স্বাধীনতার সূর্যসৈনিক বীরশ্রেষ্ঠ নুর মোহাম্মদ শেখ

Comments

একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাস, উত্তাল সময় পার করছে বাংলাদেশের(তৎকালীন পূর্ববাংলা) মানুষ। অস্তিত্বের সংগ্রামরত বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা এখন আরও সংগঠিত। অসংখ্য লড়াইয়ের পরীক্ষিত-পরিণত যোদ্ধা এক এক জন। মুক্তিযোদ্ধাদের মরণ কামড়ে ক্রমে পিছু হটছে পাকিস্তানী হানাদাররা।

৫ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১, সকাল নয়টা, তৎকালীন যশোহরের গোয়ালহাটি গ্রামে নজরদারির কঠিন দায়িত্ব পালন করছে হালকা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত তিনজন মুক্তিযোদ্ধা। অল্প দূরেই গুটিপুর ঘাঁটিতে জড়ো হয়েছে অসংখ্য পাকসেনা। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ক্রমাগত মার খেয়ে চূড়ান্ত আক্রমণের জন্য ওই ঘাঁটিতে জড়ো হচ্ছিলো তারা। মুক্তিযোদ্ধারাও সুযোগের সন্ধানে ছিলো, তাই নজরদারির দায়িত্ব দেওয়া হয় ইপিআরের অভিজ্ঞ যোদ্ধা ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখকে। সহযোদ্ধা নান্নু আর সিপাহী মোস্তফা কামালকে নিয়ে তিনি নজরদারির কাজ করছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে একটু বড় পাকিস্তানী সেনাদলের নজরে পড়ে যান তাঁরা।

পাকিস্তানী হানাদাররা তাঁদের তিনদিক ঘিরে ফেলে ক্রমাগত গুলি করতে করতে এগিয়ে আসতে থাকে। পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায় স্কাউট দলটির, তাঁরা পশ্চাদপসারণ শুরু করে কিন্তু এসময় নান্নু মিয়ার গায়ে গুলি লাগে। মূহুর্তে নান্নু মিয়ার এলএমজিটা তুলে নেন নূর মোহাম্মদ, এসময় তার বুদ্ধিদ্বীপ্ত পাল্টা গুলিবর্ষণে ক্ষণিকের জন্য বিভ্রান্ত হয় পাকিস্তানিরা। এই সুযোগে সহযোদ্ধা আহত নান্নু মিয়াকে নিরাপদ জায়গায় বয়ে নিয়ে যেতে থাকেন নূর মোহাম্মদ শেখ ও মোস্তফা কামাল। তাঁরা পিছিয়ে মূল ঘাঁটিতে ফিরে এলে পাকিস্তানিরা মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান টের পেয়ে যেতে পারে এমন আশংকাও বিরাজ করছিলো সে অবস্থায়। এসময় এক মর্টারের গোলায় মারাত্মক আহত হন নূর মোহাম্মদ।

অবস্থা বিবেচনা করে নূর মোহাম্মদ, মোস্তফা কামালকেকে নির্দেশ দেন নান্নু মিয়াকে নিয়ে পিছনে সরে যেতে। তাঁর রাইফেলটি তুলে নিয়ে আহত বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েন আক্রমণরত হানাদারদের উপর। তাঁর অব্যর্থ গুলি বর্ষণের সুযোগে সহযোদ্ধা দুজন মূল ঘাঁটিতে ফিরে যান। তাঁর প্রবল প্রতিরোধের মুখে হানাদার বাহিনীর অনুসরণ ব্যর্থ হয়। আকস্মিক আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পায় মূল ঘাঁটির মুক্তিযোদ্ধারা। এভাবেই নিজের জীবনের বিনিময়ে সহযোদ্ধাদের বাঁচিয়ে দেন বাংলার এই বীরযোদ্ধা, নড়াইলের সন্তান ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর এই অসমসাহসী ভূমিকার জন্য বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত হন তিনি। এটি স্বাধীন দেশের সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব। এদিকে তাঁর প্রবল প্রতিরোধে পশ্চাতধাবন ব্যর্থ হওয়ার আক্রোশে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে বিকৃত করে দেশমাতৃকার এই অকুতোভয় সৈনিকের মৃতদেহ।

ঘণ্টাখানেক পর মুক্তিযোদ্ধাদের একটু বড় দলের পাল্টা আক্রমণে পালিয়ে যায় পাকিস্তানীরা। এসময় মুক্তিযোদ্ধারা একটি ঝোপের উপর থেকে তাঁর ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে। মুক্তিযুদ্ধের এই কিংবদন্তি সৈনিক নিজের জীবন দিয়ে রক্ষা সহযোদ্ধাদের রক্ষা করেছেন। তাঁর এই বীরত্বগাঁথা স্বাধীন বাংলার ইতিহাসে তোলা থাকবে অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে।

দেশমাতৃকার এই বীর, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ১৯৩৬, নড়াইলের মহেশখোলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আমানত শেখ, মাতা জেন্নাতুন্নেসা। কৃষক বাবার সন্তান নূর মোহাম্মদ শৈশবেই বাবা-মাকে হারান। অনাথ নূর মোহাম্মদ বাঁধাহীন ফিঙের মতো উদ্দাম ডানপিটে জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। গানের গলা ভালো হওয়ায় আবহমান বাংলার লোকগানকে বরণ করে নেন উষ্ণ হৃদয়ে। কার্যত বাউন্ডুলে, অসংসারী, ডানপিটে জীবনেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। বিয়ে করেন তোতাল বিবিকে।

বিয়ের পর অনুধাবন করেন অর্থের প্রয়োজনীয়তা, আনসারের চাকুরীতে যোগ দেন। কিন্তু সে বেতনেও চলছিলো না টানাটানির সংসার। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও উদ্যম, সাহস আর সুঠামদেহের কল্যাণে জুটে যায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস তথা ইপিআরের চাকুরী। প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত দিনাজপুর সেক্টরে দায়িত্ব পালন করেন। একাত্তরের উত্তাল হাওয়া দোলা দেয় স্বপ্নচারী এই দেশপ্রেমিকের হৃদয়ে। এই দেশপ্রেমিক বীর পরাধীনতার মানে খুব ভালো করেই বুঝতেন। তাই নতুন ভোরের স্বপ্ন, স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর পড়েন সেসময়।

পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বরতা চাক্ষুষ করে, আর ঘরে বসে থাকেননি বাংলার এই দামাল সন্তান। যোগ দেন দেশকে শত্রুমুক্ত করার সংগ্রামে। মুক্তিযুদ্ধে সাবেক ইপিআর সদস্যদের নিয়ে গঠিত ৮ নং সেক্টরে যুদ্ধ করেন তিনি। যুদ্ধ চলাকালীন, সেপ্টেম্বর মাসে অভিজ্ঞ যোদ্ধা নূর মোহাম্মদের নেতৃত্বে গোয়ালহাটি গ্রামে স্থায়ী টহল বসানো হয়েছিলো, সূতিপুরে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপত্তার স্বার্থেই। সূতিপুরের মূল ঘাঁটির নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজের জীবন দিয়ে পালন করেন এই বীর। জীবনের শেষরক্তবিন্দু দিয়ে স্বাধীনতার জন্য লড়েছেন এই সূর্যসৈনিক। তাঁর রক্তের উপর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলার সার্বভৌমত্ব।

বাঙালীয়ানা/এএ/জেএইচ

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.