স্বাধীন বাংলা বেতারে যোগদান
মুক্তিসংগ্রামে বিদ্রোহী বেতারের অপরিসীম ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। কে কতটা স্বীকার করল কি করল না, তাতে কিছু যায় আসে না। যৌবনে রাজপথে স্লোগানে উচ্চকিত কন্ঠ, শহিদ মিনারে কী পল্টন ময়দানে, কী টঙ্গীর শ্রমিকাঞ্চলে অথবা নওগাঁর ঈদগাঁ ময়দানে, সিলেটে কুলাউড়ার কৃষক সম্মেলনে, চট্টগ্রামের জাম্বুরী মাঠে – এমনি কত না কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতার সমাবেশে ধারাভাষ্যপাঠের বলিষ্ঠতায় যে কন্ঠকে নিরন্তর কাজে লাগিয়েছি, পাকিস্তানি বেতারে কোনদিন যাইনি তীব্র ক্ষোভে-প্রতিবাদে; সেই আমিই গিয়ে উপস্থিত হলাম কলকাতায়, ১৯৭১ -এর মে মাসে। লক্ষ্য, আমার এই কন্ঠ এখন দেশের মুক্তিসংগ্রামে কাজে লাগাতে চাই। তাই ভাবলাম, স্লোগান দেওয়া এ কন্ঠকে আজ শত্রুর বিরুদ্ধে মুক্তির যুদ্ধে কাজে লাগাতে হবে।
পার্ক সার্কাস এলাকায় আমি ছোটবেলা কাটিয়েছি। ঐ এলাকা আমার বেশ পরিচিত। শুনলাম থিয়েটার রোডে বাংলাদেশ সরকারের অফিস এবং সার্কাস এভিনিউতে বাংলাদেশ মিশন। আমি সার্কাস এভিনিউতে গেলাম। ওখানে দেখলাম বাংলাদেশ মিশনের ঠিক উল্টাদিকে রাস্তার ওপারে নজরুলজয়ন্তী অনুষ্ঠানের জন্য প্যান্ডেল টাঙ্গানো হচ্ছে। বাংলাদেশ মিশনে ঢোকার একটা চেষ্টা করেও সুযোগ পেলাম না।
এমন সময় দেখা হলো সাংবাদিক আমিনুল হক বাদশার সাথে। সে ছিল ঢাকাতে দৈনিক আজাদের রিপোর্টার। পরবর্তীতে বাদশা বঙ্গবন্ধুর এসিস্ট্যান্ট প্রেস সেক্রেটারি হয়েছিল। বাদশা আমাকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে বলল, কামাল ভাই আপনি কোথায়ও যাবেন না, এখানে অপেক্ষা করেন, আমি কিছুক্ষণের মধ্যে ভিতর থেকে আসছি। আমি অপেক্ষা করছি, বাদশা আসছে না দেখে বিরক্ত লাগছিল। শেষ পর্যন্ত বের হলো এবং বাদশা আমাকে নিয়ে পার্ক সার্কাস মোড়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে দক্ষিণ দিকে রওনা দিল। আমাকে বলল, আপনাকে যেখানে নিয়ে যাব সেখানে গেলে আপনি খুশি হবেন, একটা চমৎকার জায়গায় আমরা যাচ্ছি। পথে যেতে যেতে পুরনো দিনের স্মৃতি মনে হচ্ছিল। শৈশবের কলকাতা আর আজকের কলকাতা, অনেক পাল্টে গেছে।
আরো পড়ুন
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র: আমার কথা
যাহোক, আমরা একটা গলি ধরে নির্দিষ্ট বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। এটাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্টুডিও। কিছুদিন আগেও এ বাড়িতে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীরা থাকতেন। স্থান সংকুলানের অভাবে তারা অন্যত্র চলে গেছেন বেতারের জন্য ছেড়ে দিয়ে। দোতলায় অফিস, নিচতলায় খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। উপরে নিয়ে গিয়ে বাদশা আমাকে একটা টার্কিশ টাওয়েল দিয়ে বলল, আজ থেকে এটাই আপনার সম্বল। এ টাওয়েল আপনার বিছানা, পরিধেয় কাপড় ইত্যাদি সকল কাজে ব্যবহারের জন্য দেয়া হলো। এখন থেকেই শুরু করতে হবে কাজ। আমি বাড়িতে বলে আসিনি, এজন্য উদ্বিগ্ন হলেও স্বাধীন বাংলা বেতারে কাজ করব – এ আনন্দে সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম।
এভাবেই স্বাধীন বাংলা বেতারে ঢুকলাম। এখানে আশফাকুর রহমান খান, তাহের সুলতান, টিএইচ শিকদার, শহীদুল ইসলাম, আশরাফুলকে পেলাম। এখানে সবাই প্রোগ্রাম প্রডিউসার। কেউই টেকনিকাল হ্যান্ড নয়। আবার কালুরঘাটের টিমটি আগরতলা রয়ে গেছে। তো তাহের তার অভিজ্ঞতা থেকে রেকর্ডিং মেশিন চালু করে দিল।
এদিকে প্রস্তুতি চলছে নজরুলজয়ন্তীতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু করতে হবে। ৫০ কিলোওয়াটের শক্তিশালী এ ট্রান্সমিটারটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের অনুরোধে ভারত সরকারের কাছে থেকে পাওয়া গেছে। ৩/৪ দিন পর অবশ্য আমি প্রতাপ হাজরার ভাইয়ের বাসায় খবর দিলাম। তারা অবশ্য একটু ক্ষেপেও গিয়েছিলেন। কারণ এ সময়টায় নকশালবাড়ী আন্দোলনের ধুমধাড়াক্কার সময়। নকশালরা তো আমাদের বিরোধিতা করছিল। স্বাভাবিক কারণেই শঙ্কিত হয়েছিলেন তাঁরা।
২৫ মে থেকে ২য় পর্বে অনুষ্ঠান শুরুর সময়ে পটুয়া কামরুল হাসান আমাদের বললেন, শান্তিনিকেতন স্টাইলে ফ্লোরে বসে কাজ করতে শুরু করো। শুরুতে লেখার কাগজ পর্যন্ত ছিল না। খবরের কাগজের ফাঁকা জায়গায় সংবাদ ও অনুষ্ঠানের ঘোষণা লিখতে হয়েছে। পরে অবশ্য কাগজ ইত্যাদি পেয়ে গিয়েছিলাম।
প্রথম অনুষ্ঠান শুরুর দিন আমরা একটা ঘরের মধ্যে সব দরজা জানাল বন্ধ করে রেকর্ড করা শুরু করি। মে মাস, গরমের দিন। প্রচণ্ড গরমে সবাই ঘেমে যাচ্ছিলাম। প্রথম দিকে গানের রেকর্ডিংয়ের সময় কোনো বাদ্যযন্ত্র ছিল না একমাত্র হারমোনিয়াম ছাড়া। তবলা বাজানো হতো টেবিলে টোকা দিয়ে। আস্তে আস্তে সব যোগাড় হয়ে গেল। মন্দিরা, খঞ্জনী, তবলা, ঢোল এসব নিজেরাই যোগাড় করে ফেলেছিলাম। ভারত সরকার বা আকাশবাণীর কাছ থেকে আমরা দুটো রেকর্ডিং মেশিন ছাড়া কিছুই সহযোগিতা হিসেবে নেইনি। অদক্ষ অনভিজ্ঞ তরুণ হলেও বেতারের কর্মীরাই সব করতেন, কারো কোনো সাহায্য ছাড়াই।
প্রথম দিন ইংরেজি বুলেটিনটি লিখে আমিই পড়েছিলাম। ইংরেজি সংবাদ পড়ালেখার অভিজ্ঞতা ছিল না। তবে সংবাদপত্রে কাজের সময় ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করতাম। পরবতীতে আবদুল্লাহ আল ফারুক এলেন। তিনি চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ১০ জন বিদ্রোহী সংগঠকের একজন। অসাধারণ গলা ছিল তার। চমৎকার গান গাইতেন ফারুক। ইংরেজি সংবাদ তাকে দিয়েই পাঠ করানো হতো। পরে ঢাকা থেকে আলমগীর কবির, আলী জাকের এলেন। এরা ইংরেজি সংবাদ পাঠের দায়িত্ব নিলেন। বড়জোর ১২ ফুট লম্বা ও ১০ ফুট চওড়া একটা রুমে ছিল আমাদের স্টুডিও। এখানেই সারাদিন কাজ করতাম, রাতে এখানেই ঘুমাতাম।
প্রথমে ভারত সরকারের কাছ থেকে আমরা একটা রেকর্ডি মেশিন পেয়েছিলাম। এছাড়া অনুষ্ঠান তৈরি, টেকনিক্যাল কাজ সবকিছু আমরা স্বাধীন বাংলা বেতারের লোকেরা করেছি। এমনকি কোনো বিশেষজ্ঞ সাহায্যের প্রয়োজন পড়েনি। আকাশবাণীর কোনো শিল্পী স্বাধীন বাংলা বেতারে অনুষ্ঠান করতে আসেননি। নজরুলজয়ন্তীতে শুধু সব্যসাচীর একটি আবৃত্তি প্রচার করা হয়েছিল। এছাড়া গোবিন্দ হালদারের কয়েকটি সাড়া জাগানো গান স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচার করা হয়। এছাড়া আংশুমান রায়ের সুরে ও কণ্ঠে “শোনো একটি মুজিবের কণ্ঠস্বরের…” গানটি প্রচার করা হয়। এছাড়া সকল অনুষ্ঠানের লেখক, পাঠক, প্রস্তুতকারী, গানের সুর ও কণ্ঠ সবই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও কলাকুশলীরা করেছেন। এমনকি সংবাদ প্রচারেও আমরা বাইরের সাহায্য নেইনি। যার জন্য সংবাদ সংগ্রহ, প্রস্তুত ও উপস্থাপনা একজনকেই করতে হয়েছিল প্রথম কদিন। তিনিও ঢাকারই একজন সাংবাদিক ছিলেন। প্রকৌশল বিভাগও তরুণ কর্মীদের দ্বারা পরিচালিত হতো। এরা সবাই বাংলাদেশের।
প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে কোরআন তেলাওয়াত করলেন মোহাম্মদুল্লাহ চৌধুরী। তিনি জয়বাংলা পত্রিকায়ও কাজ করতেন। জয়বাংলা পত্রিকা তখন বের হতো কলকাতার বালুহাক্কাক লেন থেকে। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার একটি অংশ নিয়ে ‘বজ্রকণ্ঠ’ নামে একটা অনুষ্ঠান করা হতো। স্বাধীন বাংলা বেতারে সাইন ইন হিসেবে ব্যবহার করা হতো ‘জয় বাংলা বাংলার জয় গানটি।’ এ সমবেত কণ্ঠে গাওয়া একটি গান।
সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ে ১০/১৫ লক্ষ লোক মারা গেল। পশ্চিম পাকিস্তান সাহায্যের হাত বাড়াল না। ইয়াহিয়া খান দেখতেও এলেন না। এমনকি সরকারি মন্ত্রিসভায় বাঙালি মন্ত্রীরাও পশ্চিম পাকিস্তানে বসে থাকলেন। এর মধ্য দিয়ে এ সরকার সাধারণ মানুষের কাছে একটা ঘৃণার বস্তু হয়ে গেল। চীনপন্থী কমিউনিস্টদের একটি অংশ পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে। মো. তোয়াহা, আবদুল হক প্রমুখ কমিউনিস্ট নেতারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে সমর্থন করে। চীনপন্থী আরো কতকগুলো গ্রুপ ছিল এরা মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছে। চীনপন্থী অনেকে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে। দেবেন শিকদার, আবুল বাশার এর গ্রুপ, কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো-দের গ্রুপও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে।
আমাদের প্রতিবেশী কে? আমাদের প্রতিবেশী ত্রিপুরা, আসাম, পশ্চিম অর্থাৎ ভারত। এদের বাদ দিয়ে তো আমাদের যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। সঙ্গত কারণেই প্রাথমিক পর্যায়ে আমাদের ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার সম্পর্কিত একটি সভার কার্য বিবরণ।
MINUTES OF MEETING ON CO-ORDINATION ON PROPAGANDA AND PUBLICITY EFFORTS IN SUPPORTS OF WAR A CIVITY HELD ON 10-10-1971
Members Present:
1. A. Samad, Secretary, Ministry of Defense
2. Dr. B. Hossain. Adviser
3. Mr. Alamgir Kabir
4. Mr. Shamsul Huda Chowdhury
5. Mr. Kamal Lohani
6. Mr. A. Rahman
7. Mr. B. Mahmood
Progress of action on decisions taken in last meeting was discussed. Members from Radio Bangladesh assured that they are working on lines already decided upon significant improvement with be noticeable from 15-10-71 onwards.There was further discussion on measures which will contribute to improve the Radio Programme.
DECISIONS.
1. An office will be immediately set-up in the Radio Building.
2. The method of news composition will be changed and text will be the same for English, Bengali and Urdu Bulletins. In view of pressure of work Mr. A. Kabir will compose the night bulletin and Mr. K Lohani will compose the morning and afternoon bulletins.
3 The Radio will be immediately provided with a typewriting machine, two portable tape recorders and one Cassette tape recorder.
4. The Staff of outside broadcast section will go out frequently to the field. They will be given T.A. as now conveyance can be arranged at present.
5. Dependence on patriotic songs should be reduced and in its place martial songs and music should be introduced.
6. Arrangement for bringing the microphone from Agartala should be immediately made.
7. Security checking be made rigid from 15.10.71. In the meantime I.D. Cards should be issued where necessary.
8. Payments for script writers and talkers should be regular.
9. The panel of Talents should be finalized immediately in consultation with Mr. A. Mannan. MNA in charge.
10. Programme shall be drawn up for 7 days at a time sufficiently in advance (at least 4 days). The responsibility of filling the programme shall lie with the respective programme organizer/section heads.
11. Arrangement shall be made by Secretary, Information for getting Pak Newspapers for the counter propaganda.Sd/-A. Samad
Secretary
Ministry of Defence,
Memo No-D-003/76(8)1) Copy forwarded to Mr. M.A. Mannan, MNA-incharge, Information & Broadcasting for information.
2) Mr. Shamsul Huda Chowdhury, Swadhin Bangla Betar Kendra for information.
এ বৈঠকের সব সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তবে গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার এবং তথ্য বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত এমএনএ জনাব আব্দুল মান্নানের মাধ্যমে প্রাপ্ত সরকারি নির্দেশাবলীতেই স্বাধীন বাংলা বেতারের সকল অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো।
স্বাধীন বাংলা বেতার: নানা স্মৃতি
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যারা কাজ করতেন, কলকাতায় বিভিন্ন বাসায় তারা থাকতেন। এরা বাড়িওয়ালাদের কাছ থেকে বেশ সহযোগিতা পেয়েছেন। অনেকে পাঁচশো টাকার বাসা তিনশো টাকায় ভাড়া দিয়েছেন। দুএক মাসের ভাড়াও নেননি। আবার অনেক বাড়িওয়ালা বাংলাদেশ জেনে ভাড়া দেননি এমন ঘটনাও রয়েছে। ভাড়া না দিয়ে পালিয়ে যাবে এমন ধারণাও অনেক বাড়িওয়ালা করতেন।
আমি আমার শাশুড়ি, ছেলেমেয়ে ও শ্যালককে নিয়ে এক বাসায় থাকতাম। আমার স্ত্রী তখনো কলকাতায় পৌঁছাননি। একদিন বাসায় মুরগি এনে রান্না করাতে বাড়িওয়ালা আপত্তি করলেন। আরেকদিন গরুর মাংস আনলাম। ভাবলাম জানাজানি হলে একটা সমস্যা হতে পারে। শাশুড়ি বললেন শুটকিমাছ আনতে। রান্নার সময়ে চুলোয় শুটকি মাছ দিয়ে দিলে ওর গন্ধে গরুর মাংসের গন্ধ আর বাড়িওয়ালার নাকে যাবে না। খাওয়ার পর হাড়িকড়াই শাশুড়ি নিজেই মেজে রাখলেন। যেন ধরা না পড়ে যাই।
অনেক জায়গায় আমাদের ছদ্মনামও ব্যবহার করতে হয়েছে নিরাপত্তার জন্যে। কলকাতায় যারা উর্দুভাষী এরা মনে করত পাকিস্তান ভেঙে দিচ্ছি আমরা। অতএব এরা আমাদের শত্রু। তারা জানত না পূর্ববঙ্গে কি নিপীড়ন চলছিল। নকশালপন্থীরা অনেক সময় আমাদের টিটকারী করতো। আমার অনেক পরিচিত নকশালপন্থী কলকাতাতে ছিল। এরা বলত দেশ স্বাধীন করতে এখানে এসেছ, কেন দেশের ভিতরে থেকে স্বাধীন করতে পারতে না?
ত্রিপুরা, পশ্চিম বাংলায় বাংলাদেশের মানুষের চাপটা বেশি পড়ে। শহরগুলোতে, বিশেষত কলকাতা ও আগরতলাতে বাংলাদেশের শরণার্থীদের চাপ ছিল বেশি। তবে সাধারণভাবে সকল মানুষ আমাদের আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেছে। বিশেষ করে যারা পূর্ব বাংলা থেকে বিভিন্ন সময়ে ভারতে গিয়ে স্থায়ী হয়েছেন তাদের সহযোগিতা অসাধারণ। এখানে আঞ্চলিকতা নয়, আদর্শের জন্য সহযোগিতা করেছেন। পৃথিবীর যেখানেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, সেখানে মানুষ এভাবে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতের বিভিন্ন সংস্থা আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা সহজে প্রতিবেশী দেশ ভারতে ঢুকে যেতে পেরেছিলাম। পাকিস্তান সরকারের ভারতবিরোধী একটা বৈরী মানসিকতা ছিল। এ থেকে ভারতের একটা সহানুভূতি আমাদের দেশের জনগণের প্রতি গড়ে উঠে। এছাড়া এ-বাংলা ও-বাংলায় আত্মীয়স্বজন, পারিবারিক সম্পর্ক ইত্যাদি তো ছিলই। একসময় অনেকে কলকাতায় পড়াশুনা করেছেন এবং পরে পূর্ববঙ্গে চলে আসেন। এসবের মধ্য দিয়ে যে সম্পর্কটা গড়ে উঠেছিল একাত্তরে তা আমরা কাজে লাগাতে পেরেছি।
পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরা – এ দুটো রাজ্য ছিল বামপন্থীদের শক্তিশালী ঘাঁটি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের পক্ষে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। সে কারণেও প্রগতিবাদী মানুষ আমাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
মে থেকে ডিসেম্বর একাত্তর পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ)। বেতার কর্মীদের নিরাপত্তার দায়িত্বও সেদিন বিএসএফ গ্রহণ করেছিল। বিএসএফ-এর আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজুমদার মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সহযোগিতা করেছেন। একাত্তরে তার ভূমিকা ছিল অসাধারণ। তিনি তাজউদ্দীন আহমদকে সীমান্তে মর্যাদার সাথে গ্রহণ করেন, বিএসএফ প্রধান রুস্তমজীর সাথে যোগাযোগ করে তাঁকে কলকাতায় আনা, রুস্তমজীসহ দিল্লিতে নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তাজউদ্দীন আহমদের বৈঠকের ব্যবস্থা করেন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে (১৭ এপ্রিল ’৭১ মুজিবনগর), গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযুদ্ধের গোটা সময়টা তিনি নির্ভীকভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে বিএসএফ সীমান্ত খুলে দেয়, বাংলাদেশে আশ্রয়প্রার্থী অসহায় মানুষকে ভারতে আশ্রয় দেয়, মুক্তিযোন্ধাদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে একটি বিশেষ বাহিনী হিসেবে মুজিববাহিনী ছিল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যার সাথে মুজিবনগর সরকার জড়িত ছিল না। আমি মনে করি, একাত্তরে এভাবে মুজিববাহিনী গঠন সঠিক ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ যারা করেছে তার মধ্যে শুধু আওয়ামী লীগ ছিল তা তো নয়। সেখানে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ছিল, কমিউনিস্ট পাটি ছিল, মওলানা ভাসানী নিজে ছিলেন, চীনপন্থী কমিউনিষ্ট পার্টির একটি অংশ ছিল। জাফর-মেনন রনোরা মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন। অথচ এই মুজিববাহিনী মেননপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ওয়াজীউল্লাহসহ ১২ জনকে হত্যা করে। মুজিববাহিনী থেকে পরে হলো রক্ষীবাহিনী। স্বাধীনতা-উত্তর আওয়ামী লীগ শাসনামলে অন্তত ৩৬,০০০ বামপন্থী কর্মীকে এরা হত্যা করেছে। রক্ষীবাহিনীর আরেকটি অংশ হিসেবে তৈরি হয়েছিল লালবাহিনী।
প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন মুক্তিযুদ্ধকালে একটি সর্বদলীয় পরামর্শক কমিটি গঠন করলেন। মওলানা ভাসানী এ কমিটির প্রধান হলেন। এ কমিটিতে মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, মনোরঞ্জন ধর প্রমুখেরা ছিলেন। কমিটির প্রথম সভায় মওলানা ভাসানী দীর্ঘক্ষণ বক্তৃতা করেন। এরপরে এ কমিটির আরেকটি সভা হয়। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এ কমিটিকে এক প্রকার অস্বীকার করলেন। স্বাধীনতার পর দেশে প্রয়োজন ছিল একটি সর্বদলীয় সরকার গঠনের। কিন্তু তা আর হয়নি।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র আমরা কিভাবে পরিচালনা করতাম এটা বঙ্গবন্ধুকে বিস্তারিত জানাতে চাইলাম। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতারের সকলকে গণভবনে ডাকলেন। অনেকে পরিবারবর্গসহ গেলেন। আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যেভাবে অনুষ্ঠান করতাম, অনুষ্ঠান উপস্থাপনাসহ সবকিছু বঙ্গবন্ধুকে দেখালাম। তিনি খুশি হলেন। তিনি সবার সাথে কথা বললেন। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে ডাকলেন। আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি সর্বদলীয় পরামর্শক কমিটি গঠিত হয়েছিল মুজিবনগরে। তার একটা বৈঠক ডাকলে বুঝতে পারতেন কেমন করে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। কিন্তু তিনি বললেন, আরে রাখ, আমি তো এসে গেছি, আর কমিটির দরকার কি?
মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল প্রগাঢ়। দেশ স্বাধীনের পর তিনি আবার এ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করলেন। এর অংশ হিসেবে তিনি গেলেন ওআইসি (Organisation of Islamic Conference) সম্মেলনে। উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করা।
বর্ষীয়ান জননেতা মওলানা ভাসানীকেও তিনি কোনো গুরুত্বই দিলেন না। এমন কি পরবর্তীতে যে তাজউদ্দীন আহমদ ন’মাস মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে দেশকে শত্রুমুক্ত করলেন, তাঁকেও তিনি মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দিয়েছিলেন। পৃথিবীর কোথাও মুক্তিযুদ্ধ নয় মাসে শেষ হয়নি। এ মুক্তিযুদ্ধ তাই পূর্ণতা পেল না।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে গাজীউল হক, ফয়েজ আহমদ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, এম.আর. আখতার মুকুল, তোয়াব খান, হাসান ইমামসহ অনেকেই ছিলেন। আবদুল গাফফার চৌধুরীর চাকরি করতেন দৈনিক পূর্বদেশে। মুজিবনগরে এসে প্রথমে তিনি জয়বাংলা পত্রিকায় যোগদান করেন। তিনি পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আসেন। ‘পুতুল নাচের খেল’ নামে একটি কথিকা লিখতেন।
ফয়েজ আহমদের কথিকার নাম ছিল ‘পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে’। সলিমুল্লাহ লিখতেন সাদেকিন লিখতেন। এদের কথিকা রেকর্ড করে প্রচার হতো। ফয়েজ ভাইয়ের কথিকাটি নিয়মিত আমি পড়তাম। গাজীউল হক ‘এহিয়া বধ’ নামে রসাত্মক কাব্য কথিকা লিখতেন। এম. আর. আখতার মুকুলের চরমপত্র ছিল খুবই জনপ্রিয়। ‘জল্লাদের দরবার’ নাটকটি লিখতেন কল্যাণ মিত্র। এ নাটকে রাজু আহমদ ইয়াহিয়ার চরিত্রে অভিনয় করতেন। জল্লাদের দরবারও জনপ্রিয় হয়েছিল। পাকিস্তান সরকার সম্পর্কে জনমনে যে ঘৃণা এ নাটকে তা প্রকাশ পেত। হাসান ইমাম প্রথম দিকে খবর পাঠ করলেও পরে নাটক পরিচালনার কাজে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। আশরাফুল আলম লিখতেন ‘দর্পণ’। তার কণ্ঠে একটা মাধুর্য ছিল। অনেকটা দেবদুলালের মতো কণ্ঠ ছিল তার। সৈয়দ আলী আহসান ইসলামের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ’ কথিকাটি প্রথম দিন (২৫ মে) পাঠ করেন। ঐদিন আমি কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলাম।
গানের কথা বললে বলতে হয় সমর দাশ, আবদুল জব্বার, আপেল মাহমুদ, রথীন্দ্রনাথ রায়সহ অনেকের কথা। রথীন্দ্রনাথ রায়ের দুটো গান। ‘বগিলারে ক্যান বা খালু বাংলাদেশে …’ এবং ‘ছোটদের বড়দের সকলের গরীবের নিঃস্বের ফকিরের…’ বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। উদ্দীপনামূলক গানগুলো নিয়ে একদল শিল্পী শরণার্থীশিবিরে, মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে যেতেন এবং গান গেয়ে উৎসাহিত করতেন সাময়িক গৃহহারা নিঃস্ব বাংলার মানুষদের। তাদের বলা হতো শিল্পী-সংগ্রামী দল।
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার এ বাংলার মানুষ ছিলেন। তিনি পাবনায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি অনেক গান লিখেছেন। ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে…’ তার বিখ্যাত গান। গোবিন্দ হালদার দুটো গানের খাতাই আমাকে দিয়েছিলেন। তাঁর তিনটি বিখ্যাত গান স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচার করা হয়। ‘মোরা একটি ফুলকে’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’ ও ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ খুবই জনপ্রিয়।
স্বাধীন বাংলা বেতারে কর্মরত অবস্থায় একদিন বরিশালের একটি ঘটনা জানতে পারলাম। বরিশালে পাক আর্মি এক তরুণকে আটক করে বলল, আমরা পানি খাব। গাছ থেকে ডাব পেড়ে আন। ছেলেটির তখন জীবনমরণ সমস্যা। সে ভালোমতো গাছে উঠতেও পারে না। প্রাণভয়ে গাছে উঠে ডাব এনে কাটাারি দিয়ে কেটে দিল। সৈনিকটি যখন ডাবের পানি খাচ্ছিল তখন ছেলেটি তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিল এক কোপে ওর গলা কেটে ফেলবে। সাথে সাথে পাক আর্মির গলায় কাটারি বসিয়ে দিল এবং একজন শত্রুর পতন ঘটাল।
এমনি অনেক ঘটনা আমরা জানতে পারতাম মুক্তিযোদ্ধা ও রণাঙ্গন প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। স্বাধীন বাংলা বেতারে কর্মরত অবস্থায় একদিন আমি আমার বাবার মৃত্যুসংবাদ পেলাম। সাংবাদিক নির্মল সেন আমাকে খবরটা দিলেন। আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। ভাবলাম কত বাবাই তো প্রতিদিন মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। লাখো লাখো মৃত্যুর মধ্যে আমার বাবার মৃত্যুও এমনি একটি ঘটনা। ঢাকায় ২৫ মার্চে ও তারপরে গণহত্যার চিত্রটি আমি নিজের চোখে দেখেছি। তাই বাবার মৃত্যুসংবাদ পেয়েও চোখে সেদিন জল আসেনি।
গাজীউল হক কলকাতায় জয়বাংলা পত্রিকা এবং স্বাধীন বাংলা বেতারের সাথে যুক্ত ছিলেন। গাজীউল হকের বড় অবদান হচ্ছে, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তার ভূমিকা। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ২১ ফেব্রুয়ারি মিছিলের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় আয়োজিত ছাত্রসভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন এবং এদিন তিনি এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা করেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের পরে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের একজন নেতা ছিলেন। উদাত্ত ছিল তার কণ্ঠ। … বক্তা ছিলেন। ভালো গান গাইতেন, ভালো সেতার বাজাতেন। এক সময় গাজীউল হকের গান ছাড়া ছাত্র ইউনিয়নের কোনো সম্মেলন হতো না। তিনি জেলায় জেলায় ছাত্র ইউনিয়নের সভা করতে যেতেন। তার গানের জন্য তাঁর একটা বিশেষ চাহিদা সব জায়গাতে ছিল। উদাত্ত কণ্ঠে তিনি জ্বালাময়ী ভাষণ দিতেন। আবার গল্প করে তিনি সারা রাত কাটিয়ে দিতেন।
সময়টা ১৯৫৩ সাল। পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনের সময় আমি ও হোসেন তৌফিক ইমাম পাবনার বিভিন্ন থানায় গেছি সংগঠন গড়ে তোলার জন্য। জেলা সম্মেলনে যোগ দেয়ার জন্য ঢাকা থেকে গাজীউল হক, মো. ইলিয়াস (ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম সাধারণ সম্পাদক) ও যুগ্ম সম্পাদক আবদুস সাত্তার – এ তিনজন পাবনাতে আসবেন। আমরা পাবনায় প্রস্তুত, কেন্দ্রীয় নেতারা ঢাকা থেকে এখনো এসে পৌঁছাননি। তখন রাত ১১/১২টা হবে। আমরা বাসস্ট্যান্ডে খুঁজতে বের হলাম। দেখলাম আমাদের খুঁজে না পেয়ে একটি বাসে তিনজন শুয়ে আছেন। এ তিনজনই আমাদের অতিথি। ওদের নিয়ে এলাম। তারপর সারারাত গাজী ভাইয়ের গল্প শুনে রাত কাটালাম। পরদিন ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন যথারীতি গাজীউল হকের গান দিয়ে শুরু হলো।
গাজীউল হক এক সময় যুবলীগ করতেন। অবশ্য এসব পঞ্চাশের দশকের কথা। একুশের চেতনা পরিষদ নামে আমরা একটা সংগঠন করেছিলাম আশির দশকে। জেলায় জেলায় ভাষা সৈনিকদের একত্রিত করা ছিল আমাদের কাজ। ১১ জনের একটি কমিটি করা হয়েছিল।
একাত্তরে গাজীউল হক কলকাতায় ধাঙ্গড়বাজারের কাছে বাসা নিয়ে থাকতেন। প্রথম প্রথম তিনি জয়বাংলা পত্রিকা গড়ের মাঠে, কলকাতার রাস্তায় বিক্রিও করেছেন। গাজী ভাইয়ের বাসায় মাঝে মাঝে আমরা চট্টগ্রামের শিল্পীরাসহ দল বেঁধে যেতাম। ভাবী আমাদের চালের গুঁড়ো দিয়ে রুটি এবং গরুর মাংস রান্না করে খাওয়াতেন। সে সময়ে আমাদের ভালো খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা তেমন ছিল না। গাজী ভাইয়ের বাসায় যেতাম খাওয়ার জন্য। আর সেই সাথে তাঁর জমাট গল্পতো ছিলই।
আমাদের সেক্টর কমান্ডার
মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডারদের অনেকেই বীরত্বের সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। এমনি একজন সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের সম্পর্কে আমরা জানতে পারি যখন তিনি পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে যুদ্ধ করতে যেয়ে আহত হন। তাঁর পা কেটে ফেলা হয়। তিনি অসীম সাহসী এবং মেধাবী যোদ্ধা ছিলেন। সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। এক্ষেত্রে আরেক সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুরের অবস্থান ছিল এর পরই। অনেক যুদ্ধে তিনি সফলতা বয়ে এনেছেন। কর্নেল তাহের বামপন্থী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। আমরা বেতারের ভিতরে থাকার কারণে সেক্টর কমান্ডারদের সাথে কথা বলার বা তাদের সম্পর্কে জানার সুযোগ তেমন পেতাম না। তবে আলী জাকেরসহ দু-একজন রণাঙ্গন প্রতিনিধি হয়ে তাদের সাথে কথা বলেছেন এবং সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, যা প্রচার করা হয়েছিল বেতারে।
কামালপুরের যুদ্ধে মেজর জিয়াউর রহমান নেতৃত্ব দেন। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়। জেনারেল ওসমানী মেজর জিয়ার উপর বিভিন্ন সময়ে নানা কারণে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। সে কারণে জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে মেজর জিয়া কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণও করেননি।
মেজর মঞ্জুুরের যুদ্ধকৌশল, তার প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা প্রশংসিত হয়েছে। ভারতীয় সেনা কর্মকর্তারা মঞ্জুরের দক্ষতার প্রশংসা শুনেছেন এবং অনেক সময় তার দায়িত্বে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। ‘রুস্তমের মা’ নামে লেখা আমার একটি কথিকা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত হয়েছিল। যশোরের এক রণাঙ্গনে রুস্তম নামে একটি ছেলেকে মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুপক্ষের খবরাখবর সংগ্রহের জন্য রেকী করতে পাঠিয়েছিলেন। ছেলেটি রেকী করতে গিয়ে পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এবং পাকবাহিনী তাকে হত্যা করে। রুস্তমের বৃদ্ধা মা তখন তার আরেক ছেলেকে মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘আমার আর কিছু দেয়ার নেই। আমার শেষ সম্বল আট বছরের এ ছেলেটাকে দেশের জন্য আপনাদের কাছে নিয়ে গেলাম। এমন মানবিক দিকগুলো মেজর মঞ্জুরদের উৎসাহিত করেছিল।
কর্নেল (অব.) নূরুজ্জামান সেক্টর কমান্ডারদের সিনিয়র এবং সমর কৌশল বিষয়ে পড়াশুনা করা এক বিচক্ষণ সেনা অফিসার। পাকিস্তান শাসন আমলে জেনারেল আইয়ুব খানের সাথে মতবিরোধে সেনাবাহিনী ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭১ সালে গণহত্যা শুরু হলে তিনি স্বেচ্ছায় মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পরে তিনি কোনো সুযোগ গ্রহণ না করে স্বাভাবিক নিয়মিত জীবনে ফিরে যান। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা উত্তরকালে প্রত্যাখ্যাত হলো। তিনি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এ ক্ষোভ মেটাতে পারেননি। ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল কে কোথায়’ গ্রন্থটি অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছে যুদ্ধাপরাধীদের শনাক্তকরণ ও বিচারে।
মেজর রফিকুল ইসলামের বিরাট অবদান রয়েছে চট্টগ্রামে। তখন অবশ্য তিনি ইপিআর ক্যাপ্টেন রফিক। মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শুরুতে চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বেতারকর্মীরা ক্যাপ্টেন রফিকের কাছে গিয়েছিলেন বেতারে কিছু ঘোষণা দেয়ার জন্য তাকে অনুরোধ জানাতে। তিনি তাদের বলেন, আমার চেয়ে সিনিয়র চট্টগ্রামে দ্বারা আছেন তাদের নিয়ে ঘোষণা দিলে ভালো হয়। ক্যাপ্টেন রফিকের কাছে গিয়েছিলেন বেতারে কিছু ঘোষণা দেয়ার জন্য তাকে অনুরোধ জানাতে। তিনি তাদের বলেন, আমার চেয়ে সিনিয়র চট্টগ্রামে যারা আছেন তাদের নিয়ে ঘোষণা দিলে ভালো হয়। ক্যাপ্টেন রফিক ইচ্ছে করলে সেদিন বেতার ঘোষণার সুযোগটা নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সিনিয়রদের প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন। পরে অবশ্য মেজর রফিকুল ইসলাম একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদান রেখেছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধ নিয়ে তিনি ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ নামে বই লিখে প্রশংসিত হয়েছেন।
মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ২৬ মার্চ থেকেই চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ মেহেরপুর এলাকা মুক্ত রেখেছিলেন। মেহেরপুরের মুক্ত এলাকায় বৈদ্যনাথতলায় ১৭ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে এবং সে থেকে এলাকার নাম হয় মুজিবনগর। এ অঞ্চলে একটি বিশাল এলাকাকে মুক্ত রাখার পিছনে মেজর ওসমান চৌধুরী, মেহেরপুরের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক তৌফিক এলাহী চৌধুরী, ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন (যিনি এসপি মাহবুব নামে সর্বাধিক পরিচিতি)-এ তিনজন ব্যক্তিত্বের অসাধারণ অবদান রয়েছে। মুক্তাঞ্চল দিয়ে তাজউদ্দীন আহমদকে ভারতে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে এরা প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন।
লেখক পরিচিতি:
কামাল লোহানী:
শব্দসৈনিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
(প্রবন্ধটি লেখকের ‘রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলা বেতার’ এবং ‘মুক্তি-সংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার’ গ্রন্থের বিভিন্ন অংশ থেকে সংকলিত হয়েছে – সম্পাদক)