সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা

Comments
‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে
স্মৃতি যেন আমার এ হৃদয়ে বেদনার রঙে রঙে ছবি আঁকে।।’

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নামটি মনে হলেই বাঙালীমাত্রই এক সুরেলা জগতে প্রবেশ করে। সেই সাথে কালো ফ্রেমের চশমা আর ফিল্মের হিরোর মত একটি কোমল চেহারাও ভেসে ওঠে চোখের সামনে। পঞ্চাশ-ষাটের দশককে আধুনিক গানের স্বর্ণযুগ মনে করা হয়। আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে বলা হয় আধুনিক গানের প্রবাদ পুরুষ। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কত বড় গায়ক ছিলেন কিংবা সুরকার সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তিনি যে বাঙালীর আবেগ সে কথাও নতুন করে বলতে হয় না। তাঁর গান আজও প্রায় প্রতিটি বাঙালী বাড়িতে বাজে। তাঁর গাওয়া প্রায় পৌনে দু’হাজার গানের মধ্যে এখন অনেক গানই আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু, তাতে করে বাংলা গানে তাঁর স্থান এতটুকুও ম্লান হয় না। কালজয়ী এই সঙ্গীতব্যক্তিত্ব সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীতানুরাগীদের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে চিরভাস্বর হয়ে আছেন। শিল্পীসত্তাকে অক্ষুন্ন রেখে কি করে একজন ভালো মানুষ হওয়া যায়, সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠা যায়– হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জীবনজুড়েই তার উদাহরণ রয়েছে।

Hemanta Mukharjee01

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

রানার, পাল্কির গান, বম্বের নাগিন ইত্যাদি গান গেয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় যখন সুপার ডুপার হিট তখন একদিন কলকাতায় গাড়ি করে যাচ্ছিলেন তিনি। চালকের আসনে সবসময়কার মতই সনৎবাবু। হঠাৎ হেমন্ত দেখলেন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন ছোট বেলার বন্ধু নন্দন। সনৎবাবুকে বললেন গাড়ি থামাতে। নন্দন দেখলেন হঠাৎ ব্রেক কষে তাঁর পাশে একটা গাড়ি দাঁড়ালো। তিনি একটু সরে দাঁড়ানো মাত্রই গাড়ির জানলা খুলে তাঁকে ডাকলেন ছোটবেলার বন্ধু হেমন্ত, বিখ্যাত শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। কিছুটা বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন এস কে নন্দন। এস কে নন্দন তখন অতি সাধারণ চাকরি করতেন কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টে। কিন্তু মানুষ হেমন্তের কাছে ওসব কোন ধর্তব্যের বিষয়ই ছিল না। বন্ধুর কাছে তিনি কেবল ‘হেমন্ত’ হয়ে ছিলেন, সেলিব্রেটি নয়।

‘কি রে কোথায় যাচ্ছিস?’, বন্ধু হেমন্তের আন্তরিক প্রশ্ন এক মুহূর্তে নন্দনের সমস্ত সংকোচকে উড়িয়ে দিয়েছিল। বন্ধুর গন্তব্য জেনে নিয়ে তাঁকে আর একটি কথাও বাড়াতে দেননি হেমন্ত। প্রায় জোর করেই গাড়িতে তুলে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

Hemanta Mukharjee02

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

অত্যন্ত বন্ধুবৎসল হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় একবার স্মৃতিচারণ করেন, ‘হেমন্ত বহুদিন বাজার করে একটা ব্যাগ আমার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যেত। এ তো কিছু নয়। আমার তখন রোজগার বলতে কিছুই ছিল না। লেখাপত্তর বেরোলে কিছু টাকাপয়সা আসে। তাতে কী আর কিছু হয়! একদিন হেমন্ত এসে বলল, ‘চল, গাড়িতে ওঠ। তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব।’ তা ওর কথামতো গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি এসে থামল সম্ভবত মিশন রো’র কাছে। একটা ঘরে নিয়ে এল। ঘরে ঢুকেই মনে হল একটা সুন্দর অফিস। আমি বললাম, কি রে নতুন অফিস করলি নাকি! হেমন্ত বলল, ‘তোর পছন্দ হয়েছে?’ আমি বললাম, বেশ হয়েছে। হেমন্ত বলল, ‘এটা তোর জন্যে। এখান থেকে তুই নতুন পত্রিকা বার করবি। আর এই ঘরটা তোর। সম্পাদকের জন্যে তো আলাদা একটা ঘর লাগবেই।’ আমি সাকুল্যে চার-পাঁচদিন গিয়েছিলাম ওই অফিসে। ভাবনা-চিন্তা হলও অনেক। আমার দ্বারা কি বাঁধাধরা কাজ হয়! হলও না। এটা হেমন্তও জানত। তবুও আমার যাতে ভাল হয় সেইজন্য এত খরচ করেছিল। এই যে আমি অফিস গেলাম না, পত্রিকা করলাম না, এ নিয়ে একটা কথা কোনওদিন আমাকে বলেনি। হেমন্ত আমার জন্য অনেক কিছু করেছিল। ওর মতো বন্ধু পাওয়া মানে অনেক কিছু পাওয়া।’

পরিশীলিত শিল্পী হেমন্ত একবার ছাত্রদের অনুরোধে হুগলী মহসীন কলেজের একটি অনুষ্ঠানে গান গাইতে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন উৎপলা সেন, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়। গানের আসরের শেষে সবার সম্মানদক্ষিণা আয়োজক ছাত্রেরা এক সঙ্গে একটি খামে করে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের হাতে দিয়ে দেয়। অত্যন্ত পরিশীলিত মানুষটি একবারের জন্যেও খামটা খুলে দেখেননি। গাড়িটা কিছুদূর যাবার পর সবাইকে টাকা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যে খামটা খুলে দেখেন, মাত্র দু-তিনটা দশ টাকার নোট! সাথে একটা চিরকুটে ছাত্ররা লিখেছে, ‘এর বেশি কিছুতেই আমরা জোগার করতে পারলাম না। দয়া করে আমাদের ক্ষমা করে দেবেন।’ উৎপলা সেন তখন রেগে আগুন। বললেন, ‘এক্ষুনি গাড়ি ঘুরিয়ে কলেজে চলুন হেমন্তদা। এভাবে ঠকাবে?’

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছিলেন নিশ্চুপ। সামনে দেখলেন একটা ছোট্ট দোকানে আলুর চপ ভাজছে। উৎপলাকে একটা কথাও না বলে প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বললেন, ‘চল, ভারি সুন্দর আলুর চপ ভাজছে। ওই দশটাকাগুলোর সদব্যবহার করে ব্যাপারটা সেলিব্রেট করি।’

উৎপলার দিকে একবার ফিরে তাকিয়ে বললেন, ‘ছাড় না বেলুন (উৎপলার ডাকনাম), ছাত্ররাই তো করেছে। ওরা কোথায় অতো টাকা পাবে বল তো?’

পরে সবাই শান্ত হয়, বুঝতে পারে হেমন্ত কোন মাপের শিল্পী।

Hemanta Mukharjee_Sheikh Mujibur Rahman

বঙ্গবন্ধুর আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন এই গুণী শিল্পী

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কারো ভিতরে এতোটুকু সম্ভাবনা দেখলে স্পষ্ট ভাষায় বলতেন। স্পষ্ট অথচ কটুত্বহীন কথা ছিল তার চরিত্রের সব থেকে বড়ো বৈশিষ্ট। অথচ তাঁকেও এক সময় রেকর্ড কোম্পানির দরজায় দরজায় ঘুরতে হয়েছে। জলসায় গাইতে দেবার আশ্বাস পেয়েও ঠায় চার ঘণ্টা বসে থেকে শুনেছেন, ‘দূর মশাই, আপনার গান কে শুনবে? দেখছেন না, পঙ্কজ মল্লিক এসে গেছেন! ওঁর গান শুনে বাড়ি চলে যান।’

এক সময় ভেবেছিলেন, সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে সাহিত্যিক হবেন। গল্প লিখতেন। তার কয়েকটি প্রকাশও পেয়েছিল। তিনি যে গল্প লিখেছেন, এমন তথ্য খুব কম সংখ্যক লোকই জানেন। ১৯৩৭ এবং ১৯৮৮ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গল্প লিখেছিলেন। ১৯৩৭ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি লিখেছিলেন ‘একটি দিন’ নামের একটি গল্প। ‘শতাব্দীর আর্তনাদ’ লিখেছেন তার অনেক পরে। তখন সাহিত্যিক হবার স্বপ্নে তিনি মশগুল। গায়ক-বন্ধুর ব্যাপারে স্কুলবেলার সহপাঠী সুভাষ মুখোপাধ্যায়, রমাকৃষ্ণ মৈত্ররা শুধু হাল ছাড়েনি। যার হবার কথা সঙ্গীতশিল্পী, তিনি কি অন্য কোনো কাজে মন বসাতে পারেন!

Hemanta Mukharjee_Asha Bhosle

সঙ্গে আশা ভোসলে

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যিক হওয়া হয়নি। কিন্তু ফার্স্ট ডিভিশনে ম্যাট্রিকে পাশ করার পর বাবার ইচ্ছেয় ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হতে হয়েছিলেন যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। চার ছেলে, এক মেয়ের দ্বিতীয় হেমন্তকে নিয়ে ছোট থেকেই বাবা কালিদাস মুখোপাধ্যায়ের অনেক আশা। চৌদ্দ পুরুষের ভিটে বড়ুগ্রাম ছেড়ে কালিদাস পরিবার নিয়ে উঠেছিলেন ভবানীপুরের ২৬/২এ রূপনারায়ণ নন্দন লেনে। দু’ঘরের বাড়ি। ম্যাকনিন ম্যাকেনজির সাধারণ কেরানি কালিদাস। টানাটানির সংসার। মিত্র ইনস্টিটিউশনের মতো বেশি মাইনের স্কুলে ছেলেদের পড়ানোর ক্ষমতা তাঁর ছিল না। কিন্তু মেজ ছেলের পড়াশুনোয় আগ্রহ দেখে হেডমাস্টারমশাইকে ধরেটরে হাফ-ফি-তে কোনওক্রমে ভর্তি করেছিলেন। ছেলে পড়াশুনোয় তো ভালই, কিন্তু গোলটা বাধল ঠিক ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার তিন মাস আগে। স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে! তার মূলেও কিন্তু ওই গান! টিফিন টাইমে অন্যরা সব খায়-দায়। কালিদাসবাবুর মেজছেলের না আছে বাড়ির দেওয়া টিফিন, না পকেটে কানাকড়ি। বন্ধুদের নিয়ে সে টেবিল বাজিয়ে গান গায়। পঙ্কজ মল্লিক, শচীন দেববর্মনের রেকর্ডের গান। তাতে এমন হইচই, হট্টগোল রেজিস্টার থেকে নাম কেটে দিয়ে বলা হল— ‘যাও, এবার গান গেয়ে বেড়াও গে, যাও।’

ফাইনাল পরীক্ষার বাকি মাত্র তিন মাস! কালিদাসবাবু স্কুলে গিয়ে প্রায় হাতে-পায়ে ধরে সে-যাত্রায় ছেলেকে রক্ষা করেন। এরপরও যখন ফার্স্ট ডিভিশন পেল ছেলে, খুব চেয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ার হোক। কিন্তু ততদিনে গান যে তাঁকে পেয়ে বসেছে! বন্ধু সুভাষ অসিতবরণকে ধরে রেডিওতে অডিশনের ব্যবস্থা করে ফেললেন। অভিনেতা অসিতবরণ তখন রেডিওতে তবলা বাজান। অডিশনে পাশ করার তিন মাস পর প্রোগ্রামের চিঠি এল। গান শুনে পাহাড়ী সান্যাল বললেন, ‘বাহ্, চর্চা করলে ভাল গাইয়ে হবে।’ পঙ্কজ মল্লিক এক দিন আকাশবাণীতে অনুজ হেমন্তকে দেখে বললেন, ‘তুমি তো দেখছি আমাদের ভাত মারবে!’

১৯৩৩ সালে শৈলেশ দত্তগুপ্তের সহযোগিতায় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’র জন্য প্রথম গান ‘আমার গানেতে এল নবরূপী চিরন্তন’ রেকর্ড করেন হেমন্ত। কিন্তু গানটি সেভাবে জনপ্রিয়তা পায়নি। প্রথম রেকর্ড বেরনোর পর সেটাকে কাগজে মুড়ে হাতে নিয়ে চেনাজানা বাড়িতে বাড়িতে ঘুরতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। যাতে কারও কৌতূহল হয়, জানতে চান, ওটা কী! সাহিত্যিক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের লাল বাড়িতে এক আড্ডায় হেমন্ত সেসব গল্প করেন,

“গানের আগে একটা গল্প বলি। তখন অনেক ধরাধরি করে কোনও রকমে আমার প্রথম রেকর্ড বের হয়েছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ছটফট করে মরছি। লোকে শুনবে তো? একটা মতলব ভাঁজলাম। রেকর্ডটা ভাল ব্রাউন পেপারে মুড়ে ভর-দুপুরে ঘেমে নেয়ে একেক দিন একেক জন নামকরা মানুষের বাড়ি যেতে লাগলাম। এঁদের শোনানো গেলেই অব্যর্থ পাবলিসিটি। প্রত্যেককে একই কথা ‘এই এ দিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, যা গরম! ভাবলাম একবার দেখা করে একটু জল খেয়ে যাই’… বলতে বলতে কাগজে মোড়া ঢাউস রেকডর্টা চোখের সামনে নামিয়ে রাখলাম। বুকের মধ্যে ধুকপুক এই বার নিশ্চয়ই অবধারিত প্রশ্ন আসবে ‘এটা কী?’ আর ব্যস্‌, তা’হলেই কেল্লা ফতে। কিন্তু…”

থেমে গেলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সলজ্জ স্বীকারোক্তি লাজুক মুখে, “জল এল, কোথাও জলের সঙ্গে টলও। কিন্তু আমার নিশ্চিন্ত বিশ্বাসের ওই অবধারিত প্রশ্নটা কোথাও এল না। খানিকক্ষণ বোকার মতো বসে থেকে শেষে নিজের রেকর্ড বুকের সঙ্গে সেঁটে গুটি গুটি পায়ে প্রস্থান।”

Hemanta Mukharjee_Montu Basu_Shyamol Mitra

মন্টু বসু, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও শ্যামল মিত্র (বাঁ দিক থেকে)

শেষে ১৯৩৭ সাল থেকে তিনি পুরোপুরি প্রবেশ করলেন সঙ্গীত জগতে। এই বছর তিনি নরেশ ভট্টাচার্যের কথা এবং শৈলেশ দত্তগুপ্তের সুরে গ্রামোফোন কোম্পানী কলম্বিয়ার জন্য ‘জানিতে যদি গো তুমি’ এবং ‘বলো গো তুমি মোরে’ গান দুটি রেকর্ড করেন। বাল্যবন্ধু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁকে গান গাইবার জন্য ইডেন গার্ডেনের স্টুডিওতেও নিয়ে গিয়েছিলেন একবার। এরপর থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরই তিনি ‘গ্রামোফোন কোম্পানী অফ ইন্ডিয়া’র জন্য গান রেকর্ড করেছেন। ১৯৪০ সালে, সঙ্গীত পরিচালক কমল দাসগুপ্ত, হেমন্তকে দিয়ে, ফাইয়াজ হাস্মির কথায় ‘কিতনা দুখ ভুলায়া তুমনে’ ও ‘ও প্রীত নিভানেভালি’ গাওয়ালেন।

হেমন্ত যখন খ্যাতির শিখরে, সাবেক বম্বে, এখনকার মুম্বাইতে তখন প্রায় ডেলি প্যাসেনজারি করতে হত তাঁকে। টেলিফোনের আজকের সুবিধা তখনকার মানুষের কষ্ট কল্পনাতেও আসবে না। বম্বে থেকে রওনা হওয়ার সময়ে প্লেন ছাড়ার পর থেকে দমদমে ল্যান্ড করবার মুহূর্ত পর্যন্ত হেমন্ত’র মা ঠাকুর ঘরে বসে থাকতেন ছেলের নিরাপদ অবতরণের কামনায়।

Hemanta Mukharjee_Uttam Kumar_Suchitra

চরিত্র বিশ্লেষণে আন্তরিক হেমন্ত, উত্তম আর সুচিত্রা

১৯৪১ সালে এই শিল্পী তাঁর প্লে-ব্যাক সংগীত জীবন শুরু করেন ‘নিমাই সন্ন্যাস’ ছবির মাধ্যমে। এরপর থেকেই তিনি ভারতীয় বাংলা সিনেমার একজন অপরিহার্য শিল্পী হিসেবে পরিগণিত হন। ফলে দর্শক-শ্রোতা একের পর এক কালজয়ী বাংলা গান উপহার পেয়েছেন। ১৯৪৪ সালে ‘ইরাদা’ ছবিতে প্লে-ব্যাক করে হিন্দী গানের শ্রোতাদেরকেও নিজের জাত চিনিয়েছিলেন হেমন্ত। একই বছরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রথম নিজের কম্পোজিশনে দুটো গান করেন। গান দুটির গীতিকার ছিলেন অমিয় বাগচী। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বেশ কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড বের করেছিলেন। তবে তিনি প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিলেন ১৯৪৪ সালে ‘প্রিয় বান্ধবী’ সিনেমাতে। এছাড়াও কলম্বিয়ার লেভেলে রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড বের করেছিলেন তিনি। তবে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে হেমন্ত আত্মপ্রকাশ করেন ১৯৪৭ সালে ‘অভিযাত্রী’ সিনেমার মাধ্যমে। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকেই হেমন্ত নিজেকে সম্ভাবনাময় শিল্পী এবং কম্পোজার হিসেবে সবার নজর কাড়েন। সেসময় তিনিই ছিলেন একমাত্র পুরুষ কণ্ঠশিল্পী যিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে কাজ করেছিলেন। ১৯৫৪ সালে বলিউডি সিনেমা ‘নাগিন’ এর সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি। এই ছবির গান সেসময় দুই বছর ধরে টপচার্টের শীর্ষে অবস্থান করেছিল এবং এই সিনেমার জন্যই হেমন্ত ১৯৫৫ সালে ‘ফিল্মফেয়ার বেস্ট মিউজিক ডিরেক্টর’ এর পুরস্কার লাভ করেন। এরপর তিনি বাংলা সিনেমা ‘শাপমোচন’ এর সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এই ছবিতে তিনি উত্তম কুমারের জন্য চারটি গান করেছিলেন। তারপর থেকেই যেন উত্তম কুমারের ছবি মানেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান। পরবর্তী সময়ে এই জুটি পেয়েছিল অসম্ভব জনপ্রিয়তা।

Hemanta Mukharjee_Uttam Kumar

উত্তম কুমারের সঙ্গে

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রথম হিন্দি ছবি ‘বিশ সাল বাদ’ ছবিটি নাকি তৈরি হয়েছিল ‘ডালডা’র সবচেয়ে বড় বড় ডাব্বায় জমানো টাকা দিয়ে! ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা! সেই ’৬০-’৬১ সালে টাকাটা নেহাত কম নয়। এই সময়ের ঠিক আগে ছ’মাস গান গাওয়া বন্ধ রেখেছিলেন লতা মঙ্গেশকর। গলায় কী একটা অসুবিধের জন্য গাইতে পারছিলেন না। ভেবে বসেছিলেন, আর বোধ হয় কোনও দিন গানই গাওয়া হবে না।

ঠিক এমন সময়ই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাঁকে প্রস্তাব দেন, ‘আমি ছবি করছি, তিন দিন বাদে ‘ফিল্ম সেন্টার’ ষ্টুডিওতে রেকর্ডিং। আমি তোমাকে জোর করব না। তোমার ইচ্ছে হলে তুমি এসো।’

এসেছিলেন লতাজি। গেয়েওছিলেন। আর সম্মানদক্ষিণা দিতে গেলে ফুঁসে উঠে বলেছিলেন, ‘দাদা, আপ মুঝে প্যয়সা দে রহেঁ হ্যায়?’ ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিলেন খাম। জানা যায়, লতা মঙ্গেশকর-আশা ভোঁসলে দুজনেই কোনও দিন গানের জন্য হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে অর্থ নেননি।

ব্যক্তিগত জীবনে ১৯৪৫ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সাথে বেলা মুখোপাধ্যায়ের বিয়ে হয়। ১৯৪৩-এ বাংলা ছায়াছবি, কাশিনাথে, সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজ মল্লিক বেলাকে দিয়ে কিছু জনপ্রিয় গান গাইয়েছিলেন, কিন্তু বিয়ের পর তিনি আর সঙ্গীত জগতে প্রবেশ করলেন না। হেমন্তর দুই সন্তান, জয়ন্ত ও রাণু। রাণু মুখোপাধ্যায় ১৯৬০-৭০ এ গান গাইতেন। জয়ন্ত স্মৃতিচারণ করেন, ‘রাণু ঠিক মতো গানটা গাইল না বলে বাবার খুব দুঃখ ছিল। বিশেষ করে শ্রাবন্তী মজুমদারের সঙ্গে ডুয়েট ‘আয় খুকু আয়’ গানটা রাণুরই করার কথা ছিল। বালসারাজি রাণুর কথা ভেবেই গানটা কম্পোজ করেছিলেন। মনে আছে, ‘মাসুম’ ছবির গান ‘নানী তেরি’-র শেষ অন্তরাটা গাড়িতে বাবা কী যত্নে রাণুকে শেখাতে শেখাতে নিয়ে যাচ্ছে রেকর্ড করাতে। রাণুকে না পেয়ে ফিমেল ভয়েস-এর জন্য কবিতা কৃষ্ণমূর্তিকে নেয়। কবিতার আসল নাম ছিল সারদা। বাবাই ওকে কবিতা নাম দেয়। বাবার সঙ্গে ও নানা জায়গায় গাইতে যেত। পরে মান্না দে’ও বাবার কাছ থেকে ওকে প্রোগ্রাম করতে নিয়ে যেত।’

Hemanta Mukharjee_Bela Mukharjee

স্ত্রী বেলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে

সুরের যাদুকর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ১৯২০ সালের ১৬ জুন ভারতের বারাণসী শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ছোটবেলা কাটে তিন ভাই আর এক বোনের সাথে। ছোটভাই অমল মুখোপাধ্যায় কিছু বাংলা ছায়াছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন এবং ১৯৬০ এর দশকে কিছু গানও গেয়েছিলেন। বড় ভাই তারাজ্যোতি ছোটগল্প লিখতেন। দেব সাহিত্য কুটিরের এক পূজা বার্ষিকীতে ‘ঠোঙা বাবা’ নামে খুব সুন্দর গল্প লিখেছিলেন তারাজ্যোতি।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে সঙ্গীতে অবদান রাখার জন্য রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। ১৯৮৮ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধীতে ভূষিত করে, তিনি এই পদক প্রত্যাখান করেন। ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে, আমি যদি আর নাই আসি হেথা ফিরে’ মৃত্যুর মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ঢাকায় এসে এই গানটি শুনিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

১৯৮৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি কন্ঠশিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক এবং প্রযোজক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বাঙালীর হৃদয়ে এই শিল্পীর স্বরলিপি চিরদিন থাকবে।

ভেঙে গেছে আজ সেই মধুর মিলন মেলা।
ভেঙে গেছে আজ সেই হাসি আর রঙেরো খেলা।
কোথায় কখন কবে কোন তারা ঝরে গেলো,
আকাশ কি মনে রাখে।’

কৃতজ্ঞতা:
*হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বাঙালির আবেগ- কমলেন্দু সরকার
*হেমন্ত মুখোপাধ্যায়: কিছু কথা।

বাঙালীয়ানা/এজে/এসএল

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.