২৪ মার্চ ১৯৭১ এ কি ঘটেছিল
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শেখ মুজিবের বাসভবনে সমাগত বিভিন্ন মিছিলকারীদের উদ্দেশে শেখ মুজিবর রহমান বলেন, ‘কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া চলবে না। কোনো রক্ত চক্ষু শ্য করা হবে না। আমি যদি আপনাদের নির্দেশ দিতে না পারি তবে আপনারা আরও দৃঢ়তার সাথে ৭ কোটি বাঙালীর মুক্তির জন্যে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন’।
সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগ ও সরকারী উপদেষ্টা পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ ও কামাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন। এ বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষ হতে ফেডারেশনের পরিবর্তে ‘কনফেডারেশন’ নামটি প্রস্তাব করা হয়। সরকারী দল এর প্রতিবাদ করে বলে, এটা আওয়ামীদলের নীতিগত মৌলিক পরিবর্তন। আওয়ামীদল নিজ অবস্থান সমর্থনে বলে, অন্য সব কিছু অপরিবর্তিত থাকলে নামের পরিবর্তন কোন মৌলিক পরিবর্তন নয়। এসময় সরকারী আইন বিশেষজ্ঞ কর্নেলিয়াস ‘কনফেডারেশন’ এর স্থলে ‘ইউনিয়ন’ শব্দটি প্রস্তাব করেন। আওয়ামী লীগ বলে, এ বিষয়ে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হোক মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকে। বৈঠকে দুপক্ষ খসড়া সংবিধানের সব অনুচ্ছেদ ও তফসিলের উপর দফাওয়ারী আলোচনা শেষ করেন। দু’ঘন্টা স্থায়ী বৈঠক শেষে তাজউদ্দিন আহমেদ উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আমাদের বক্তব্য আমরা উপস্থাপন করেছি। আলোচনা অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আর আলোচনার প্রয়োজন নেই।
এদিন শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে খান আব্দুল ওয়ালী খান বৈঠক করেন।
এদিনেও ভুট্টো-ইয়াহিয়া বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষ ভুট্টো বলেন, ‘we are making some progress’।
২৩ মার্চ রাত হতে ২৪ মার্চ সকাল পর্যন্ত পাকসেনাবাহিনী সৈয়দপুর সেনানিবাসের পার্শ্ববর্তী বোতলাগাড়ী, গোলাহাট ও কুন্দুল গ্রাম ঘেরাও করে অবাঙালীদের সাথে নিয়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। এতে শতাধিক নিহত হয় এবং অসংখ্য মানুষ আহত হয়। শহরে কারফিউ দিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্য এবং অবাঙালীরা সম্মিলিতভাবে বাঙালীর বাড়িঘরে আগুন দেয় এবং হত্যা অভিযান চালায়।
রংপুর হাসপাতালের সামনে ক্ষুব্ধ জনতা ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে পাকসেনারা রংপুর সেনানিবাস সংলগ্ন এলাকায় নিরস্ত্র অধিবাসীদের ওপর বেপরোয়াভাবে গুলিবর্ষণ করে। এখানেও অর্ধশতাধিক নিহত এবং বহু আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
মিরপুরে অবাঙালীরা সাদাপোশাকধারী পাকসেনাবাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতায় বাঙালীদের বাড়িঘরের শীর্ষে ওড়ানো বাংলাদেশের পতাকা এবং কালো পতাকা নামিয়ে জোর করে তাতে আগুন দেয় এবং পাকিস্তানি পতাকা তোলে। রাতে বিহারীরা এখানে ব্যাপক বোমাবাজি করে আতঙ্কের সৃষ্টি করে।
চট্টগ্রামে পাক সেনারা নৌ-বন্দরের ১৭ নং জেটিতে নোঙর করা এম.ভি.সোয়াত জাহাজ থেকে সমরাস্ত্র খালাস করতে গেলে প্রায় ৫০ হাজার বীর বাঙালী তাদের ঘিরে ফেলে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা জাহাজ থেকে কিছু অস্ত্র নিজেরাই খালাস করে ১২ টি ট্রাকে করে নিয়ে যাবার সময় জনতা পথ রোধ করে। সেনাবাহিনীর ব্যারিকেড রচনাকারী জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালালে অসংখ্য শ্রমিক শহীদ হন।
টিভি কেন্দ্রে প্রহরারত সৈন্যরা টিভি কর্মীদের সাথে দুর্ব্যবহার করলে সন্ধ্যা থেকে ঢাকা টিভির কর্মীরা টিভির সব ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার থেকে বিরত থাকেন।
এদিন মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী কুমিল্লা ও যশোর সেনানিবাস সফর করে এবং ব্রিগেড কমান্ডারদের সাথে বৈঠক করেন।
চট্টগ্রাম সেনানিবাসের বাঙালী ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদারকে ঢাকায় বদলি করে সেখানে ব্রিগেডিয়ার আনসারীকে নিযুক্ত করে।
স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র গণবিপ্লবকে আরো জোরদার করার জন্য সংগ্রামী বাংলার জনগণের প্রতি আহ্বান জানান।
সাংবাদিকরা এক জরুরি সভায় মিলিত হয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সেনাবাহিনীর সদস্যদের হয়রানিমূলক আচরণের তীব্র নিন্দা জানান।
বাঙালীয়ানা/এসএল