‘সর্বত্র, সবসময়- দু’ ধরনের ইতিহাস চালু থাকে। একটিকে বলা যায় অফিসিয়াল ইতিহাস- মিথ্যার ভাগই বেশী থাকে সেখানে। আরেকটি হল, একই অধ্যায়ের গোপন ইতিহাস- সেখানে আপনি ঘটনাবলীর আসল কার্যকরণের হদিস পাবেন’ এমনটা বলেছেন Honore De Balzac(১৭৯৯-১৮৫০), ফরাসি উপন্যাসিক ও নাট্যকার।
তরুন শেখ মুজিবদের ব্যাপক সাপোর্টে মাওলানা ভাসানী গরমে সেদ্ধ হয়ে ‘আওয়ামি মুসলিম লীগ’ গঠনে ব্যস্ত। শেখ মুজিব তখন জেলের ঘানি টানছেন। আর ঠিক সেই সময় গনতন্ত্রের মানসপুত্র(!) হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী করাচীতে বসে বসে ‘জিন্নাহ মুসলিম লীগ’ বানানোর তালে ব্যাপক শ্রম ব্যয় করে যাচ্ছেন।
চলেন তাহলে আরেকটু পেছনে মাইনে দু’ তিন বছর আগে ঘুরে আসি। ভারত বিভাগের বছরে শরৎ বসু ও কিরণ শংকর রায়ের সাথে মিলে শহীদ সাহেব প্রস্তাবিত ভারত ও পাকিস্তানের ডমিনিয়নের বাইরে স্বতন্ত্র স্বাধীন যুক্তবাংলা গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই ঘটনার বাস্তবায়নের ফল কি হত জানিনা। তবে শহীদ সাহেব কিন্তু এই আন্দোলন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন বহু আগেই। দিল্লিতে মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় জিন্নাহর প্রতি আপোষমূলক নীতি গ্রহণ করলেন এবং বাংলা ভাগ করার প্রস্তাবে সমর্থন জানান।
ওদিকে চোখে কম দ্যাখা এক ভদ্রলোক জিন্নাহর প্রচন্ড ধমকের মুখেও ‘যুক্ত বাংলা’র প্রস্তাবে অটল ছিলেন! তিনি কে জানেন? তিনি তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিমলিগের সাধারন সম্পাদক আবুল হাশিম।
কথা হল শহীদ সাহেব জিন্নাহ মিয়াকে নিয়ে আপোষে কেন গেলেন? ঐ-যে ক্ষমতা আর লোভ! তার খায়েশ ছিল পূর্ববাংলার মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা আর প্রধানমন্ত্রীর পদ – এই দু’টিকেই একসাথে রক্ষণ করা। শহীদ সাহেব জিন্নাহকে চেনেন নাই! ঠিকই কয়দিনের মধ্যেই জিন্নাহ তার স্বভাবসুলোভ পল্টি নিয়ে নিলেন।
বাংলা ভাগ হওয়ার সাথে সাথেই জিন্নাহর ইঙ্গিতে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির নেতৃত্ব থেকে শহীদ সাহেবরে ঘাড় ধরে নামাইয়া দেয়া হল, তিনি অপসারিত হলেন। নতুন নেতা হলেন খাজা নাজিমুদ্দিন। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রীত্বের পদ গেল প্রতিক্রিয়াশীল খাজা নাজিমুদ্দিন এবং তার গ্রুপের দখলে।
এদিকে শহিদ সাহেব কলকাতার বেলেঘাটায় মহাত্না গান্ধীর আশ্রমে কিছুদিন খোল-করতাল বাজালেন, ক্লান্ত হওয়ার পর যখন ঢাকার পথে রওনা হলেন তখন মধ্যপথে এসে জানলেন পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর প্রবেশ নিষেধ। পাকিস্তান গনপরিষদেও তার সদস্যপদ বাতিল করে দেয়া হলো এবং পাকিস্তানের দ্বিতীয় স্বাধীনতা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে করাচীর জাহাঙ্গীর পার্কে বক্তৃতা দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান শহীদ সাহেবকে গালি দিয়ে কইলেন,”ও হচ্ছে ভারতের লেলিয়ে দেয়া কুত্তা”!
তারপরেও এদেশের ইতিহাসে তিনি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তাঁকে স্কীপ করে নাকি ইতিহাস চর্চা বা রচনার কোন সুযোগ নেই।
গ্রন্থ সহায়তা: ইতিহাসের রক্ত পলাশ- আব্দুল গাফফার চৌধুরী (ভাষার খানিক পরিবর্তন করেছি)