আপা, আজ সকালে তোমার একাত্তরের দিনগুলি বইয়ের সেই আগস্টের শেষ সপ্তাহের দিনগুলোর কথা পড়ছিলাম। বীরের মায়ের মুখে বীরত্বের এক অভূতপূর্ব গাথা তুমি দিয়ে গেছ আমাদের জন্যে আমাদের সন্তানদের জন্যে। সেখানেই আমার পরিচয় এদেশের, এ মায়ের বেশ ক’জন বীর সন্তানের সঙ্গে। তুমিই পরিচয় করিয়ে দিয়েছ। জানিয়েছ তাঁদের বীরত্বের কাহিনী।
আমার বয়স তখন কত, ৭ কিম্বা ৮, রুমী ভাইকে কতটুকুই আর দেখেছি সে বয়সে বল! তবু যেটুকু দেখেছিলাম তাতেই তাঁর মুখখানা আজও আমার মনে যেন গেঁথে আছে। প্রথম দেখা সম্ভবত নয়া পল্টনের এক বাসায়, সেখানে তুমিও ছিলে, বাবার সংগে গেছিলাম। আজ আর আমার মনে নেই সেই বাসাটি কোনটি ছিল বা কার ছিল। তবে এটুকু খুব স্পষ্ট মনে আছে তোমার সাথে তোমার ছেলে ছিল। শুনেছিলাম তার নাম রুমী। এর পরেও আরও দুয়েকবার দেখা হয়েছিল রুমী ভাইয়ের সাথে। কিন্তু কবে যে তাঁর তবলা বাজানো দেখে আমার তবলা শেখার আগ্রহ জন্মেছিল আজ আর তা মনে করতে পারি না। সেই আগ্রহই তবলা শিখতে ধরে বেঁধে বসিয়েছিল।
আমার বড় মামা সৈয়দ মঞ্জুর হোসেন এপ্রিল মাস থেকেই মুক্তিযুদ্ধে বা ভারতে যেতে আগ্রহীদের আগরতলা পৌঁছে দেবার কাজটি করতেন খুব সুচারু ভাবে। নিজের লম্বা একহারা চেহারা আর চোস্ত উর্দু কথন পাকিস্তানীদের মনে কোন সন্দেহ জাগাতে পারেনি বলেই আমার ধারণা। তাই তার সাথে যারা গেছেন আগরতলায় তারা নিরাপদে সেই বিপদসংকুল পথ পেরিয়েছিলেন।
সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ, চিত্রপরিচালক বাদল রহমান, মুক্তিযোদ্ধা মেসবাহউদ্দিন সাবু, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ষ্ট্রাইকার প্রতাপ হাজরা, হাজরা পরিবারের ৭/৮জন, সাংবাদিক সলিমুল্লাহ, ডা. বর্ধন (ডা. এম এন নন্দীর সহকারী) ও তাঁর পরিবার, মুক্তিযোদ্ধা ইশরাক ভাই, বাবা-মাসহ আমাদের পরিবার এবং রুমী ভাইসহ অসংখ্য মানুষ বড় মামার সাথে ওপারে গেছিলেন।
১৯৭১ এ রুমী ভাইয়ের ভারতে যাবার কথা জেনেছিলাম অনেক পরে কারণ যাবার দিন রাতে তিনি অন্যদের মত আমাদের বাসায় ছিলেন না। পথে যুক্ত হয়েছিলেন মামার দলে। যখন আমি, আমার নানী আর আমার ছোট বোন (বন্যা) ওপারে গেলাম তখন জানলাম যে বাবাসহ আমাদের পরিচিত অনেকেই ভারতে এসেছেন মামার সাথে তার মধ্যে রুমী ভাইও আছেন।
মাকে খুঁজতে যখন পাকিস্তানী আর্মী মায়ের স্কুলে আর বাসায় হানা দিল তখন মা মতিঝিল কলোনীর বাড়ী ছেড়ে আমার সর্বকনিষ্ঠ বোনকে (ঊর্মি) নিয়ে কিছুদিন ঢাকাতেই গা ঢাকা দিয়ে থেকে শেষে চলে গেলেন ওপারে। যোগ দিলেন স্বাধীন বাংলা বেতারে। ঢাকা ছাড়বার আগে ঢাকায় চাকুরীরত আমাদের এক দাদীকে আমাদের বাসার চাবী দিয়ে দাদীর থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন মা। কিন্তু প্রতিবেশী সরকারী চাকুরে এক পাকিস্তানী দালাল তাঁকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে আমাদের সমস্ত আসবাবপত্র লুট করে বাড়ীটা অন্যের কাছে অবৈধভাবে ভাড়া দিয়েছিল।
যুদ্ধ শেষে ফিরে এলাম আমাদের স্বাধীন দেশে। নিজেদের ঘর নেই তাই উঠলাম ফুলবাড়িয়া রেল কলোনীতে বড় মামার বাসায় তার কিছুদিন পরে খালার বাসায়। আমাদের বাড়ী উদ্ধার করতে প্রায় দু’মাস পেরিয়ে গেল। সে সময়েই শুনলাম রুমী ভাই আর নেই, নেই “আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো” গানের সুরকার যিনি বাবার খুব কাছের মানুষ সেই আলতাফ মাহমুদ। বাবার প্রতিষ্ঠিত “ক্রান্তি”র সহসভাপতি আলতাফ মাহমুদকে বহুদিন আমাদের বাসার রিহার্সালে দেখেছি। আসলে তখন এক এক করে পরিচিত মানুষদের শহীদ হবার খবর পাচ্ছিলাম।
তখন আমার বয়স ১০, সেই থেকে জানি আমার জন্যে, আমাদের জন্যে এই দেশ আর ঐ লাল সবুজ পতাকাটা দিয়ে গেছেন আলতাফ মাহমুদরা। ফুপুর ছেলে আবুল বারক আলভী, যাকে সে রাতেই আর্মী ধরেছিল কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান নিজের আলভী নাম লুকিয়ে, তাঁর কাছে তাঁদের উপর অত্যাচারের কিছু কথা শুনে শিউড়ে উঠতাম। বুক ফেটে কান্না পেত।
আপা, আজ যখন এই বয়সে এসে বহুবার পড়া তোমার বইটা আবার হাতে নিলাম, পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে অজান্তেই আগস্ট মাসে এসে থমকে গেলাম। একটানা পড়ে নিলাম সেই দিনের লাইনগুলো। দু’চোখের কোল থেকে কখন যে জল ঝরেছিল জানতেই পারিনি, অঝোর সে ধারা যেন থামতেই চায় না। চোখ মুছে মোবাইলের তারিখের দিকে তাকাতেই দেখলাম আজ সেই ২৯ আগস্ট যেদিনের শেষে রাতে ওরা নিয়ে গেছিল রুমী, বদি, জুয়েল, আজাদ, বকর, হাফিজ, আলতাফ মাহমুদদের।
ওরা আর ফিরে আসেনি, আসবে না কোনদিন। ওরা মিশে আছে প্রতিটি শিশির বিন্দুতে, মিশে আছে ফুলের প্রতিটি রেণুতে। থাকবে আমাদের মাঝে আমাদের মনের গহীনে, আমাদের মাথার মণি হয়ে জ্বলজ্বল করবে ততদিন যতদিন এই দেশ থাকবে, এই পতাকা থাকবে, এই নদী খাল বিল থাকবে, থাকবে এদেশের মানুষ।
রুমী, বদি, জুয়েল, আজাদ, বকর, হাফিজ, আলতাফ মাহমুদ, একেকটি নামই নয় একেকটি গনগনে আগুনের পিণ্ড যার স্ফুলিঙ্গ থেকে উত্তাপ নিয়েই আমরা বেঁচে থাকবো গড়ে তুলবো একটা শোষণহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ!
২৯ আগষ্ট, ২০১৫
ফিচার ফটো: রুবিনা হোসেন
লেখক: সাগর লোহানী, সম্পাদক, বাঙালীয়ানা