১৯৭১: অপারেশন ডেসটিনেশন আননোন

Comments

২৫ আগষ্টের অপারেশনে কাজী কামালউদ্দিন (কাজি),  বদিউল আলম (বদি), আবদুল হালিম (জুয়েল), শাফী ইমাম (রুমী), কামরুল হক (স্বপন) ও হাবিবুল আলম (আলম)কে নিয়ে দল গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু জুয়েল সিদ্ধিরগঞ্জ অপারেশনে আঙুলে গুলির আঘাত পাওয়ায় এ অভিযানে অংশ নেননি।

২৫ আগস্ট বিকেলে ধানমন্ডি ৪ নম্বর রোডে আলম ও বদি হাইজ্যাক করার জন্যে সাদা রঙের একটি মাজদা গাড়ি থামালেন। সাদা রংয়ের গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে খুবই ফর্সা এক লোক, পাশে বসা অল্প বয়সি একটি ছেলে। দেখে প্রথমে বিহারি বলে মনে হয়েছিল ওদের। এগিয়ে জানালার কাছে গিয়ে হাতের অস্ত্রটা বের করে বদি ঠাণ্ডা মাথায় বললেন, “আপনি কি অবাঙালী?” উত্তর এল, “আমি বাঙালী”। বদি বললেন, “আমরা মুক্তিযোদ্ধা। আপনার গাড়িটি দরকার। আপনি নামুন, না হলে আপনার ছেলেকে মেরে ফেলা হবে। আমরা অপারেশনে যাব। আর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে আপনি থানায় খবর দেবেন যে, আপনার গাড়ি ছিনতাই হয়েছে। এর আগে খবর দিলে পরিণাম খারাপ হবে।”

গাড়ি চালক সম্মতি দিলেন। ভদ্রলোক ছেলেকে নিয়ে রিক্সায় উঠে চলে গেলেন। গেরিলারা গাড়ি নিয়ে কিছুদূর আসার পর ড্যাস বোর্ড খুলে দেখলেন লাইসেন্সে মালিকের নাম লেখা “মাহবুব আনাম”। ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি পাকিস্তানের কর্মকর্তা। তখন তারা বুঝলেন হাইজ্যাক করা গাড়িটা তাদের পরিচিত মাহফুজ আনামের (ডেইলি ষ্টারের সম্পাদক, মুক্তিযোদ্ধা) বড় ভাইয়ের।

২৫ আগস্ট, ১৯৭১ সন্ধ্যায় সেই হাইজ্যাক করা মাজদা গাড়িটার স্টিয়ারিং ধরে বসলেন হাবিবুল আলম। এসএমজি হাতে বদি বসলেন ঠিক তার পাশে। আলমের ঠিক পেছনে স্বপন। বাঁ দিকে কাজী কামালউদ্দিন, আর মাঝখানে রুমি। গেরিলাদল রওয়ানা হলো, “টার্গেট মোবাইল, অপারেশন ডেস্টিনেশন আননোন”।

ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের কালভার্ট পেরিয়ে পশ্চিম দিকে আবাহনী মাঠ ছাড়িয়ে উপস্থিত হলো ২০ নম্বর রোডে চীনা ডিপ্লোম্যাটের বাড়ির সামনে। কিন্তু কোন পাকিস্তানী সেন্ট্রি পাওয়া গেল না সেখানে। আলম গাড়ি ঘুরিয়ে চলে এলেন ১৮ নম্বর রোডে এক পাকিস্তানী ব্রিগেডিয়ারের বাড়ির সামনে। যেখানে পাওয়া গেল আয়েশি ভঙ্গীতে ডিউটিরত ৭-৮ জন পাকিস্তানী সেনাকে। চাপা গলায় আলম বললেন, “ওকে, দেয়ার ইউ গো। জানোয়ারগুলো আমাদের নলের রেঞ্জে, ওদের জাহান্নামে পাঠানোর জন্য তোমাদের হাতে সময় আছে মাত্র তিন মিনিট। গাড়ি চালিয়ে সাত মসজিদ রোড দিয়ে ঘুরে আসবো, আসবার পথে ওরা পড়বে হাতের বাঁ দিকে। আমি কমান্ড দেবার সঙ্গে সঙ্গে বদি আর কাজি জানালা দিয়ে টানা ব্রাশ-ফায়ার করবে। স্বপন আর রুমী নজর রাখবে রাস্তার দিকে, পুরো সময়টা। এভ্রিওয়ান আন্ডারস্ট্যান্ড?” সবাই মাথা ঝাঁকালেন।

৭টা ২৫ মিনিট, নিঃশব্দে চকচকে মাজদাটা মৃত্যুদূত হয়ে এসে দাঁড়াল বাড়ির গেটের সামনে, নিচু গলায় আলমের অর্ডার এলো, “ফায়ার”। শত্রুর বুক বরাবর বদি আর পেট বরাবর কামালের স্টেন দুটো গর্জে ওঠল। ঝাঁজরা হয়ে লুটিয়ে পড়ল আট পাকিস্তানী পিশাচ। এক্সেলেটর দাবিয়ে সাঁই করে ১৮ নম্বর থেকে বেরিয়ে গেল মাজদা।

পেছনের সিটে ক্ষুব্ধ রুমী আর স্বপন। ক্ষোভের সাথে একজন বললেন “ধুর মিয়া, খালি তোমরাই পাকিস্তানী মারবা, আর আমরা বইসা বইসা মজা দেখুম?”

হাবিবুল আলম হাসতে হাসতে বললেন, “ঠিক আছে, তাহলে আবার ২০ নম্বরে যাই চলো। দেখা যাক, এইবার তোমাদের শুটিং প্র্যাকটিসের সুযোগ দিতে পারি কিনা!” কিন্তু দুর্ভাগ্য পাকিস্তানী সেন্ট্রিগুলো তখনো ফেরেনি।

কী আর করা, ৭ নম্বর রোড ধরে মিরপুর রোডে এসে উঠে এলো মাজদা। নিউ মার্কেটে যাবার পথ ধরে এগুতে গিয়ে পাঁচ নম্বরের কাছে এসে হঠাৎ প্রমাদ গুনলেন আলম।

১৮ নম্বরের অপারেশনের খবর পৌঁছে গেছে। দুটি আর্মি ট্রাক আড়াআড়ি রেখে ব্যারিকেড দিয়ে বিশাল চেকপোস্ট বসিয়ে ফেলেছে পাকিস্তানীরা। প্রতিটি গাড়িতে চলছে জোর তল্লাশি। সামনে পেছনে গাড়ির সারি, গাড়ি ঘুরিয়ে পালাবার কোনও উপায় নেই। হয় এই পাহাড়-প্রমাণ চেক পোস্ট উড়িয়ে চলে যেতে হবে, নাহলে ধরা পড়া নিশ্চিত। স্বপন আর বদি বললেন, “অবস্থা তো ভালো ঠেকে না রে। বেরোতে পারবা?”

আলম স্বপনকে ইশারায় দেখিয়ে বললেন, “কর্নারে এলএমজি তাক করে শুয়ে থাকা সেনাটাকে যদি ফেলতে পারো, তাহলে আমি ওদিক দিয়ে বের হয়ে যেতে পারবো। পারবা?” স্বপন খালি গম্ভীর গলায় বললেন, “রেঞ্জের মধ্যে আসতে দাও।” হঠাৎ রুমি বললেন, “আর এদিকে বাম পাশে পাঁচ নম্বর রোডের মাথায় যে তিনজন অটোমেটিক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার কী হবে?” আলম বললেন, “দেখেছি, ওটা সামলানোর দায়িত্ব বদি আর কাজীর। তারা যদি না পারে, তাহলে বাঁচার কোন সম্ভাবনা নাই।”

মাজদাটা ব্যারিকেডের কাছে এলে আলম বললেন, “আমি স্রেফ একবার ‘ফায়ার’ কমান্ড দেবো, এন্ড উই গটা হিট অ্যাট দ্যা সেম টাইম… একসঙ্গে… এনিওয়ান ফেইলস টু রেসপন্ড টাইমলি, উই লুজ ইন দ্যাট ভেরি মোমেন্ট।” বলতে বলতে আলম লাইন ভেঙ্গে আস্তে আস্তে ডান দিক বরাবর এগোতে শুরু করলেন। তল্লাশি চালানো পাকিস্তানী সেনা দুজন চিৎকার করে উঠলো, ‘কিধার যাতা হারামজাদে, রোক্কো!” ডানে মোড় নেবার ইনডিকেটর লাইট জ্বলা কয়েকটি বিভ্রান্ত মুহূর্তই যথেষ্ট ছিল গেরিলাদের জন্য। পলকের ভেতর হতচকিত পাকিস্তানী সেনাদের বিস্মিত চেহারার সামনে বাম দিকে শার্প টার্নে পাঁচ নম্বর রোডের দিকে সজোরে মাজদাটা ঘুরিয়ে নিলেন আলম। তার গলার রগ ফুড়ে বেরিয়ে এলো চিৎকার, “ফায়ার! ফায়ার!!”

অকুতোভয় কয়েক তরুণ সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত হয়ে হাজির হলো পাকিস্তানীদের সামনে। গাড়ির ভেতর একের পর এক পড়তে লাগলো সদ্য শেষ হওয়া কার্টিজ আর শেল, কেঁপে উঠলো পুরো এলাকা। তিনটা জানালা দিয়ে শিকারি বাজের ক্ষিপ্রতায় ওরা ষ্টেনগান গুলো ঘোরাতে লাগলো এদিক থেকে ওদিক।

গাড়ির বাঁ পাশে রাস্তায় শুয়ে থাকা মিলিটারি পুলিশটা চাকার তলে পিষে যেতে যেতে বেঁচে গেল অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় গড়িয়ে, কিন্তু জানালা দিয়ে স্টেনটা নিয়ে ঝুঁকে পড়ে ওকে খুঁজে বের করে কাজী কামালের নির্ভুল ব্রাশ-ফায়ার থেকে সে বাঁচতে পারলো না।

ব্যারিকেডটা স্রেফ উড়ে গেল, পড়ে রইল কেবল পৃথিবীর তথাকথিত পঞ্চম শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনীর ‘বীর পালোয়ান’দের ঝাঁজরা দেহ। বাঁচতে পারলো না স্তব্ধ হতচকিত একটা পাকিস্তানী সেনাও। ৮-১০ সেকেন্ডের এ আক্রমণে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মারা পড়লো তারা, স্তব্ধ হয়ে গেল সেই চেকপোস্ট।

মাছি গলতে না পারার মত কড়া ব্যারিকেড ভেঙে বেরিয়ে এলো দুর্ধর্ষ গেরিলারা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে। ততক্ষণে গাড়ি চলে এসেছে পাঁচ নম্বর রোডে। আলম পেছনে পাকিস্তানীদের বিভ্রান্ত করতে বাম দিকে ইনডিকেটর লাইট জ্বালিয়ে দিলেন, যেন মনে হয় তারা আবার ইউটার্ন নিয়ে গ্রিন রোড ফিরবে।

ঠিক যে মুহূর্তে গাড়িটা টার্ন করাবেন আলম, হঠাৎ পেছনে সতর্ক দৃষ্টি রাখা রুমি চিৎকার করে উঠলেন, “লুক আউট! দেয়ার ইজ অ্যা জিপ। দ্যা বাস্টার্ডস আর ট্রায়িং টু ফলো আস!”

আর কিছু বলতে হলো না। আর কারোর কমান্ডের অপেক্ষায় থাকলো না রুমী, উনিশ বছরের অকুতোভয় গেরিলা। মুহূর্তের মধ্যে স্টেনটা তুলে নিয়ে পেছনের কুঁদো দিয়ে পেছনের উইন্ডশিল্ডটা ভেঙ্গে ফেললো, তারপর জানালা দিয়ে গুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করলো অসম্ভব ক্ষিপ্রতায়। সঙ্গে সঙ্গে দুপাশে যোগ দিল কাজী আর স্বপন। আলম ব্যাক ভিউ মিররে দেখলেন ওদের মুহুর্মুহু ব্রাশে জীপটা দিশা হারিয়ে আছড়ে পড়ল পাশের ল্যাম্পপোস্টে। মারা পড়লো সবগুলো। ড্রাইভারের লাশটা জানালা দিয়ে আধহাত বেরিয়ে ঝুলতে লাগলো পাকিস্তানীদের বীরত্বগাথার প্রতীক হয়ে…।

ততক্ষণে আলম মাজদা শার্প টার্ন নিয়ে ঘুরিয়ে ফেলেছেন নিউমার্কেটের দিকে।

মাত্র বেঁচে ফিরেছেন কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই গেরিলাদের। গরম কার্তুজে ফোস্কা পড়ে যাবার দশা প্রায় প্রত্যেকের শরীরে, অথচ হাঁটুতে ব্রেন নিয়ে চলা পাকিস্তানীদের বোকামীতে প্রাণ খুলে হাসলেন পাঁচ দুদর্মনীয় বঙ্গশার্দুল। “পাকিস্তানী শালারা আর মানুষ হইল না, এতো বোকাও মানুষ হয়!” কে একজন বলে উঠলেন পেছনের সিট থেকে।

রুমি আর কাজী কামালকে গাউছিয়ার মোড়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েই আলম বললেন, “এখুনি গিয়ে আম্মাকে (শহীদ জননী জাহানারা ইমাম) বল তোর বাসার উল্টো দিকের গলিতে আসতে। এই আর্মসগুলো রাখতে হবে”। এলিফ্যান্ট রোড থেকে সরু রাস্তা দিয়ে সেই গলিতে চলে এল মাজদা। গাড়ি নিয়ে অপেক্ষারত জাহানারা ইমামের গাড়িতে অস্ত্রগুলো উঠিয়ে দিয়ে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে মাজদা নিয়ে ভূতের গলিতে একটি বাড়ির সামনে গাড়িটি ফেলে চুপচাপ হেঁটে চলে গেলেন আলম আর স্বপন। কে বলবে একটু আগে এঁরা পুরো শহরটা কাঁপিয়ে দিয়ে এসেছে?

তথ্যসূত্র: গেরিলা ১৯৭১ ও হাবিবুল আলম বীর প্রতীক এর সাক্ষাৎকার
ফিচার ফটোটিতে সেক্টর ২ এর উপ-প্রধান ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দারের সাথে হাবিবুল আলমসহ কয়েকজন গেরিলা।

বাঙালীয়ানা/এসএল

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.