১১ জানুয়ারী ১৯৮৩ আপসহীনতার মাইলফলক । মোহন রায়হান

Comments
১১ জানুয়ারী ১৯৮৩ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের একটি যুগান্তকারী দিন। এইদিনে অবৈধ ক্ষমতাদখলদার, স্বৈরশাহী এরশাদের ধমকে, ১৪টি ছাত্র সংগঠন সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আপসকামী অংশের ভেটোর কারণে, মজিদ খানের শিক্ষা নীতি বাতিলের দাবিতে, প্রথম সামরিক আইন ভেঙে রাজপথে মিছিল করে, শিক্ষা ভবন ঘেরাও এবং স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচি স্থগিতের বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্রদের বিদ্রোহ, প্রতিবাদ ও শিক্ষাভবন ঘেরাও করার এবং আপসহীনতার মাইলফলক দিবস। সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট। সেদিনের সেই ছাত্রবিদ্রোহ না ঘটলে আপোষের চোরাগলিতে মুখ থুবড়ে পড়ত এরশাদ বিরোধী আন্দোলন। অংকুরেই বিনাশ হয়ে যেত গণতন্ত্রের আকাংখা।
এক মাসের প্রচার-প্রচারণায় সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায়, ঢাকা জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সমবেত হয়েছিল হাজার হাজার ছেলে মেয়ে। মজিদ খানের শিক্ষা নীতি বাতিলের দাবিতে শিক্ষা ভবন ঘেরাও কর্মসূচিতে।
তাছাড়া ১৯৮২’র ২৪ মার্চ সামরিক শাসন জারির দিন সকালে জাসদ ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ঐক্য ফোরামের তাৎক্ষণিক মিছিল ব্যতিরিকে তখন পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক বা ছাত্র সংগঠন রাজপথে মিছিল করার সাহস দেখাতে পারেনি। সেদিনই ছিল  রাজপথে মিছিল করে আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক আইন অমান্য করার প্রথম কর্মসূচি।
কিন্তু এরশাদ হুমকি দিল, রাজপথে মিছিল বের হলে পরিণতি ভয়ানক হবে। জানমালের ক্ষতির জন্য সরকার দায়ি হবে না। ভিসি আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও জানিয়ে দিল। আগের দিন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হলো। রেডিও, টেলিভিশনে মুহুর্মুহু তা প্রচার চলল। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব। ছাত্র সংগঠগুলোকে অনুরোধ করল, কর্মসূচি স্থগিত করতে। ভিসির মাধ্যমে প্রস্তাব দিল ১০ জানুয়ারী রাতে ক্যান্টনমেন্টে এরশাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে। জাসদ ছাত্রলীগ, জাতীয় ছাত্রলীগ, ছাত্রমৈত্রী, ছাত্র ঐক্য ফোরাম, নির্মল সেনের ছাত্র সংগঠন কর্মসূচি পালনের পক্ষে কিন্তু ডাকসু, আওয়ামী ছাত্রলীগ, বাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ মেজরিটি তাদের মুরুব্বি রাজনৈতিক দলের নির্দেশে কর্মসূচি বাতিলের পক্ষে। ফলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্মসূচি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়।
Student Movement_11 January_1983_FP

১১ জানুয়ারী ১৯৮৩, শিক্ষাভবনের সামনে বক্তৃতা করছেন মোহন রায়হান। সঙ্গে মুশতাক হোসেন, মির্জা ইয়েন (জাতীয় ছাত্র দল), ইকবাল হোসেন (মুজিববাদী ছাত্রলীগ), জাফর(সাধারণ ছাত্র) ও অন্যান্যদের দেখা যাচ্ছে। ছবি: তারেক মাসুদ।

১১ জানুয়ারী বটতলার বিশাল ছাত্র-জমায়েতে সেই ঘোষণা সংগ্রামী ছাত্রসমাজ মেনে নিতে পারে না। তারা এই ঘোষণার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতাদের অগ্রাহ্য করে, ইটপাটকেল, জুতা ছুঁড়ে, ধাওয়া দিয়ে বিশাল মিছিল নিয়ে গিয়ে শিক্ষাভবন ঘেরাও করে। মজিদ খানের শিক্ষা নীতি বাতিলের দাবিতে স্মারক লিপি প্রদান ও পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে শিক্ষাভবনের সামনে সমাবেশ করে।
সেই ঘেরাও কর্মসূচিতে ১৪ ছাত্র সংগঠনের ২৮ জন নেতা এবং তাদের গুটিকয় তস্য মোসাহেব ছাড়া সব ছাত্র সংগঠনের বাকি নেতা কর্মীরা অংশ নেয়। জাসদ ছাত্রলীগের মুশতাক হোসেন, লুতফা হাসিন রোজী, নাজমুল হক প্রধান, প্রয়াত মশিউর রহমান দুলাল, সলিমুল্লাহ খান, শফি আহমেদসহ ৯৯% ভাগ নেতা কর্মী সেই দ্রোহ, প্রতিবাদ ও ঘেরাও কর্মসূচিতে যোগ দেয়। এমনকি ছাত্রদলের অনেক নেতা কর্মীরাও অংশগ্রহণ করেছিল সেই প্রোগ্রামে। ডাকসুর সাবেক জিএস, জাসদ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি  ডাঃ মুশতাক হোসেন ‘১১ জানুয়ারী ১৯৮৩ঃ মোহন ও ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠা’ নামে একটি লেখায় এবিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন।
সেই বিদ্রোহ, সামরিক আইন পদদলিত করে রাজপথে প্রকাশ্য মিছিল ও শিক্ষাভবন ঘেরাও এর নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে ১৩ জানুয়ারী দুপুরে বাঙালির জাতি রাষ্ট্রের অন্যতম রূপকার ও জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল আলম খানের বাসা থেকে সলিমুল্লাহ খান, নাজমুল হক প্রধান এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জাসদ ছাত্রলীগের নেতা মনিরুজ্জামান আর আমি একসঙ্গে বেরিয়ে ইস্কাটন রোডে রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী (ডিজিডিএফআই)-এর কয়েজজন সাদা পোশাকধারী সদস্য অস্ত্রের মুখে আমাকে জোর করে টেনে হিচড়ে ‘ব-২৪’ নং একটি জলপাই রং জিপে তুলে চোখ-হাত বেধে, ঘাড়ে, পিঠে, তলপেটে বিশেষ কায়দায় আঘাত করে অজ্ঞান করে ফেলে কচুক্ষেতে ওদের হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যায়।
২১ দিন আমাকে গুম করে রেখে সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর টর্চারসেলে চলে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্মম, নিষ্ঠুর, নৃশংশতম, বর্বর, অমানবিক নির্যাতন। আমাকে উপরে ঝুলিয়ে, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের চাবুকের কষাঘাতে রক্তাক্ত করা হতো, কয়েক দফা ইলেকট্রিক শক দেয়া হয়, বুট দিয়ে আমার হাতের আঙুলসহ সমস্ত শরীর থেতলে দেয়া হয়, সঙ্গে সমান তালে চলে কিল, ঘুষি, লাথি, চড়-থাপ্পর, দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রেখে অনেকক্ষণ পর পর উপর থেকে মাথার চাঁদির ঠিক মধ্যিখানে হিম শীতল ঠান্ডা পানির ফোটা ফেলা আর অশ্লীল, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ।
যতক্ষণ আমি জ্ঞান না হারিয়ে ফেলতাম ততক্ষণই চলতো সেই বিচিত্র বিকৃত সামরিক নির্যাতন। পাশাপাশি ঘন্টার পর ঘন্টা চলত অদ্ভুত, আশ্চর্য, গাজাখোরি সব ইনটারোগেশন! কেন আমি সামরিক আইন অমান্য করে রাজপথে মিছিল নামালাম? এর পেছনে কোন কোন নেতার ইন্ধন ছিল? কোনো সামরিক অফিসাররা জড়িত ছিল কিনা? বড় ধরনের নাশকতার মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের জন্য কী কী পরিকল্পনা ছিল? দেশি-বিদেশি কারা কারা এই পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ছিল? ইত্যাদি আজগুবি সব জিজ্ঞাসা! আর এরশাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে যে কোনো সুযোগ সুবিধা বা পোস্ট-পজিশন গ্রহণের চাপ।
ছাত্র, শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিকসহ নানা পেশার মানুষদের দাবির মুখে এরশাদ আমাকে ২১ দিন পর মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। চোখ-হাত বেধে এনে মানিক মিয়া এভিনিউয়ের নির্জন রাস্তায় রাত দশটার পরে আমাকে ফেলে রেখে যায় ওরা। একজন রিকসাওয়ালা আমাকে তুলে নিয়ে মোহসীন হলে রাত পৌনে এগারটার দিকে পৌঁছে দিয়ে যায়।
সেই জঘন্য আত্যাচার বিষয়ে আমি মুক্ত হওয়ার পর ‘নিখোঁজ সংবাদ’ নামে একটি কবিতা লিখি। আমার মা সেই কবিতা পড়ে হু হু করে কেঁদেছিলেন, তাঁর গর্ভে নয় মাস বেড়ে ওঠা সন্তানের উপর এমন পৈশাচিক নির্যাতনের অসহ্য কষ্টে। বাংলা ডিপার্টমেন্টে আমার শিক্ষক হুমায়ূন আজাদ স্যারও তাঁর কক্ষে বসে তাঁর ছাত্রের উপর সেই নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা শুনে কেঁদে ফেলেছিলেন আর বাংলাবাজারে ‘নসাস’ প্রকাশনার কক্ষে ইফতেখার রসুল জর্জ আর প্রয়াত সাংবাদিক হেদায়েত হোসেন মোর্শেদ সেই অত্যাচারের বর্ণনা শুনতে শুনতে মোর্শেদ ভাই অজ্ঞান হয়ে চেয়ার থেকে পড়ে গিয়েছিলেন।
আজও সেই অন্যায় অত্যাচারের স্মৃতি মনে হলে শিউরে উঠি, সমস্ত শরীরের রক্ত যেন জমাট বেধে  আসে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেন ব্যথায় টনটন করে ওঠে। জানোয়ারেরা আমাকে মেরে আমার মেরুদণ্ডের তিন, চার,পাঁচ নম্বর ডিস্ক ডিসপ্লেস করে দিয়েছিল। আমি প্রায় পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলাম। হাঁটতে পারতাম না। চেন্নাইয়ের ‘আ্যপোলো’ হাসপাতালের ডা. হেগড়ে কয়েক ঘন্টার অপারেশনে আমার মেরুদন্ড মেরামত করে দেন। অনেক বিধি নিষেধ আমার চলাফেরা, জীবন যাপনে। আমার উপুড় হওয়া নিষেধ, নীচে কিম্বা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসা নিষেধ, কাত বা উপুড় হয়ে শোয়া নিষেধ, ভারি কোনো জিনিস তোলা, লাফানো বা জোরে দৌড়ানোসহ আরও অনেক বিধি নিষেধ রয়েছে। এক প্রকারের প্রতিবন্ধী জীবনই!
আজ ৩৮ বছর সেই শারিরীক ও মানসিক ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছি। কিন্তু তার চেয়েও অনেক বেশি যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাই, খেতে পারি না, ঘুমাতে পারি না, মাঝে মাঝে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করে, যখন সেই অবৈধ ক্ষমতা দখলদার, সংবিধান লঙ্ঘনকারী, গণতন্ত্রহরণকারী, জয়নাল, জাফর, মোজাম্মেল, কান্চন, আইয়ুব, দীপালি সাহা, তাজুল, ময়েজউদ্দিন, শাহজাহান সিরাজ, রাউফুন বসুনিয়া, সেলিম, দেলোয়ার, ডাঃ মিলন, নূর হোসেন, জেহাদসহ অসংখ্য শহীদের খুনি এরশাদ জান্তার প্রেতাত্মা-দোসরদের বাংলাদেশের রাজনীতিতে দৃঢ় পুনর্বাসন এবং তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্ত আর দুলক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম খচিত পবিত্র সংসদে লম্ফঝম্প আর গণতন্ত্রের ছবক দিতে দেখি!
আহা ক্ষমতা! ক্ষমতার কালো কেদারা এতটা মোহিনীয়! ক্ষমতার জন্য কেউ একাত্তরের ঘাতক, দালাল আর কেউ নব্বইয়ের অবৈধ ক্ষমতাসীন, খুনি, পতিত স্বৈরাচারকে কোলে তুলে নেয়! চুমু খায় তাদের রক্তাপিপাসু হিংস্র করাল ঠোঁটে! সত্যি ক্ষমতা কত নির্লজ্জ, বেহায়া, নিষ্ঠুর, স্বার্থান্ধ, লোভাতুর, ধান্ধাবাজী, গাদ্দার, বেঈমান…

ছবি: লেখক

লেখক:
Mohan Raihan02
মোহন রায়হান, কবি ও প্রাক্তন জাসদ ছাত্রলীগ নেতা

*এই বিভাগে প্রকাশিত লেখার মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই এখানে প্রকাশিত লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই।

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.

About Author

বাঙালীয়ানা স্টাফ করসপন্ডেন্ট