১৪-১৫ ফেব্রুয়ারী ’৮৩ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ছাত্র প্রতিরোধ
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের শুরু যে ভাবে হল
২৪ মার্চ ১৯৮২ তারিখে ভোরবেলা বেতার-টিভির মাধ্যমে এরশাদ রাষ্ট্র্রীয় ক্ষমতা ছিনতাই করার ঘোষণা প্রদান করে। ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের মধুর কেন্টিনে ছাত্র সংগঠনের কর্মীগণ সকাল ১০টা থেকে এসে জড়ো হয় প্রতিদিনের মত। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রপন্থী ছাত্রলীগের (আমি যে সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলাম ঐ সময়) কর্মীগণ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সামরিক আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ছাত্রলীগ নেতা খায়রুজ্জামান বাবুল, মসিউর রহমান দুলাল, জাফর আহমেদ দুলাল প্রমুখ এ মিছিলের নেতৃত্ব দেন। বাবুলের উচ্চকন্ঠের শ্লোগান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন এলাকা প্রকম্পিত করে তুলল। মধুর কেন্টিন থেকে ৫০-৬০ জনের মিছিল কলাভবন প্রদক্ষিণ করে টিএসসি চক্কর দিয়ে আবার মধুর কেন্টিনে ফিরে আসে। টিএসসি মোড়ে মিছিল দাঁড় করিয়ে একটি পথসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং বাবুল সামরিক শাসন জারীর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ডাক দিয়ে বক্তৃতা করে।
এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দফা দিয়ে পরবর্তীতে আন্দোলন সংগঠিত হলেও ”সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ” – এর বিরোধীতাই ছিল দীর্ঘ সংগ্রামের মুখ্য বিষয়। স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের ছাত্র সংগঠন (ছাত্রলীগ- বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র) স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই ছিল সোচ্চার। আওয়ামী লীগ সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ, একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে তো বটেই – ১৯৭৫এর ১৫ আগস্টের সামরিক ক্যুদেতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত খন্দকার মোশতাক ও জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র) ধারাবাহিক সংগ্রাম চালিয়ে এসেছে। তাই এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে আমাদের এক মুহুর্তও দেরী হয় নি। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে শ্রমিক-ছাত্র-মেহনতী জনতার ঐক্যবদ্ধ গণজাগরণ ও গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সংগ্রাম জয়ী হলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ত্বরান্বিত হবে এ ধারণা নিয়েই আমাদের সংগঠন আন্দোলনে উদ্যোগী ও নেতৃত্বের ভূমিকায় থেকেছে। যারা প্রকৃত সমাজতন্ত্রী, তারাই সবচাইতে আপোষহীন গণতন্ত্রী – নেতৃবৃন্দ আমদেরকে এ কথা বলেই উদ্বুদ্ধ করতেন।
আমাদের কর্মকৌশল ছিল ছাত্র আন্দোলনের সাথে শ্রমিক-পেশাজীবী-মেহনতী মানুষকে সম্পৃক্ত করে একে ব্যাপক গণআন্দোলনে রূপান্তরিত করা। পদ্ধতি ছিল ছাত্র-শ্রমিক-পেশাজীবীদের সমন্বয়ে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত আন্দোলনের কাঠামো গড়ে তোলা যা ব্যাপক জনগণকে নেতৃত্ব দেবে এবং আন্দোলন পরবর্তী পর্যায়ে গণতান্ত্রিক অধিকারকে রক্ষা করতে ভূমিকা রাখবে। এ জন্যে সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির সর্বোচ্চ ঐক্য গড়ে তোলার জন্য আমরা সব সময় সচেষ্ট ছিলাম, এবং আন্দোলনকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে নিয়ে যাবার জন্য সব রকমের চেষ্টায় নিয়োজিত ছিলাম।
আগের কথা
১৯৮১ সালের ৩০ মে সামরিক বাহিনীর একদল কর্মকর্তার হাতে জেনারেল জিয়াউর রহমান নিহত হবার পর সেনাবাহিনীতে শৃংখলা ভঙ্গের বিচারের নামে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সামরিক কর্মকর্তাকে গোপন বিচারের মাধ্যমে ফাঁসী দেয়া হয়। এ ষড়যন্ত্রমূলক ফাঁসীর প্রতিবাদে ১৯৮২ সালের প্রথম দিক থেকেই মুক্তিযোদ্ধা ও প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনসমূহ একসাথে প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তোলে। গঠিত হয় মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল ছাত্রলীগ (বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র), ছাত্রলীগ (বাকশাল – পরবর্তীতে জাতীয় ছাত্র লীগ নাম ধারণ করে), ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র সমিতি প্রমুখ। যখন এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা ছিনতাই করে তখন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এর বিরোধীতা করার আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অবৈধ ক্ষমতা দখলের দু’দিন পর ২৬ মার্চ সাভার জাতীয় স্মৃতি সৌধে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সংঘবদ্ধভাবে উপস্থিত হয় এবং স্মৃতিসৌধে সামরিক আইনের বিরুদ্ধে শ্লোগান তোলে। সাভার সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনী এসে সমাবেশ ভেঙ্গে দেয় এবং নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করে।
এ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ জোটবদ্ধভাবে এবং নিজ নিজ অবস্থান থেকে সংগঠিত হতে থাকে। জোটবহির্ভূত ছাত্রলীগ (আওয়ামী লীগ) ও ছাত্রলীগ (বাসদ)-কে সম্পৃক্ত করার জন্য চেষ্টা চলতে থাকে। তবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কর্মীগণ সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে একাত্ম হলেও এর নেতৃবৃন্দের একটা বড় অংশ সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের সাথে তাদের পূর্বতন সম্পর্কের ভিত্তিতে ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তিতে লিপ্ত ছিলেন। তাই সংগঠনগতভাবে ছাত্রদল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে শরীক হতে পারে নি।
এরশাদের সামরিক শাসনকে মোকাবেলার প্রস্তুতি পর্ব
একটু আগেই বলেছি যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর কেন্টিন থেকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রী ছাত্রলীগ (মুনীর-হাসিব) ১৯৮২ সনের ২৪ মার্চ সকাল ১১টাতেই সামরিক শাসন বিরোধী বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। আমরা হলে হলে গোপনে বৈঠক করতাম, ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন অঞ্চলে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হলে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় হলে, নারায়ণগঞ্জ শহরের বিভিন্ন এলাকায় গোপনে আমরা ছাত্র বৈঠক করতাম। এ সব বৈঠকের প্রত্যেকটিতে আমি ও ছাত্রলীগের (বৈ.স.) তৎকালীন দফতর সম্পাদক বজলু ভাই উপস্থিত থেকে কর্মীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছি। দীর্ঘ ৮ মাস ব্যাপী প্রস্তুতির পরে ৮ নভেম্বর ১৯৮২ সামরিক শাসনকে চ্যালেঞ্জ করে প্রকাশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মধুর কেন্টিন থেকে মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১৯৭৫ এর ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার অভ্যুত্থান স্মরণে প্রতি বছর ৮ নভেম্বর ছাত্রলীগ (বৈ.স.) কর্মসূচী গ্রহণ করে। ৭ নভেম্বর ছুটি থাকায় ক্যাম্পাস বন্ধ থাকতো, তাই এর পরদিন সভা-সমাবেশ করা হতো। ১৯৮২ সালে সামরিক শাসন থাকায় প্রকাশ্যে আইনানুগভাবে কোন কর্মসূচী পালন করার সুযোগ ছিল না। তাই গোপন প্রস্তুতি নিয়ে ঝটিকা মিছিল ও লিফলেট বিতরণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
তবে ৮ নভেম্বরের আগেও ঢাকার রাজপথে মিছিল হয়েছিল। প্রথম মিছিল ও প্রচারপত্র বিতরণ হয় তুরস্কে সামরিক শাসন জারীর প্রতিবাদে। পরেরটা হয় প্যালেস্টাইন মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। তারিখটা ঠিক মনে নেই, দিনটি ছিল শুক্রবার জুমাতুল বিদার দিন। এ দিন বিশ্বজুড়ে আল কুদস দিবস পালিত হয়। একটি বিক্ষোভ মিছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মধুর কেন্টিন থেকে মার্কিন দূতাবাস পর্যন্ত যায়। মিছিলে ছাত্রলীগের (বৈ.স.) কর্মী ছাড়াও বাংলাদেশে অধ্যয়নরত প্যালেস্টাইনী ছাত্ররা এতে অংশ নেয়। মার্কিন দূতাবাসে একটি স্মারকলিপি দেয়া হয়। একজন যুবক বয়সের মার্কিন কর্মকর্তা সেটি গ্রহণ করেন রাস্তায় নেমে এসে। দু’টি মিছিলেরই উদ্যোক্তা ছিলেন সলিমুল্লাহ খান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার পাট চুকিয়ে সলিমুল্লাহ তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ডক্টরস ক্লাবের (এখন যার নাম শহীদ ডা. মিলন হোস্টেল) ২০৩ নং কক্ষে আমার অতিথি হিসেবে থাকতেন। স্মারকলিপি দেয়া-নেয়ার ফাঁকে প্যালেস্টাইনী ছাত্ররা আদমজী কোর্টের নীচতলায় মার্কিন দূতাবাসের নামফলক খুলে নিয়ে আসে এবং ফিরতি মিছিলে ঐ ফলকের গায়ে জুতা পরানো হয়। মিছিলটি যখন ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আসছিল তখন বাংলা একাডেমির সামনে পুলিশ হঠাৎ করেই হামলা চালায়। তারা আমাদেরকে গ্রেফতার করার চেষ্টা করে। প্যালেস্টাইনী ছাত্ররা ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশের কাছ থেকে আমাকে উদ্ধার করে। বিনিময়ে তাদেরকে পুলিশের লাঠিপেটা খাওয়া ও একরাত হাজতবাস করতে হয়। আমার পরনের জামা ছিঁড়ে গিয়েছিল। ফুলার রোডে লুতফা হাসীন রোজীর বাসায় গিয়ে জামা বদলিয়ে মধুর কেন্টিনে ফিরে আসি।
১১ জানুয়ারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ
৮ নভেম্বরের মিছিল ও সর্বদলীয়ভাবে পুলিশী হামলা প্রতিরোধের পর দ্রুতগতিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে ছাত্র মিছিলের অধিকার ফিরে আসে। সামরিক শাসনের পর এসব নিষিদ্ধ ছিল। ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে বিভিন্ন কর্মসূচী পালনের পর এক পর্যায়ে ১১ জানুয়ারী ১৯৮৩ ক্যাম্পাসের বাইরে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে যাওয়ার কর্মসূচী (শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি পেশ) গ্রহণ করা হয়। এ কর্মসূচী ঘোষণার পর সামরিক সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরণের প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য হুমকি আসা শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রোক্টর প্রমুখের মাধ্যমে সামরিক সরকার ছাত্র নেতৃবৃন্দের কাছে হুমকির বার্তাগুলো পৌাঁছানোর চেষ্টা করে। নেতৃবৃন্দ আমাদেরকে সেগুলো বলতেন না। তবে বিভিন্ন মাধ্যম ঘুরে যতটুকু আমাদের কাছে পৌঁছেছিল তাতেই আমরা দারুণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলাম। ১০ জানুয়ারী সরকার ছাত্রদেরকে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে এক প্রেস নোট জারী করে। সেটি বেতার ও টেলিভিশনে মুহুর্মুহু প্রচার হতে থাকে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মীরা এতে ভয় তো পেলই না, উল্টো পণ করেছিলাম যে, সামরিক জান্তার ব্যারিকেড আমরা ভাঙবোই। ১০ জানুয়ারী রাত্রিবেলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ সবদিক বিবেচনা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি পেশের কর্মসূচী এক মাস পিছিয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি নির্ধারণ করেন। তবে ১১ জানুয়ারির বটতলার সমাবেশ বহাল রেখে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যন্ত মিছিল করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ছাত্র আন্দোলনের সাথে তাল রেখে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলসমূহের প্রস্তুতি না থাকাটাই প্রধান কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয় (যদিও ১৪ ফেব্রুয়ারিতেও দেখা গেছে যে, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রস্তুত নন)। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দের রাতের বেলার এ সিদ্ধান্ত প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের মত মাঝারী পর্যায়ের নেতৃত্বের কাছে পৌঁছে যায়। আমাদের মাধ্যমে সে খবর পৌঁছে যায় কর্মীদের কাছে। কর্মীরা বজ্রশপথ গ্রহণ করে সামরিক আইনকে চ্যালেঞ্জ করার, এতে নেতৃবৃন্দ সাথে থাকুক বা নাই থাকুক।

১৪ ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৩ সকালে সচিবালয় অভিমুখে ছাত্রদের মিছিলে এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ বিডিআর
কর্মীদের এ মনোভাব সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে জানানোর উদ্দেশ্যে রাতের বেলাতেই মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে মিছিলে আমি, খায়রুজ্জামান বাবুল, মসিউর রহমান দুলাল, শফী আহমেদ, লাভলু সহ মাঝারী পর্যায়ের আরো কয়েকজন নেতাসহ প্রায় অর্ধশতাধিক কর্মী ছিল। মিছিলটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) হলসমূহ, মেডিক্যাল হোস্টেল ঘুরে জগন্নাথ হলে প্রবেশ করে। বুয়েট ও মেডিক্যাল ক্যাম্পাসে মিছিল করার উদ্দেশ্য ছিল ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতৃত্বের কানে আমাদের বার্তা পৌঁছে দেয়া। সন্ধ্যার পরে অধিকাংশ বৈঠক ঐ দু’ জায়গাতেই অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু জগন্নাথ হলে পৌঁছে আমরা খবর পাই যে, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে বৈঠক করছেন। তখন আমরা জগন্নাথ হল থেকে মিছিল নিয়ে সরাসরি ভিসি বাংলোতে ঢুকলাম। আমাদের শ্লোগান ছিল, ’আপোষ না সংগ্রাম: সংগ্রাম সংগ্রাম’, ’প্রেস নোটে লাথি মার: আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়’, ’সামরিক আইনে লাথি মার: শিক্ষা ভবন ঘেরাও কর’, ’গণবির্ধোী শিক্ষানীতি: জ্বলিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও’, ’এরশাদের ঘোষণা: মানি না মানি না’ ইত্যাদি। এক পর্যায়ে দু’ একজন ছাত্র নেতা বেরিয়ে এসে আমাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চেয়েছিলেন বোধ হয, তবে মিছিলের শ্লোগান ও জঙ্গীরূপ দেখে তারা সম্ভবতঃ সে পরিকল্পনা ত্যাগ করেন। মিছিলটি এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন এলাকার ছেলেদের সব ক’টি হল প্রদক্ষিণ করে। প্রথমে কেবল ছাত্রলীগের (বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র) কর্মীরা মিছিল করলেও ক্রমান্বয়ে বাকশাল ছাত্রলীগ, ছাত্র মৈত্রী, ছাত্র ঐক্য ফোরাম, আওয়ামী ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীগণ মিছিলে যোগদান করে।
পরদিন সকাল ৯টার মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর বিক্ষোভ শ্লোগানে সরগরম হয়ে উঠলো। আমরা কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদকবৃন্দ একমত হলাম যে, নেতৃবৃন্দ শিক্ষাভবন অভিমুখে মিছিল নিয়ে যেতে না চাইলে আমরা সাংগঠনিক সম্পাদকবৃন্দ ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে যাব। আমি, মুকুল বোস, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আলী নেওয়াজ খৈয়াম একসাথে বটতলায় ও অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ঘুরে ঘুরে কর্মীদের সাথে কুশল বিনিময় করছিলাম। কর্মীরা ইঙ্গিতটা ঠিকই ধরতে পারলো।

১৪ ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৩ সকালে সচিবালয় অভিমুখে ছাত্রদের মিছিল থেকে আহত ও নিহতদের গুম করা হয়
আমাদের সংগঠনের সভাপতি জনাব মুনীর উদ্দিন আহমেদকে সভাপতি করে বিশাল ছাত্র সভা শুরু হলো। আমাদের সংগঠনের কর্মীরা একটু হকচকিয়ে গেল। কারণ নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের উদ্যোগটা আমাদেরকেই নিতে হবে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ ভেবেছিলেন যে, আমাদের সংগঠনের কর্মীরা যেহেতু তুলনামূলকভাবে একটু বেশী বিদ্রোহী মনোভাবাপন্ন, তাই আমাদের সংগঠনের জনপ্রিয় সভাপতি তা সামাল দিতে পারবেন। কিন্তু ইতিমধ্যে বিদ্রোহে সব সংগঠনের (ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা ছাড়া) ছাত্র-ছাত্রীদের অদৃশ্য একাত্মতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে মুনীর ভাই কতটুকু সামাল দিতে পারবেন? মুনীর ভাই সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে মাইক ধরলেন, খুবই জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুরু করলেন। কিন্তু যখন তিনি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে বললেন মিছিল শহীদ মিনারে যাবে, তখন সব কিছু তার আয়ত্বের বাইরে চলে গেল। আমাদেরই সংগঠনের সহ-দপ্তর সম্পাদক ইকবাল (তখন জসীমুদ্দীন হলে থাকতো) সভাপতির মাইকটি খুলে মাটিতে নামিয়ে দিল এবং চিৎকার করে বলতে লাগলো, ”মুনীর ভাই আপনার সিদ্ধান্ত মানি না, মিছিল শিক্ষা ভবনে যাবে।” হাজার হাজার ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে গেল। সবাই বলতে লাগলো ’চলো চলো শিক্ষা ভবন’, কে দেবে নেতৃত্ব? আমরা বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের মাঝারী সারির নেতারা প্রকাশ্য বিদ্রোহের দায় নিতে চাই ছি না, আবার ছাত্ররাও সম্ভাব্য পুলিশী হামলার মুখে নিজেরা এলামেলোভাবে যেতে চাচ্ছে না। কারো কাছ থেকে প্রকাশ্য ঘোষণা চাচ্ছে অর্থাৎ নেতৃত্ব দেখতে চাচ্ছে। জমায়েতে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরাও এসেছে। তারাও সামরিক সরকারের ব্যারিকেড ভঙ্গ করবে। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতৃত্বের একটা অংশ সামরিক সরকারের পক্ষে চলে যাওয়ায় তাদের নেতৃত্ব অগোছালো এবং আরো কেউ কেউ সামরিক সরকারের সাথে যোগাযোগ রাখছে। তবে তাদের মাঝারী সারির নেতা ও সাধারণ কর্মীরা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভা-মিছিলে আসতো।
জটলার মধ্যে আমাদের সংগঠনের দপ্তর সম্পাদক বজলু ভাই একটা উ্ঁঁচু বেদীর ওপর দাঁড়িয়ে একবার তার ক্ষীণ গলায় চিৎকার করে সবাইকে শিক্ষা ভবনের দিকে রওনা হবার আহ্বান জানালেন। যারা তাকে চিনতো না তারা তাকে বললো, ’আপনি কে, আপনার কথা শুনবো না, আপনি নামেন’। একেবারে বিশৃংখল অবস্থা। এ অবস্থায় মিছিলে যাওয়াও তো বিপদ। সরকারের এজেন্টরা ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারে। কি করা যায়? সলিমুল্লাহ খান একটা বুদ্ধি বার করলেন। মোহনকে কবি হিসেবে জনতার কাছে তুলে ধরে বলতে হবে। সে ছাত্রনেতা নয়, কবি। তার কথা শুনতে আমাদের আপত্তি নেই। আর ছাত্ররাও তাকে কবি হিসেবেই বেশী চিনতো, মোহনের সাংগঠনিক পরিচয় কবি পরিচয়কে তখনও ছাপিয়ে ওঠে নি। এটা করলে উত্তেজিত ছাত্রদেরকে নিয়ন্ত্রণও করা যাবে, আবার আন্দোলনের রাশটাও আমাদের হাতে থাকবে, সরকারী গোয়েন্দাদের এজেন্টরা এতে ঢুকতে পারবে না। আমরা আরো সিদ্ধান্ত নিলাম যে, নেতৃবৃন্দ ছাড়া শিক্ষা ভবনের সামনে পুলিশী ব্যারিকেড ভাঙ্গা ঠিক হবে না। হতাহতের দায়িত্ব কে নেবে? তাই ছাত্র-ছাত্রীরা একটু শান্ত হলে তাদেরকে ফিরিয়ে আনতে হবে। পরিকল্পনামাফিক আমাদের কর্মীরা শ্লোগান তুললো, ’আমরা কারো কথা শুনবো না, শুধু মোহন ভাইয়ের কথা শুনতে চাই’, ’মোহন ভাই হুকুম চাই’ ইত্যাদি ইত্যাদি। বাসাবোর স্বপন, শুভ্র, মাসুদ, এনামুল, এদের বন্ধু মাহফুজ-শহীদ-তানভীর এবং এদের অন্যান্য বন্ধুরা মিলে এ শোরগোল তুললো। এক পর্যায়ে মোহনকে চ্যাংদোলা করে বজলু ভাইকে যেখান থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছিল সেই উঁচু সিমেন্টের বেদীতে ওঠানো হলো। মোহন দাঁড়িয়ে সামরিক জান্তাকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করে বক্তৃতা করা শুরু করলো, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্তে তার কবি হৃদয় ভেঙ্গে গেছে বলে মন্তব্য করলো এবং সর্বশেষে উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রীদের অনুরোধে সুশৃংখল মিছিল নিয়ে শিক্ষা ভবনের অভিমুখে পুলিশী ব্যারিকেডের সামনে অবস্থান গ্রহণের জন্য আহ্বান জানালো।
বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মত হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী রওনা হলো। টিএসসি পার হয়ে দোয়েল চত্বর হয়ে শিক্ষা ভবন অভিমুখে চলল মিছিল। মোহনের সাথে আমি ও সলিমুল্লা খান। প্রথমে আমরা মিছিলের সামনে থাকলেও মিছিলের জোয়ারের ধাক্কায় খানিকটা পিছিয়ে পড়েছি। মিছিলের প্রথম ভাগ পুলিশী ব্যারিকেডের সামনে গিয়েই ব্যারিকেড ভাঙ্গার চেষ্টা করছিল। আমরা কিছুক্ষণ পর সেখানে পৌঁছেই সংঘর্ষ থামিয়ে দেই, আর পুলিশও তখন ইট-পাটকেল খেয়েও ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর লাঠি চার্জ বা ধাওয়া করেনি। সেখানে কিছুক্ষণ শ্লোগান চলার পর আমাদের পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মিছিল ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নেবার কথা ঘোষণা করতে মোহনকে আবদুল গনি রোডের সিমেন্টের নামফলকের ওপর দাঁড় করানো হয়। আমি ও আওয়ামী ছাত্রলীগের কাজী ইকবাল ভাই (পরবর্তীতে যুবলীগ নেতা, প্রয়াত হয়েছেন) নীচে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মোহন আবারো জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে সবাইকে বৃহত্তর আন্দোলনের প্রস্তুতি নেবার জন্য সেখানকার মত কর্মসূচী শেষ করে শান্তিপূর্ণভাবে কলাভবনে ফিরে যাবার আহ্বান জানায়। সমবেত ছাত্ররা মোহনকে কাঁধে তুলে মিছিল করে কলাভবনে ফিরে আসে এবং শ্লোগান দিয়ে বলে যে, ’আজ থেকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা মোহন ভাই’, ’নেতৃবৃন্দ বাতিল হয়ে গেছে’ ইত্যাদি। কলাভবন চত্বরে বিদ্রোহী ছাত্রদের সাথে আমাদেরকে কয়েকদফা বৈঠক করে তাদেরকে শান্ত করতে হয়েছে, এবং কয়েকদিন পরে অবশেষে তাদেরকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১৪ ফেব্রুয়ারীর কর্মসূচীর কাজে সম্পৃক্ত করি। ১৪ ফেব্রুয়ারীতে শিক্ষা ভবন অভিমুখী মিছিলে আরো অনেক ছাত্র-ছাত্রী সামিল হয়। ১১ জানুয়ারীতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দের ওপর সাধারণ কর্মী ও ছাত্র-ছাত্রীদের যে ক্ষোভ ছিল তার কোন চিহ্নই এক সপ্তাহ পরে আর ছিল না। এর মাঝে জানুয়ারীর মধ্যভাগে মোহন রায়হানকে সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের বিশেষ টীম ধরে নিয়ে যায়। মোহন এবং সলিমুল্লা খান ঐ সময় জাসদের প্রতিষ্ঠাতা জনাব সিরাজুল আলম খানের নিউ ইস্কাটনস্থ বাসা থেকে ফিরছিলেন। বড় রাস্তায় আসতেই মোহনকে ধরা হয়, সলিমুল্লা খান পালিয়ে এসে মুহসীন হলে সবাইকে মোহন ধরা পড়ার খবর দেন। মোহনকে জঘন্য শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করে সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী। ১৪ ফেব্রুয়ারীর কিছুদিন আগে মোহন ছাড়া পায। অত্যাচারিত অসুস্থ শরীরে মিছিলে না আসার জন্য তাকে অনুরোধ করা হলেও মোহন ১৪ ফেব্রুয়ারীর মিছিলে এসেছিল।
১১ জানুয়ারী স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জন্য মোড় পরিবর্তনের দিন। এদিনের পর নেতা-কর্মী কারো মধ্যে সামরিক জান্তাকে চ্যালেঞ্জ করার ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল না। ১১ জানুয়ারীর মধ্য দিয়ে সামরিক শাসন বিরোধী লড়াইয়ে এক নতুন প্রজন্মের লড়াকু সৈনিকদের আবির্ভাব ঘটে।
১৪-১৫ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৩ কি ঘটেছিল?
১৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৩। এরশাদের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের এক রক্তাক্ত অথচ গৌরবময় দিন। ১৪ ফেব্রুয়ারীর ছাত্র অভ্যুত্থানের মহড়া বা ড্রেস রিহার্সাল হয়ে গিয়েছিল ১১ জানুয়ারী। ১১ জানুয়ারীর স্বতঃস্ফূর্ততা ১৪ ফেব্রুয়ারীতে পরিপক্ক হয়। যে নেতৃবৃন্দ এক মাস আগে লড়াকু ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে ছিলেন সমালোচিত ও নিন্দিত, তারাই ছিলেন ১৪ ফেব্রুয়ারীর ছাত্র অভ্যুত্থানের বীর নায়ক। এটা একটা আশ্চর্য ব্যাপার! নেতৃত্ব যদি সত্যিই আপোষকামী হতেন তাহলে তারা ১৪ ফেব্রুয়ারীর আগেও আবার তালবাহানা করতেন। এবার নেতৃত্বের সামনে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল না। ১১ জানুয়ারীতে সম্ভবতঃ রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরামর্শে ছাত্র নেতৃবৃন্দ শিক্ষা ভবন অভিমুখে মিছিলের কর্মসূচী স্থগিত করেছিলেন। ১৪ ফেব্রুয়ারীর আগে সেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষে পুনরায় কর্মসূচী স্থগিত রাখতে পরামর্শ দেবার প্রকাশ্য যুক্তি ছিল না। তবে তাদের একাংশ যে ১৪ ফেব্রুয়ারীর কর্মসূচীর পক্ষে ছিলেন না, তা বোঝা যায় ১৪-১৫ ফেব্রুয়ারীর ছাত্র হত্যার পরে তাদের প্রতিক্রিয়ায়, যার কুপ্রভাব ছাত্র আন্দোলনেও পড়েছিল।

১৪ ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৩ সকালে সচিবালয় অভিমুখে ছাত্রদের মিছিল
মজিদ খানের গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিল, ছাত্র বন্দীদের মুক্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবীতে ছাত্র সমাজ সামরিক আইনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি প্রদানের উদ্দেশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে যাত্রা শুরু করে। মিছিলের অগ্রভাগে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন কলেজ, বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রীরা। কার্জন হল ও শিক্ষা ভবনের সামনে শান্তিপূর্ণ মিছিলটি পেঁঁৗঁছা মাত্রই অপেক্ষমান পুলিশ-বিডিআর-সেনাবাহিনী সাঁড়াশী আক্রমণ চালায় ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর। শহীদ হন জয়নাল, জাফর, দীপালী সাহা সহ অনেক নাম না জানা ছাত্র-ছাত্রী। বিকেলে বটতলায় শহীদ জয়নালের জানাজা শুরু হবার মুহুর্তে হাজার হাজার পুলিশ-বিডিআর-সেনাবাহিনী পুরো ক্যাম্পাস ঘেরাও করে ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর নজিরবিহীন বর্বরতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। নির্যাতনে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী পঙ্গুত্ব বরণ করে এবং হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে গ্রেপ্তার করে সেনানিবাস ও বিডিআর সদর দপ্তরের অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখে। নির্মমভাবে পিটিয়ে ট্রাকে তুলতে থাকে শত শত ছাত্র-ছাত্রীকে। আমি শহীদ জয়নালের লাশের সাথে মুহসীন হলে আশ্রয় নেই। ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন সভাপতি খন্দকার ফারুক ভাই দীর্ঘদেহী মানুষ। তিনি জয়নালের লাশের খাটিয়া কাঁধে নেয়ায় আমার মত মাঝারী উচ্চতার মানুষের পক্ষে তার সাথে তাল মিলিয়ে খাটিয়ায় কাঁধ লাগানো খুবই কষ্টকর ছিল বৈকি! রেজিস্টার ভবনের দেয়াল টপকে লাশসহ আমরা মুহসীন হলে ঢুকে পড়েছিলাম। পুলিশ-বিডিআর-সেনাবাহিনী জয়নালের লাশ খুঁজে পায় কলাভবনের সমস্ত হল খুঁজতে খুঁজতে। বিকেলে লাশ মুহসীন হলে ঢোকানো হয়েছিল, আর পুলিশ-বিডিআর-সেনাবাহিনী তা খুঁজে পায় মধ্যরাতেরও পরে। কোন ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী এ তথ্য বাহিনীগুলোকে দেয় নি। এমনি সংগ্রামী ঐক্য ছিল সবার মাঝে! আমি তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের (মুনীর-হাসিব) সাংগঠনিক সম্পাদক। ১৪ ফেব্রুয়ারী রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হল থেকে আমি গ্রেপ্তার হই। আমাকে গ্রেফতার করার পর পুলিশ-বিডিআর-সেনাবাহিনী যে অত্যাচার চালায় তার ছিল খুবই পৈশাচিক। এ কারণে গুজব ওঠে যে আমি বন্দী অবস্থায় মারা গেছি। ছাত্র নেতৃবৃন্দের মধ্যে যারা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন জনাব খ. ম. জাহাঙ্গীর, প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম নোমান, আশরাফুল হক মুকুল, লেনিন আজাদ, জালাল আহমেদ, শামসুজ্জামান দুদু প্রমুখ। এমনকি মধুর কেন্টিনের শহীদ মধুদা’র ছেলে অরুণকেও হামলাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার করে চরম নির্যাতন চালায়।

১৪ ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৩ সকালে হাইকোর্ট গেটে শিক্ষা ভবনের সামনে পুলিশী একশনের মুহুর্ত
আন্দোলন দমনের জন্য সামরিক জান্তাা ১৪ ফেব্রুয়ারী বিকেল থেকে কারফিউ জারী ও গণগ্রেপ্তার চালালেও ছাত্র-জনতা কারফিউ ভেঙ্গে রাজপথে নেমে পড়ে। হত্যা-নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৫ ফেব্রুয়ারী ছাত্র সমাজ হরতাল আহ্বান করে এবং বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ঢাকা-চট্টগ্রাম সহ সারা দেশে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। পুরো ঢাকা মহানগরীতে হত্যা-নির্যাতন উপেক্ষা করে হাজার হাজার ছাত্র রাস্তায় বেরিয়ে আসে। পুলিশ-বিডিআর-সেনাবাহিনী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা কলেজ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, তিতুমীর কলেজ সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হল-হোস্টেল ঘেরাও করে হাজার হাজার ছাত্রকে পাইকারী গ্রেপ্তার করে বেইলী রোড, হেয়ার রোডের সামরিক আদালতের প্রাঙ্গনে জমা করে। গ্রেপ্তারের সময় ও পরে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা চালায় চরম নির্যাতন। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্রনেতা বাকী সহ অনেক ছাত্রের চোখ লক্ষ্য করে বাহিনীর সদস্যরা লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে চোখ নষ্ট করার চেষ্টা করে। বাকীর চোখ বেঁচে গেলেও অনেকের চোখ এতে স্থায়ীভাবে নষ্ট হয়ে যায়। হাত-পা তো অনেকেরই ভেঙ্গেছে। এদিন শহীদ হন চট্টগ্রামে মোজাম্মেল কাঞ্চন, ঢাকায় জগন্নাথ কলেজের মোজাম্মেল আইউব সহ আরো অনেক নাম-না-জানা ছাত্র-শ্রমিক-জনতা। আমি ও খ. ম. জাহাঙ্গীর সহ যাদেরকে সামরিক বাহিনীর বন্দীখানায় এবং সামরিক গোয়েন্দা দপ্তরের ‘সেইফ হোল’ নামক অন্ধকূপে আটকে রাখা হয়েছিল তাদেরকে চরম নির্যাতন করা হয়। জাতীয় নেতৃবৃন্দ ড. কামাল হোসেনের বেইলী রোডের বাসায় ১৫ ফেব্রুয়ারী বৈঠকে বসে ছাত্র নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সিদ্ধান্ত নেন। সেখান থেকে ড. কামাল সহ শেখ হাসিনা, মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ তোয়াহা, নির্মল দাস ও অন্যান্যদের গ্রেপ্তার করে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়।
২৬ মার্চ ১৯৮৩ স্বাধীনতা দিবসের আগেই আমাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়। সামরিক গোয়েন্দা দপ্তরের বন্দীশালা থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অফিসে এনে খাতায় স্বাক্ষর করিয়ে আমাকে মুক্তি দেয়া হয়। আমার পরনে ছিল লুঙ্গী, কারণ যখন আমি মুহসীন হলে গ্রেপ্তার হই তখন লুঙ্গী-গেঞ্জি পরে ঘুমুচ্ছিলাম। সেনা হেফাজতে কাউকে আমার সাথে দেখা করতে না দেয়ায় অতিরিক্ত কোন পোষাক পাইনি। তাই মুক্তি পাবার আগ পর্যন্ত লুঙ্গী-গেঞ্জি পরেই ছিলাম। জেল গেট থেকে বেরিয়েই দেখলাম জাহাঙ্গীর কবির নানক ভাই, আওয়ামী ছাত্রলীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক। জিজ্ঞেস করলেন, পয়সা কড়ি আছে কিছু? ’না’ বোধক মাথা নাড়লেই আমাকে কিছু টাকা দিলেন। আমি একটা রিকশা নিয়ে কাছেই বখশীবাজারস্থ মেডিক্যাল হোস্টেলে পৌঁছলাম। আমাদেরকে মার্চের মাঝামাঝি ছেড়ে দেয়া হলেও মোহাম্মদ তোয়াহাকে আরো কয়েক মাস জেলে আটকে রাখা হয়।
দশ দফা
১৯৮৩ সনের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে সাভার স্মৃতি সৌধে রওয়ানা হবার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন চত্বরে ছাত্রদের সমাবেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে ছাত্রলীগ (আ.লীগ) সাধারণ সম্পাদক জনাব খ ম জাহাঙ্গির ১০ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করেন। ১০ দফাতে মূলতঃ শিক্ষার প্রগতিশীল পরিবর্তনের প্রস্তাবনাগুলোই তুলে ধরা হয়েছিল। তবে সে পরিবর্তনগুলো এরশাদের অবৈধ সরকার করে দেবে এমন আশা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ করে নি। তাই সামরিক শাসন তুলে নেবার দাবি অন্যান্য সব দাবিকে ছাপিয়ে উঠেছিল। তবে ছাত্রদের দাবি ও গণতন্ত্রের দাবির পাশাপাশি শ্রমিক-কৃষক ও অন্যান্য পেশার মানুষের দাবির মূল বিষয়গুলোও ১০ দফাতে সন্নিবেশিত হয়।
বৃহত্তর আন্দোলনে দশ দফার প্রভাব
শিক্ষা ও গণতন্ত্রের দাবীতে ছাত্র আন্দোলনের সবচাইতে তুঙ্গ সময় ছিল ১৯৮৩ সনের মধ্য ফেব্রুয়ারী। এর পরে ১০ দফা রচিত হয়। মধ্য ফেব্রুয়ারীর পরে ঐ মাপের কোন ছাত্র অভ্যুত্থান আর ঘটে নি। যদিও গণআন্দোলনের অনেক গৌরবজনক অধ্যায় রচিত হয়েছে। এবং তা হয়েছে রাজনৈতিক জোটসমূহের ৫ দফাকে সামনে রেখেই। ১০ দফা কর্মসূচীর সাথে ৫, ৭, ৮ দলীয় রাজনৈতিক জোটসমূহের সবাই একাত্মতা প্রকাশ করেছিল। তিন জোটের রূপরেখাতেও ১০ দফা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ছিল। তবে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রভাব বেশী কাজ করেছে জাতীয় রাজনৈতিক দলসমূহকে ঐক্যবদ্ধ করতে, আন্দোলনকে আপোষহীন রাখতে এবং শেষ পর্যায়ে ১৯৯০তে গণঅভ্যুত্থানকে সংগঠিত করতে। এটা ঠিক যে, ১০ দফা সে তুলনায় সামনে থাকে নি।
শেষ মন্তব্য
সামরিক সরকার প্রণীত ড. মজিদ খানের গণবিরোধী শিক্ষানীতির ও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্রুয়ারীতে রচিত হয় এক গৌরবজনক অধ্যায়। এ আন্দোলনই পরিণতি লাভ করে গণআন্দোলনে এবং এরশাদের স্বৈরশাহীর পতন ঘটে। একই ভাবে অতীত ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরে শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে যে গৌরবজনক সংগ্রামের সূচনা হয় তা পরিণতি লাভ করে ১৯৬৯ সনের গণঅভ্যুত্থানে ও ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধে।
১৩/০২/২০১৯
ছবি: ইন্টারনেট
লেখক:
মুশতাক হোসেন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ডাকসু