শাহনেওয়াজ ছাত্রাবাসের দোতলায় ৯ নম্বর রুমে থাকি, ১৯৭৩ সালে। আর্ট কলেজে ভর্তির পর কার্টুনিস্ট নজরুল ভাইয়ের আনুকুল্যে, তারই সিটে ডাবলিং করি। উত্তম দেও শেখরদার কারণে থাকে। আমি উত্তম একইসাথে ভর্তি হই ১৯৭২ সালের শেষ দিকে। নজরুল ভাই জানালেন নিয়ম বিহীন এই ভাবে ছাত্রাবাসে থাকার পরোক্ষ সম্মতি দিয়েছেন স্বয়ং হোষ্টেল সুপার সমরজিৎ স্যার, কোনো অনিয়ম অন্যায় হবে না আমাদের দ্বারা এই শর্তে। আসলে আমাদের ক্লাসের আরো অনেকেই সিনিয়রদের সহযোগিতায় এইভাবে হোষ্টেলবাসি। ৯ নম্বর রুমটি ছিলো আসলে ১০ নম্বর কক্ষ, দোতলায় প্রথম রুমটিতে থাকতেন দুইজন শিক্ষক ভাস্কর হামিদুজ্জামান ও ইংরেজির শিক্ষক শাহেদ স্যার। তাই সেই রুমটি গণনায় বাদ দেয়া হতো।
আমাদের ইংরেজি ক্লাসে স্যারের সাথে বিবাদ বাধে, ক্ষোভ প্রকাশের পদ্ধতি হিসাবে আমি ও উত্তম স্যারের রুমের দরজার নিচ দিয়ে বাগানে দেয়ার পানির পাইপ এনে গভীর রাতে কল ছেড়ে কিছু পানি ঢুকিয়ে দেই। পরদিন সমরজিৎ স্যারের কাছে নালিশ যায়। তিনি আমাদের ডেকে ভর্ৎসনা করেন, স্যারকে হাসিমুখ ছাড়া কখনোই দেখিনি। আমরা অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাই। তিনি আর কখনোই করবো না শর্তে সে যাত্রা ক্ষমা করেন। ভর্ৎসনা কালেও তাঁর চোখের হাসি মিলিয়ে যায়নি। তিনি আমাদের ভালোবাসতেন।
১৯৭৪ সালে আমরা ঢাকা পেইন্টার্স দল গঠন করি। দলের একটা লোগো দরকার। হাসিদা (হাসি চক্রবর্তী) পরামর্শ দিলেন সমরজিৎ স্যারকে অনুরোধ করতে লোগোর জন্য। তিনি আমাদের লোগো করে দেন একটি হিরক খন্ড দিয়ে। আমরা আমাদের প্রথম প্রদর্শনীর কভার পৃষ্ঠা জুড়ে লোগোটি ছাপাই।
তিনি শিক্ষক ছিলেন গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগের। তৎকালে বিভাগটির নাম ছিলো কমার্শিয়াল আর্ট বিভাগ। একবার আমাদের প্রিডিগ্রি ক্লাশে বেসিক ডিজাইন ও লেটারিং ক্লাস নিয়েছিলেন তিনি।
সদা হাসিমুখ স্যারের চারিদিকে একটা অদৃশ্য দেয়াল ছিলো। এমন হাসিখুশি মানুষটা খুব কাছে আমরা নিচু ক্লাশের ছাত্ররা খুব বেশি যেতে পারতাম না। তৎকালিন ঢাকা আর্ট কলেজে আমি পড়েছি মাত্র দুইবছর। তারপর চট্টগ্রামে চলে যাই।
গ্যালারি কায়ার এক আর্ট ক্যাম্পে বান্দরবানে আমি তাঁর খুব কাছে আসার সুযোগ পাই। তিনি নিজের কথা যেমন বলেছেন, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার অনেক কথা জানতে চান। ছবি আঁকার ভাবনা, করণকৌশল ইত্যাদি। নানান মাধ্যমে আমার কাজ করার নেশাকে তিনি খুব ভালো দিক বলে জানালেন। এমনকি সংসারে আমরা অনেক ভাইবোন তাদের বাচ্চাদের নিয়ে থাকি সেটাও। আমাদের উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের বাসায় তিনি এসেছেন।
একদিন গ্যালারি কায়ায় এক নিমন্ত্রণে আমি তাঁর পাশে বসে গল্পের ফাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ৪০ বছর আগে তিনি আমাদের দলের লোগোটি কেনো হীরকখণ্ড এর নক্সা করেছিলেন? জবাবে বললেন, “হিরক খন্ডের মতোই তো”! আমার চোখ আর্দ্র হয়ে উঠলো।
ভাতৃকন্যার ডালাসের বাড়িতে বেড়াতে এসে সকালে (৯ সেপ্টেম্বর ২০২২) ঘুম ভেঙে ফেসবুকে দেখলাম সুরজিতের স্ট্যাটাস – “আমাদের বাবা নেই”।
আমার দেখা এমন একজন শিল্পী, এমন একজন ভালো মানুষের চলে যাওয়ায় বড় একা লাগে। সমাজের কাংখিত ভালোরা যখন নষ্ট হয়ে গেছে বা যাচ্ছে সেখানে একজন ভালো মানুষের বিদায় অনেক অনেক বেশি ক্ষতি মনে হয়।
দীর্ঘদিন আপনি মানুষের স্মৃতিতে থাকুন, এই কামনা।
লেখক:
কাজী রকিব, শিল্পী