২৬ মার্চ ১৯৭১ এ কি ঘটেছিল
রাত ১২টার দিকে বাঙালী পুলিশ সদস্যদের মরণপণ প্রতিরোধে থমকে যায় ট্যাংক ও কামান সজ্জিত প্রায় আটশত সদস্যের পাকবাহিনী। একটু পরে মর্টার ও হেভি মেশিনগান দিয়ে গুলিবর্ষণ শুরু করে। বাঁশের বেড়ার তৈরী ৪টি ব্যারাকে আগুন ধরে যায়। পাক বাহিনী ট্যাংক বহরসহ প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রবেশ করে।
সাড়ে ১২টার দিকে পাকবাহিনীর ভারী অস্ত্রের মুখে বাঙালী পুলিশ সদস্যরা তাদের কৌশল পরিবর্তন করে। গেরিলা পদ্ধতিতে পাকবাহিনীর ওপর হামলা চালায় এবং অনেককে হতাহত করে।
২৫ মার্চ পাকবাহিনীর হামলার সাথে সাথেই শেখ মুজিব অনুধাবন করলেন মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার জন্য একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণার প্রয়োজনীয়তা। তাই মধ্যরাতের পর তিনি ইংরেজিতে স্বাধীনতা ঘোষণা তৈরি করে ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। ঘোষণাটি নিচে উদ্ধৃত করা হল।
‘This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with what ever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.’
রাত ১টায় পাকবাহিনীর একটি দল শেখ মুজিবের বাসভবনের অদূরে শুক্রাবাদে ব্যারিকেডের মুখোমুখি হয়। এখানে প্রতিরোধ ব্যুহ ভেঙে হানাদাররা রাত দেড়টায় তাঁর বাসভবনে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।
শেখ মুজিবকে রাত দেড়টায় তাঁর বাসভবন থেকে বন্দী করে প্রথমে শেরেবাংলা নগরস্থ সামরিক বাহিনীর সদর দফতর এবং পরে সেনানিবাসে নিয়ে সকাল পর্যন্ত আদমজী কলেজের একটি কক্ষে আটক রাখা হয়।
সকালে আদমজী কলেজ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে সেনানিবাসের ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউজে (বর্তমানে সেনা প্রধানের বাসভবন যেখানে) নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাঁকে সন্ধ্যায় অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।

পথে পথে এখানে ওখানে লাশের স্তূপ।
রাজারবাগ পুলিশ লাইনে ২৫ মার্চ রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে শুরু হওয়া যুদ্ধ থেমে থেমে চলতে থাকে রাত ৩টে সাড়ে ৩টে পর্যন্ত। বাঙালী পুলিশের কিছু সদস্য বুকে অসীম সাহস নিয়ে সমান তালে লড়ে চলে ট্যাংক, কামান আর মর্টারের বিরুদ্ধে। অপর একটি গ্রুপ অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ মালিবাগ-চামেলীবাগ প্রান্ত দিয়ে ঢাকা শহরে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। (রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সেদিনকার সেই অস্ত্র আর গোলাবারুদ ব্যবহৃত হয়েছে সারাদেশে, সীমান্তবর্তী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবিরে এবং সন্মুখ সমরে।)
২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের পাকসৈন্যরা রাতে পিলখানায় ইপিআর-এর উপরে যে হামলা শুরু করে বাঙালী সৈন্যরা সেই প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যায় সারা রাত। শত শত বাঙালী সৈন্য নিহত হয়। একজন পাকিস্তানী অফিসারসহ বহু পাকিস্তানী সৈন্যও নিহত হয়। যুদ্ধ এতটা প্রচণ্ড ছিল যে, ২৬ মার্চ অপরাহ্নে ট্যাংক বাহিনীকে পাকিস্তানী সৈন্যদের সাহায্যার্থে পিলখানায় আসতে হয়। পিলখানা ৩ নম্বর গেটের কাছে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। ইপিআর সদস্যরা অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে অসম যুদ্ধে টিকতে না পেরে তারা বুড়িগঙ্গা অতিক্রম করে জিঞ্জিরায় অবস্থান গ্রহণ করে। ইপিআর সদস্যদের একটি অংশ বাস নিয়ে চলে যায় মিরপুরের দিকে। সেখানে তারা পাকিস্তানী ও অবাঙালীদের মোকাবেলা করে এবং হরিরামপুর ও সাভার হয়ে আরিচার দিকে সরে যায়। অনেক বাঙালী ইপিআরকে বন্দি করা হয়।
পাক হানাদার বাহিনী ঢাকায় দিনরাত কারফিউ দিয়ে ভবন, বস্তি, বাজারের উপর ভারি মেশিনগান ও কামানের গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। এলাকার পর এলাকা আগুন লাগিয়ে ভয়ার্ত নর-নারী-শিশুকে অগ্নিদগ্ধ ও গুলি করে হত্যা করে।
২৫ তারিখ রাত থেকে ২৬ তারিখ ভোর পর্যন্ত ট্যাংক, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, রকেট নিক্ষেপক, ভারি মর্টার, হালকা মেশিনগানসহ নানা ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-শিক্ষক-কর্মীদের হত্যার এক উন্মত্ততা চালানো হয়। মূলত গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়।
এরপর বেশির ভাগ লাশ বিভিন্ন হল সংলগ্ন মাঠে মাটিচাপা দিয়ে তার ওপর বুলডোজার চালিয়ে মাটি সমান করে দেওয়া হয়। জীবিত কর্মচারীদের দিয়ে লাশ টেনে এনে গর্তে ফেলতে বাধ্য করে এবং তাদেরও লাশের স্তূপের পাশে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। অনেক লাশ উন্মুক্ত স্থানে ফেলে রাখে হানাদার বাহিনী। ওই রাতে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিক কতজন মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা আজও হয়নি। যাদের পরিচয় পাওয়া গেছে বিশ্ববিদ্যালয় তালিকায় তেমন ১৯৫ জনের নাম আছে; যাদের মধ্যে জগন্নাথ হলের ৬৬ জন।
ওই দিন ভোরে পাকিস্তানীদের গুলিতে ঘরের মাঝেই প্রাণ হারান মধুর ক্যান্টিনের প্রতিষ্ঠাতা মধুসূদন দে’র স্ত্রী যোগমায়া, সদ্যবিবাহিত বড় ছেলে রণজিৎ ও পুত্রবধু রীনা রানী। অসুস্থ মধুসূদন দে লুকিয়ে থেকে সে যাত্রা প্রাণ পেলেও ঘণ্টাখানেক পর পাকিস্তানীরা ফিরে এসে তাকে ধরে নিয়ে জগন্নাথ হলের মাঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী, শিক্ষকদের সঙ্গে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে।
২৫ তারিখ রাত ও ২৬ তারিখ ভোরের মধ্যবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন ইকবাল হল, সলিমুল্লাহ হল, জগন্নাথ হল, সূর্যসেন হল, মহসীন হল, ফজলুল হক হল, রোকেয়া হলসহ শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় আক্রমণ চালিয়ে ড. জি সি দেব, ড. মুনিরুজ্জামান, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (আহত হয়ে পরে মারা যান)সহ ৯ জন শিক্ষককে ঘরে ঢুকে হত্যা করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের বেশির ভাগ ছাত্রী আগেই হল ছেড়ে গেছিল, অল্প কয়েকজন ছাত্রী হলে অবস্থান করছিল। ২৫ মার্চ রাতে সেখানে চালানো হয় পৈশাচিক বর্বরতা। পরবর্তি সময়ে হলের অন্তত একটি কক্ষে ছয়টি মেয়ের লাশ পা-বাঁধা ও নগ্ন অবস্থায় পাওয়া যায়। এ রাতেই রোকেয়া হল থেকেই পাকবাহিনী শুরু করে ৯ মাসব্যাপী ধর্ষণের পৈশাচিক উল্লাস।
এদিন ভোর বেলা ৩৬ এলিফেন্ট রোডের বাসায় আগরতলা মামলার ২ নম্বর অভিযুক্ত পাকিস্তানী নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত বাঙালী অফিসার লেফটেনেন্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। তার লাশ জিপে উঠিয়ে নিয়ে যায় হানাদার বাহিনী। তার লাশ আর পাওয়া যায়নি।
এদিন ভোরে পাক হানাদার বাহিনী প্রেসক্লাব, দি পিপল, সংবাদ, ইত্তেফাক, বাংলার বাণী অফিসে ট্যাঙ্কের গোলাবর্ষণ করে।
সকালে পাক হানাদার বাহিনী কয়েকবারের চেষ্টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ট্যাঙ্কের গোলায় ধ্বংস করতে না পেরে সেদিন রাতে ডিনামাইট দিয়ে শহীদ মিনার ধূলিসাৎ করে দেয়।
২৬ মার্চ সকালে গুরুদুয়ারা নানক শাহী, শিব ও কালীমন্দিরে ঢুকে সেখানকার পুরোহিতদের গুলি করে হত্যা করা হয়। অবাঙালীদের সহযোগিতায় পাকসেনারা দুপুরে পুরনো ঢাকা আক্রমণ করে এবং মধ্যরাত পর্যন্ত ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
পুরনো ঢাকায় নিহতদের লাশ বুড়িঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়া হয়।

বুড়িগঙ্গায় ভাসছে অগণিত লাশ। ছবি আনোয়ার হোসেন
বিদেশী সাংবাদিকদের হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে আটকে রাখা হয়।
সকালে পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভূট্টো কড়া সামরিক প্রহরায় ঢাকা ত্যাগ করেন। করাচী বিমান বন্দরে পৌঁছে তিনি ঢাকায় ২৫ মার্চের সেনাবাহিনীর অপারেশনের প্রশংসা করে বলেন, আল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ। সেনাবাহিনী পাকিস্তানকে রক্ষা করেছে।
পীলখানায় ইপিআর ব্যারাক থেকে শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণা ওয়ারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দফতরে পৌঁছায়। চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙর করা একটি বিদেশী জাহাজও এই ম্যাসেজ গ্রহণ করে।
চট্টগ্রামে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণাটির বাংলা ভাবানুবাদ সাইক্লোস্টাইল করে শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন।
‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতে পিলখানা ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের লোকদের হত্যা করছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করছি।
আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ, দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান।
আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপস নেই, জয় আমাদের হবেই। আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সব আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং অন্য দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতাপ্রিয় লোকদের এ সংবাদ পৌঁছে দিন।
আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন।
শেখ মুজিবুর রহমান
জয় বাংলা।’
২৫ মার্চ, ১৯৭১
আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম জেলা সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান দুপুর ২টা ১০ মিনিটে এবং ২টা ৩০ মিনিটে আগ্রাবাদ চট্টগ্রাম বেতার থেকে মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।
আগ্রাবাদ বেতার ভবনের নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবে ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় কয়েকজন বেতার কর্মী চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার ট্রান্সমিশন কেন্দ্রের ষ্টুডিও ব্যবহার করে স্বাধীন বাংলার বেতার কার্যক্রম শুরু করেন, নাম দেন “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র”। এখান থেকেই কিছুক্ষণ পরপর শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন অনেকেই। প্রচার করা হয় বিভিন্ন নির্দেশাবলী। মাত্র ১০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রান্সমিটার থেকে ৫০ মাইল জুড়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে স্বাধীনতার সে বার্তা। বাঙালীর প্রাণে সাহস সঞ্চারিত হয়।
রাত আটটায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান করাচী থেকে এক বেতার ভাষণে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে সরকারের ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সেনাবাহিনীকে আদেশ দেয়া হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলন করে রাষ্ট্রদ্রোহিতার কাজ করেছেন। আমি শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সহযোগিদের বিরুদ্ধে আগেই ব্যবস্থা নিতে পারতাম। কিন্তু আমি শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষপাতী বলেই ন্যায় সঙ্গত উপায়ে উদ্ভুত পরিস্থিতির সমাধান চেয়েছি। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের একগুঁয়েমি, অনড় মনোভাব থেকে এটাই প্রতিয়মান হয় যে, লোকটি এবং তার দল পাকিস্তানের শত্রু। শেখ মুজিবুর রহমান দেশের সংহতি ও সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হেনেছেন। এ অপরাধের জন্য তাকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে।
২৩ বছরের শোষণ, বঞ্চনা, অত্যাচার, নিপীড়ন, ইতিহাসের নির্মমতম গণহত্যা ও সর্বোপরি পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিক ও সামরিক নেতাদের চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে পূর্ব পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে ২৬ মার্চ একাত্তরের সূর্যোদয়ে বাংলাদেশ নামের এক নতুন দেশের গর্বিত পদভারে প্রকম্পিত হল বিশ্ব।
বাঙালীয়ানা/এসএল