অতি সম্প্রতি (শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২০ সন্ধ্যার পর) সিলেটে একটা হিন্দু মন্দিরকে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই নিয়ে বাংলাদেশের একটি বহুল প্রচারিত অনলাইন পোর্টাল এ নিয়ে রিপোর্টও করেছে। রিপোর্টের শিরোনাম হচ্ছে, ‘সিলেটে হিংসার আগুনে ভস্মীভূত হিন্দু মন্দির’। তবে, কাদের হিংসার কারণে সিলেট জেলার কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার শিমুলতলার নোয়াগাঁও গ্রামের কালী মন্দিরে আগুন লেগেছে, সেই বিষয়ে এই রিপোর্টে পরিষ্কার করে কিছু বলেনি। (কোম্পানিগঞ্জ থানার ওসি সজল কুমার কানু আগুন লাগার কথা স্বীকার করে বলেন, “মন্দিরের সভাপতি বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছেন এবং আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মামলা গ্রহণ করেছি। তদন্ত চলছে।” – সম্পাদক) শুধু বলা হয়েছে এই কাজ করেছে স্থানীয় ভিন্ন মতাবলম্বীরা। এই ভিন্ন মতাবলম্বী কারা, সে বিষয়ে আমাদের ধারণা করতে খুব বেশি মাথা খাটানোর প্রয়োজন পড়ে না। একই সাথে এই পত্রিকা তাদের নাম সরাসরি না নিয়ে কেনো ‘ভিন্ন মতাবলম্বী’ বলছে, সেটা বুঝতেও খুব একটা অসুবিধা হয় না। এই ‘ভিন্ন মতাবলম্বী’-রা দুইদিন আগেও পার্শ্ববর্তী এক গ্রামে ওয়াজ শুনে এতোই উত্তেজিত এবং উন্মত্ত অবস্থায় ছিলো যে তারা কয়েকটা হিন্দু বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর এবং লুটপাট চালায়। সেই সঙ্গে হিন্দু দেব-দেবীর প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনা ঘটায়।
এই লেখাটা নীচে অনেক ‘ভিন্ন মতাবলম্বী’ মন্তব্য করেছে। তার মধ্যে একজন ভদ্রমহিলাও আছেন। তাঁর নাম হাসিনা আক্তার। এই ভদ্রমহিলা আমার পরিচিত। শুধু আমার না, টরন্টোর বহু মানুষেরই পরিচিত তিনি। মহিলা আওয়ামী লীগ ক্যানাডার সভানেত্রী তিনি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দাঁড়ানো তাঁর ছবি তাঁর প্রোফাইল পিকচারে শোভা পায়।

আগুনে পুড়ছে মন্দির
ওই রিপোর্টের নীচে করা তাঁর মন্তব্যটা এ’রকম,
“আজাহারীর ওয়াজ আমি অনেক শুনি সব সময়ই বলে অন্য ধর্মের প্রতি সম্মান দেখাতে। ইসলামও বলে তাই। কারো ইশারায় যদি চাঁদ দ্বীখনডিত হয়ে থাকে সেটা মুসলমানের বিশ্বাস এনিয়া কথা বলা উচিত না। মাইকেল কলিন চাঁদ দিখনডিত দেখেই মুসলিম হয়েছে। মন্দিরের উপর হামলা হয়েছে এটা নিয়া কথা বলেন। আমরা নিন্দা জানাই।”
মন্দিরে হামলার ব্যাপারে তিনি নিন্দা জানিয়েছেন, এটাতে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য তিনি। কিন্তু, এর বাইরে গেলে তাঁর এই মন্তব্য একজন অশিক্ষিত এবং ধর্মান্ধ লোকের মন্তব্যের বাইরে আর কিছু বলে মনে হয় না। ক্যানাডা আওয়ামী মহিলা লীগের সভানেত্রীর জ্ঞানের স্তর এবং বোধগম্যতার স্তর যদি এই পর্যায়ের হয়, তবে দেশটাকে নিয়ে আতংকিত হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এই সব অর্ধশিক্ষিত এবং ধর্মান্ধ নেতারা আমাদের কোথায় নিয়ে ঠেলে দেবে সেটা অনুমান করতে খুব বেশি অসুবিধা হয় না।

পুড়ছে দেবী প্রতিমা
আসুন দেখি উনার মন্তব্যের ত্রুটিগুলো, জ্ঞানহীনতাগুলো ঠিক কোথায়।
তিনি বলেছেন আজাহারীর ওয়াজ তিনি অনেক শোনেন। সেই সব ওয়াজে আজাহারী অন্য ধর্মের প্রতি সম্মান দেখাতে বলেন। এই বক্তব্য দিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে ওয়াজ শুনে কেউ উন্মত্ত হয়ে হিন্দুদের উপর আক্রমণ চালায়নি। আজাহারীর কোনো ওয়াজ আমি শুনি নাই। কাজেই জানি না আজাহারী অন্য ধর্মের প্রতি সম্মান দেখাতে বলেন কিনা। কিন্তু, আরো অনেক হুজুরের ওয়াজ আমি শুনেছি। সেইসব ওয়াজে বিধর্মীদের যেভাবে গালাগাল করা হয়, যেভাবে তাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হয়, তাতে করে সেইসব ওয়াজ শুনে কিছু লোক উন্মত্ত হয়ে হিন্দুদের বাড়িঘর কিংবা মন্দিরের হামলা চালালে আমি মোটেও অবাক হবো না। হাসিনা আক্তার চান মুসলমানের উদ্ভট বিশ্বাস নিয়ে কারো কোনো কথা বলা উচিত না, কিন্তু তিনি একবারও বলছেন না যে এই বিষয়টা মুসলমানদের দিক থেকেও একই হওয়া উচিত। তাদেরও অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস নিয়ে কিছু বলা উচিত না। সংখ্যায় বেশি দেখে মুসলমানরা যা খুশি বলে যাবে, আর সংখ্যায় কম বলে হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা খৃস্টানদের সবকিছু সহ্য করতে হবে কিংবা ‘ভিন্ন ধর্মাবলম্বী’দের জোশের কারণে তাদের বাড়িঘর পুড়বে, লুটপাট হবে, মন্দির ধ্বংস হবে, সেটাতো হতে পারে না।
এবার আসা যাক তাঁর মাইকেল কলিনের চাঁদ দ্বিখণ্ডিত দেখে মুসলমান হওয়া প্রসঙ্গে। আমার ধারণা মাইকেল কলিন বলতে তিনি খুব সম্ভবত প্রথম চন্দ্রে পদার্পনকারী ব্যক্তিদের নিয়ে উড়ে যাওয়া এপোলো ইলেভেনের অধিনায়ক মাইকেল কলিন্সের কথা বলছেন। এপোলো ইলেভেনের অধিনায়ক ছিলেন মাইকেল কলিন্স। তিনি চাঁদে নামেন নাই। লুনার মডিউল ঈগলে করে চাঁদের বুকে গিয়ে নেমেছিলেন নীল আর্মস্ট্রং এবং বাজ অলড্রিন। মাইকেল কলিন্স দূর থেকে চাঁদের বুকের দ্বিখণ্ডিত হবার দাগ দেখার মতো অবস্থায় ছিলেন কিনা, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে আমার। সত্যি কথা বলতে তিনি চাঁদের দ্বিখণ্ডিত হবার দাগ দেখেছেন, এই খবর উনার এই মন্তব্য পড়ার আগে কখনো শুনি নাই।
আশির দশকে এই ধরনের একটা গুজব ছড়িয়েছিলো নীল আর্মস্ট্রংকে নিয়ে। তিনি চাঁদে গিয়ে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হবার দাগ দেখেছেন, সেই সাথে চাঁদে আজানের শব্দ শুনেছেন, এটি গুজব ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ে। নানা জায়গায় দাবি করা হতে থাকে যে তিনি এই দৃশ্য দেখে এবং আজানের সুমধুর শব্দ শুনে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হয়ে গিয়েছেন। নীল আর্মস্ট্রং এবং বাজ অলড্রিন চাঁদের অসংখ্য ছবি তুললেও এই দ্বিখণ্ডিত হওয়ার দাগের ছবি কোনো এক বিচিত্র কারণে তুলে আনেন নাই। আবার চাঁদে বাতাস নেই। বাতাসহীন অবস্থায় কোনো শব্দ শুনতে পাবার কথা নয়, কীভাবে নীল আর্মস্ট্রং আজানের শব্দ শুনলেন, সেটাও বোধগম্য নয়।
তবে, কথা হচ্ছে, ধর্মানুরাগীরা এইসব যুক্তি কিংবা বিজ্ঞানের ধার ধারে না। তারা প্রবল উৎসাহে নীল আর্মস্ট্রং এর মুসলমান হবার খবর ছড়িয়ে দিতে থাকে দিকে দিকে। অবস্থা এমন পর্যায়ে যায় যে নীল আর্মস্ট্রং-কে মাঠে নামতে হয় এটা সত্যি না, নিছকই এক গুজব এবং মিথ্যাচার সেটা প্রমাণ করতে।
এশিয়ান রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক ফিল পার্সালের কাছে লেখা এক চিঠিতে আর্মস্ট্রং এর হয়ে ওই মিথাচারের জবাব দেন ভিভিয়ান হোয়াইট। সেই চিঠিতে বলা হয়,
“Mr. Armstrong has asked me to reply to your letter and to thank you for the courtesy of your inquiry.
The reports of his conversion to islam and of hearing the voice of adzan on the moon and elsewhere are all untrue.
Several publications in Malaysia, Indonesia and other countries have published these reports without verification. We apologize for any inconvenience that this incompetent journalism may have caused you.”
শুধু আর্মস্ট্রংকেই নয়, তিনি যে মুসলমান হননি, সেটা প্রমাণ করার জন্য ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টকেও চিঠি পাঠাতে হয়েছিলো নানা জায়গায়।
শুধু নীল আর্মস্ট্রং নয়, সুনীতি উইলিয়ামসের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিলো। ইসলামি বিশ্বে রটে গিয়েছিলো যে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। বাস্তবে সেটা মোটেও সত্য ছিলো না। তিনি একজন ধার্মিক হিন্দু। ভারতীয় গণমাধ্যমের সাথে সাক্ষাৎকার দেবার সময় তিনি বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যাওয়ার সময় তিনি এক কপি ভগবদ্ গীতা ও ভগবান গণেশের ছোট একটি মূর্তি নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে অবস্থানকালে গীতা পাঠ করতেন বলেও জানান তিনি। যে ভদ্রমহিলা আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে গীতা নিয়ে যান পাঠ করার জন্য, তিনি কোন দুঃখে মুসলমান হবেন, কে জানে?
হাসিনা আক্তারে আবার ফিরে আসি। ক্যানাডার মতো দেশে থেকে এখনো তিনি পড়ে আছেন এমন এক জ্ঞানের স্তরে, যেখানে সত্য এবং মিথ্যা, ফ্যাক্ট এবং ফ্যান্টাসির মধ্যে পার্থক্য করার মতো সক্ষমতাও তাঁর নেই। তিনি অন্ধ এক ধর্মবিশ্বাসের বলে নিজের ধর্মকে সুরক্ষিত করতে চান, নিশ্চয়তা আশা করেন সমালোচনার বিপক্ষে, কিন্তু তাঁর ধর্মের লোকেরাই যে অন্য ধর্মকে প্রতিনিয়ত শুধু অপমান বা অবজ্ঞাই করছে না, কঠোরভাবে আঘাতও করছে, সে বিষয়ে তাঁর কোনো বিকার নেই, ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি আছেন তাঁর নিজস্ব ধর্মের নাজুক অনুভুতি নিয়ে, অন্যের অনুভূতির প্রতি তাঁর কোনো সহানুভুতি নেই, নেই কোনো সদয় আচরণ।
তিনি একজন সাধারণ মানুষ হলে আমি তাঁর বক্তব্যকে উপেক্ষা করে যেতাম। কিন্তু, তিনি একটা রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা। তাঁর কাছ থেকে আরো প্রাজ্ঞতা, পরিপক্কতা এবং পরিশীলিত আচরণ আমরা আশা করতেই পারি।
ছবি: ইন্টারনেট
লেখক:
ফরিদ আহমেদ, প্রবাসী, প্রাক্তন শিক্ষক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়