ফার্মগেট, ঢাকার কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল, অদূরেই ক্যান্টনমেন্ট। ২৫শে মার্চের রাতে পাকিস্তানী হিংস্র পশুদের অমানবিক, নির্দয়, পাশবিক হত্যাযজ্ঞের পর ফার্মগেটে একটি চেকপোস্ট স্থাপন করেছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। সে সময় নির্মাণাধীন আনন্দ সিনেমা হলের উপরে ছিল মেশিনগান। তার থেকে সোজা বরাবর সামনে ট্রাফিক আইল্যান্ডে তাঁবু খাটানো ফার্মগেটের চেকপোস্ট। ভেতরে বাইরে ভারি ও হাল্কা অস্ত্র হাতে সজ্জিত পাকি মিলিটারি ও স্বদেশী বেঈমান রাজাকারদের দল।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ৭ আগস্ট অপারেশনের দিন নির্ধারণ করা হয়েছিল আবদুস সামাদের ইস্কাটনের বাসায় বসে। সারাদিনব্যাপী রেকি করলেন হাবিবুল আলম, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, এবং বদিউল আলম। সবকিছু পরিকল্পনামাফিক হলেও, সন্ধ্যার দিকে মিলিটারি পুলিশের টহল বেড়ে গেল। এমন অবস্থায় অভিযান অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ মনে হল। তাই আক্রমণের দিন পিছিয়ে ৮ আগস্ট পুনঃনির্ধারণ করা হল।
৮ আগস্ট, ১৯৭১, রাত ৮ টা বেজে ৭ কিম্বা ১০ মিনিট। ১৯৬৫ সাল মডেলের একটি ‘মেটালিক গ্রিন’ টয়োটা সেডান গাড়িতে করে অভিযানে বের হলেন বদিউল আলম বদি, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, হাবিবুল আলম, পুলু , কামরুল হক স্বপন আর গাড়িটির মালিক আবদুস সামাদ।

ফার্মগেটের এই ছবির ডান পাশে উত্তরা ব্যাংক ভবনের পাশে গেরিলাদের অবস্থান ছিল এবং ছবির মধ্য অংশে (যেখানে সিঁড়ির পাশে গাছ রয়েছে) সেখানে পাকিস্তানী ক্যাম্প ছিল
ইস্কাটন থেকে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে তৎকালীন পাক মোটরে (বর্তমান বাংলা মোটর) ডানে মোড় নিয়ে ধীরগতিতে এগুতে থাকলেন দুর্ধর্ষ গেরিলারা। এসময় বর্তমান সোনারগাঁও হোটেলের কাছে ‘দারুল কাবাব’ রেস্তোরাঁর সামনে দুটি জীপ গাড়িতে পাকিস্তানী সেনাদের দেখা গেল জীপে বসে পা ছড়িয়ে কাবাব খাচ্ছে। রাস্তাটি সেসময় ময়মনসিংহ রোড ( বর্তমান কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ) নামে পরিচিত ছিল।
গেরিলারা গাড়িতে করে তেজকুনিপাড়ার বেশ কিছু রাস্তা ঘুরে হলিক্রস স্কুল পেরিয়ে ফার্মগেটের মুখে থামলো। ড্রাইভিং করছিলেন সামাদ, পাশে মায়া, পেছনে বদি, আলম, পুলু, আর স্বপন। অমিততেজী গেরিলারা বদিউল আলমকে অনুসরণ করে ক্ষিপ্র গতিতে গাড়ি থেকে নেমে এলেন। চোখের পলকে অবস্থান নিতেই গর্জে উঠলো পাঁচটি স্টেনগান ও এলএমজি।
মাত্র সোয়া মিনিট স্থায়ী এ অভিযানে গেরিলাদের ব্রাশফায়ারে মুহূর্তেই ৫ পাকিস্তানী জল্লাদ আর সাথে ৬ দেশীয় বেঈমান রাজাকার কাটা কলাগাছের মতই মাটিতে পড়ে গেল। প্রত্যক্ষদর্শী পরে জানিয়েছিল, অভিযান শেষেই পাকিস্তানী সেনারা ট্রাকে করে ছুটে এসে বালতি বালতি পানি ঢেলে রক্ত পরিষ্কারের চেষ্টা করেছিল।
এই গেরিলা অপারেশন বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল পুরো ঢাকায়। নতুন উদ্যম যোগ হয়েছিল গোটা দেশের মুক্তিকামী জনমানুষের মনে। খোদ ক্যান্টনমেন্টের এত কাছে এমন দুর্ধর্ষ গেরিলা অভিযান খোদ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কাছেই ছিল অবিশ্বাস্য। পরদিন ঢাকা শহরব্যাপী পাকিপশুদের চোখেমুখে আতঙ্ক ছিল স্পষ্ট। ফার্মগেট ছিল জনশুন্য।
ছবি ও তথ্যসূত্র: গেরিলা ১৯৭১
ফিচার ফটো: জালালুদ্দিন হায়দারের তোল্লা ফার্মগেট অপারেশন এলাকার ছবি ১৯৮৭ সালে তোলা।
বাঙালীয়ানা/এসএল