পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট ধলপহরে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বরের চিরচেনা বাড়িতে স্বাধীনতাবিরোধী একদল নরঘাতকের গুলিতে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন। একই সময়ে তাঁর ভগ্নিপতি ও মন্ত্রিসভার সদস্য আবদুর রব সেরানিয়াবাত এবং তাঁর ভাগ্নে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি বাসায় প্রাণ হারান। তাঁদের সঙ্গে ওই তিনটি বাড়িতে আরও নিহত হন পরিবারের সদস্য, আমন্ত্রিত অতিথি, বঙ্গবন্ধুর ছোটভাই শেখ নাসের এবং কামানোর গোলার আঘাতে মোহাম্মদপুরের একটি পরিবারের বেশ ক’জন।
পনেরোই আগস্ট একই সময়ে ওই নরঘাতকদের একটি গ্রুপ দ্বারা আক্রান্ত হয় শাহবাগে অবস্থিত সে সময়ের বাংলাদেশ বেতারের ঢাকা কেন্দ্রটি। তারা অবশ্য গুলি-গালা না ছুঁড়েই কেন্দ্রটি দখল করে নেয়। এই কেন্দ্রটি থেকে খুনী মেজর ডালিম প্রথম ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার কথা। ইথারে ছড়িয়ে দেয়া সেই কুৎসিত ভাষায় উচ্চারিত ঘোষণাটি শুনেই দেশবাসী জানতে পারে বঙ্গবন্ধুর সেই মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা। ঘোষণাটির পূর্বে ওই খুনী বাংলাদেশ বেতারের নাম পাল্টিয়ে রেডিও পাকিস্তানের আদলে ঘোষণা করে রেডিও বাংলাদেশ। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানী ভাবধারায় নামটি বজায় থাকে। জিয়া, সাত্তার, খালেদা ও এরশাদ কেউ প্রকৃত নামটি ফিরিয়ে আনার জন্য পঁচাত্তরের পূর্বে ফিরে যায়নি।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় ও বিবরণ, সাক্ষ্য এবং পত্রিকায় প্রকাশিত নানা লেখায় আমরা পনেরোই আগস্টের প্রকৃত ঘটনা জানতে পেরেছি। কিন্তু ওই দিন সকালে বাংলাদেশ বেতার অপারেশনে বিনাবাধায় মেজর ডালিম ও কিসমত কিভাবে বেতার ভবনটি দখল করে নেয়- সেই কাহিনী আজও পর্দার আড়ালে রয়ে গেছে। পর্দার আড়ালে রয়ে গেছে দখলকারী খুনীদের যোগসাজশ দখল ও ওই দিন জানপ্রাণ দিয়ে সহায়তাকারীদের নাম। কেন লেখা হয়নি এই দখল নেয়ার কাহিনী। এখনও বেঁচে আছে খুনীদের বেতার দখল নেয়ার পর নির্যাতনভোগকারী আশরাফুল আলম, প্রমুখ। ইতোমধ্যে মারা গেছেন অপর নির্যাতনভোগকারী ফজল এ খোদা ও শহীদুল ইসলাম। যারা ছিলেন শব্দ সৈনিক ও শহীদুল ইসলাম ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ’ গানটির অমর গীতিকবি।
যা বলছিলাম -বিনা বাধায় খুনী চক্রের মেজর ডালিম, কিসমত বেতারের মূল ফটকের বাইরে জীপ-ট্রাক রেখে স্বদর্পে বেতারের ছোট দরজাটি দিয়ে ঢুকে ফটক সংযুক্ত অভ্যর্থনা কক্ষে বেতার গুরুত্বপূর্ণ সরকারী স্থাপনা বিধায় সাধারণত পুলিশ নিরাপত্তা বিধান করে এবং এই নিরাপত্তা কর্মীরা একটি বড় কক্ষে ভেতরে অবস্থান করে। প্রয়োজনে তারা ফটক পাহারা দেয়। তবে ভারি অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত কোন সামরিক বাহিনীকে বাধা দেয়ার মতো তাদের অস্ত্র ও শক্তি থাকে না। সাধারণত দেখা যায় অনুষ্ঠান প্রচার শেষে গেটরক্ষা ও নিরাপত্তা কর্মী- ওই অভ্যর্থনা কক্ষেই বিশ্রাম নিয়ে রাতটি অতিবাহিত করেন। পনেরোই আগস্ট ঢাকা বেতার কেন্দ্রটির নিরাপত্তা ছিল এমন। ভোর ৪টায় পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক রাইফেল ও স্টেনগানধারী একদল সৈনিক নিয়ে বরখাস্তকৃত মেজর ডালিম পূর্বে আরেকটি অপারেশন শেষ করে গেট পেরিয়ে অনায়াসে ভেতরে প্রবেশ করে এবং মূল গেট খোলার কর্কশ নির্দেশ দিয়ে ডিউটি রুমের সামনে দাঁড়ায়। ডিউটি রুম অনুষ্ঠান প্রচার শেষ হলে বন্ধ রাখা হয়। ওই দিন রুমটির দরজা চাপানো ছিল। মেজর ডালিম ওই সময় সঙ্গী দুজন ক্যাপ্টেনকে নিয়ে পাশের একটি খোলা কক্ষে প্রবেশ করে। কক্ষটি ছিল এক বেতার কর্মকর্তার। অফিস কক্ষ ছুটি হলে সকল কর্মকর্তার কক্ষই বন্ধ করে দেয়া হয়। কিন্তু ওই দিন ঐ কক্ষটি পূর্ব থেকেই দরজা চাপানো অর্থাৎ খোলা রাখা হয়েছিল। কক্ষটিতে আসন নেয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে রুমের আধিকারিক আপেল মাহমুদ ভবনে ঢুকে হাসতে হাসতে মেজর ডালিমকে অভিনন্দন জানায় এবং পূর্বের পরিকল্পনা মোতাবেক বেতার চালু উদ্যোগ নেয়। ইতোমধ্যে আপেল মাহমুদ ফোন করে বেতার চালু অর্থাৎ স্টুডিওর মেশিনপত্র চালনা করার টেকনিশিয়ান ও প্রকৌশলীদের হত্যার ভয় দেখিয়ে বেতার ভবনে নিয়ে আসে।
কিছুক্ষণ পরেই ওয়্যারলেসে মেজর ডালিম বঙ্গবন্ধু এবং অন্যদের নিধনের সংবাদ পায়। এরপর আপেল মাহমুদের মুসাবিধার বঙ্গবন্ধু হত্যার সংবাদটি হাতে নিয়ে বেতার স্টুডিওতে যায় মেজর ডালিম। প্রথম ক’বার খুনী স্বকণ্ঠে ঘোষণাটি প্রচার করে। পরে আপেল মাহমুদের লেখা ওই ঘোষণা রেকর্ড করে বার বার প্রচার করা হয় এবং নির্দেশ জারি করা কার্ফুসহ অন্যান্য ভয়ার্ত সংবাদ।
সকাল ১০টার দিকে পূর্বের আলোচনা মোতাবেক বেতার ভবনে ছুটে আসে মুক্তিযুদ্ধের প্রচণ্ড বিরোধীকারী খান আতা ওরফে খান আতাউর রহমান। তিনি আপেল মাহমুদের রুমে বসে নিজের লেখা দুটি গানের সুর করেন। গান দুটি -মেজর ডালিমের সঙ্গে আলাপ করে আগেই লেখা। গান দুটিতে ফারুক- রশিদ- ডালিমদের সূর্যসন্তান আখ্যায়িত করে লেখা। একটি গানের প্রথম চরণ এ রকম- ওরা সূর্যসন্তান- সূর্যসেনা… ওরা কোন বাধা মানবে না । গান দুটি তড়িঘড়ি করে রেকর্ড করেই বাজানো হয়। তখন বেতারের কিছু কিছু কর্মকর্তা আসা শুরু করেছে। কিছু কর্মচারী ও কর্মকর্তা অতি উৎসাহে মেজর ডালিম নির্দেশ পালনে রত হয়।
ইতোমধ্যে মেজর ডালিমের সঙ্গে আসা সৈন্যরা বেতার ভবনের চতুর্দিকে ঘিরে ফেলে। বেতার ভবনের বাইরে এবং অদূরে দাঁড়িয়ে থাকে মেজর শাহরিয়ারের ট্যাঙ্কবাহিনী। ঢাকার রাস্তায় তখন শুধু খুনীদের গাড়ির অবাধ চলাচল। সেনানিবাস, বেতার আগামসি লেন ও বঙ্গভবনে অবাধ যাতায়াত। এরই মধ্যে ফারুক- রশিদ- খন্দকার মোশতাককে নিয়ে যায় বঙ্গভবনে। বঙ্গবন্ধু হত্যার অন্যতম নির্দেশদাতা ও পরামর্শক জিয়াও রশিদের সঙ্গে বঙ্গভবনে এসে খন্দকার মোশতাককে অভিনন্দন জানায়। মাহবুবুল আলম চাষী, তাহেরউদ্দিন ঠাকুররাও সেখানে আগে থেকে উপস্থিত। সিদ্ধান্ত হয় রাষ্ট্রপতি হিসেবে খন্দকার মোশতাক জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। জুমার নামাজের পর মাথায় পাকিস্তানী টুপি পরে বেতার ভবনে আসে এই ঘৃণিত ব্যক্তিটি। বেতারে তখনও চলছে বঙ্গবন্ধু হত্যার বুলেটিন এবং খুনীদের সূর্যসন্তান আখ্যায়িত করে খান আতার লেখা গান। আপেল মাহমুদের রুমটি তখন মেজর ডালিমের রুমে রূপ নিয়েছে। খানা-পিনা ও পানে বিভোর রুমের অবস্থানকারীরা। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেতারে তাশরিফ আনে খন্দকার মোশতাক। তার সঙ্গে ঠাকুর, চাষী (মাহবুবুল আলম চাষী), (শাহ) মোয়াজ্জেমসহ সাঙ্গপাঙ্গরা।
জাতির উদ্দেশে স্বঘোষিত নতুন রাষ্ট্রপতি ভাষণ দেবে। ভাষণও রেডি। কিন্তু স্টুডিওতে গিয়ে বেঁকে বসে খন্দকার। তিনি শেখ মুজিবকে হত্যার প্রমাণ চান। কথা ও ঘোষণা তিনি বিশ্বাস করেন না। ভাষণ দেয়ার জন্য স্টুডিওতে কালক্ষেপণ করে মোশতাক। বেতার ভবন দখলকারী খুনীরা রীতিমতো হতবাক। তাদের সকল আয়োজন বুঝি ভেস্তে যায়। বেলা আড়াইটার দিকে বেশকটি ছবি নিয়ে স্টুডিওতে ঢোকে মেজর ডালিম। ছবিগুলো বঙ্গবন্ধু ও অন্যদের। বঙ্গবন্ধু ও অন্যরা মৃতুবৎ পড়ে আছে সিঁড়িতে ও মেঝেতে। খন্দকার ছবি দেখে দাড়ি ও টুপিতে হাত বুলিয়ে ধন্যবাদ জানান মেজর ডালিমদের এবং বিসমিল্লাহ বলে ভাষণ শুরু করেন এবং শেষ করেন বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলে। ভাষণের সময় খন্দকার কাঁপছিলেন এবং কণ্ঠ আড়ষ্ট হয়ে আসছিল। খুব অল্প কথার ভাষণ। ভাষণ শেষে দ্রুত তিনি খুনীদের প্রহরায় বঙ্গভবনে আশ্রয় নেন।
এরপর বেতার ভবনে চলে আনুগত্যের পালা। বন্দুকের নলের মাথায় ধরে নিয়ে আসা হয় পুলিশ ও বিডিআরের প্রধানদের। তারাও খুনীদের কর্মকাণ্ড স্বীকার করে মোশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ১৫ আগস্ট রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত চলে খুনীদের যা ইচ্ছে তাই প্রচার, মোশতাকের ভাষণ, মেজর ডালিমের নির্দেশ, আনুগত্য স্বীকারের ঘোষণা ও সূর্যসন্তানদের নিয়ে রচিত গান আতার গান। রাত সাড়ে ১টার পর আবার খানা-পিনা ও পানে মেতে ওঠে মেজর ক্যাপ্টেনরা। মাঝে দু’তিনবার বেতার ভবনে পরিদর্শন করে গেছে অপারেশনের সিপাহসালার কর্নেল ফারুক। না, আপেল মাহমুদ সে রাত বাসায় ফিরে যায়নি। দোস্ত ডালিমের বুকে মাথা রেখেই রাত কাটিয়েছেন। বঙ্গবভন ও বেতার ভবন যতদিন বঙ্গবন্ধুর খুনীরা দখলে রেখেছিল, ততদিন বেতারও দেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ছিল ডালিম-দোস্ত আপেল মাহমুদ।
আমরা বিস্মিত হয়েছি বঙ্গবন্ধু হত্যার মামলার আসামিদের নামের তালিকা দেখে বেতার অপারেশনে যারা বা যিনি পূর্ব থেকেই ডালিমের সঙ্গে সরাসরি জড়িত এবং গান রচনা করে দেশের শোকাহত মানুষকে ব্যথা দিয়েছে, তাদের মামলায় আসামি করা হয়নি। বঙ্গবন্ধু পরিষদ থেকে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটি পুস্তিকায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও খান আতার নাম উল্লেখ করেছেন। তাহলে আপেল মাহমুদ ও খান আতার দায়মুক্তি কেন? আর ওই সময় মুজিবভক্তরা বেতারে চাকরি করে খুনীদের অত্যাচার নির্যাতন ভোগ করেছিল, তাদের কথা কী দেশবাসী জানতে পেরেছে?
বাংলাদেশ বেতার একটি রাষ্ট্রীয় প্রচার যন্ত্র। এই যন্ত্রটি দখল করে খুনীরা কত মিথ্যে ভাষণ ও কথা প্রচার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। কিন্তু খুনীদের শেষ রক্ষা হয়নি। কারও ইতোমধ্যে ফাঁসি হয়েছে। পনেরো আগস্ট ফিরে এলেই সেই বিভীষিকাময় সময়ের কথা আমাদের মনে পড়ে। মনে পড়ে খুনী ডালিমগংয়ের কথা। মনে পড়ে ওই দিন আপেল মাহমুদ এবং বেঁচে আসা কিছু বেতার কর্মীর কথা। তারা ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বেতারে দাপটের সঙ্গে চাকরি করেছে। ইতিহাস কত নির্মম? আজ তারা চিরতরে হারিয়ে গেছে।
লেখক :
খালেক বিন জয়েনউদদীন, বাংলাদেশ বেতারের সাবেক স্ক্রিপ্ট রাইটার, সহসম্পাদক বেতার বাংলা
*প্রকাশিত লেখার মতামত ও বানানরীতি লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাঙালীয়ানার সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই প্রকাশিত লেখা বা লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা সংক্রান্ত আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় বাঙালীয়ানার নেই। – সম্পাদক