১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ভোররাত আনুমানিক দেড়টা থেকে দুটো:
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটকের সামনে একটি পিকআপ এসে থামল। গাড়িতে রয়েছে কয়েকজন সশস্ত্র সেনা সদস্য।
কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজনস) টেলিফোনে জেলার আমিনুর রহমানকে তাৎক্ষনিকভাবে আসতে বললেন। দ্রুত কারাগারের মূল ফটকে পৌঁছে আমিনুর রহমান দেখলেন, পিকআপের সেনা সদস্যরা কারা মহাপরিদর্শককে একটি কাগজ দিলেন। সে কাগজে কী লেখা ছিল জানতে পারেননি আমিনুর রহমান।
কারাগারের মূল ফটক দিয়ে ঢুকে বাম দিকেই ছিল জেলার আমিনুর রহমানের কক্ষের টেলিফোনটি বেজে উঠল। আমিনুর রহমান টেলিফোনের রিসিভারটি তুললেন, অপর প্রান্ত থেকে টেলিফোনে বলা হলো, “প্রেসিডেন্ট কথা বলবেন আইজি সাহেবের সাথে”। তখন আমিনুর রমান দৌড়ে গিয়ে আইজিকে খবর দিলেন। ফোনে কথা শেষে আইজি সাহেব বললেন, “প্রেসিডেন্ট সাহেব ফোনে বলেছেন আর্মি অফিসাররা যা চায়, সেটা তোমরা কর।”
এরপরেও মূল ফটকের সামনে কথাবার্তার চলতে থাকল। রাত তিনটা বেজে যায়। কারা মহাপরিদর্শক (আইজি) একটি কাগজে চার ব্যক্তির নাম লিখে জেলার আমিনুর রহমানকে দিলেন। এক পর্যায়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগের চার নেতাকে একত্রিত করার আদেশ এলো। সে চারটি নাম – সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামান।
বিবিসি বাংলা সার্ভিসকে আমিনুর রহমানের দেয়া বর্ণনা অনুসারে, “সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দীন আহমদ কারাগারের একটি কক্ষে ছিলেন। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে অপর কক্ষ থেকে এখানে নিয়ে আসা হয়। সেখানে আসার আগে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী কাপড় পাল্টে নিলেন”।
আমিনুর রহমানের বর্ণনায়, “তাজউদ্দীন সাহেব তখন কোরআন শরীফ পড়ছিলেন। ওনারা কেউ আমাদের জিজ্ঞেস করলেন না আমাদের কোথায় নেও ( নেয়া হচ্ছে)? সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব হাত-মুখ ধুলেন। আমি বললাম আর্মি আসছে। চারজনকে যখন একটি কক্ষে একত্রিত করার ক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগার কারণে সেনাসদস্যরা কারা কর্মকর্তাদের নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করছিল”।
আমিনুর রহমান বলেন, “মনসুর আলি সাহেব বসা ছিলেন সর্ব দক্ষিণে। যতদূর আমার মনে পড়ে। আমি মনসুর আলীর ‘ম’ কথাটা উচ্চারণ করতে পারি নাই, সঙ্গে সঙ্গে গুলি”।
কারাগারের ভেতর এ ভয়াবহ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবর চার নেতার পরিবার সেদিন জানতে পারেনি। পরদিন অর্থাৎ ৪ নভেম্বর পুরনো ঢাকার এক বাসিন্দা তাজউদ্দীন আহমদের বাসায় এসে জানান যে তিনি আগের দিন ভোরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গুলির শব্দ শুনেছেন।
তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে সিমিন হোসেন রিমি ২০১০ সালে বিবিসি বাংলাকে বলেন, “৪ নভেম্বর বিকেল চারটার দিকে খবর আসতে শুরু করলো তাজউদ্দীন আহমদসহ চারজন নেতাকে হত্যা করা হয়েছে”।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে। এই সরকার পুরোপুরি সেনা সরকার ছিল না। অন্যদিকে ১৫ আগস্ট থেকে মুজিব হত্যাকারী রশিদ-ফারুক ও তার কিছু সহযোগীরা অবস্থান নেয় বঙ্গভবনে। মোশতাক ও তার সরকারকে মূখ্যত পরিচালনা করত। এ কারণে সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের একাংশের মধ্যে সৃষ্টি হয় অসন্তোষ। এই প্রেক্ষাপটে ২ নভেম্বর দিবাগত রাতে অর্থাৎ ৩ নভেম্বর ভোররাতে মোশতাকের নেতৃত্বাধীন আধাসামরিক সরকারের বিরুদ্ধে এক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ। আর এই অভ্যুত্থানকালেই মোশতাক-রশিদ-ফারুকের প্রেরিত ঘাতক দল জেলখানায় হত্যা করে জাতীয় চার নেতাকে।
১৫ আগস্টের পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও এম মনসুর আলীসহ অসংখ্য রাজনৈতিক নেতাকে আটক করে কেন্দ্রীয় কারাগারের রাখা হয়েছিল। নিউ জেলের পাশাপাশি তিনটি রুমে তাঁদের রাখা হয়। ১ নম্বর ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদসহ আটজন বন্দী। ২ নম্বর রুমে ছিলেন এ এইচ কামারুজ্জামানসহ ১৩ জন। ৩ নম্বর রুমে ছিলেন এম মনসুর আলীসহ ২৬ জন।
সে রাতে ১ নম্বর রুমে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদকে রেখে বাকি ছয়জন বন্দীকে অন্য রুমে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং ২ নম্বর রুম থেকে এ এইচ কামারুজ্জামান ও ৩ নম্বর রুম থেকে এম মনসুর আলীকে ১ নম্বর রুমে নিয়ে যাওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার আড়াই মাসের মাথায় ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে সেই ১ নম্বর কক্ষেই এক সঙ্গে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও এম মনসুর আলীকে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৫ আগষ্টের পর ৩ নভেম্বরের জেল হত্যাকাণ্ড আরেকটি কলঙ্কজনক ও বেদনাদায়ক অধ্যায়।
সেই কালোরাতে জেলখানায় কী ঘটেছিল তার আরও একটি বর্ণনা পাওয়া যায় ৫ নভেম্বর, ১৯৭৫-এ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে জমা দেওয়া তৎকালীন কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কর্তব্যরত কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) এর প্রতিবেদন থেকে।
কারা মহাপরিদর্শক এন নুরুজ্জামানের প্রতিবেদন
১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর রাত ৩টায় আমি বঙ্গভবন থেকে মেজর রশিদের একটি ফোন পাই। তিনি আমার কাছে জানতে চান, ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে কোনো সমস্যা আছে নাকি। আমি জানালাম, ঠিক এই মুহূর্তের অবস্থা আমার জানা নাই। এরপর তিনি আমাকে জানালেন, কয়েকজন বন্দীকে জোর করে নিয়ে যেতে কয়েকজন সেনা সদস্য জেল গেটে যেতে পারে, আমি যেন জেল গার্ডদের সতর্ক করে দিই। সে অনুযায়ী আমি সেন্ট্রাল জেলে ফোন করি এবং জেল গেটে দায়িত্বে থাকা ওয়ার্ডারকে মেসেজটি জেলারকে পৌঁছে দিতে বলি, যাতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়।
৩/৪ মিনিট পর বঙ্গভবন থেকে আরেকজন আর্মি অফিসারের ফোন পাই। তিনি জানতে চান আমি ইতিমধ্যেই ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে গার্ডদের সতর্ক করে দিয়েছি কিনা। আমি ইতিবাচক জবাব দেওয়ার পর তিনি আমাকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য জেলগেটে যেতে বলেন। আমি তখন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ডিআইজি প্রিজনকে ফোন করি। খবরটি জানিয়ে আমি তাঁকে তাৎক্ষণিকভাবে জেলগেটে চলে যেতে বলি। দেরি না করে আমিও জেলগেটে চলে যাই এবং ইতিমধ্যেই সেখানে পৌঁছে যাওয়া জেলারকে আবার গার্ডদের সতর্ক করে দিতে বলি। এর মধ্যে ডিআইজিও জেলগেটে পৌঁছেন। বঙ্গভবন থেকে পাওয়া খবরটি আমি আবার তাঁকে জানাই।
এর পরপরই মেজর রশিদের আরেকটি ফোন পাই। তিনি আমাকে জানান, কিছুক্ষণের মধ্যেই জনৈক ক্যাপ্টেন মোসলেম জেলগেটে যেতে পারেন। তিনি আমাকে কিছু বলবেন। তাঁকে যেন জেল অফিসে নেওয়া হয় এবং ১. জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ২. জনাব মনসুর আলী ৩. জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম ৪. জনাব কামারুজ্জামান-এই ৪ জন বন্দীকে যেন তাঁকে দেখানো হয়।
এ খবর শুনে আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে চাই এবং টেলিফোন প্রেসিডেন্টকে দেওয়া হয়। আমি কিছু বলার আগেই প্রেসিডেন্ট জানতে চান, আমি পরিষ্কারভাবে মেজর রশিদের নির্দেশ বুঝতে পেরেছি কিনা। আমি ইতিবাচক জবাব দিলে তিনি আমাকে তা পালন করার আদেশ দেন।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই ৪ জন সেনা সদস্যসহ কালো পোশাক পরা ক্যাপ্টেন মোসলেম জেলগেটে পৌঁছান। ডিআইজি প্রিজনের অফিসকক্ষে ঢুকেই তিনি আমাদের বলেন, পূর্বোল্লিখিত বন্দীদের যেখানে রাখা হয়েছে সেখানে তাঁকে নিয়ে যেতে। আমি তাঁকে বলি, বঙ্গভবনের নির্দেশ অনুযায়ী তিনি আমাকে কিছু বলবেন। উত্তরে তিনি জানান, তিনি তাঁদের গুলি করবেন। এ ধরনের প্রস্তাবে আমরা সবাই বিমূঢ় হয়ে যাই। আমি নিজে ও ডিআইজি প্রিজন ফোনে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি, কিন্তু ব্যর্থ হই। সে সময় জেলারের ফোনে বঙ্গভবন থেকে মেজর রশিদের আরেকটি কল আসে। আমি ফোনটি ধরলে মেজর রশিদ জানতে চান, ক্যাপ্টেন মোসলেম সেখানে পৌঁছেছেন কিনা। আমি ইতিবাচক জবাব দিই এবং তাঁকে বলি, কি ঘটছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তখন মেজর রশিদ আমাকে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। আমি প্রেসিডেন্টকে ক্যাপ্টেনের বন্দীদের গুলি করার ইচ্ছার কথা জানাই। প্রেসিডেন্ট জবাব দেন, সে যা বলছে তাই হবে। তখন আমরা আরও উত্তেজিত হয়ে যাই। ক্যাপ্টেন মোসলেম বন্দুকের মুখে আমাকে, ডিআইজি প্রিজন, জেলার ও সে সময় উপস্থিত অন্যান্য কর্মকর্তাদের সেখানে যাওয়ার নির্দেশ দেন, যেখানে উপরোল্লিখিত বন্দীদের রাখা হয়েছে। ক্যাপ্টেন ও তার বাহিনীকে তখন উন্মাদের মতো লাগছিল এবং আমাদের কারও তাদের নির্দেশ অমান্য করার উপায় ছিল না। তার নির্দেশ অনুযায়ী পূর্বোল্লিখিত ৪ জনকে অন্যদের কাছ থেকে আলাদা করা হয় এবং একটি রুমে আনা হয়, সেখানে জেলার তাদের শনাক্ত করেন। ক্যাপ্টেন মোসলেম এবং তার বাহিনী তখন বন্দীদের গুলি করে হত্যা করে। কিছুক্ষণ পর নায়েক এ আলীর নেতৃত্বে আরেকটি সেনাদল সবাই মারা গেছে কিনা তা নিশ্চিত হতে জেলে আসে। তারা সরাসরি সেই ওয়ার্ডে চলে যায় এবং পুনরায় তাদের মৃতদেহে বেয়নেট চার্জ করে।
কারা উপমহাপরিদর্শক কে আবদুল আউয়ালের প্রতিবেদন
২ নভেম্বর’ ৭৫ দিবাগত রাত ৩ ঘটিকায় আমি আমার বাসভবনে অবস্থানকালে জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেলের কাছ থেকে আমাকে জেলগেটে যাওয়ার নির্দেশ সংবলিত একটি মেসেজ পাই। তিনি আরও জানান, বঙ্গভবন থেকে প্রাপ্ত নির্দেশের ভিত্তিতে তিনি নিজেও জেলগেট অভিমুখে রওনা দিচ্ছেন। আমাকে আরও বলা হয়, কতিপয় সামরিক কর্মকর্তা জেলগেটে আসতে পারেন এবং জোরপূর্বক কয়েকজন বন্দীকে নিয়ে যেতে পারেন। মুহূর্তমাত্র ব্যয় না করে আমি জেলগেটের উদ্দেশে রওনা দিলাম এবং রাত ৩টা ২০ মিনিট নাগাদ সেখানে পৌঁছলাম। গিয়ে দেখি জেলগেটে জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেল এবং জেলার আগে থেকেই উপস্থিত। অতঃপর আমি ইন্সপেক্টর জেনারেলকে সঙ্গে নিয়ে আমার অফিস কক্ষে গেলাম। একটু পরেই জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেল একটি টেলিফোন কল রিসিভ করলেন, আমাকে বলা হলো তা বঙ্গভবন থেকে এসেছে। এখানে বলা যেতে পারে, এই টেলিফোন সংলাপে ইন্সপেক্টর জেনারেল প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। টেলিফোনে আলাপ সেরে ইন্সপেক্টর জেনারেল আমাকে জানালেন যে, তাঁকে বলা হয়েছে কয়েকজন সশস্ত্র গার্ড নিয়ে ক্যাপ্টেন মোসলেম জেলে আসবেন এবং তাঁকে ভেতরে নিয়ে যেতে হবে। তিনি (মোসলেম) যা করতে চান তাঁকে তা করতে দিতে হবে এবং বন্দী তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও এ এইচ এম কামরুজ্জামান কারা, তাঁকে তা চিনিয়ে দিতে হবে। ইতিমধ্যে ইন্সপেক্টর জেনারেল বঙ্গভবন থেকে আর একটি টেলিফোন মেসেজ রিসিভ করলেন। ইন্সপেক্টর জেনারেল আমাকে জানালেন, তাঁকে আবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, সব গার্ডকে ঠিকমতো সতর্ক করা হয়েছে কিনা। তিনি কর্মকর্তাসহ অন্যান্য স্টাফদের খুবই সতর্ক ও অতন্দ্র থাকার নির্দেশ দিলেন। ইন্সপেক্টর জেনারেলের এই নির্দেশ পালন করা হলো। এর কিছুক্ষণ পর স্টেনগান, এসএলআর প্রভৃতিতে সুসজ্জিত ৪ জন সশস্ত্র কর্মকর্তা সহযোগে ভীতিকর ভঙ্গিতে ক্যাপ্টেন মোসলেম আমার অফিসকক্ষে এলেন এবং জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেলকে জিজ্ঞেস করলেন, তিনিই নুরুজ্জামান কিনা। জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেল ‘হ্যাঁ’ বোধক উত্তর দিলেন। এরপর তিনি ইন্সপেক্টর জেনারেলকে তাড়াতাড়ি করতে বললেন। ইন্সপেক্টর জেনারেল তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, কি করতে হবে? আমাদের ভয়ানক আতঙ্কিত করে তিনি ইন্সপেক্টর জেনারেলকে বললেন, তাঁর কাছে পূর্বে যে কয়জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তিনি তাদের গুলি করবেন। ইন্সপেক্টর জেনারেল বললেন যে, তিনি পূর্বে এ জাতীয় কোনো নির্দেশ পাননি এবং তাঁকে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলে নিতে হবে। আমার অফিসের টেলিফোনে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলো কিন্তু যোগাযোগ করা গেল না। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ইন্সপেক্টর জেনারেলকে জানানো হলো যে, জেলারের অফিসের টেলিফোন সেটে তাঁর নামে বঙ্গভবন থেকে টেলিফোন এসেছে। ইন্সপেক্টর জেনারেল টেলিফোন ধরার জন্য রওনা দিলেন। আমি তাঁকে অনুসরণ করলাম। পেছন পেছন চলল সামরিক কর্মকর্তারা। টেলিফোনে কথা বলার সময় ইন্সপেক্টর জেনারেল প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন এবং তার অনুরোধ রাখা হলো বলে স্পষ্ট মনে হলো। ইন্সপেক্টর জেনারেলকে বলতে শুনলাম, ক্যাপ্টেন মোসলেম তাঁদের গুলি করবেন বলে বলেছেন। এরপর ইন্সপেক্টর জেনারেল টেলিফোন রেখে দিলেন এবং তাঁর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল।
ক্যাপ্টেন মোসলেম তখন বন্দুকের নল ঠেকিয়ে আমাদের তখনই পূর্বোক্ত বন্দীরা যেখানে আটক রয়েছে সেখানে যাওয়ার হুকুম দিলেন। নির্দেশমাফিক সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে ইন্সপেক্টর জেনারেল রওনা দিলেন। আমি জেলার এবং অন্যান্য নির্বাহী স্টাফরাও সঙ্গে চললাম। পথিমধ্যে আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছার কথা জানালাম। ক্যাপ্টেন হুমকির সুরে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি ভয় পাচ্ছেন? আমি বললাম, ভয়ের প্রশ্ন আসছে না, আমার ৩২ বছরের চাকরি জীবনে আমি এ জাতীয় ঘটনার কথা শুনিনি। তিনি ক্রোধান্বিত হলেন এবং একজন সামরিক কর্মকর্তা (সেপাই) আমার কাঁধে হাত রেখে আমাকে চলে যেতে বললেন। এতে ইন্সপেক্টর জেনারেল বললেন, না, উনি থাকবেন। আতঙ্ক ধরিয়ে দেওয়া চোখে ক্যাপ্টেন আমার দিকে তাকালেন। ইতিমধ্যে ক্যাপ্টেন মোসলেমের নির্দেশে জেলার এবং অন্যান্য কয়েকজন নির্বাহী স্টাফ মিলে তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে অন্যান্য বন্দীদের থেকে আলাদা করলেন। তাঁদের একটা ওয়ার্ডে জড়ো করা হলো এবং ওই ওয়ার্ডের অন্যান্য সদস্যদের সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা হলো।
ইতিমধ্যে ক্যাপ্টেন এ জাতীয় বিলম্বে বেশ কয়বার বিরক্তি প্রকাশ করে বলছিলেন, শেখ মুজিবকে খতম করতে তার মাত্র ৩ মিনিট সময় লেগেছিল। যখন তাঁদের জানানো হলো ৪ বন্দীকে একটি কক্ষে আনা হয়েছে, ক্যাপ্টেন মোসলেম আর তাঁর দল তৎক্ষণাৎ সেই রুমের দিকে রওনা হয়ে গেলেন। যে ওয়ার্ডে উক্ত বন্দীদের আটক রাখা হয়েছে সেখান থেকে ৪০ গজ দূরে আমি আর জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেল দাঁড়িয়ে রইলাম। অচিরেই আমাদের কানে গুলি করার ভয়াবহ শব্দ ভেসে এল। তাঁরা ফিরে এলেন আর তড়িঘড়ি জেলগেটের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমরা তাঁদের অনুসরণ করলাম। রেকর্ড অনুসারে ক্যাপ্টেন মোসলেম আর তার দল জেলগেটে ঢুকেছে ভোর ৪টায় এবং জেলগেট ছেড়ে গেছে ভোর ৪টা ৩৫ মিনিটে। এরপর ভোট ৫টা ২৫ মিনিটে বঙ্গভবন থেকে নায়েক এ আলীর নেতৃত্বে সশস্ত্র কর্মকর্তাদের আর একটি দল এল এবং গুলি করার জায়গাটি পরিদর্শন করে ভিকটিমদের মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে চাইল। তাদের নির্দেশও পালন করা হলো। যেহেতু আমি সে সময় আমার অফিস কক্ষে ফজরের নামাজ পড়ছিলাম আমি এই দলটিকে স্বচক্ষে দেখিনি। নামাজ শেষ করে আমি জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেলের কাছ থেকে এ তথ্য পেলাম। তিনি তখনো তার অফিস কক্ষে ছিলেন। দলটি তাদের পরিদর্শন শেষে ৫টা ৩৫ মিনিটে জেল ছেড়ে চলে যায়। আমি পরে জানতে পারি এই দলটি মনসুর আলী এবং নজরুল ইসলামের দেহে বেয়নেট দিয়ে আঘাতও করে।
১৫ই আগষ্টের অভ্যুত্থানের বিপরীতে আরেকটি পাল্টা অভ্যুত্থান হয়েছিল ৩ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ নেতৃত্বে। অনেকের মতে তা ছিল অনিবার্য। কারণ মুজিব হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছয়জন জুনিয়র সেনা কর্মকর্তা তখন বঙ্গভবনে বসে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাককে পরিচালনা করছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে মেনে নিতে না পারা এবং এই ছয় জুনিয়র সামরিক কর্মকর্তাকে সেনাবাহিনীর চেইন অব কম্যান্ড-এর আওতায় আনার প্রয়োজনে ৩ নভেম্বর খালেদ মোশারফের নেতৃত্ব অভ্যুত্থান হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়।
শেখ মুজিবকে হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা ধারণা করেছিল যে কোন পাল্টা অভ্যুত্থান হলে সেটি আওয়ামী লীগের সমর্থন পাবে। সে ধরনের পরিস্থিতি হলে কী করতে হবে সে বিষয়ে মুজিব হত্যাকারী সেনা কর্মকর্তারা কিছুটা ভেবেও রেখেছিল বলেই ধারণা করা যায়। তাদের এমনও ধারণা ছিল যে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় ঐ চার নেতাকে হত্যা করা হলে পাল্টা অভ্যুত্থান হলেও সেটি রাজনৈতিক সমর্থন পাবে না। কেননা তখনকার আওয়ামী লীগে এতে করে কোন ধরনের লিডারশিপ থাকবে না। তারা বোধ হয় এটাই নিশ্চিত করেছিল জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও এম মনসুর আলীকে নৃশংস ও কাপুরুষোচিত হত্যার মধ্য দিয়ে।
লেখক: সাগর লোহানী, সম্পাদক, বাঙালীয়ানা