কি না? সাহেবেরা পর্যন্ত, যে সাহেবী প্রথা এদেশের উপযোগী নহে, মনে করেন, তাহাও আমরা অবলম্বন করিতে সঙ্কুচিত হই না। সাহেবেরা নিজে বলিয়া থাকেন, সাহেবী পোশাক কোনও মতে এদেশের উপযুক্ত নয়; কিন্তু আমাদের দেশের কোনও কোনও ব্যক্তি ঐ পোশাক ব্যবহার করিতে সঙ্কুচিত হয়েন না। আমাদের দেশের কোনও বিখ্যাত ব্যক্তি ভূতপূর্ব লেফটেন্যান্ট গভর্নর বীডন সাহেবের সহিত ধুতি চাদর পরিয়া দেখা করিতে যাইতেন। তাহাতে গভর্নর সাহেব বিরক্তি প্রকাশ করিতেন। একবার গ্রীষ্মের সময় দেখা করিতে গিয়াছেন, গিয়া দেখেন যে, গভর্নর সাহেব ঢিলে পাজামা ও পাতলা কামিজ পরিয়া বসিয়া আছেন। আমাদের বন্ধুকে দেখিবা মাত্র তিনি বলিলেন, ‘তোমাকে দেখিয়া আমার হিংসা হচ্ছে, ইচ্ছা করে তোমাদের ন্যায় পরিচ্ছদ পরিয়া থাকি।’ আমাদের বন্ধু উত্তর করিলেন, ‘তাই কেন করুন না?’ বীডন সাহেব বলিলেন, ‘ওরূপ পরিচ্ছদ পরিধান করা আমাদের দেশাচারবিরুদ্ধ, সুতরাং কেমন করিয়া করি।’ আমাদের বন্ধু উত্তর করিলেন, ‘আপনাদের বেলা দেশাচার বলবৎ, আর আমাদের বেলা কিছুই নহে, আপনারা এরূপ বিবেচনা করেন কেন?” আমাদের দেশের শীর্ষস্থানীয়, এই সদাশয় মহাপুরুষ গভর্নরের সমক্ষে যেরূপ স্বাধীনভাবে জাতীয় রীতি রক্ষা করিয়াছিলেন, তদনুরূপ আচরণ করা আমাদের সর্বদা কর্তব্য। পাঠক হয়ত বুঝে গেছেন এই মুখফোড় জবাব দেওয়া মানুষটি বিদ্যাসাগর মশাই।
রাজনারায়ণ বসুর কথা বলতে গেলে ‘হিন্দু মেলা’ পরে যা ‘জাতীয় মেলা’ হিসেবে অনুষ্ঠিত হত তার কথা বলতেই হবে। ১৮৬৭ সালের এপ্রিল মাসে চৈত্র সংক্রান্তির দিনে হিন্দু মেলা প্রথম শুরু হয়। এখানে বাংলার এবং পরে অন্য রাজ্যেরও শিল্পকর্ম, হস্তশিল্প, কুটিরশিল্প ইত্যদি সব ধরণের দেশীয় পণ্যের প্রদর্শনী হত। ঠাকুরবাড়ি ছিল এই মেলার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক, যাকে আজ আমরা বলি ‘স্পনসর’। গণেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম সচিব এবং মেলার মূল আয়োজক নবগোপাল মিত্র সহকারী সচিব হন। মেলার সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন হলেন রাজা কমল কৃষ্ণ বাহাদুর, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, রমানাথ ঠাকুর, পেয়ারীচরণ সরকার, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কৃষ্টদাস পাল এবং রাজনারায়ণ বসু।বেলগাছিয়ায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বার্ষিক মেলায় (১৮৬৮) সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত দেশাত্মবোধক সংগীত ‘গাও ভারতের জয়’ গাওয়া হয়। এটি এত জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে, সদ্যোজাত জাতীয়তাবাদীদের জাতীয় সঙ্গীতে পরিণত হয় গানটি। প্রদর্শনী ছাড়াও কবিতা, গান-বাজনা, নাটক, লোকগীতি ও বাংলা ভাষার অন্যান্য সকল শাখায় দেশাত্মবোধের ঢেউ সৃষ্টি করতে সফল হয় এই মেলা। মেলাটি সাফল্যের উচ্চ শিখরে পৌঁছায় ১৮৭৫ সালের বার্ষিক সমাবেশে। রাজনারায়ণ বসু এতে সভাপতিত্ব করেন। এ সমাবেশেই ১৪ বছর বয়সী কিশোর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম তাঁর স্বরচিত কবিতা ‘হিন্দু মেলার উপহার’ আবৃত্তি করেন এবং কবিতাটি অমৃত বাজার পত্রিকায় ১৮৭৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয়। রাজনারায়ণ বসুর উৎসাহেই কবির প্রথম জনসমক্ষে আত্মপ্রকাশ।
এছাড়াও রাজনারায়ণ বসু এক গুপ্তসভার প্রতিষ্ঠা করেন কলকাতায়, ঠাকুর পরিবারের অনেকে এমনকি বালক রবীন্দ্রনাথও তার সভায় যোগ দেওয়ার কথা লিখে গেছেন জীবনস্মৃতিতে। নানা স্বদেশি জিনিশ তৈরিতে অকুন্ঠ উৎসাহ যোগাতেন তিনি, বেশির ভাগ সময় তা ফলপ্রসূ হত না, যেমন মনে পড়বে সেই দেশলাই কাঠির কথা যা আর যাই হোক রোজকার কাজে একবারেই বেকার, কিন্তু রাজনারায়ণ হাল ছাড়ার পাত্র ছিলেন না। অপরিসীম আশাবাদী মানুষটি স্বাভিমান ও স্বাধীনতার আন্দোলনের বীজ বপন করেছিলেন তরুণদের মনে, রবীন্দ্রনাথের কথায় স্বাদেশিকতার আলোটিকে নিত্য প্রজ্বলিত রেখেছিলেন। এই মাসটি তাঁর স্মৃতিতর্পণের মাস।