বাংলার অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ এক অবিস্মরণীয় নাম। শৈশব থেকেই যে মানুষটি মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন সহপাঠীদের সাথে, ক্রমশ তিনি রাজনৈতিক পথপরিক্রমায় বাংলার সাধারণ মানুষের ‘বঙ্গবন্ধু’তে পরিণত হলেন। দেশবাসি তাঁকে ‘জাতির পিতা’ অভিধায় স্থাপন করলেন। শিশুকালে যে হ্যাংলা পাতলা ছেলেটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কিংবা দাবি আদায়ের দৃঢ় প্রত্যয়ে কথা বলতেন সেই ছেলেটি বিপুলদেহী সুদর্শন এক পুরুষকান্তি নিয়ে আবির্ভূত হলেন রাজনীতিতে।
প্রথমে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলনে, পরে ‘পাকিস্তান সংগ্রাম’-এ রাজপথে যে বলিষ্ঠ যুবক শ্লোগান তুলেছিলেন ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’, তিনিই একদিন সেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নতুন জাতীয়তাবাদী পথে লড়াইয়ে নাবলেন। ১৯৪৮ এ, দেশবিভাগের মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের অবাঙালি নেতৃবৃন্দের যে বৈরী মন ও মানসিকতার পরিচয় পেলেন তাতে যৌবনদীপ্ত শেখ মুজিবুর রহমান আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের পথে পা বাড়ালেন। নির্যাতিত হলেন বারবার, নিক্ষিপ্ত হলেন কারাগারে। আর এমনি করেই সেই যৌবনদীপ্ত পুরুষ বাংলার মানুষের অকুতোভয় নেতায় পরিণত হলেন এবং রাজনৈতিক পরিক্রমার মাধ্যমে ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দাবি উত্থাপন করে নতুন করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। পশ্চিমের প্রাসাদ রাজনীতির কুশিলবেরা এই জাতীয়তাবাদী উত্থানে ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হলো। কিন্তু তাতে কি এসে যায়? শেখ মুজিবুর রহমান তার ৬ দফা নিয়ে পূর্ববাংলার পথে পান্তরে সভা-সমাবেশে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে গেলেন আঞ্চলিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে, দমন-পীড়নকে রুখে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বাংলার স্বার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে।
আইয়ুবী সামরিকতন্ত্রের পতনের পর জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করে জনপ্রিয় হওয়ার লক্ষে ১৯৭০ সালে সারাদেশে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করলেন। ইয়াহিয়ার মতলবের পাশাপাশি ক্ষমতালোভী ‘পাঞ্জাবি ক্লিক’ পূর্ববাংলার অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে হিংসার চোখে দেখছিল। তাই সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও যখন শেখ মুজিব দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেলেন না, এমনকি জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন ঢাকায় অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্তকে বাতিল করে জেনারেল ইয়াহিয়া যখন ১ মার্চ ১৯৭১ বেতারের মাধ্যমে ঘোষণা দিলেন তখন পূর্ববাংলা রুদ্ররোষে ফেটে পড়লো। জনগণ ছুটলো হোটেল পূবার্ণীতে বৈঠকরত শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে। নির্বাচিত সদস্যদের বৈঠক থেকে নেবে এলেন এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করলেন। নিন্দা জানিয়ে শেখ মুজিব অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন এবং বললেন ‘৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আমি আমার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবো’। জনগণের বিপুল সমর্থনে শেখ মুজিবুর রহমান যখন পথে-প্রান্তরে মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছেন, তখনই সংগ্রামরত ছাত্রনেতৃবৃন্দ তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। সেদিন ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ এই ঘোষণা দেন। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অধিকার না পাওয়ায় দমন-পীড়নে নির্যাতিত এবং অবহেলা ও অপহরণে ক্ষুব্ধ বাংলা যেন মুক্তিপথের দিশা পেল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বজ্রকণ্ঠ উচ্চারণে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। সামরিক শাসক ক্ষমতালিপ্সুদের পরামর্শে ছলনার আশ্রয় গ্রহণ করলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আহ্বান জানালো সংলাপের টেবিলে। তিনি বসলেন কিন্তু প্রতিদিন বৈঠকের ব্যর্থতা জানালেন সাংবাদিকদের। বাংলার যে অমিততেজ জনগণ শ্লোগান ধরলেন, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ এবং ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা’ তারাই এই ছলনাকে প্রত্যাখ্যান করে গর্জে উঠলেন, ‘গোল টেবিল না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ছলনা সম্পূর্নরূপে ব্যর্থ হলো আর তিনি পিন্ডির উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করলেন। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’র মাধ্যমে গণহত্যা শুরু করলো। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করলো। কিন্তু গ্রেফতারের আগের মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু বাংলার ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ দিয়ে গেলেন।
বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে শুরু হলো প্রতিরোধ। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সহযোগী সংগ্রামী তাজউদ্দীন আহমদ ভারতে গিয়ে নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনার মাধ্যমে গঠন করলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন মন্ত্রীসভা। নয় মাসের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ে আমরা বিজয়ী হলাম। যুদ্ধক্লান্ত ও আত্মবিশ্বাসহীন পাকিস্তান সেনাবাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে সমর্পণ করলো নিজেদের। আর এই অবিস্মরণীয় বিজয়ের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারী ১৯৭২ ফিরে এলেন মুক্ত স্বদেশে। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের রাষ্ট্রপতি। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাকে গড়ে তোলা এবং নিপীড়িত মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য তিনি রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, হলেন প্রধানমন্ত্রী।
বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী ও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পথপরিক্রমায় যে মানুষটি স্বাধীনতার মহানায়ক হিসেবে আবির্ভূত হলেন, সবাই সম্বোধন করলেন জাতির পিতা হিসেবে, তাঁর সাথে আমার স্মৃতিময় অতীতের কথা আজও অম্লান। আমি সাংবাদিকতায় সম্পৃক্ত ছিলাম সেইসাথে প্রগতিশীল রাজনীতির আদর্শে বিশ্বাস করতাম। পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আমি শামিল ছিলাম বলে আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বিভিন্ন সভা-সমিতিতে দেখেছি। তাঁর জলদ গম্ভীর বক্তব্য শুনেছি, শুনেছি বজ্রকণ্ঠের ভাষণও। কিন্তু রাজনীতি ও সাংবাদিকতার বাঁকে বাঁকে আমাকেও বারংবার জেলে যেতে হয়েছে। তাই ১৯৬২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারী আমি যখন দৈনিক আজাদ থেকে রাতের ডিউটি শেষে রাত আড়াইটায় বাড়ি ফিরবো এমনই সময়ে গ্রেফতার হয়ে প্রথমে লালবাগে রাতভর জিজ্ঞাসাবাদের পর পরদিন সকালে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে গেলাম। ২৬ নম্বর সেলে আমার জায়গা হলো। এখানে যাঁদের পেলাম তাঁরা সবাই আমার শ্রদ্ধেয় ও অভিভাবকতুল্য। তারমধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন।
এইখানে তাঁর মতো একজন রাজনৈতিক নেতাকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখার ও জানার সুযোগ হয়েছে আমার। একটানা সাড়ে তিন মাস তাঁর সঙ্গে থেকে রাজনৈতিক সম্পর্কের উর্ধ্বে উঠে একটা প্রীতিধন্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তিনি আমাকে স্নেহ করতেন, জানতেন আমার রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা ভিন্ন, কিন্তু তারপরও তাঁর আচার ব্যবহারে এবং হৃদত্যাপূর্ণ সম্পর্কের কারণে বুঝতে পেরেছিলাম, তিনি কতটা উদার এবং সহনশীল। আমি যখন তাঁকে ‘লিডার’ বলে সম্বোধন করি, তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘তুই আমাকে লিডার বলে ডাকিস না। আমি জানি তোর লিডার কে।’ কিন্তু তারপরেও আমি তাঁকে লিডার বলে সম্বোধন করেছি। অবশ্য পরে তিনি আমাকে ‘ক্যাপ্টেন’ বলে ডাকতেন। তার কারণ হলো, জেলপ্রবাসে থেকে রাজবন্দীদের সময় কাটাবার জন্য নানা ধরণের খেলার ব্যবস্থা থাকতো। সে খেলার মধ্যে সাধারণত দাবা, তাস, ক্যারামবোর্ড ও লুডু খেলার ব্যবস্থা থাকতো আর মাঠে খেলার জন্য সব জায়গায় সুযোগ না থাকলেও ২৬ নং সেলে ভলিবলের একটি কোর্ট ছিল। আমরা তার সদ্ব্যবহার করতাম। দু’টো দলও ছিল আমাদের। একটি দলে বঙ্গবন্ধুও খেলতেন। তাই তিনি সে দলের ‘ক্যাপ্টেন’ আমাকে বানিয়েছিলেন আর এ নামেই ডাকতেন। বঙ্গবন্ধু ভলিবল বেশ ভালোই খেলতেন। তিনি ছিলেন ‘মিডলম্যান’, আবার কখনো কখনো নেটে খেলতেন। লম্বা মানুষটা বল তুলে দিলে নেটে ‘চাপ’ মারা তাঁর জন্য খুবই সুবিধে ছিল। প্রায় প্রতিদিনই বিকেলবেলা আমরা খেলতাম।
তাঁর সাথে মাঝেমধ্যে আলাপচারিতায় রাজনীতি নিয়ে যে কথা হতো না তা নয়। আর সেই আলাপেই বোঝা যেত দেশমাতৃকা ও জনগণ সম্পর্কে কী তাঁর ভাবনা। হালকা মনে হলেও, একদিন তিনি বললেন, ‘দেখ এই পাকিস্তানিদের সাথে আমাদের সম্পর্ক ত্যাগ করা খুব একটা কঠিন নয়। পিআইএ (পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স) বন্ধ করে দিলেই সব ল্যাঠা চুকে যাবে তবে তোদের ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ভেঙে দিতে হবে।’ কথাটা শুনে আমি বললাম, ‘লিডার, ওরা তাহলে সমুদ্র দিয়ে যুদ্ধজাহাজ নিয়ে বঙ্গোপসাগরে হাজির হবে।’ তিনি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ব্যাপারটাকে তুচ্ছ করে বললেন, ‘আরে রাখ্, ওরা তো সাঁতার জানে না। ওদের ডুবিয়ে মারবো’। কথাটা যত হালকাভাবেই তিনি বলে থাকুন না কেন, তাঁর মনে বাংলার মুক্তিসংগ্রামের যে পূর্বাভাস এ মনে হয় তারই প্রকাশ ছিল।
আমার যখন মুক্তির নির্দেশ আসলো, তখন আমাদের সেলের সবাই মুক্তি পেয়ে গেছেন, ছিলাম মাত্র শেখ মুজিব, রণেশ দাশগুপ্ত এবং আমি। তাই অর্ডারটা হাতে নিয়ে লিডার বললেন, ‘তুইও চলে যাবি। ভেবেছিলাম আমরা বুঝি থেকে গেলাম। যাবিই যখন, বিছানাপত্র গুছিয়ে নে।’ আমি আমার বিছানাপত্র গুছিয়ে নিতে গিয়ে যখন বাড়ি থেকে দেওয়া খাতায় হাত দিলাম তখন চমকে উঠলাম কারণ দেখলাম তাতে অনেকগুলো পাতা নেই। বাইরে থেকে যে খাতা ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয় তা গোয়েন্দা বিভাগ থেকে পৃষ্টাগুলোর নাম্বার দিয়ে কত পাতা আছে তার উল্লেখ করে যে রাজবন্দীকে দেওয়া হচ্ছে তার নাম লিখে, সিল মেরে তারপরেই দেওয়া হয়। আমি যখন মুক্তি পাচ্ছি তখন তো জেলগেটে সবকিছু চেক করতে গেলে খাতার ব্যাপারটা ওদের চোখে পড়ে যাবে আর তাহলে জেলের নিয়ম অনুযায়ী আমার কারাদন্ড বেড়ে যাবে ফলে মুক্তি পাব না। এই না দেখে আমি খুবই চিন্তিত হয়ে গেলাম। লিডারকে বললাম আমার খাতার দুরবস্থার কথা। তিনি হাতে নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখলেন। তিনি আমাকে জিগ্যেস করলেন, ‘তুই কি বউমাকে চিঠি লখেছিস এসব কাগজে?’ আম জবাব দিলাম, ‘না, কারণ ১৫ দিনে চিঠি লেখার জন্যে যে একটা পাতা পেতাম তাতেই আমার হ’য়ে যেত কারণ আমার হাতের লেখা খুবই ছোট ছিল। দুই পৃষ্ঠার কোন জায়গাই খালি থাকত না’। এবারে তিনি বললেন, ‘তাহলে করলোটা কে?’ বলেই তিনি চিন্তা করতে শুরু করলেন। একটু পরে মুচকি হেসে বললেন, ‘এবার বুঝতে পেরেছি চোর কে’। একটু থামলেন তারপর আবার বললেন, ‘এটা বরিশালের নুরুল ইসলাম মঞ্জুর কাজ, বিয়ের পরপরই ও গ্রেফতার হয়ে গিয়েছিল’ এরপর জমাদারকে বললেন, ‘যে ডেপুটি জেলার গেটে থাকবে তাকে বলিস আমি বলেছি ওর বিছানাপত্র সার্চ না করতে’। যাই হোক অবশেষে আমার জিনিসপত্র নিয়ে বিদায় নিলাম শেখ মুজিবুর রহমান ও রণেশ দাশগুপ্তের কাছ থেকে। জেলগেটে দায়িত্বরত ডেপুটি জেলার লিডারের কথাকে সম্মান জানিয়ে আমার সাথের জিনিসপত্র চেক করলেন না।
আমি তখন বাংলাদেশ বেতার ঢাকার পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের নির্দেশে। সে ছিল ২৫ ডিসেম্বর ১৯৭১। বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন মুক্ত স্বদেশে ১০ জানুয়ারী ১৯৭২। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে আমরা বাংলাদেশ বেতার মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের নিয়ে বৈঠক করে ঠিক করলাম, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা হবে এবং রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত মোট ৩ টি স্পট থাকবে এবং সেখান থেকে ধারা বিবরণী প্রচার করা হবে। ভারত থেকে আকাশবাণী দিল্লীর ইংরেজি ও উর্দু সংবাদপাঠক সুরজিৎ সেন ও কে কে নায়ার এবং কলকাতার দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায় এসে পৌঁছোলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ধারা বিবরণী দেওয়ার জন্য। আমরা চলতি ধারা বিবরণী প্রচারের জন্য তেজগাঁ বিমানবন্দর, ফার্মগেট ইন্দিরা রোড মোড়, বেতার ভবন ও রেসকোর্স ময়দান এই চারটি পয়েন্ট নির্ধারণ করে ধারা বিবরণী প্রচারের দায়িত্ব দিলাম টি এইচ শিকদার, শহীদুল ইসলাম, মোস্তফা আনোয়ার ও আশরাফুল আলমকে আর আমার সাথে তেজগাঁ বিমানবন্দরে থাকলেন আশফাকুর রহমান খান এবং ভারত থেকে আগত বন্ধুরা। ১০ জানুয়ারী যখন বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বৃটিশ বিমানটি বাংলার আকাশে দৃশ্যমান হলো তখন থেকেই আমরা আবেগে আপ্লুত হয়ে ধারা বিবরণী প্রচার করতে শুরু করলাম। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষক, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আগমনকে স্বাগত জানিয়ে ইতিহাসের পাতা থেকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক পরিক্রমার ঘটনাপঞ্জি প্রচার যখন করছিলাম তখনই শ্বেতহংসের মতো সেই বিমানটি যুদ্ধবিধ্বস্ত তেজগাঁ বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করলো। আমরা শিহরিত, উৎফুল্ল, আনন্দে বিহ্বল। আবেগে বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার উজার করে গর্বিত মহামানবকে অভিনন্দন জানালাম। দূর থেকে লক্ষ্য করলাম, বিমানের দরজা খুলে গেল, সামনে এসে দাঁড়ালেন ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’ বীর। বিজয় আনন্দে উদ্ভাসিত দেশমাতৃকার মুক্তিদাতা শেখ মুজিবুর রহমান। আর ডান হাতে পাইপ, ক্লান্ত অথচ নন্দিত মহান পুরুষ বা হাতে মাথার চুলটাকে সরিয়ে চোখটাকে প্রসারিত করলেন রানওয়ের দিকে। ইতিমধ্যেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সিঁড়ি দিয়ে উঠে তাঁকে পুষ্পার্ঘ নিবেদন করে অভিনন্দন জানালেন, স্নেহভরে তার বুকে মাথা রেখে রোরুদ্যমান তাজউদ্দীনকে দেখলাম দূর থেকে। পরক্ষণেই রানওয়েতে বঙ্গবন্ধু তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমানকে একটি হুইল চেয়ারে দেখতে পেলেন। সবেগে ছুটে গেলেন পিতার কাছে। হাঁটু মুড়ে বাবার বুকে মাথা রেখে এবারে কাঁদলেন বঙ্গবন্ধু। মৃত্যু যার জন্য অপেক্ষা করছিল পশ্চিমের কারাগারে, সেখান থেকে বিজয়ী জাতির গর্বে এবং বিশ্ববাসীর চাপে মুক্ত মুজিব ফিরে এলেন মাতৃভূমিতে।
বিমানবন্দরে মিত্রবাহিনী তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করলো। আর তখনই বিমানবন্দরের ছাদ থেকে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম- সে কি এক বিপুল বিশাল জনসমুদ্র। জনসমুদ্রই নয় শুধু, পথের পাশে বাড়িঘরের বেলকুনিতে, বারান্দায়, ছাদে, জানালার ফাক দিয়ে কত না চোখ শুধুই বঙ্গবন্ধুর দিকে তাকিয়ে। অসংখ্য মানুষ উঠেছে পাশের গাছগুলোতে, ডালের পাতা দেখা যাচ্ছে না, কেবলই মানুষ তাতে। যেখানেই একফালি মাটি কিংবা ফাঁকা জায়গা সেখানেই মানুষের ভীড়। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু যাবেন রেসকোর্স ময়দানে। বিমানবন্দরে মিত্রবাহিনীর নিরাপত্তা বিধানের কথা। তারা তৎপর ব্যবস্থাপনায়। কিন্তু উপস্থিতি দেখে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে যাবেন, কি করে যাবেন। এই বিশাল জনসমুদ্রে উন্মুখ চোখগুলোকে প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন না বঙ্গবন্ধু তাই মোটর গাড়িতে না গিয়ে তিনি খোলা ট্রাকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। নিরাপত্তা বাহিনীর আপত্তি তুচ্ছ হয়ে গেল বলিষ্ঠ, সাহসী ঐ বিজয়ী বীরের কাছে। বঙ্গবন্ধু উঠলেন খোলা ট্রাকে। তাঁকে ঘিরে রাখলেন ছাত্র ও যুবনেতারা – শেখ ফজলুল হক মনি, নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, তোফায়েল আহমেদ, শাহজাহান সিরাজ; এদের সাথে কুচক্রী মোশতাকও রইলেন, আরেকপাশে রইলেন তাজউদ্দীন আহমেদ। জনতার সে কি উল্লাস। মুর্হূমুর্হূ শ্লোগান, বিপুল করতালিতে উচ্চকিত চতুর্দিক। চলেছে ট্রাক, ভাসছে যেন একটি নৌকা। যে রাস্তা মোটরযানে ১০ মিনিটে অতিক্রম করা যায়, তাকে অতিক্রম করতে লেগে গেল প্রায় দু’ঘন্টা। আর আমরা বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইলাম বঙ্গবন্ধুর যাত্রাপথের দিকে। কথা ছিল আমরা যারা এই ছাদে দাঁড়িয়ে ধারা বিবরণী দিচ্ছি তারাই শেষে রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সেখানকার মঞ্চে উপস্থিতি সম্পর্কে বর্ণনা দেবো। কিন্তু তা ছিল অসম্ভব। এই অসহায়ত্বের কথা বেতার ভবনে জানিয়ে দিলাম এবং অনুরোধ করলাম ওখান থেকে হেঁটে গিয়ে রেসকোর্সের মঞ্চে কেউ যেন উপস্থিত থাকেন ধারা বিবরণী দেওয়ার জন্য। …কী যে স্মৃতিময় মুহূর্তগুলো আমার জীবনকে আপ্লুত করলো তা মনে করলে আজও শিউরে উঠি। মানুষের কী প্রবল আকাঙ্খা আর প্রত্যাশাই না সেদিন লক্ষ্য করেছি যা আজও চোখের সামনে ভেসে উঠলে প্রবলভাবে আন্দোলিত হই।
১২ জানুয়ারী ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। তিনি বাংলার জনগণের কাছে তার প্রথম বেতার ভাষণ দেবেন। আমরা গেলাম গণভবনে (পুরনো প্রেসিডেন্ট হাউজ), উদ্দেশ্য তাঁর ভাষণ রেকর্ড করবো। আমরা চেষ্টা করলাম কিন্তু ব্যর্থ হলাম। আমাদের ব্যর্থতা দেখে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘চল বেতারে’। এলেন তিনি শাহবাগের বেতার ভবনে। ৬ নম্বর স্টুডিও থেকে তিনি ‘এক্সটেম্পর’ ভাষণ দিলেন। আমরা শুনলাম, ভাবলাম বাণীবদ্ধ ভাষণের চেয়ে এই উন্মুক্ত ভাষণই অনেকবেশী ক্ষুরধার, আবেগে আপ্লুত এবং পথ নির্দেশক। সেও আরেক স্মৃতি যা আজও ভুলতে পারিনি।
১৯৭৩, শীতকাল। শাহবাগ বেতার ভবনের সামনের বাগানে আয়োজন হয়েছে তিনদিনব্যাপী ‘লোকসঙ্গীত উৎসব’ যা সম্প্রচারও করা হচ্ছে সরাসরি। অনুষ্ঠানে চলছে লোকসঙ্গীতের নানা ধরনের গান। পরিবেশন করছেন শিল্পীরা। এরমধ্যে সময় এল গম্ভীরা। কুতুবুল আলম ও রাকিবুদ্দীনের ‘নানা-নাতি’র রসালো সংলাপে উপস্থাপিত এই সমালোচনামূলক গান যা কেবল রাজনীতি থেকে শুরু করে সমাজের সকল ক্ষেত্রের অন্যায়-অবিচার এসবের প্রতিবাদ করে এই গানের মাধ্যমে। আবার সমস্যা ও সংকটের বিবরণ দিয়ে সমাধানও বাতলে দেয় গায়কীর মাধ্যমে। এমনই সময়ে বিনা পূর্বাভাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হয়েও আকস্মিকভাবে উপস্থিত হলেন লোকসঙ্গীত উৎসবের মন্ডপে, শাহবাগ বেতার ভবনে। ঢুকেই তিনি যেন তার উপস্থিতিতে গান বন্ধ না হয় সেজন্য ইশারা করলেন। বসলেন মন্ডপে, গান চললো। এবারে ‘নানা’ কুতুবুল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে লক্ষ্য করে গান বাঁধলেন। তাঁকে ‘বড় নানা’ সম্বোধন করে গান চালিয়ে গেলেন। আর তাতেও সমালোচনার ধার কম ছিল না। গম্ভীরা শেষ হলো। বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়ালেন। কুতুবুল আলম ছুটে এলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। এবারে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বুকে চেপে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘গা, এমনই করে সব অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দে’। … প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রহমানের লোকসঙ্গীত উৎসবে আকস্মিক উপস্থিতি উপস্থিত দর্শক জনতাকে হতবাক করে দিয়েছিল। আবার কুতুবুলকে বুকে ধরে স্নেহভরে যে কথাগুলো বললেন তা শুনে সবাই আমোদিত হলেন। কেবল ভাবলেন – এই তো আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কি বিশাল বিরাট হৃদয়ের মানুষ তিনি।
১৯৭২’র ফেব্রুয়ারী, বঙ্গবন্ধু যাবেন কলকাতা। পাকিস্তান থেকে মুক্তির পর তিনি লন্ডন থেকে দিল্লী হয়ে সরাসরি ঢাকা পৌঁছেছিলেন। কিন্তু কলকাতা আর আগরতলা তো ছিল মুক্তিযুদ্ধের দুটি উল্লেখযোগ্য স্থান। একটি কলকাতা, যেখানে ছিল বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয়, বাংলাদেশ মিশন ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। আর শরণার্থী সকল মানুষের আগমন ও যোগাযোগের জায়গা ছিল এই কলকাতা। আগরতলা তো আমাদের প্রতিবেশী। সীমানা পেরিয়ে অসংখ্য মানুষ যখন আগরতলা শহরে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন তখন ত্রিপুরাবাসী সরকারের কি যে বদান্যতা ও মহানুভবতা তা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। একটি উদাহরণ দেই। আগরতলা শহরের যে লোকসংখ্যা তার চেয়েও বেশি ছিল শরণার্থী। এমনও ঘটেছে গৃহবাসীরা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়ে নিজেরা বাইরে গিয়ে শুয়ে থেকেছেন। এ তো গেল হৃদ্যতা ও আন্তরিকতার সম্পর্ক। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গন হিসেবে আগরতলা আমাদের কাছে ছিল সবচেয়ে সহযোগিতাপূর্ণ। এছাড়া অনেক কারণেই আগরতলা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
…বঙ্গবন্ধু যাবেন কলকাতায়, আমরা হবো তার সাথী। তার আগে একদিন বাংলাদেশ বেতারের পক্ষ থেকে আমি ও ডিরেক্টর ইনচার্জ বাংলাদেশ বেতার আশরাফুজ্জামান খান রমনা গণভবনে দেখা করতে গেলাম। উদ্দেশ্য, একুশে ফেব্রুয়ারীর অনুষ্ঠানে কলকাতা থেকে কয়েকজন শিল্পী ও সাহিত্যিককে আমন্ত্রণ জানানোর অনুমতি চাইবো। যখন তাঁকে বিষয়টি সম্পর্কে বললাম তখন তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোর তো ঘরদোর ভাঙা, অতিথি ডাকবি থাকতে দিবি কোথায়।’ আমরা তো অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে রইলাম। আবেগে হয়তো বলেছি কথাটা কিন্তু ভাবিনি তো সে কথা। যাই হোক বঙ্গবন্ধুর সাথে আমরা বেতারের লোকজন কলকাতায় যাব। তাঁর কলকাতায় উপস্থিতি ধারাবিবরণীর মাধ্যমে বাংলাদেশ বেতারে সরাসরি প্রচার করা হবে। যতদূর মনে পড়ে ধারাবিবরণী দেওয়ার জন্য বেতারের পক্ষ থেকে আমি ও আশফাকুর রহমান খান থাকবো ঠিক হলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু টেলিভিশনের সংবাদপাঠক তাজুল ইসলামকে খুব পছন্দ করতেন। তাই তাকে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মুনীরুজ্জামানকেও নিতে বললেন। আমরা পড়লাম বিপাকে। যাই হোক আমরা সবাই মিলে কলকাতা গেলাম। আমি এবং বেতারের আঞ্চলিক প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান দু’জনে আকাশবানী কলকাতায় পরিচালকের সাথে দেখা করলাম এবং দমদম থেকে সরাসরি সম্প্রচারের কি ব্যবস্থা করা যায়, সে ব্যাপারে পরামর্শ চাইলাম। তিনি বললেন, ‘কাল তো অফিস বন্ধ, কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হবে না তবে আপনারা দমদম বিমানবন্দরে গিয়ে ওখানকার লোকেদের সঙ্গে আলাপ করলে ব্যবস্থা হতে পারে।’ একদিন পরে সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী যথাক্রমে ঢাকা এবং দিল্লী থেকে কলকাতায় আসবেন, আমরা তো তাঁদের আগমনকেও সরাসরি সম্প্রচার করতে চাই। ছুটলাম দমদম বিমানবন্দরের দিকে। সেখানে যে কর্মকর্তা ছিলেন তাঁর সাথে দেখা করতেই তিনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন; বললেন, ‘কই ফিক্র্ মাত্ কি জিয়ে, সব হো যায়েগা’। ধরে পানি এল। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী আমরা পরদিন সকালে বিমানবন্দরে এসে কানেকশন নিয়ে ‘কগনেটো’ টেলিফোনের মাধ্যমে ঢাকায় বাংলাদেশ বেতারের সাথে যোগাযোগ করে সব ঠিক করে ফেললাম। আমাদের যত আয়োজন, তা ছোট্ট একটি টাইপরাইটার মেশিনের মতোন যন্ত্রের মধ্যে। দক্ষ প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঢাকার সাথে কথা বলে দু’টো লাইন প্রতিষ্ঠা করে ফেললেন। আমরা তো সব ঠিক হয়ে যাওয়ার পর আকাশবাণীর কমেন্টেটরদের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই অভিজ্ঞ ধারাভাষ্যকার অজয় দাস জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়ে গেল?’ আমরা বললাম, ‘হ্যাঁ’। ওরা বিস্ফারিত চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে শুধোলেন, ‘এতটুকু সময়ে সব শেষ করে ফেললেন।’ আমাদের জবাব ছিল, ‘দাদা, আমরা ধার করে খেয়েছি তবে খাঁটি ঘি খেয়েছি তাই’। ভদ্রলোক দীর্ঘদিনের জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার, আকাশবাণীর সাথে যুক্ত। তার সহযোগী ভাষ্যকার ছিলেন ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক সুনন্দ দত্ত রায়। এবারে তাঁরা অভিনন্দন জানালেন।
…হঠাৎ দেখলাম আকাশের কোণে কালো মেঘের ঘনঘটা। চট্জলদি ব্যবস্থা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। সামান্য বৃষ্টি হলো। বিমানবন্দরের রানওয়েতে দেখলাম মাঝে মাঝে সামান্য জল জমেছে। নির্ধারিত সময়ের ঠিক আগেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর সহযোগী ক’জন মন্ত্রীকে নিয়ে এসে পৌঁছলেন দিল্লী থেকে। সময় হয়ে গেছে বঙ্গবন্ধুর আসার। আমরাও প্রস্তুত। পূব আকাশের একটা কোণে খানিকটা কালো মেঘ আড়াল করে আছে। এই পথেই বাংলাদেশ বিমানের উড়োজাহাজটি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে দমদমে এসে নাববেন। আমরা অপেক্ষায়। আশফাক বললেন, ‘লোহানী ভাই, মেঘটা কেটে গেছে, একঝিলিক রোদ্দুর সোনালী আলো ছড়িয়ে দিয়েছে রানওয়েতে।’ আমরা সবাই প্রচন্ড শিহরিত আর অপেক্ষমাণ। তাজুল ইসলাম খবর পাঠক তাই তিনি পকেট থেকে হাতে লেখা কাগজ বের করলেন, পড়লেন। আর মুনীরুজ্জামান অধ্যাপক মানুষ, ধারাভাষ্যে অভ্যস্ত নন, তবু তিনি বাঙালির সভ্যতা সংস্কৃতি ও বিজয়গাথা নিয়ে কথা বলছিলেন। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর উড়োজাহাজটি দমদমের আকাশে দৃশ্যমান হওয়ার পর ওঁরা থেমে গেলেন। জাহাজ থামলো রানওয়েতে; ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর সঙ্গীরা নাবলেন। এরপর বঙ্গবন্ধুকে বহন করে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট এসে থামলো দমদমে। উচ্ছ্বসিত আমরা সবাই, বিপুল আনন্দে ও আবেগে বঙ্গবন্ধুর আগমনকে কলকাতায় স্বাগত জানিয়ে আমরা আমাদের ধারাবিবরণী প্রচার করলাম। আর আকাশবাণী থেকে অজয় দাস ও সুনন্দ দত্ত রায় বঙ্গবন্ধুকে তাঁদের শব্দমালায় পশ্চিমবঙ্গ মানুষের অভিনন্দন জানালেন। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটি আদতেই ধারাভাষ্যকার শুধু নয় বিমানবন্দরে উপস্থিত বিপুল দর্শক, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর সহচর মন্ত্রীবর্গ এমনকি ভারতের অগণিত শ্রোতার কাছে চির স্মরণীয় হয়ে থাকলো।
বঙ্গবন্ধু পৌঁছুলেন কলকাতা শহরে মানুষের বিপুল করতালি আর আনন্দ উল্লাসের মধ্য দিয়ে। রাজভবনে থাকবেন। বিকেলে বক্তৃতা করবেন গড়ের মাঠে। আমরা সবাই – বাংলাদেশ বেতার ও আকাশবাণী এবং বাংলাদেশ টেলিভিশন পৌঁছে গেছে ময়দানে ইতিমধ্যেই। আমাদের ঢাকার সাথে যোগাযোগ করতে হবে আর আকাশবাণী করবে কলকাতা দিল্লী ও বিভিন্ন কেন্দ্রের সাথে। আমরা সবাই প্রচার করবো গড়ের মাঠে তৈরি বিশাল মঞ্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বক্তৃতা। দেখলাম ক্রমে গড়ের মাঠ মানুষে মানুষে ভরে উঠলো। এই তো মানুষগুলো একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় অবারিত আবেগে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ শুনেছেন এবং আপ্লুত হয়ে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাকে সশস্ত্র লড়াইয়ে সহযোগিতা করেছেন, আশ্রয় দিয়েছেন হাজার হাজার শরণার্থীকে। আর সেইসাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হয়েছেন। আজ সেই ইপ্সিত মানুষ দেবতাকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে উচ্ছ্বসিত জনতার ঢল। বজ্রকণ্ঠের বক্তৃতা শুনছেন আর করতালি এবং জয়বাংলা শ্লোগানে মুখর করে তুলছেন তল্লাট। শ্লোগানে শ্লোগানে শিহরিত দশদিক। আমরা তো দেখেছি শারদীয় উৎসবকালে সার্বজনীন দূর্জাপূজার সময় আনন্দময়ীর আগমনে যখন সারা বাংলা মুখরিত, তখন কী এক অভাবিতপূর্ব দৃশ্য দেখেছি কলকাতার প্রতিটি মণ্ডপে। দেবীদর্শনে যারা এসেছেন মণ্ডপে মণ্ডপে, তাদের পা থেমে গেছে মাঝখানে একটি ছবির সামনে। দিয়েছেন ফুলের মালা, পড়িয়েছেন ফুলচন্দন। অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে দেখেছেন দর্শনার্থী নরনারী এই সেই বঙ্গবন্ধু, যার বজ্রকণ্ঠের ঘোষণায় বাংলার বিপুল জনগোষ্ঠি মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন শত্রুবধের উৎসবে। কেউ পরোয়া করেনি প্রাণের। এই যে দুঃসাহস তারই আধার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমরা যারা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ছিলাম, কাজের অবসরে যখন সুযোগ পেয়ে এই দৃশ্য দেখেছি, শ্রদ্ধাবনত মানুষগুলোর প্রতি আমাদের প্রাণ স্পর্শ করেছে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে।
পরদিন সকালে বঙ্গবন্ধুর সাথে আমাদের দেখা হলো যখন একটি অনুষ্ঠানে, তখন তিনি কাছে ডেকে কানে কানে বললেন, ‘এই নিরাপত্তাটা সরিয়ে নিতে বল, একবার পার্ক সাকার্সে গিয়ে সাগু মিয়ার হোটেলের চা খেয়ে আসি।’ এই রসিকতা শুনে আমি শ্রদ্ধাভরে বললাম, ‘লিডার, আজ আপনার যে জায়গা তাতে নিরাপত্তা সরিয়ে নেবে কি করে?’ তিনি আমার দিকে তাকিয়ে রসপূর্ন এক জবাব দিয়ে বললেন, ‘আমাকে কেউ আক্রমণ করতে আসবে, ঐ গুণ্ডাদের তো আমি দুই পকেটে রাখি।’ ভাবলাম ইসলামীয়া কলেজের সেই তরুণ ছাত্রনেতা কী বিপুল সাহসেই না কথাগুলো বলছেন! মনে মনে বললাম, লিডার, এখন আর এইভাবে চা খানায় যেতে দেবে না আপনাকে। সেদিনের সেই তাবৎ স্মৃতি – বিমানবন্দর থেকে গড়ের মাঠ তারপর রাজভবন, কিছুই আজও ভুলিনি। …এখানে একটি কথা বিশেষ করে উল্লেখ করতে চাই, বাংলাদেশ টেলিভিশনের যে দুটি আউটডোর ভ্যান কলকাতায় গিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর গড়ের মাঠের জনসভা প্রচার করার জন্য, তাকেও দেখতে উৎসুক মানুষের প্রচণ্ড ভীড় যেমন ছিল গড়ের মাঠে তেমনি সড়কপথে ঢাকা যাওয়ার স্থানে স্থানে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকা মানুষগুলোর ভীড় দেখেছি। উল্লেখ্য, ভারতে তখনও টেলিভিশন চালু হয় নি।
অজস্র স্মৃতি আজ মনে পড়ছে, সবগুলোই এমন হৃদ্যতাপূর্ণ ছিল যে, আজও ভাবি রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এমন কোন শীর্ষ নেতা কি আর আসবেন। মনে পড়ছে, সাপ্তাহিক ‘হলিডে’ পত্রিকার সম্পাদক এ জেড এম এনায়েতউল্লাহ খানকে গ্রেফতারের পরোয়ানা নিয়ে ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক এ বি সফদার বসে আছেন গণভবণে। কারণ সম্পাদকস্থানীয় কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে গেলে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি লাগে। আর আমরা – বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি দৈনিক বাংলার সহকারী সম্পাদক নির্মল সেন ও সেক্রেটারি জেনারেল ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিনিধি গিয়াস কামাল চৌধুরী এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ও দৈনিক জনপদের বার্তা সম্পাদক কামাল লোহানী ও সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ অবজারভারের সিনিয়র রিপোর্টর রিয়াজউদ্দিন আহমেদ, চারজন এনায়েতউল্লাহ খানকে সঙ্গে নিয়ে গণভবনে গিয়ে হাজির। দেখলাম সফদার ফাইল নিয়ে বসে আছেন। আমরা ঢুকতেই প্রেস সেক্রেটারি তোয়াব খান বললেন, ‘আজ আপনাদের দেখা হবে না। বঙ্গবন্ধু বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের সাথে বৈঠকে।’ তোয়াব আরও বললেন, ‘যেদিন কোন বাহিনী প্রধান দেখা করতে আসেন সেদিন নেতা কাউকে সাক্ষাৎকার দেন না।’ আমরা বললাম, ‘কোন না কোন সময় বৈঠক তো শেষ হবে। তখন দেখা করবো।’ সহকারী প্রেস সেক্রেটারি আমিনুল হক বাদশা কিছুক্ষণ পরে বললো, ‘দাঁড়ান আমি লিডারকে খবরটা জানিয়ে আসি।’ হয়তো বাদশা বুঝতে পেরেছিল আমরা কেন এসেছি । কারণ সঙ্গে তো এনায়েতউল্লাহ খান মিন্টুও ছিল। আমরা যদি সেদিন বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে মিন্টুর গ্রেফতারের বিষয়টা বাতিল অথবা স্থগিত করতে না পারি তাহলে ওকে তো আটক করবে। তাই আমরা অপেক্ষায় রইলাম, যখনই বৈঠক শেষ হোক আমরা দেখা না করে যাচ্ছি না। সবচেয়ে বিষ্ময়কর ব্যাপার হলো, দেশের প্রধানমন্ত্রী তাও আবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি অথচ কোন আগাম অ্যাপয়নমেন্ট করিনি। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ন ও জরুরী, তাই আমরা সরাসরি গণভবনে এসে পৌঁছে গেছি। শুনলে অবাক হবেন, আমরা তো অপেক্ষা করছিলাম; কিন্তু বঙ্গবন্ধু কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে হাজির হলেন, দাঁড়ালেন গণভবনের লম্বা দরজায় দু’টো হাত রেখে বললেন, ‘কি হুকুম?’ আমরা বললাম, ‘হুকুম তো আপনি দেবেন’। নির্মল সেন বললেন, ‘একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আপনার সাথে আলাপ আছে’। তিনি বললেন, ‘চলেন তাহলে উপরে’। …বঙ্গবন্ধু আমাদের সাথে যে ভাষায় কথা বলছেন তা তো আমরা কেন কেউই ভাবতে পারি না। আর ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেন সাধারণত রেগে গেলে। অবশ্য রস করেও বলতেন কখনো কখনো। আমরা ওপরে গেলাম। সামনের যে লম্বা ঘরটায় তিনি সাধারণত লোকজনের সাথে দেখা করেন সেখানটায় কেবল আমরা বসলাম, সঙ্গে এনায়েতউল্লাহ খান। আমরা চিন্তিত বঙ্গবন্ধু না জানি কতটা ক্ষেপে আছেন! প্রথমেই নির্মলদা কথাটা পাড়লেন, ‘বঙ্গবন্ধু, আমাদের সাথে এনায়েতউল্লাহ এসেছে। ওর বিরুদ্ধে আপনার অভিযোগ আছে, আবার এনায়েতউল্লাহরও কিছু অভিযোগ আছে আপনার বিরুদ্ধে। আমরা চাই এ বিরোধ পারস্পরিক আলাপে নিষ্পন্ন হোক।’ বঙ্গবন্ধু স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে এনায়েতউল্লাহর দিকে আঙুল দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও কখনো আসতে চাইলে আমি কি আপত্তি করেছি?’ নির্মলদা বললেন, আজ আপনারা একান্তে বসে এটার ফায়সালা করেন। তারপর দু’জনকে আমি ও নির্মলদা পাশের ছোট্ট গোলাকার কামরাটিতে ঢুকিয়ে বিশাল দরজা দুটি লাগিয়ে পর্দা টেনে দিলাম। ভাবুন তো পাঠক, এও কি সম্ভব দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে? কিন্তু বঙ্গবন্ধু এমনই এক ব্যক্তিত্ব যার সাথে আমাদের সম্পর্কটা এতই মধুর যে, তার উদার মনোভাবের রূপ এমনই করে বহু দেখেছি।
বসে আছি। আর ঐ ছোট্ট কামরা থেকে প্রচণ্ড গর্জন শুনতে পাচ্ছি। উভয়েই জোরে জোরে কথা বলছেন। মাঝেমাঝে টেবিল চাপড়াচাপড়িও হচ্ছে। ১৫ মিনিট পরের দৃশ্য। অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে দেখলাম আর দু’জনেই সহাস্যে বেরিয়ে আসছেন। এনায়েতউল্লাহ এসে তার আসনে বসলেন। বঙ্গবন্ধু সামনেই আমাকে পেলেন। হাত ধরে টেনে ঐ কামরার জানালার কাছে নিয়ে আমাকে কানে কানে বললেন, ‘এখন মিন্টু অ্রারেস্ট হবে না।’ আমি বললাম, ‘লিডার কাগজটার কি হবে?’ তিনি জবাবে বললেন, ‘আমি একটা পার্টি করি। এখন অ্যারেস্টটা বন্ধ করলাম, পত্রিকাটা পরে দেখবো। একবারে যদি করি তাহলে পার্টির লোকজন তো ক্ষেপে যাবে রে।’ ইতিমধ্যেই দৈনিক আজাদের সাংবাদিকদের একটি দল নির্ধারিত সাক্ষাৎকারে এসেও ঐ কামরায় বসেছে। আজাদের বেহাল অবস্থা নিয়ে আলোচনা করবে। ওরাও উৎসুক হয়ে তাঁকিয়ে দেখলো, বঙ্গবন্ধু যেন আমাকে কি বললেন। এসে বসলেন ওনার আসনে; বললেন, ‘অ্যারেস্ট হবে না’। আমরা তো খুশিমনে গণভবন থেকে বেরিয়ে আসলাম। … ভাবুন তো, কোন দেশের ক্ষমতাসীন শীর্ষ ব্যক্তির সাথে কি এমনভাবে দেখা করা যায়! এখানে উল্লেখ্য, এ জেড এম এনায়েতউল্লাহর সম্পাদিত সাপ্তাহিক হলিডেতে এনায়েতউল্লাহ জালালাবাদ প্রদেশ ও বঙ্গবন্ধুর পরিবারের ব্যাংক একাউন্ট নিয়ে রিপোর্ট ও সম্পাদকীয় ছেপেছিল। ঐ অসত্য ভাষণের জন্য এনায়েতউল্লাহ খানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি প্ররোয়ানা জারি করা হয়েছিল এবং পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করে লেখাটি শেষ করতে চাই। একবার আমরা সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে গেছি সেও এই গণভবনেই। কথা বলতে বলতে প্রসঙ্গ পাল্টে উনি আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে তোরা কি বিদেশ থেকে টাকা এনে রাজনীতি করিস?’ আমি তো হক্চকিয়ে গেছি। একটু থেমে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তোর ভাই ফজলে লোহানী বিদেশ থেকে টাকা এনে দেশে রাজনীতি করছে। ওকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’ আমি যে জানি সেটা বুঝিয়ে মাথা নাড়লাম। তারপর তিনি বললেন, ‘ওর স্ত্রী এবং শ্বাশুড়ি এসেছিল ওর সঙ্গে জেলখানায় দেখা করার অনুমতি চাইতে। আমি বারণ করে দিয়েছি দেখা হবে না।’ কথাটা আমাকে শোনালেন, মনে হলো বিদেশের অর্থে যারা রাজনীতি করেন তাদের বিরুদ্ধে তার যে ঝাল, সেটা আমাকেও শোনালেন। পরের দিন ফজলে লোহানীর স্ত্রী এলিজাবেথ লোহানী আমাকে টেলিফোন করে জানালেন, ‘আজ তোমার ভাইয়ের সাথে দেখা করে এলাম’। ভাবলাম বঙ্গবন্ধু যতটা কঠিন শাসনকর্তা ততটাই মহৎ মানবিক আচরণে।
আরও যে কত স্মৃতি তাঁর রাজনৈতিক পরিক্রমায় আমার ব্যক্তিগতভাবে হয়েছে তার অন্ত নেই। অসহযোগ আন্দোলনের সময় পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি তাঁর কাছে কত যে পরামর্শ নিয়েছি সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও কৌশল বিষয়ে তা আজ মনে পড়ছে। এই মহৎপ্রাণ রাষ্ট্রনায়কের রাজনৈতিক জীবনের বহু স্মৃতি উহ্য রেখেই লেখাটি শেষ করলাম।
১৪.১০.২০১৯
লেখক:
কামাল লোহানী, ভাষা সংগ্রামী, শব্দসৈনিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব