১ মার্চ, ১৯৭১

Comments

একাত্তরের ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দেন। এই ঘোষণাটি যখন রেডিওতে প্রচার করা হল, তখন ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের সঙ্গে কমনওয়েলথ একাদশের ক্রিকেট খেলা চলছিল। মুহূর্তেই জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ঢাকা স্টেডিয়াম হয়ে ওঠে এক যুদ্ধক্ষেত্র। বন্ধ হয়ে যায় স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, দোকান-পাট সবকিছু। রাস্তায় নেমে আসে লক্ষ লক্ষ মুক্তিকামী মানুষ। পুরো শহর পরিণত হয় এক মিছিলের নগরীতে। মিছিলে মানুষের কন্ঠে স্লোগান: ‘জয় বাংলা’, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’

১ মার্চ ১৯৭১ এ কি ঘটেছিল

  • প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আকস্মিক এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের একটি প্রধান দল পিপলস পার্টি এবং অন্য কয়েকটি দল ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার ইচ্ছা প্রকাশ করায় এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
  • বেতারে প্রেসিডেন্টের জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণার বিবৃতি প্রচারের সাথে সাথে রাজধানী ঢাকা প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর ক্ষুব্ধ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে শহরের সকল দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়।
  • ঢাকা স্টেডিয়ামে বিসিসিপি ও আন্তর্জাতিক একাদশের মধ্যে অনুষ্ঠানরত ক্রিকেট ম্যাচ ভণ্ডুল হয়ে যায়। দর্শকরা স্টেডিয়াম থেকে বের হয়ে মিছিলে শরীক হন। মিছিলগুলো আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে নির্দেশ লাভের জন্য মতিঝিলস্থ হোটেল পূর্বাণীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
  • অধিবেশন স্থগিতের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ঢাকার বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকা বিমানবন্দর এবং পি. আই. এর মতিঝিল অফিসের কর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অফিস ছেড়ে চলে যান। ফলে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে প্রদেশের বিভিন্ন রুটে এবং আন্তঃদেশীয় রুটে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
  • বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ পৃথক বিবৃতিতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে প্রেসিডেন্টের ঘোষণাকে জনগণের সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর নস্যাৎ করার উদ্যোগ বলে অভিহিত করেন।
  • পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক শেষে হোটেল পূর্বাণীতে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট কর্তৃক জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার কঠোর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, বাংলার জনগণ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এই সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তিনি এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সর্বাত্মক আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে ২ মার্চ ঢাকা শহরে ও ৩ মার্চ সারা বাংলায় হরতাল পালন এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠানের কথা ঘোষণা করেন। ৭ মার্চের জনসভায় বঙ্গবন্ধু সর্বাত্মক আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ কর্মপন্থা ঘোষণা করবেন বলে জানান। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি অবিলম্বে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করবেন।
  • রাতে বঙ্গবন্ধু তাঁর ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাসভবনে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার সাথে আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন। সন্ধ্যার পর তিনি সন্তোষে মাওলানা ভাসানীর সাথে আলোচনার জন্য তাঁর প্রতিনিধি প্রেরণ করেন।
  • পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রধান আবদুল কাইয়ুম খান প্রেসিডেন্টের ঘোষণাকে ‘একমাত্র সঠিক সিদ্ধান্ত’ হিসেবে অভিহিত করে স্বাগত জানালে এর প্রতিবাদে মহাসচিব খান এ. সবুর দলের সদস্যপদ ও সম্পাদকের পদ ত্যাগের কথা ঘোষণা করেন।
  • রাতে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল এ. এম. ইয়াহিয়া খান ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক শাসনকর্তা লে. জেনারেল সাহেবজাদা এম. এয়াকুব খানকে প্রদেশের বেসামরিক শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। এর আগে গভর্ণর ভাইস এডমিরাল সৈয়দ মোহাম্মদ আহসানকে স্বপদ থেকে অপসারণ করা হয়।
  • গভীর রাতে ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক প্রশাসক এক নতুন আদেশ জারী করে সংবাদপত্রে দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কোনো খবর বা ছবি প্রকাশ না করার নির্দেশ দেন।
  • পিপলস পার্টি ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদ অধিবেশন অনুষ্ঠানের প্রতিবাদে ২ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানে যে সাধারণ ধর্মঘট পালনের আহবান জানিয়েছিল, প্রেসিডেন্টের ঘোষণার প্রেক্ষিতে সন্ধ্যায় তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।

বাঙালীয়ানা/এসএল

উত্তাল মার্চের আর সব দিনগুলো:
পড়ুন –

১ মার্চ ১৯৭১ ২ মার্চ ১৯৭১ ৩ মার্চ ১৯৭১ ৪ মার্চ, ১৯৭১ ৫ মার্চ, ১৯৭১
৬ মার্চ, ১৯৭১ ৭ মার্চ, ১৯৭১ ৮ মার্চ, ১৯৭১ ৯ মার্চ, ১৯৭১ ১০ মার্চ, ১৯৭১
১১ মার্চ, ১৯৭১ ১২ মার্চ, ১৯৭১ ১৩ মার্চ, ১৯৭১ ১৪ মার্চ, ১৯৭১ ১৫ মার্চ, ১৯৭১
১৬ মার্চ, ১৯৭১ ১৭ মার্চ, ১৯৭১ ১৮ মার্চ, ১৯৭১ ১৯ মার্চ, ১৯৭১ ২০ মার্চ, ১৯৭১
২১ মার্চ, ১৯৭১ ২২ মার্চ, ১৯৭১ ২৩ মার্চ, ১৯৭১ ২৪ মার্চ, ১৯৭১ ২৫ মার্চ, ১৯৭১
২৬ মার্চ, ১৯৭১ ২৭ মার্চ, ১৯৭১ ২৮ মার্চ, ১৯৭১ ২৯ মার্চ, ১৯৭১ ৩০ মার্চ, ১৯৭১
৩১ মার্চ, ১৯৭১

মন্তব্য করুন (Comments)

comments

Share.